প্রমাণ করার ইঁদুরদৌড়
অমৃতা ঘোষাল
পাবলিক নিঃশর্তভাবেই কিচাইন ভালোবাসে। কিন্তু নিজের সঙ্গে কিছু হলে অমনি ল্যাজ গুটোয়। আজ সেই ল্যাজ গুটোনোর গল্প শোনাই। হাজার একটা দেখনদারির পর যখন নিজের অবচেতনটা বেশ দৈত্যাকার দেহে সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন কারওর বেশ মজা লাগে, কারও বা খুব আড়ষ্ট। মজা লাগলে নিজেকে গোটানো, আর আড়ষ্ট লাগলে নাড়ানো। যতটা অশ্লীল শুনতে লাগে ব্যাপারটা ততটাও বিশ্রী নয়। বিশ্রী হলে কি আমরা আকছার তাই করতাম! উদাহরণ চাই? তাহলে কিছু কাল্পনিক চরিত্র-ঘটনা নিয়ে এবার একটু কাটাছেঁড়া করা যাক।'উট চলেছে মুখটি তুলে'
সকালে উঠেই রাজীব ভাবল আজ একটা নতুন সাম্প্রদায়িক ইস্যু ধরবে। ফেসবুকে দেওয়া অযোধ্যাকাণ্ড-কেন্দ্রিক ওই পোস্টটার কমেন্টগুলো চেক করল। শেয়ার করেছেও বহু জন। একটা ওয়েবিনারে এসব সাম্প্রদায়িক ব্যাপারগুলো নিয়ে এর মধ্যে একটা লেকচারও দেবে। আসলে এই কিচাইনগুলো নিয়ে একটু খোঁচাখুঁচি না করলে ঠিক লাইমলাইটে আসা যায় না। রিনার গায়ের রঙ শ্যামলা। কায়স্থ, সুদর্শন, গৌরবর্ণ রাজীব বিয়ে করেছিল নমঃশুদ্র রিনাকে। তাদের দুই ছেলেমেয়েই কালচে। শোভা পিসি এসে বলেছিল, 'এসসি, এসটি'র বাচ্চা আর কত ভালো দেখতে হবে!' রাজীব ভাবে আর ভাবে বলেই সে শুধু দেখাতে চায় যে এসব নিয়ে আর সে সত্যিই ভাবছে না। পিসির ওই মন্তব্যের প্রতিবাদ পরোক্ষভাবে কাগজে-কলমে করতে করতে কখন নেটবিশ্বে বিখ্যাত হওয়ার নেশা তাকে পেয়ে বসেছে, রাজীব সেটা নিজেও জানে না।
'ঐ দেখ ভাই চাঁদ উঠেছে'
বৌকে আদা তেজপাতা দিয়ে চা করতে বলে খবরের কাগজটা খুললেন গৌরমোহনবাবু। অধ্যাপকের কুকীর্তি ফাঁস, মেয়েলি কেচ্ছা। ঠোঁটের কোণে একটা বাঁকা হাসি ফুটিয়ে হোয়াটস্অ্যাপে নীরাকে মেসেজ করলেন। পঁচিশ বছরের ছোট নীরাকে একদিন ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্স বোঝাতে বোঝাতে নিজের পৌরুষটুকুও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। প্রথমেই বলে দিয়েছিলেন, এসব কিছুর কোনও দায় তার নেই, পুরোটাই ওপেন উইন্ডোর। লকডাউনের গ্যাপে মেয়েটা খুব উতলা হয়ে উঠেছে। দুপুরে বছর চল্লিশের বৌয়ের সঙ্গে মিউচুয়াল ফান্ড, এলআইসি-র কাগজপত্র গুছিয়ে রেখে বিকেলে উল্টোদিকেই পদ্মা আবাসনের নতুন ফ্ল্যাটটায় একবার যাবেন। ওই আবাসনেরই কিশোরী নীরা ঠিক চলে আসবে আবার ইলেকট্রা বুঝতে। তিনি জানেন সঙ্গমের পর কিভাবে কিশোরীর চোখের জলে চুমু খেয়ে 'ভালোবাসতে পারিনি' বলতে হয়। তিনি তো আর চার অক্ষরের বোকা নন, যে পাবলিকের সামনে কেস খাবেন!
'ঔষধ খেতে মিছে বলা'
পাঁচটা আঙুল দিয়ে কলমটাকে আরও পিষতে লাগল সঞ্জয়। হেডমাস্টারের দিকে আঙুল তুলেছে ক্লাস টুয়েলভের একটা পিচিকপারা মেয়ে। তাকে বলেছে, 'সাঁওতালের মতো দেখতে'! হেডমাস্টারের সঙ্গে টক্কর দেওয়ার মজা ছুঁড়িকে হাড়ে হাড়ে বোঝাবে সঞ্জয়। কোন খচ্চর বলে যে ক্ষমাই পরম ধর্ম! মেয়েদের আবার কেরিয়ার! এমন দজ্জাল স্টুডেন্ট'এর ফাইনাল পরীক্ষা আটকানোর যাবতীয় ব্যবস্থা করবেনই হেডমাস্টার সঞ্জয়। সঞ্জয়ের প্রাইমারি স্কুল টিচার বৌ জিনিয়া অবশ্য বলছে মেয়েটার সঙ্গে এমনি মুখোমুখি কথা বলে নিতে। নাহ, যার ছোট মুখে এত বড় কথা থাকতে পারে, তার মুখদর্শন! না না। খিস্তি দিলেন না। একটা ফোন করলেন আপনার বৌদ্ধিক সমিতিতে। বাকিটুকু বুদ্ধিজীবীরাই নিজেদের কৌণিক বিচারে বুঝিয়ে দেবে। মেয়েটাকে কোণঠাসা করে দেখিয়ে দেবেন সমাজের উন্নতি এভাবেই করা সম্ভব। পরদিন আপনার পেছনে পুরো বৌদ্ধিক বিশ্বের সাপোর্টার, আর মেয়েটা! বলাই বাহুল্য, মেয়েটার অবস্থা! সঞ্জয় জিতে গেলেন।
আসলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যখন নিজের বিম্ব দেখা যায় না, তখনই যত অনর্থ l এরকমটাও তো হতে পারত, যে রাজীব ফেসবুকে দগদগে লেখা না ছেড়ে শুধু সবটুকু ভাবনা দিয়ে নিজের মধ্যে একটা বিপ্লব সাজিয়ে তুলল! তারপর কোনও পোস্টানোর নেশা ছাড়াই সহজ সংলাপে, আড্ডায় সঙ্গীদের বুকে-মুখে সেই আগুন ছড়িয়ে দিল। কিন্তু পিসি-মাসির বাঁকা মন্তব্য এখনও তার গায়ে নুন ছিটিয়ে দেয়! আসলে অন্যের সবটুকু প্রদর্শন মানুষ যত না উপভোগ করে, তার চেয়েও অনেক বেশি করে তার জানার বিষয় হয়ে ওঠে কীভাবে অন্যে তাকে উপভোগ করছে। শ্রীচৈতন্যের 'অন্তঃকৃষ্ণ বহিঃরাধা' হয়ে জন্মগ্রহণের একটা কারণও তো খানিকটা এরকমই ভাবা হয়েছিল। কারণটা ছিল একটা পুনরুজ্জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত। স্মৃতির স্বরূপ নয়, আত্মস্বরূপ উদ্ধারের একটা প্রক্রিয়া। আর উদ্ধারের ফাঁদে পড়ে চোখ-কান-ঠোঁটের চামড়াটাও কাঁদে। ঠিক যেভাবে চোখ-কান-ঠোঁটের চামড়া-কাটা টুকটুকে নীরার কান্না গৌরমোহনবাবুকে এখনও দৃঢ় করে তোলে। খুব বেশিদিন যে করবে না, তা-ও জানা কথা। নীরার মন সহস্র বর্ষের সাধনার ধন হলেও তা এখনও সহজলভ্য। কারণ, আমরা ব্যবহৃত হতেও ভালোবাসি। জ্ঞাতসারে কিংবা চুপি চুপি। যার যেমন রুচি।
তবে পেছনের কথা সামনে এলেই খুব সমস্যা। মানুষের নিন্দা করো, কিন্তু ভেবেচিন্তে করো, যাতে কানে না যায়। মানুষের প্রশংসা করো, কিন্তু রয়েসয়ে করো, যাতে ঘাড়ে চেপে না বসে। সঞ্জয় নিজের শ্রেণি-ক্ষমতার গরম থেকে একটু বিচ্যুত হয়ে সেই মুখরা মেয়েটার সঙ্গে দুটো কথাও বলতে পারত। হয়তো সেই কথাই প্রমাণ করে দিত যে সে সত্যিই শিক্ষক। হয়তো শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কের রসায়ন আরও গভীর আশ্বাসে বেশ উজ্জ্বল হয়ে উঠত। কিন্তু সে সব কিছুই হয়নি। সঞ্জয় শুধু এটাই প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে, সে সাঁওতালের মতো দেখতে নয়। আমরা যা প্রমাণ করতে চাই, তাতে আরও ব্যাপকভাবে নিজেদের হীনতাকে তুলে ধরি। এই প্রদর্শন, ঘৃণ্য বিনোদন আর প্রমাণ করার খেলা একবার বন্ধ করেই দেখি না, একটা নতুন শুদ্ধ পৃথিবী হয়তো অপেক্ষা করছে!
No comments:
Post a Comment