Saturday 5 September 2020

ভারতীয় অর্থনীতির হাল

গভীর সংকটের পাঁকে

অতনু চক্রবর্তী

 

৩১ আগস্ট একটি রেকর্ড করল মোদীর নেতৃত্বাধীন ভারতবর্ষ। চার দশক পর এই প্রথম ভারতের জিডিপি বর্তমান অর্থবর্ষের প্রথম তিন মাসে কমল (গত অর্থবর্ষের প্রথম তিন মাসের তুলনায় প্রায় ২৪ শতাংশ)!  বিশ্বের আর কোনও প্রধান ও অগ্রসর অর্থব্যবস্থায় এই নিদারুণ  সংকটের কালো মেঘ ঘনিয়ে আসেনি। 

এত গভীর সংকোচন ভারতীয় অর্থনীতি এর আগে কখনও দেখেনি। আইএমএফ'এর মুখ্য অর্থনীতিবিদ গীতা গোপীনাথ জানিয়েছেন, এপ্রিল-জুন মাসে জি-২০ গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ভারতের জিডিপি সংকোচনের মাত্রা সবচেয়ে বেশি। স্বাধীনতা-উত্তর ভারত আজ পর্যন্ত দেখেছে চার চারটি 'ঋণাত্বক' বৃদ্ধির পর্বকাল- ১৯৫০'র শেষ পর্বে, ১৯৬৫তে (-২.৬ শতাংশ), ১৯৭২ (-০.৫ শতাংশ) এবং ১৯৭৯ (-৫.২৩ শতাংশ)। এই নজীরবিহীন সংকোচনের প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। এটা ৫ থেকে ১০ শতাংশ বাৎসরিক সংকোচনের অভিমুখে নিয়ে যাবে দেশের অর্থনীতিকে। বেশ কিছু বর্ষীয়ান অর্থশাস্ত্রীর অনুমান, আগামী তিন থেকে ছয় ত্রৈমাসিক পর্যন্ত চলবে এই সংকোচন। পাশাপাশি, ওই একই দিনে আট'টি কোর বা মূল সেক্টরের মধ্যে সার বাদে বাকি সাতটি সেক্টর- কয়লা, অপরিশোধিত তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, রিফাইনারিজাত পণ্য, ইস্পাত, সিমেন্ট ও বিদ্যুতের উৎপাদন জুলাই মাসে ঋণাত্বক হয়েছে। তৃতীয় ঘটনাটি হল, চলতি বাজেটে রাজস্ব ঘাটতির মোট  লক্ষ্যমাত্রাটি এপ্রিল-জুলাই'এই ছুঁয়ে ফেলা গেছে। আর সর্বশেষ ঘটনা হল, আদানি এইদিনই কব্জা করল মুম্বাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ৭৪ শতাংশ অংশীদারিত্ব।    

দেখা যাচ্ছে, চাহিদা ও জোগান- এই দুই ক্ষেত্রেই সংকুচিত হয়েছে ভারতীয় অর্থনীতি। সবচেয়ে সংকুচিত হয়েছে নির্মাণ ক্ষেত্র, যার সংকোচনের হার ৫০ শতাংশ। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, ভোগব্যয় বা চাহিদার  ২৬.৭ শতাংশ সংকোচন; কারণ জিডিপি'তে এই অংশটির অংশীদারিত্ব প্রায় ৬০ শতাংশ। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, প্রকৃত অবস্থা আরও মারাত্বক জায়গায় পৌঁছবে, কারণ, দেশীয় অর্থনীতির একটা বিরাট জায়গা জুড়ে রয়েছে অসংগঠিত ক্ষেত্র, যা জিডিপি'র প্রকাশিত সংখ্যায় প্রতিফলিত হয় না। 

২৫ আগস্ট রিজার্ভ ব্যাঙ্ক প্রকাশ করল ২০১৯-২০'র বার্ষিক রিপোর্ট। তাতে ইঙ্গিত রয়েছে, ভারত এবার ঢলে পড়তে চলেছে গভীর মন্দার কোলে। পরপর দুটো ত্রৈমাসিকে বৃদ্ধির হার নেমে গেছে শূন্যের নিচে। ২০০৮ সালে বিশ্বব্যাপী যে ফাইনান্সিয়াল মেল্টডাউন ভারতে হানা দেয় তা ছিল মূলত ফাইনান্সিয়াল সেক্টরে সীমায়িত। কিন্তু এবার কোভিড১৯'এর থাবা আরও অনেক ব্যাপ্ত, সর্বগ্রাসী, সুদুরপ্রসারী; যা চাহিদা ও জোগান, এই দুটো ক্ষেত্রকেই লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। তুলনামূলক মজবুত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে থাকা ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক বেশ কিছুটা ঠেকাতে পেরেছিল ২০০৮'এর ফিনান্সিয়াল সংকটকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মোদী সরকারের সিদ্ধান্ত এই যে, ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ সংক্রান্ত  ১৯৭০'এর  আইন এবার বাতিল করে চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক- স্টেট ব্যাঙ্ক, পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক, কানাড়া ব্যাঙ্ক ও ব্যাঙ্ক অফ বরোদা বাদে সমস্ত ব্যাঙ্কগুলোকে বেসরকারিকরণ করা হবে। এই মর্মে নীতি আয়োগ তৈরি করেছে এক পূর্ণাঙ্গ নীল নকশা।

এবার কোভিড পরবর্তী সংকট সমস্ত দিক থেকেই অভূতপূর্ব। তাই তাকে মোকাবিলার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রমী ও নজীরবিহীন দাওয়াইয়ের জন্য সমস্ত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো পরামর্শ দিয়েছে। সবার বক্তব্য মোটামুটি এক- চাহিদা বাড়াও, লক্ষ কোটি কাজহারা কর্মক্ষম মানুষের হাতে এই মুহূর্তে তুলে দাও নগদ টাকা, সবাইকে নিদেনপক্ষে ৬ মাস বিনামূল্যে পর্যাপ্ত রেশন দাও। ইউরোপের কিছু দেশে এমনকি  অত্যন্ত রক্ষণশীল শাসকগোষ্ঠীও তাদের নিজ নিজ দেশে অস্তাচলে পাঠানো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোকে আবার মজবুত করার পথে হাঁটতে শুরু করেছে। রাজকোষ ঘাটতি বা মূল্যস্ফীতির দিকে না তাকিয়ে সরকারকে দু' হাতে ঢালাও খরচ করতে হবে। পরিকাঠামোর মতো ক্ষেত্রগুলোতে বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ করলে তৈরি হবে স্থায়ী সম্পদ আর তারই হাত ধরে চাঙ্গা হবে পণ্য পরিষেবার চাহিদা। কাজহারা মানুষ কাজ পাবেন, বাড়বে মজুরি আর তা খরচ করলে বৃদ্ধি পাবে চাহিদা। এ ধরনের কিছু প্রস্তাব এবার দিয়েছে শীর্ষ ব্যাঙ্ক তাদের বার্ষিক রিপোর্টে। 

হালে, কৃষি অর্থনীতি  কিছুটা মাথা তুলেছে। ভাল বর্ষার দরুণ গ্রামাঞ্চলে চাহিদা বৃদ্ধি পেলেও নিজ নিজ গ্রামে  ফিরে আসা পরিযায়ী  শ্রমিকদের কর্মচ্যুতি ও নিম্নগামী মজুরি চাহিদা বৃদ্ধির পথে এক বিরাট অন্তরায়। আর রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বার্ষিক রিপোর্ট জানাচ্ছে, লকডাউন তুলে নেওয়ার পর মে-জুন মাসে যেটুকু চাঙ্গাভাব লক্ষ করা গিয়েছিল তা শক্তি হারায় জুলাই-আগস্টে এসে। অর্থনীতি যখন সংকটের পাপচক্রের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে, শহরাঞ্চলে রয়েছে চাহিদার বিপুল ঘাটতি, তখন গ্রামাঞ্চলের প্রাথমিক চাহিদা বৃদ্ধি নুয়ে পড়া ভঙ্গুর কাঠামোতে প্রাণ সঞ্চার করতে পারবে না, তা বলাই বাহুল্য। তাছাড়া, কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্যসূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, এই অর্থবর্ষের প্রথম পাঁচ মাসে একশো দিন প্রকল্পে গ্রামীণ মহিলাদের মোট কর্মদিবস দাঁড়িয়েছে ৫২.৪৬ শতাংশে যা গত আট বছরে সর্বনিম্ন! অতিমারির ফলে বিপুল সংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিক নিজ নিজ গ্রামে ফিরে আসায় ১০০ দিনের কাজে পুরুষদের অংশগ্রহণ লাফ দিয়ে বেড়েছে আর মহিলাদের অংশগ্রহণ হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছে প্রবল ভাবে। 

কোভিড সৃষ্ট 'দৈবদুর্বিপাক'এর জন্যই অর্থনীতির এই ঘোর দুর্দশা, এমনটাই ব্যাখ্যা দিয়েছেন দেশের অর্থমন্ত্রী। ভাবখানা এমন, যেন কোভিড হানার আগে আমাদের দেশের অর্থনীতি ছিল সাজানো বাগান, ফলে-ফুলে সমৃদ্ধ। কিন্তু আমরা সকলেই জানি যে প্রাক-কোভিড পর্বে দেশে আর্থিক বৃদ্ধির হার ঠেকেছিল তলানিতে। কর্মহীনতার হার ছিল বিগত চার দশকে সর্বাধিক। নাভিশ্বাস উঠেছিল গ্রামীণ অর্থনীতির। তার সাথে যুক্ত হয় বিপুল বহরের অনাদায়ী ঋণ। সরকারি ভাষ্যের সাথে সুরে সুর মেলানো  রিজার্ভ ব্যাঙ্ক প্রাক-কোভিড পর্বে চলতে থাকা অর্থনৈতিক শ্লোডাউনের কথা উল্লেখ করেনি, উপরন্তু অত্যন্ত রক্ষণাত্বক অবস্থান থেকে সেই আগের অবস্থায় কী করে ফিরে যাওয়া যায় তার জন্য সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে।      

প্রাক-কোভিড অর্থনীতির প্রধান ব্যামো ছিল চাহিদার গুরুতর  সংকট। ক্রয়ক্ষমতা খোয়ানো আমজনতা কেনাকাটা করছিল খুব ভেবে চিন্তে, এমনকি দশ টাকা দামের বিস্কুটও বাজারে বিকোচ্ছিল না। তখন থেকেই অর্থনীতিবিদেরা সরকারকে পরামর্শ দিয়ে  আসছিলেন সরকারি ব্যয় বাড়ানো, সাধারণ মানুষের হাতে পর্যাপ্ত ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করার জন্য। মোদী কর্ণপাত করেননি। এবারও সমস্ত প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী, অর্থশাস্ত্রী সেই একই কথা বলেছেন, সরকার কোনও কিছুকেই আমল দিল না। উল্টে, ভারতের রাষ্ট্রনায়কেরা বিপরীত অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছেন। 

যে বিশ্ব ব্যাঙ্ক-আইএমএফ নির্দেশিত নিও-লিবারেল 'উন্নয়নী' মডেল ধরে ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো তৈরি করেছিল তাদের আর্থিক গতিপথ, সেই  আইএমএফ প্যান্ডেমিক পরবর্তী দুনিয়ায় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে সরকারকে বিপুল পরিমাণে টাকা খরচ করার নিদান দিয়েছে। তাদের প্রস্তাব, সরকার লগ্নি করুক স্বাস্থ্য, শিক্ষা, গবেষণা, পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি, পরিকাঠামো প্রভৃতি ক্ষেত্রে আর প্রবর্তন করুক প্রগতিশীল কর ব্যবস্থার। যার যত বেশী আয়, সরকার তার থেকে বেশি করে কর নিক। আর্থিক সাহায্য করুক কাজহারা মানুষদের। আর সবচেয়ে বড় যে কথাটা তারা বলেছে, অর্থনীতিকে সচল করতে এই সময়ে অনেক বেশি বেড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর গুরুত্ব। ৩ এপ্রিল লন্ডনের 'ফিনান্সিয়াল টাইমস' তার সম্পাদকীয় নিবন্ধে লিখেছে, বিগত চার দশক ধরে নীতিসমূহের যে গতিমুখ ছিল, তার আমূল বদল ঘটিয়ে নতুন নীতি সামনে আনতে হবে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে আরও সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে সরকারকে। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগকে বোঝা হিসাবে না দেখে বিনিয়োগের উপর জোর দেওয়াটা জরুরি। যে শ্রম বাজার হয়ে উঠেছে মারাত্বক ঝুঁকিপূর্ণ, তাকে সুরক্ষিত করতে হবে। সম্পদের পুনর্বন্টনকে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে এক অ্যাজেন্ডা হিসাবে। যে নীতিগুলোকে এতদিন গণ্য করা হত পাগলামি বলে, যেমন, ন্যূনতম বেসিক আয়, সম্পত্তি কর, তার একটা মিশেল চালু করা দরকার।

বাম অর্থশাস্ত্রীরা এতদিন যে কথাগুলো বলে আসছিলেন, আজ বিদেশের সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত মুখপত্র, নিও-লিবারেল অর্থনীতির সবচেয়ে বড় মতাদর্শগত প্রবক্তা 'ফিনান্সিয়াল টাইমস' স্বীকার করে নিচ্ছে যে বিগত চার দশক ধরে চলা নীতিমালা আজ অচল হয়ে পড়েছে। পরিহাস এটাই, গত বছর ব্রিটেনে নির্বাচনের সময়ে ব্রিটিশ লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন সম্পদের পুনর্বিন্যাসের অ্যাজেন্ডা সামনে আনায় এই 'ফিনান্সিয়াল টাইমস' তীব্র সমালোচনা করে লেখে সম্পাদকীয় নিবন্ধ। তারা বলে, এটা হচ্ছে ব্যবসার উপর আঘাত। আর ব্যবসার উপর আঘাতের অর্থ সম্পদ সৃষ্টির উপর আঘাত, যা শেষ বিচারে গণতন্ত্রের উপর হামলার সামিল। 

মোদীর ভারত আজ ভিন্ন অভিমুখের অভিযাত্রী। জিএসটি'র ক্ষতিপূরণ রাজ্যগুলোকে না দেওয়া, সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর বিরাষ্ট্রীয়করণ, গণতন্ত্রের সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে লকডাউন নামিয়ে আনা, যে কোনও বিরুদ্ধ মতকে দমন করা- দুঃশাসনের এক সার্বিক পরিমণ্ডল আজ ভারত জুড়ে। আশার কথা, দেশের কয়েকটি হাইকোর্ট সম্প্রতি কিছু ইতিবাচক রায় দিয়েছে, সংঘ পরিবারের নিজস্ব মাধ্যমে মোদীর ভাষণে 'অপছন্দের' বোতামে বন্যা বয়েছে, প্রতিরক্ষা শিল্পে সারা ভারত জুড়ে শ্রমিকেরা লাগাতার ধর্মঘটের কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। 

অন্ধকারের উৎস হতে এগুলোই উৎসারিত আলোর ঠিকানা।   

1 comment:

  1. গোটা পৃথিবী জুড়ে ঋণাত্মক বৃদ্ধি র ঘনঘটা। সুই ডেন ও এই তালিকায় আছে।ব্যতিক্রম চীন।অবশ্য তথ্যে জল আছে কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে

    ReplyDelete