Wednesday, 9 September 2020

শাসকের ভয়!

ভীতির ভাইরাসে আক্রান্ত শাসক

সোমনাথ গুহ

রাজা ক্রমশ উলঙ্গ হয়ে যাচ্ছে। দেশ জুড়ে সে এখন আতশ কাঁচ নিয়ে প্রতিবাদী কন্ঠস্বর খুঁজে বেড়াচ্ছে। সম্প্রতি ‘ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ’এ জীববিজ্ঞানের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসার পার্থসারথি রায়কে এনআইএ এলগার পরিষদ-ভিমা কোরেগাঁও ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠিয়েছে। ওনাকে ১০ সেপ্টেম্বর মুম্বাইয়ে হাজিরা দিতে বলা হয়েছে।

প্রথমেই ভিমা কোরেগাঁও সম্পর্কে দু-চারটে কথা বলা প্রয়োজন। ১৮১৮ সালের পয়লা জানুয়ারি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিম্নবর্ণ মাহার সম্প্রদায়ের সেনারা প্রবল প্রতাপশালী পেশোয়া বাজি রাও(দ্বিতীয়)'কে যুদ্ধে হারিয়েছিল। মাহাররা উচ্চবর্ণের দ্বারা নিপীড়িত ছিল তাই ব্রিটিশদের সাহায্য করতে তারা কোনও কুন্ঠা বোধ করেনি। এই ঘটনার ২০০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে দলিতদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে হামলা হয় এবং পুরো মহারাষ্ট্র জুড়ে হিংসা ছড়িয়ে পড়ে। যারা হিংসা ছড়িয়েছিল তাদের গ্রেফতার করার পরিবর্তে সরকার এই সমাবেশের সাথে মাওবাদীদের যোগাযোগের অভিযোগ আনে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করার পরিকল্পনার প্রমাণ তারা পেয়েছে বলে পুলিশ দাবি করে। এর ফলে ভারভারা রাও, গৌতম নাভলাখা, সুধা ভরদ্বাজ, সোমা সেন, আনন্দ তেলতুম্বেদের মতো বিশিষ্ট দশজনকে, যারা সারা জীবন নিপীড়িত মানুষদের স্বার্থে কাজ করেছেন, পুলিশ এই ঘটনার জন্য গ্রেফতার করে। প্রায় দু' বছর হয়ে গেল এঁদের গ্রেফতার করা হয়েছে কিন্তু এখন অবধি এঁদের বিচার শুরু হয়নি।

পার্থসারথি রায় প্রেসিডেন্সি এবং ‘ইন্ডিয়ান ইন্সটিউট অফ সায়েন্স’এর অত্যন্ত কৃতী ছাত্র। আইআইএসসি'তে উনি মলিকিউলার বায়োলজিতে পিএইচডি করেন। এরপরে উনি আমেরিকার লের্নার রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক থেকে পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণা করেন। বর্তমানে তিনি একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী, যাঁর কাজ বিশ্বখ্যাত জার্নাল ‘নেচার’ এবং ‘সেল’এ প্রকাশিত হয়েছে। কোভিড১৯ অতিমারি শুরু হওয়ার পর হু (WHO) যে কয়েকজন বিজ্ঞানীর সাথে নিয়মিত পরামর্শ করেছে, তার মধ্যে উনি অন্যতম। গুরুত্বপূর্ণ হল, অতিমারির শুরু থেকেই উনি ব্যাধি নিয়ন্ত্রণে সরকারি নীতির মুখর সমালোচক। ১২ এপ্রিল, অর্থাৎ লকডাউন শুরু হওয়ার মাত্র ১৮ দিন বাদেই, উনি এক সাক্ষাৎকারে বলে দিয়েছিলেন যে ভারত ভাইরাসের চরিত্র নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছে। সারা বিশ্বে যেখানে ভাইরাসের ২৯টি জিনোটাইপ খুঁজে পাওয়া গেছে, ভারতে পাওয়া গেছে মোটে দুটি। বিভিন্ন জিনোটাইপ খুঁজে বার করার কোনও প্রচেষ্টাই আমাদের দেশে নেওয়া হয়নি। এই কারণে মারি কী ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে সে সম্পর্কে কেউ কোনও ধারণাই করতে পারছে না। আরও বলেছিলেন, একুশ দিনের লকডাউন কোনও কাজে দেবে না যদি না এই সময় টেস্টিং বাড়ানো হয়। লকডাউন শুধুমাত্র ব্যাধিটাকে সাময়িক ভাবে ধামাচাপা দেয়। লকডাউন উঠে গেলেই উপসর্গহীন রোগীরা (৬৫ শতাংশ) জনজীবনে মেলামেশা করবে এবং আরও অনেককে সংক্রামিত করবে যার ফলে সংক্রমণ প্রবল গতিতে বাড়বে। পাঁচ মাস বাদে তাঁর কথার সারবত্তা বোঝার জন্য এখনকার পরিসংখ্যানই যথেষ্ট; কোভিড১৯ এর মারণ দৌড়ে ভারত তো প্রায় শীর্ষ ছুঁয়ে ফেলেছে, হয়তো উৎসব মরসুমের আগেই আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যাবে।

অধ্যাপক রায় কিন্তু শুধুমাত্র বিজ্ঞানী নন, যে কারণেও তিনি সমস্ত শাসকদেরই চক্ষুশূল হতে পারেন। তিনি একজন মানবাধিকার কর্মী; ‘পারসিকিউটেড প্রিজনারস সলিডারিটি কমিটি’র আহ্বায়ক, ‘সংহতি’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ২০১২ সালের ৪ এপ্রিল রুবি হাসপাতালের কাছে নোনাডাঙ্গা বস্তি উচ্ছেদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের কারণে ওনাকে গ্রেফতার করা হয়। অথচ ঐ দিন তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিতই ছিলেন না; তিনি ছিলেন প্রায় ৭০ কিমি দূরে আইআইএসইআর ক্যাম্পাসে। এই গ্রেফতারের বিরুদ্ধে প্রবল জনমত গড়ে ওঠার কারণে সরকার ওনাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ২০১৮'র সেপ্টেম্বর মাসে একটি মিডিয়া রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র দফতর রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে অধ্যাপক রায় এবং আরও নয়জনের ওপর নজর রাখতে। এই সময়েই অধ্যাপক ইয়াহু কোম্পানি থেকে একটি বার্তা পান যে তাঁর মেল সরকারি কোনও সংস্থার নিশানায় আছে, যার অর্থ তাঁর মেলের যাবতীয় তথ্য তাদের করায়ত্ত হতে পারে। এর থেকে বোঝা যায়, সরকারের সমালোচনা ও বিভিন্ন বিষয়ে বিরোধী অবস্থান নেওয়ার কারণে তাঁকে বারবার হেনস্থা করার চেষ্টা করা হয়েছে, তাঁর ওপর নজরদারি হয়েছে। তিনি কোনওদিনও ভিমা কোরেগাঁও নামক জায়গায় যাননি, তিনি ২০১৮'র জমায়েতের সংগঠকদেরও চেনেন না এবং ঐ ঘটনা তিনি সংবাদপত্র থেকেই জানতে পেরেছিলেন। অথচ তাঁকেই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মুম্বাই ডেকে পাঠানো হচ্ছে! এটি একটি অশনি সংকেত। জিজ্ঞাসাবাদ মানেই যে তিনি গ্রেফতার হবেন না, তার কিন্তু কোনও নিশ্চয়তা নেই।

শুধু অধ্যাপক রায় নন, এনআইএ সংগ্রামী কবি ও লেখক ভারভারা রাওয়ের দুই জামাইকেও ৯ সেপ্টেম্বর মুম্বাইয়ে হাজির থাকার জন্য শমন পাঠিয়েছে। কবির কন্যা পাবানার স্বামী কে সত্যনারায়ণন ‘ইংলিশ অ্যান্ড ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ ইউনিভার্সিটি’র অধ্যাপক। দ্বিতীয় কন্যা আনালার স্বামী কে ভি কূর্মানাথ হিন্দু বিজনেস লাইন পত্রিকার বর্ষীয়ান সাংবাদিক। সত্যনারায়াণন জানান, তাঁরা কোনওভাবেই ভিমা কোরেগাঁও ঘটনার সাথে যুক্ত নন অথচ শুধুমাত্র ভারভারা রাওয়ের জামাই হওয়ার কারণে তাঁদের বারবার হেনস্থা করা হচ্ছে। দু' বছর আগে পুলিশ তাঁর বাড়ি তল্লাশি করে এবং এমন ব্যবহার করে যেন তিনি সন্ত্রাসবাদী। তারা এমনকি দম্পতির ব্যক্তিগত চিঠিপত্রও পড়তে শুরু করে। তাঁর ল্যাপটপ, পেনড্রাইভ, হার্ড ডিস্ক এবং তাঁর ২০ বছরের অ্যাকাডেমিক কাজ তাঁরা বাজেয়াপ্ত করে। এমনকি পাবানাকে তারা প্রশ্ন করে কেন তিনি হিন্দুদের মতো দেখতে নন বা হিন্দু মহিলাদের মতো সাবেকি গয়না পরিধান করেন না। সেই সময় পুলিশ এই সব ঘটনা পুরো অস্বীকার করে এবং বলে ভিমা কোরেগাঁও কেসে তল্লাশির জন্য কোনও ওয়ারেন্টের প্রয়োজন হয় না। ভারভারা রাও সম্প্রতি কোভিড থেকে সুস্থ হওয়ার পর তাঁকে আবার জেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাঁর পরিবার এমনিতেই তাঁর স্বাস্থ্য সম্পর্কে উদ্বিগ্ন, এর মধ্যে দুই জামাইকে শমন তাঁদেরকে আরও মানসিক ভাবে বিচলিত করে দিয়েছে।

ভিমা কোরেগাঁও ঘটনা দলিতদের দাপটের একটি প্রতীক। এই আন্দোলন যদি তথাকথিত ‘আর্বান নকশাল’রা হাইজ্যাক করে নেয় তবে তা হিন্দুত্বর পরিকল্পনা রূপায়িত করতে হয়ে দাঁড়াবে একটা বড় বাধা। তাই এই পুরো আন্দোলনটাকেই মাওবাদী ছাপ্পা মেরে দাও এবং যে কোনও প্রতিবাদী কন্ঠস্বরকে এদের সাথে একাকার করে দাও। সরকার কখনই চায় না দলিত, সংখ্যালঘু, প্রান্তিক সম্প্রদায়গুলির দাবিদাওয়া, অস্তিত্বের লড়াইয়ের সাথে এই বিশিষ্ট ও বরেণ্য সমাজকর্মী, লেখক, গবেষকরা এক জোট হোক কারণ এঁদের ঐক্য সরকারের ক্ষমতার ভিত টলিয়ে দিতে পারে। আসলে সরকারের এখন নাজেহাল অবস্থা। কোভিড নিয়ন্ত্রণে ডাহা ফেল; অর্থনীতির শোচনীয় অবস্থা; শুধুমাত্র সংগঠিত ক্ষেত্রেই বেকারত্ব দু কোটি; বাজারে ক্রেতা নেই, ব্যাংকের ঋণ নেওয়ার লোক নেই; নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম হু হু করে বাড়ছে; অভুতপূর্ব ভাবে প্রধানমন্ত্রীর ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠান লক্ষাধিক শ্রোতা ডিসলাইক করেছে। সরকার এতটাই মরীয়া যে বিহারে সুশান্ত সিং রাজপুতের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুকে তারা আসন্ন নির্বাচনে তুরূপের তাস করেছে। ‘না ভুলেঙ্গে, না ভুলনে দেঙ্গে’- সুশান্তকে নিয়ে পোস্টারে রাজ্য ছেয়ে গেছে। মনে রাখতে হবে, বিহারে প্রায় ২৩ কোটি পরিযায়ী শ্রমিক ফিরে এসেছিল। পরিবার পিছু যদি চারজনও সদস্য হয় তাহলে সংখ্যাটা কত দাঁড়ায়? এছাড়া কৃষির অবস্থা সঙ্গিন। এইসব জ্বলন্ত সমস্যাকে আড়াল করতে অতএব সুশান্তই ভরোসা। পাশাপাশি ‘দেশ বিপন্ন’, ‘রাষ্ট্রনেতা বিপন্ন’ এটা প্রমাণ করেও ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার একটা প্রচেষ্টা চলছে। যার জন্য বারবার ভিমা কোরেগাঁও, দিল্লি দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে গ্রেফতার করা হচ্ছে, শমন জারি হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ ‘শত্রু’র ওপরেই আঘাত হেনে প্রচারের ঝড় তুলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা হচ্ছে যে 'আর্বান নকশাল', জিহাদি, টুকরে টুকরে গ্যাং এদের জন্যই দেশের আজ টালমাটাল অবস্থা।  


1 comment:

  1. সময়োচিত,প্রতিবাদী আর সাবলিল লেখা!ভালো লাগল!

    ReplyDelete