Monday, 21 September 2020

কৃষির বিপদ

দেশ জুড়ে কৃষক বিক্ষোভ

অতনু চক্রবর্তী

 

কর্পোরেটদের স্বার্থে গাজোয়ারি করে মোদী সরকার পাশ করাল সর্বনাশা কৃষি-চাষি বিরোধী বিল। বহু ঢাক পেটানো বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের উচ্চকক্ষে ভোটাভুটি করে নয়, সংসদীয় গণতন্ত্রকে চূড়ান্ত প্রহসণে পরিণত করে ধ্বনি ভোটে পাশ হয়ে গেল ঐ বিলটি।  ভারতের কৃষি ও খাদ্য সুরক্ষার বিরুদ্ধে এইভাবে ফ্যাসিস্ট মোদী সরকার সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করল।

রাজ্যসভায় এই চরম অগণতান্ত্রিক আচরণের বিরুদ্ধে ১২টি বিরোধী দল একযোগে কক্ষের ডেপুটি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আনল অনাস্থা প্রস্তাব। ওদিকে, সেদিনই ক্রোধে ক্ষোভে ফুঁসে ওঠা হরিয়ানা-পঞ্জাবের হাজারে হাজারে কৃষকেরা বহু জায়গায় বিক্ষোভ দেখালেন, অবরোধ করলেন এনএইচ ৩৪৪ হাইওয়ে সহ বেশ কিছু জাতীয় সড়ক, কালো বেলুন উড়িয়ে জানালেন প্রতিবাদ। উত্তাল হল ঐ দুই রাজ্য। কিন্তু কী আছে সেই বিলে, যা অগণন কৃষকদের টেনে নামাল রাজপথে? কী সেই কৃষি সংস্কার যা এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করল? 

কোভিড১৯'কে সুযোগে পরিণত কর‍তে মোদী সরকার সংসদকে মুলতুবি রেখে একের পর এক অধ্যাদেশ জারি করে। তার মধ্যে কৃষির ক্ষেত্রে আনা হয় তিনটি অধ্যাদেশ, যা এবারের বাদল অধিবেশনে পাশ করাতে মরিয়া হয়ে ওঠে তারা। যে তিনটি অধ্যাদেশকে রাজ্যসভায় জোরাজুরি ও অনৈতিক উপায়ে পাশ করানো হল:

১) অত্যাবশকীয় পণ্য আইনে সংশোধন করে চাল-ডাল-আলু-পেঁয়াজ-গম-তৈলবীজ ইচ্ছেমতো মজুত করার ঢালাও অনুমোদন। 

২) কৃষিপণ্যের সাথে যুক্ত কর্পোরেট, ব্যবসায়ী, রফতানিকারী ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ সংস্থাগুলো এরপর চাষিদের সাথে চুক্তির ভিত্তিতে চাষ করিয়ে সরাসরি ফসল কিনে নিতে পারবে। এর ছাড়পত্র দিয়েছে সদ্য পাশ হওয়া কৃষি আইন। 

৩) বেসরকারি সংস্থার সাথে চাষিদের ব্যবসায় ফসলের দাম নিয়ে দরাদরির অনুমোদন।

এর ফলাফল কী হবে? 

এতদিন সরকার  চাষিদের কাছ থেকে যে কৃষি পণ্য  সংগ্রহ করত, তা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাবে। ফসলের দাম সম্পর্কে যেটুকু নিরাপত্তার আশ্বাস এতদিন চাষিরা পেত, এবার তাও আর থাকবে না। কারণ, নতুন আইন বেসরকারি মান্ডি বা ফসলের বাজার তৈরি করার সবুজ সঙ্কেত দিয়েছে। এতদিন অত্যাবশ্যকীয় পণ্য হিসেবে ধরা হত আলু-পেঁয়াজ-দানাশস্য-তৈলবীজ-ডাল। এখন আর সেভাবে তা গণ্য করা হবে না। বৃহৎ কর্পোরেট-ব্যবসায়ীদের অঙ্গুলি হেলনে এবার থেকে নির্ধারিত হবে তার দাম ও বিপণন। ফলে, কর্পোরেটদের ধার্য করা দামে চাষিরা তাদের ফসল বিক্রি করতে বাধ্য থাকবে। চাষিদের কাছ থেকে কম দামে কিনে চড়া দামে বাজারে বিক্রি করবে সেই সমস্ত কর্পোরেট সংস্থাগুলো। ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বজায় থাকবে বলে খোদ প্রধানমন্ত্রী যে প্রচার চালাচ্ছেন তা নির্জলা মিথ্যাচার। মনে রাখা দরকার, এই সরকারেরই গঠিত শান্তা কুমার কমিটি জানিয়েছে, মাত্র ৬ শতাংশ চাষি এমএসপি'র (ন্যূনতম সহায়ক মূল্য) সুবিধা পেয়ে থাকেন। এই কমিটির সুপারিশ হল, এফসিআই, নাফেড শস্য সংগ্রহ করা বন্ধ করে দিক, গণ বন্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে খাদ্যশস্য সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হোক। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০২০-র আর্থিক সমীক্ষা প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে, জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইনের অধীনে যারা যারা পড়েন, সেই সংখ্যাটা ৭০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনা হোক, কারণ চাষিদের কাছ থেকে ফসল কিনে এফসিআই'কে দেওয়ার মতো গ্যাঁটের টাকা নাকি সরকারের নেই। এইভাবে আগামী দিনে খাদ্য সুরক্ষার উপরও বড় আঘাত নেমে এল। 

চাষিদের সবচেয়ে বড় আশঙ্কা, এই নতুন আইন বলে এগ্রিকালচার প্রোডিউস মার্কেট কমিটি বা এপিএমসি মান্ডির বাইরে গিয়ে তৈরি হবে নতুন এক বাজার। ফলে, মান্ডির পরিসরে এখন যে কৃষি বাজারটি রয়েছে, সেখানে আর খরিদ্দার খুঁজে পাওয়া যাবে না। মান্ডির বাইরে কোনওরকম ফি বা সেস বা লেভি না দিয়ে কোম্পানির এজেন্টরা ফসল কেনার অধিকার পাবে। এইভাবে মোদী সরকার কর্পোরেট সংস্থাগুলোকে তোফা দিল। ছোট চাষিরা কর্পোরেট সংস্থার সাথে লেনদেন করতে গিয়ে ঠকবেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাও নিতে পারবেন না। মান্ডি বা গ্রামীণ হাটে ফসল বিক্রি করলে চাষিদের সম্মিলিত ভাবে দরকষাকষির একটা ক্ষমতা থাকত। এখন সে সব তুলে দিয়ে কর্পোরেটদের অবাধ লুঠের রাস্তা পরিষ্কার করা হল। মান্ডি বা বাজারগুলোকে ধাপে ধাপে অকার্যকরী করে দেওয়া হলে চাষিরা আর ফসলের সহায়ক মূল্য পাবে না। এমএসপি'কে কঠোরভাবে কার্যকর না করার নেপথ্যে এটাই কেন্দ্রের চক্রান্ত। 

নতুন 'ট্রেড এরিয়া' বা বাজারে যেহেতু থাকবে না কোনও সেস, ফি বা লেভি, তাই কেন্দ্রীয় সরকারের মান্ডিগুলো থেকে রাজ্যগুলো এতদিন যে লেভি আদায় করত (যেমন পঞ্জাবই আদায় করত সমস্ত লেনদেনের পেছনে ৮.৫ শতাংশ), তাও হাতছাড়া হবে। এতদিন সংবিধানে কৃষি ছিল রাজ্য তালিকাভুক্ত। কৃষিকে কেন্দ্রীয় সরকার এবার নিজের কুক্ষিগত করে তুলে দেবে বিদেশি কোম্পানিগুলোর কাছে। শুরু হবে নতুন এক কোম্পানি রাজ। এর ইঙ্গিত পাওয়া যায় ২২ জুলাই মোদীর ভাষণে। মার্কিন কোম্পানিগুলোর কাছে দেওয়া সেই ভাষণে সেদিন মোদী কৃষির এই অধ্যাদেশ সম্পর্কে জানান যে এরপর তারা ভারতে নির্দ্বিধায় কৃষি ক্ষেত্রে অবাধে বিনিয়োগ করার সুযোগ-সুবিধা পাবেন!        

মোদীর জমানায় কৃষকদের ঋণ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে কাঁচামালের দাম। এবং সেচের জন্য যন্ত্রপাতিতে যা একান্ত প্রয়োজন, যেমন বিদ্যুৎ ও ডিজেল, তার দামও বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। বেড়ে চলেছে কৃষকদের আত্মহত্যার ঘটনা। পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে, প্রতি দু' ঘন্টায় একজন কৃষক বাধ্য হয়ে বেছে নিচ্ছেন ওই চরম পথ। ভারতের অর্থনীতি গভীর খাদের কিনারে, জিডিপি বৃদ্ধির হারের যে সরকারি পরিসংখ্যান (-২৪ শতাংশ) দেখানো হচ্ছে তাতে অসংগঠিত ক্ষেত্রকে ধরা হয়নি। প্রাক্তন মুখ্য পরিসংখ্যানবিদ প্রণব সেন বলেছেন, জিডিপি'র সংকোচন হয়েছে ৩২ শতাংশ। কৃষি ক্ষেত্রে যেটুকু বৃদ্ধি দেখা যাচ্ছিল তাও এবার সংকটের  আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। 

একের পর এক কেন্দ্রীয় আইন হরণ করে নিচ্ছে রাজ্য সরকারগুলোর ক্ষমতা। অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীও- যিনি মোদীর কাছের মানুষ বলে পরিচিত- সোচ্চার হয়েছেন বিদ্যুৎ বিলের মাধ্যমে রাজ্য সরকারগুলোর ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার পদক্ষেপে। যুক্তরাষ্ট্রীয় ধারণাকে বিপন্ন করে সমস্ত ক্ষমতার চরম কেন্দ্রীকরণের ভারতীয় ফ্যাসিবাদী মডেল ক্রমেই তার আসল স্বরূপ নিয়ে সামনে আসছে। যেখানে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক স্তম্ভটি সর্বোচ্চ ক্ষমতা কুক্ষিগত করে আইনসভা-বিচারব্যবস্থাকে তার অধীনে ও নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। 

এর মধ্যেও দেখা গেল নতুন এক দিক। গত ১৭ সেপ্টেম্বর মোদী ৭০ বছরে পা দিলেন। বলিউডের নক্ষত্রখচিত সেলিব্রিটিরা ভক্তকুলের সাথে #হ্যাপিবার্থডে দিয়ে রাজাধিরাজকে ট্যুইটারে যতই অভিনন্দিত করুক না কেন, #ন্যাশনালআনএমপ্লয়মেন্টডে আগের ট্যুইটকে অনেক পেছনে ফেলে এক নম্বর ও বিশ্ব জুড়ে দু' নম্বর ট্রেন্ডিং হয়ে উঠল। আরও একটা জন্মদিনের উপহার অপেক্ষা করছিল মোদীর জন্য। সেদিনই এনডিএ'তে আরও একটি ফাটল ধরল। সবচেয়ে পুরাতন শরিক অকালি দল'এর হরসিমরত কউর বাদল, যিনি ছিলেন মোদীর মন্ত্রীসভার খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ মন্ত্রী, পদত্যাগ করলেন। অকালি দল হুমকি দিয়ে রাখল, এনডিএ থেকে বিচ্ছেদ ঘটানোটা এখন সময়ের অপেক্ষা।     

ভারতীয় কৃষি আবার উঠে এল দেশের রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডায়। কৃষি সংকট আবার হয়ে উঠেছে আলাপ আলোচনার বিষয়। 

 

5 comments:

  1. অনেক ধন্যবাদ। এই মুহূর্তে এই কিছুটা বিস্তৃত এই আলোচনাটি অত্যন্ত দরকারি ছিল।

    জয়া মিত্র

    ReplyDelete
  2. েই লেখা কি আপনাদের নাম উল্লেখ করে শেয়ার করা যাবে?

    ReplyDelete
  3. অবশ্যই শেয়ার করুন। এই লেখা ছড়িয়ে পড়ুক। একক মাত্রা ব্লগের নামোল্লেখ থাকলে খুব ভাল হয়।

    ReplyDelete
  4. সরকার মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস কিছুটা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে।তবে FCI বা অন্য সংস্থা গুলি যদি বাধ্য তামুলক ভাবে পণ্য সংগ্রহ না করে যদি উৎপাদন ও বণ্টনের ক্ষমতা কর্পোরেটদের হাতে চলে যায় তবে ভবিষ্যতে সুষম বণ্টন নিশ্চিত হবেনা।মুনাফা হবে ।বাড়বে দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা

    ReplyDelete