শব্দকল্পদ্রুম অথবা লক্ষ্যভেদ
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
এক অভূতপূর্ব মহামারি, বিধ্বস্ত অর্থনীতি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত ভার্চুয়াল দুনিয়া- এই ত্র্যহস্পর্শে ভারতবাসীর এখন হাঁসফাঁস অবস্থা। মহামারিটা আচম্বিত ছিল (যদিও এর উত্তরোত্তর বাড়বৃদ্ধিতে আজ যে অসহনীয় অবস্থা তার দায় প্রায় সম্পূর্ণতই শাসকশ্রেণির; কারণ, থালাবাটি বাজিয়ে তো আর সুরাহা হয় না), কিন্তু অর্থনীতির ভগ্নদশা ও ভার্চুয়াল দুনিয়ার সর্পিল আগ্রাসন নতুন কিছু ছিল না, অন্তত গত পাঁচ–সাত বছরের হিসেবে। যদিও তার আগে বিশ্ব অর্থনীতির এক বেসুরো সজোরে ধাক্কা খাওয়া ছিল, যা ততটা আঁচ করা যায়নি: সাব-প্রাইম ক্রাইসিস। আর তাতেই বিশ্বায়নের ললিপপ যেন কতকটা তেতো হয়ে গেল, ‘চাচা আপন ঘর বাঁচা’ মন্ত্রেই বহুজনে সায় দিল।
অতএব, ২০১০ সালের পর থেকে দেশে দেশে সময়ের অবগাহনে উগ্র জাতীয়তাবাদী, বর্ণবাদী, ধর্মবাদী, জাতিবাদী ইত্যাদি ইত্যাদি নানা ধরনের তথাকথিত রক্ষণশীল শক্তিগুলি একজোট হয়ে গেল, নিজেদের প্রাসঙ্গিকতাকে সাব্যস্ত করে জনপ্রিয়তা পেল ও স্বভাবতই ক্ষমতায় চড়তে থাকল। সেইদিক থেকে বিচার করলে, ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, রাশিয়া, ফ্রান্স, ইউকে প্রভৃতি বহু দেশে সংকীর্ণ, উদারতা-বিরোধী শক্তি ক্ষমতার বলয়ে আসীন হল। পিছু হঠল তথাকথিত উদারবাদী ও বিশ্বায়নপন্থী শক্তিগুলি। অবশ্য তা বলে এ ভাবার কোনও কারণ নেই যে উদারবাদী ও রক্ষণশীল শক্তিগুলির মধ্যে অর্থনীতির বিশ্বায়ন নিয়ে কোনও বড়সড় মতপার্থক্য আছে। ফারাকটা মাত্রায় এবং অর্থনীতির সঙ্গে জাতীয়তাবাদের রাজনীতিকে যুক্ত করার প্রশ্নে। আর অর্থনীতি ব্যতিরেকেও রাজনৈতিক দলগুলি ও তাদের নেতাদের তো ক্ষমতায় টিকে থাকার বাসনাও থাকে! তাই, অর্থনীতি সহ সমাজের আর সব সমস্যাকে মোকাবিলা করার কৌশলে এইসব দলগুলির মধ্যে ক্ষমতায় যাওয়া ও টিকে থাকার নানারকম গোপন ও প্রকাশ্য অ্যাজেন্ডাও থাকে। যেমন, যখন এ দেশে দিল্লির দাঙ্গার জন্য শুধু জেএনইউ বা জামিয়া মিলিয়ার ছাত্র-ছাত্রীদের বেছে বেছে ধরা হয়, দাঙ্গার মূল প্ররোচনাকারী কপিল মিশ্র’র বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করা হয় না, অথবা, ও দেশে জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে উত্তাল গণ জমায়েতে সমবেত মানুষদের ‘লুঠেরা’ বলে অভিহিত করে ডোনাল্ড ট্রাম্প তাদের গুলি করে মারার কথা বলেন, তখন বোঝা যায় এইসব শক্তির প্রকৃত উদ্দেশ্যটা। অবশ্য, তার মানে এই নয় যে আগের সরকারগুলি সব সময় মানুষের ক্ষোভ-বিক্ষোভের প্রতি ঔচিত্য দেখিয়েছে বা তাদের ওপর কোনও দমন-পীড়ন নামায়নি। কিন্তু আজকের রক্ষণশীল শক্তির প্রয়োগ-কৌশল আরও নির্মম। তাদের সুস্পষ্ট উদ্দেশ্যই হল, জনতার মধ্যে বর্ণ, ধর্ম, জাতি, জাতপাত, লিঙ্গ- এইসব বিবিধ বিভিন্নতার নিরিখে তাদের ভাগ করে পরস্পরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া এবং গোষ্ঠী-সংখ্যা অনুপাতে এমন এক সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভাষ্য নির্মাণ করা যা তাদের পুনর্বার ক্ষমতায় আসতে সহায়তা করে। তার সঙ্গে প্রচুর অর্থ ঢেলে সোশ্যাল মিডিয়া বাহিনী দিয়ে ঘৃণা উদ্রেককারী বয়ান নির্মাণ ও বিরুদ্ধপক্ষকে ট্রোলিং তো আছেই, আর এই বাবদে জনতার মধ্যে লাগিয়ে দেওয়া রেষারেষিতে কর্পোরেট পুঁজির পোয়াবারো ও ফলত তাদের পূর্ণ মদতও নিশ্চিত।
তাই, গোটা সেপ্টেম্বর মাস জুড়ে আজ পর্যন্ত যখন করোনার দৈনিক সংক্রমণ ও মৃত্যুতে ভারত বিশ্বে প্রথম স্থানে উপনীত, সর্বমোট হিসেবে ব্রাজিলকে টপকে দ্বিতীয় স্থানে আপাত স্থিত (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাপিয়ে যাওয়া সময়ের অপেক্ষা মাত্র), উপরন্তু, জিডিপি’র বৃদ্ধির হার (-)২৩.৯ শতাংশে ভয়াবহ ভাবে নিম্নমুখি, তখন এক অভিনেতার মৃত্যুকে ঘিরে যে কুনাট্যের নির্মাণ ও রঙ্গ-রসিকতা, তাকে নির্মমতার পরিহাস ভিন্ন আর কী বলা যেতে পারে!
এই সামগ্রিক আবহে গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহ কীভাবে পুনর্জন্ম নিতে পারে, চরম বিষবাষ্পে আবৃত সমাজ কীভাবে তার স্বাভাবিকত্ব ফিরে পাবে, তা এক অমূল্য প্রশ্ন। সবচেয়ে বড় কথা, এক সময়ে অর্থনৈতিক যাপনকে অক্ষে রেখে সমাজের সর্বস্তরের গরিব ও শ্রমজীবী মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে নানা অর্থে সমাজ বদলের যে রাজনীতি বিশ্ব জুড়ে তুমুল আলোড়ন ফেলেছিল (যার বহু সুফল আমরা পেয়েছি, যেমন, বহু জায়গায় চালু হওয়া সমাজ-সুরক্ষা নীতি, আট ঘন্টা কাজের রীতি), তার নেতৃত্বকারী শক্তিগুলি (কমিউনিস্ট, সমাজতন্ত্রী, বামপন্থী, প্রজাতন্ত্রী, ক্রান্তিকারী ইত্যাকার মতাদর্শগুলি) আজ কানাগলিতে পড়ে বর্তমান অবস্থাকে আরও শোচনীয় করে তুলেছে। গত ৫০ বছরে অর্থনীতিতে যে ধীর ক্রমপরিবর্তন, তাকে অনুধাবন না করে উঠতে পারার মধ্যেই তাদের ব্যর্থতার বীজ লুকিয়ে আছে। একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে দেখা যাচ্ছে, তারা কার্যত অপ্রাসঙ্গিক ও বাতিলের দলে পড়ে গেছে। যদিও বিক্ষিপ্ত ঘটনাপ্রবাহে মনে হতে পারে, এদের অস্তিত্ব ও প্রভাব এখনও ততটা মলিন নয়, কিন্তু সামগ্রিক পট-পরিবর্তনে দেখাই যাচ্ছে, এরা অনেকটাই প্রান্তিক শক্তি আজ। অথচ এই শক্তি যদি আজকের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক অর্থনীতির পটবদলকে অনুধাবন করে নিজেদের প্রাসঙ্গিক অর্থে পুনঃসংগঠিত না করতে পারে, তাহলে জনতার মধ্যে বর্ণ, ধর্ম, জাতি নিয়ে যে চলমান বিভেদের রাজনীতি তার থেকে উত্থিত ভয়ঙ্কর শক্তি সমাজ ও অর্থনীতিকে ছারখার করে দেবে।
কিন্তু মুশকিল হল, উক্ত শ্রমজীবী মতাদর্শ ও মত-পথগুলি (বোঝার সুবিধের জন্য যদি গোটা পরিমণ্ডলটাকে ‘বামপন্থী’ বলে চিহ্নিত করি) বহুদিন যাবৎ উদারবাদীদের গোলকধাঁধায় পড়ে বিভ্রান্ত ও ক্ষয়িষ্ণু। সমাজের মূল শ্রমজীবী শ্রেণির স্বার্থরক্ষার রাজনীতি থেকে বিচ্যুত হয়ে এদের অনেকেই উদারবাদের পৃষ্টপোষকতায় ও আয়েসে কিছু ছাত্র-যুব, কতিপয় মধ্যবিত্ত, বিভিন্ন এনজিও এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একশ্রেণির গবেষক ও অধ্যাপককুলের লেখালিখি, সেমিনার, বিদেশে কনফারেন্স ও অ-অর্থনৈতিক ইস্যু’র অনুশীলন-বৃত্তে নিমগ্ন থেকেছে। তবে মেহনতী মানুষের মধ্যেও অনেকের কাজ আছে, কিন্তু তার প্রভাব আজ আর তেমন ব্যাপক বা প্রসারিত নয়। উপরন্তু, এদের মধ্যকার দলাদলি ও খেয়োখেয়িও কম দস্তুর নয়। এমতাবস্থায় বলাই যায়, বৃহৎ বামপন্থী-সমাজতন্ত্রী পরিমণ্ডলটি একপ্রকার বিধ্বস্ত, কুক্ষিগত ও কূপমণ্ডুকতায় আক্রান্ত। তা আরও বোঝা গেল, গোড়ায় করোনা-আক্রান্ত ইউরোপের বিধ্বংসী রূপ দেখে এদের অনেকেই পুঁজিবাদের অন্তিম দশার কথা উচ্চকিত ভাবে বলতে শুরু করেছিল- যেন ভগবান অবশেষে মাথা তুলে চেয়েছেন, পুঁজিবাদ এই নিকেশ হল বলে! আর কুক্ষিগত তো বহুকাল আগেই হয়ে গেছে, যখন বামপন্থার মন্থন আর শ্রমিক বস্তিতে বা গরিব কৃষকের গ্রামে নয়, হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে অথবা অভিজাত কফি শপে। বামপন্থা আজ লিবারেলিজম বা উদারবাদের পোশাক পরে নিয়েছে; তাদের কাছে শ্রেণি বা ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন অথবা শ্রমিক-কৃষক ঐক্যের মৌলিক অনুশীলন থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ধর্ম-নিরপেক্ষতা, জাতপাতের রাজনীতি, নারীবাদ অথবা শিক্ষা সংস্কার।
আসলে, ধর্ম নিরপেক্ষতার অর্থ যে রাষ্ট্রের তরফে সব ধর্মকে তা’ দেওয়া নয়, সমস্ত ধর্ম থেকে দূরত্ব বজায় রাখা, সে রাজনীতিকে তারা ধরে রাখতে পারেনি। জাতপাত বিভাজনের বিভীষিকাকে মুছতে বছরের পর বছর সরকারি সংরক্ষণ, আরও বেশি সংরক্ষণ যে পথ নয়, বরং গরিব জনতার জন্য সামাজিক সুরক্ষার দাবিতেই মুখর হওয়া কাম্য, তা তারা বিস্মৃত হয়েছে। দেখাই গেছে, সরকারি সংরক্ষণের পরিসর সমাজে এতই ক্ষুদ্র যে সেখানে সংরক্ষণের কোটা বাড়িয়েও অবস্থার গুণগত কোনও হেরফের গত ৭১ বছরেও হয়নি। বরং, জাতপাতের বিভাজন আরও প্রকট হয়েছে। নারীর অবদমন যে নিছক নারী-পুরুষ দ্বন্দ্বের মধ্যে অবস্থিত নয়, নারীর মুক্তির মৌলিকতা অর্থনৈতিক স্বাধীনতায় ব্যাপ্ত, সে প্রস্তাব তাদের কাছে থাকলেও তাকে তারা হেলায় হারিয়েছে। উল্টে, অতি-নারীবাদের পাল্লায় পড়ে নারী-পুরুষ বিভাজনের বাতাবরণকেই তারা মান্যতা দিয়েছে। শিক্ষার পেশাগত তাগিদে কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, গবেষণা প্রতিষ্ঠানে সমাজবিজ্ঞানের সম্মেলন কক্ষে পেপার থেকে পেপারে ঘুরে কেরিয়ারের পথ বেয়ে তত্ত্বের প্রকোষ্ঠে বর্গ নির্মাণের যে তাড়না, তাকেই উপাদেয় ও সার ভেবে আলেয়ার পিছনে ছুটে বামপন্থীরা বাস্তবের পথ হারিয়েছে। পোস্ট-স্ট্রাকচারিলিজম থেকে পোস্ট-মডার্নিজম ঘেঁটে, সাব-অল্টার্ন হয়ে পোস্ট-ট্রুথে এসে দেখা গেল, আসলে সবটাই শব্দকল্পদ্রুম।
অর্থাৎ, অনেক আগেই উদারবাদের কাছে পরাজিত বামপন্থীদের চিন্তার বিন্দুগুলি একাডেমিক-ঘেটোতে গিয়ে ঠাই নিয়েছে। সে চিন্তা থেকেই বামপন্থী দলের সরকারও ‘পুঁজিবাদ বিকাশের’ ‘ঐতিহাসিক’ দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিতে দ্বিধা বোধ করে না। আজকের ভয়ানক রক্ষণশীলদের পরাজয়ও তাই উদারবাদের রাজনীতি দিয়েই তারা সারতে চায়। কিন্তু উদারবাদ ও রক্ষণশীলতা, অথবা সহজ করে বললে, কংগ্রেস বনাম বিজেপি যে আদতে তেমন কোনও জলবিভাজিকা নয়, ইউপিএ আমলেও বহু কালা-কানুন জারি হয়েছে, গণতন্ত্র লঙ্ঘিত হয়েছে, বামপন্থীরাও এক সময়ে কংগ্রেস সরকারকে আধা-ফ্যাসিস্ট বলেছে, তেমন নজির তো বেশি পুরনো কিছু নয়।
তাই, একুশ শতকের দুটি দশক পার করে বিপন্ন বামপন্থীদের আজ আবার নতুন করে রাজনৈতিক অর্থনীতিকে পুনঃআবিষ্কার করতে হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অভিষেকে আজ অর্থনীতি ও রাজনীতির যে বাঁকবদল, পুরনো সত্তাগুলি ভেঙ্গে গিয়ে নতুন যে পরিসরের নির্মাণ ও নানা আঙ্গিকে শ্রমজীবী মানুষের উত্থান, তাকে অনুধাবন করেই শ্রেণি-দ্বন্দ্বের উদ্ভুত বাস্তবতাকে লড়াইয়ের ময়দানে নিয়ে আসতে হবে। না হলে উদারবাদ ও রক্ষণশীলদের ‘কাম-অন-ফাইট’এ বামপন্থী বা সমাজতন্ত্রীরা সমাজে উলুখাগড়া আর ‘বোদ্ধাজনের’ সেমিনারে সুবক্তা হয়েই থেকে যাবে।
বিপন্ন বামপন্থা কার হাত ধরে উঠে আসবে? কৃত্রিম বু দ্ধি মত্তা শ্রমিকদের প্রান্তিক করে দিয়েছে।কৃষকের সংগ্রাম সংগঠিত করার ভিত্তিভূমি ও শক্তি লুপ্তপ্রায় আর নেতৃত্বের বিশ্বাসযোগ্যতা ও প্রশ্নচিহ্ন এর মুখে।বাকি থাকে শহুরে মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধজীবী।এরাও নানাভাবে বিভক্ত।তাই বামপন্থার পুনরুত্থান আজ স্বপ্ন মাত্র। পৃথিবী ব্যাপী কোনো পরিবর্তন ... তাও দূর অস্ত
ReplyDeleteমননশীল লেখা।পড়ে ভালো লাগলো।
ReplyDeleteদারুন সময় উপযোগী লেখা।।
ReplyDelete