Saturday, 25 April 2020

লকডাউন ও ডুবসাঁতার

অজস্র স্থবির বিন্দু
অমৃতা ঘোষাল

লকডাউনে আপাতত কলকাতার গঙ্গায় দূষণ নেই, দিল্লির যমুনায় বিষাক্ত ফোম নেই, মুম্বইয়ের বাতাসে ধুলোর আস্তরণ নেই। শুধু আপনার মনে নির্জনতা আছে। একবিংশ শতাব্দীর ষড়যন্ত্র, নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখার পরিকল্পনা কিংবা নিয়তির শিকার, যা-ই হোক না কেন, মোদ্দা কথা হল আপনি একা। 

প্রথমত, আপনি সিঙ্গল মাদার। তিন বছর আগে আপনার প্রেমিক যখন দুর্দান্ত সেক্স করেই অন্য একটা রিলেশনে জড়িয়ে পড়েন, তখন আপনি ঠিক কী অবস্থায়? প্রাইমারি টিচারের চাকরিতে জয়েন করলেন আর অবিবাহিত অবস্থায় মা হলেন। মা, বাবা, প্রেমিক, বন্ধু- কেউই আর যোগাযোগ রাখেনি। অসহায় 'সিঙ্গল' ভেবে একজন মধ্যবয়স্ক বিবাহিত লাইন লাগিয়েছিল। তার বুকে অনেক চুল আর দেহে অনেক ছদ্ম-দয়া থাকলেও চরিত্রে মনুষ্যত্ব ছিল না। তাই আপনার আর এগোতেও সাহস হল না। এখন দুপুরে সাদামাটা খিচুড়ি বসিয়ে একটাই চিন্তা আপনার মাথায় এল- যদি এক্ষুনি হাসপাতালে ভর্তি হন তাহলে বাচ্চাটা কোথায় থাকবে! আর যদি মরেই যান তখন! সরকারি অনাথ আশ্রমেই শেষ অবধি বাচ্চাটার গতি!

দ্বিতীয়ত, পেতলের ননীচোরা গোপালই আপনার সবচেয়ে বড় সম্পদ। পাড়ার ভোলা সপ্তাহে দুদিন চাল তেল দুধ আরও কী কী সব বারান্দার সামনে দিয়ে যায়। টাকাও নেয়নি এখনও। ও এখন কোনও কথা বলে না আপনার সঙ্গে। শুধু সমাজের কাজ করে। তাই আপনি সারাদিন একা একাই প্রলাপ বকেন। আজ  গোপালকে চান করাতে করাতে সত্তর বছরে এসেও আপনার হঠাৎ মনে পড়ে গেল, আপনি বাঁজা মহিলা। এটা আপনার পাপ। মানুষের সব পাপ কিভাবে ধোয়া যায়! দুধ নাকি গঙ্গাজলে! আপনি তো সেই চেষ্টা অনেকবারই করে দেখেছেন। এমনকি সকালে নিয়ম করে গোমূত্র খাওয়াও শুরু করেছিলেন। এবার আপনি ভাবলেন লকডাউনে এত লোকে মরে, আপনি মরেন না কেন! আচ্ছা, আপনি মরলে ঠাকুর-গোপালের নিত্যসেবা করবে কে!

তৃতীয়ত, লকডাউনে আপনার লিভ-ইন পার্টনার ভেগে গেছে। আপনার স্টুডিও ফ্ল্যাটটায় আপনি একা। সোনা গার্লফ্রেন্ড নিজের পুরো মাল-কড়ি নিয়েই পালিয়েছে যখন, আর ফিরবে বলে বোধ হয় না। ফলে, যাবতীয় খরচা অনির্দিষ্ট সময়ের জন্যে আপনার একার ওপর। নো নাইটক্লাব, নো এক্সট্রিম প্লেজার। নীল ছবি, পানু গল্প খুব বোরিং। উপায় একটা করা আছে। আলমারির এক কোণে গার্লফ্রেন্ডের চোখ বাঁচিয়ে ব্যাগপ্যাকে রেখেছেন বেবি ডল, সঙ্গে একটা ছোট রবারের আর্টিফিশিয়াল ভ্যাজাইনা। কিন্তু লকডাউন না উঠলে এই মালে আর আপনার কত দিন চলবে !

চতুর্থত, লকডাউনে আপনার বাচ্চার আয়া বীণা বা বিনিমা আসছে না। আপনার অফিস ছুটি। সকালে বর বাচ্চার মন জয় করতে পিৎজা বানিয়েছেন। বর নেটফ্লিক্স দেখতে দেখতে দিব্যি খেয়ে নিল। কিন্তু কী অসভ্য হয়ে গেছে বাচ্চাট! বিনিমার হাতের মাখা মুড়ি, গরম দুধ, বাতাসা, কলা খাওয়ার জন্যে আপনার বাচ্চা কাঁদছে। কী ডিসগাস্টিং! কলকাতার টপ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করা বাচ্চার  কিনা এসব খাওয়ার রুচি! কান্না থামাতে অনলাইনে আনানো সসেজ ফ্রাই করে দেন। বাচ্চা তা-ও খায় না, বলে বিনিমার মতো চিড়ে ভাজা করে দাও। আপনার ইংরেজি সেন্টেন্স বলতে শুরু করা বাচ্চাকে বিনিমা লো-মিডল ক্লাস বানিয়ে ফেলেছে! সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, লকডাউনে বাচ্চাকে একটু স্মার্ট বানিয়ে ফেলবেনই। তবু বাচ্চা সসেজ, পিৎজা, নুডুলস, পাস্তা, পেস্ট্রিকেক ইত্যাদি ভুলে কার্পেটের ওপর দু' পা ছড়িয়ে কাঁদতে লাগল। আপনি চুপ করাবার জন্যে মোবাইলে কার্টুন চালিয়ে বাচ্চার হাতে ধরিয়ে দিলেন! সসেজে এক কামড় বসিয়ে এবার ভাবতে লাগলেন, ওই গাঁইয়া আয়া কত দিনে আসবে, আপনি ওর লুকিয়ে মুড়ি-চিড়ে-খই-বাতাসা আনা চিরতরে বন্ধ করে দেবেন।

প্রত্যেকের গল্প আলাদা। মিল শুধু একাকিত্বের সুতোয়। এই আমরা যারা একা অথচ কোনও না কোনও ভাবে মধ্যবিত্ত সমাজের একটা ছোট অংশ, প্রত্যেকে নিজের ভবিষ্যৎ চিন্তায় মগ্ন। যারা সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেকে অবিরাম পরিবারের মধ্যেই প্রকাশ করে চলেছি, তারাও কিন্তু একাকিত্বে ভুগছি। কারণ, পূর্ণতাকে যে প্রতিক্ষণে প্রমাণ করার প্রয়োজন হয় না। দেশে কত মানুষ পরিযায়ী শ্রমিক, কত মানুষ ছাদ খুঁজতে গিয়ে ওভারব্রিজের তলায় পুলিশের খেদানি খেয়েও টিকে আছে- সে সব ভাবতে আমাদের বয়ে গেছে। তার চেয়ে অনলাইনে মশালা ওটস থেকে দামি নাইট ক্রিম কিংবা চিজ স্প্রেড থেকে ডটেড কন্ডোম সার্চ করা অনেক সুখপ্রদ। 

মধ্যবিত্ত আসলে ইকোনমিক্স কিংবা ইকোক্রিটিসিজম কোনওটারই ধার ধারে না। শুধু জানে আত্মরতিকে কিভাবে জিইয়ে রাখতে হয়! প্রথম উদাহরণে যেমন মধ্যবিত্ত সমাজই দু'টো প্রাণীকে একেবারে একা করে দিয়েছে! আর লকডাউন পিরিয়ডে এই 'একা করা' আর 'একা হওয়া'র প্রবণতাগুলো সমাজে এক ভয়ঙ্কর ক্যান্সারের জন্ম দিয়ে চলেছে। এক একটি স্থবিরতার কোষ বিভাজিত হয়ে জন্ম দিচ্ছে অজস্ৰ স্থবির বিন্দু। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের 'সমুদ্রের কাছে এসে' কবিতার শেষ লাইনটার মতো তাই লকডাউনেও একাকিত্বে তলিয়ে যাওয়া প্রতিটি মানুষকে মনে করিয়ে দেওয়া যায়- 'তুমি না মানুষ! বেশ কিছুদিন সাঁতার শিখেছো!' আর সাঁতার না জানলে অন্তত ভেসে থাকো।
 

4 comments:

  1. Darun, ekta film chokher samne bhese uthlo..

    ReplyDelete
  2. এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলার মত লেখা নিঃসন্দেহে। ভাল লেখা। তবে মুখোমুখি আলোচনা আছে এটা নিয়ে। - হাজা থেকে ফোবস।

    ReplyDelete
  3. বেশ অন্যরকম লেখা - ভাল লাগল

    ReplyDelete