Sunday 19 April 2020

লকডাউনে পরিবার

অমৃতের পুত্র নই!
অমৃতা ঘোষাল

ছুটি, অনলাইনে সামান্য কাজ, মাইনে আপাতত পুরোই পাচ্ছেন, বাজারও সকালে ভালোই মিলছে। দিব্যি আছেন। চোখের দূষণ শুধু হয়ে উঠছে একজন। আপনার থপথপে ম্যাড়ম্যাড়ে ধর্মপত্নী। কেমন যেন নোংরা মতো নাইটি পরেই কিচেনে ঢুকছে! চান করে এলেও বেশ নোংরা লাগে। নাইটিগুলোয় হলুদ ছোপ। 'কাজের মাসি'-মার্কা স্ত্রী নিয়ে আপনার মন খুব খারাপ। কিছুক্ষণ ফেসবুক। অফিসে তিন মাস আগে জয়েন করা তরুণীর ঝকঝকে ডিপি। ছবিতে বুকের ভাঁজে নীল পাথরের লকেট। মুগ্ধ হয়ে দেখছেন, অমনি ঘরের ওই মহিলা এসে আপনার চেয়ারের নিচে সিগারেটের ছাই মুছে দিচ্ছে। ঘামের বিকট গন্ধে আপনার গা গুলিয়ে উঠল। আপনি সহ্য করতে না পেরে ঘর মুছতে থাকা প্রাণীটির কাঁধে বেশ কষিয়ে লাথি মারলেন। গৃহকর্তা হিসেবে খুব অন্যায় করলেন নাকি!

ছেলে স্কুলে অনলাইনে দেওয়া হোমটাস্ক করছে। বর 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম' করে চলেছে। শাশুড়ি শয্যাশায়ী। আয়া সবেতন ছুটিতে। সকালে শাশুড়ির বেডপ্যান নিতে গিয়ে খুব বমি পেল আপনার। তারপর আপনি শাশুড়ির ব্রেকফাস্টে স্যুপ বানিয়ে তাতে মাত্রাতিরিক্ত নুন দিয়ে দিলেন। দুপুরে তাকে গলা-ভাতের সঙ্গে দিলেন একটাই উচ্ছের তরকারি। শাশুড়িকে পরিষ্কার করার সময় ডেটল জলে না মিশিয়ে এমনিই তার লোলচর্মে ঢেলে দিলেন। তারপর একটা রুক্ষ তোয়ালে দিয়ে ঘষে ঘষে শাশুড়িকে পরিচ্ছন্ন করলেন। আপনি তো লক্ষ্মী সোনা বৌমা নাকি!

আপনার কিছুই ভালো লাগছে না। ঘরে মদ নেই। মাইনে ঢুকেছে অর্ধেক। ছেলে ছয় মাসের। ওইটুকু বাচ্চা কি আরামে থাকে! খালি খায়, ঘুমায় আর কাঁদে! ভাবছেন ছেলের মাকে বলবেন, বাপের বাড়ির থেকে কিছু টাকা আদায় করতে। চাকরি রেখে আর লাভ নেই। বৌকে আদর করে বোঝাতে যাবেন। অমনি ছেলে উঠল কঁকিয়ে। হাত নিশপিশ করে উঠল। এক হাতে ছেলের ঠোঁট দুটো চেপে যদি অন্য হাতে গলাটা টিপে ধরা যায়। আপনার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল--- 'যাহঃ শালা'! বৌ উঠে গিয়ে আপনার বাচ্চাকে কোলে তুলে নিল! আপনি কিছুই করলেন না আর। আপনি তো একজন দায়িত্ববান পিতা নাকি!

আপনি মোবাইল এখন প্রায়ই বন্ধ রাখেন। বরকে সময় দেন। লোকটা ভালোই ঘর সামলায়। রান্নার দায়িত্বও বরের। হেয়ার রিমুভাল ক্রিম অনলাইনে আনিয়েছেন। আপাতত সেগুলো প্রয়োগ করে মসৃণ হওয়ার অপেক্ষা। বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে অনেকদিন দেখা হবে না। দুপুরে তাই বরের সঙ্গেই চাইছেন বিডিএসএম-খেলা। নখ আপনার এমনিতেই বেশ বড়। তার ওপর ডিপ অরেঞ্জ নেলপলিশ। পুরুষের লোমশ বুকে তীক্ষ্ণ নখাগ্র ফুটিয়ে আনন্দ নেবেন। হঠাৎ ধরিয়ে নেবেন সিগারেট। নিজের মুখের ধোঁয়া অন্যের মুখে চালান করতে করতে উত্তেজিত হবেন। বয়ফ্রেন্ডের মুখ মনে করে সিগারেটের একটা আলগা ছ্যাঁকাও দিয়ে দিন ভেজা পাউরুটির মতো 'সুইট হাবি'র গলায়। আপনি বিছানায় চূড়ান্ত আবেদনময়ী তো নাকি!

ঘটনাগুলো আপাতভাবে বানানো মনে হলেও একেবারে মিথ্যে নয়! লকডাউন প্রত্যেক মুহূর্তে বুঝিয়ে দিচ্ছে, আমরা বন্দী, আর নিজের মতো করেই বাঁচবার উপায় খুঁজে নিতে হবে। বাঁচার চেয়েও আরও বেশি করে খুঁজছি কিভাবে নিজের শখ-আহ্লাদকে অব্যাহত রাখব সেই পন্থা! জৈবিকতাকে মেটানোর বিবিধ উপায় খুঁজে চলেছে মানুষ। অবদমিত ব্যাপারগুলো কিন্তু অনেক সময়েই অতিরিক্ত গুরুত্ব পাচ্ছে। শুধু পূর্ণতাসাধনের পদ্ধতি খুঁজতে গিয়েই যত হয়রানি! এক স্বামী-সোহাগিনী সুন্দরী যেমন সেদিন ফোন করে জানতে চাইলেন, 'তোরাও কি রাত্রে মাস্ক পরেই...!'

বিস্ময়ের পরতে পরতে 'Phobos', 'Thanatos', 'Deimos' প্রমুখ এসে উঁকি মারেন। আমরা যে সত্যিই এবার বিমূঢ় সময়ে পৌঁছে গিয়েছি, বেঁচে থাকতে হলে বিভ্রান্ত হতে হবে। মানসিকভাবে একটু পিছিয়ে পড়া শিশু হঠাৎই মায়ের হাতে তুমুল মার খেয়ে বারান্দায় বসে নিজের মনে দুলতে আরম্ভ করে। মাটির দিকে তাকিয়ে দোলে, আকাশ দেখতে সে ভয় পায়। সব মিলিয়ে একটা ক্যালেইডোস্কোপিক পটভূমি গড়ে উঠেছে, নতুন নতুন গঠন যেন একবার গড়ে উঠেই অতল কৃষ্ণগহ্বরে ডুবে যাচ্ছে। করোনার অ-প্রত্যাশিত অভিঘাত স্পষ্টভাবেই প্রমাণ করে দিয়েছে যে আমরা কোনও অংশেই অমৃতের পুত্র অন্তত নই। বাইরের চকচকে পৃথিবীর বিলাস-উপাদানের ওপর বড্ড বেশি নির্ভরশীল আমরা।

লকডাউন পরিস্থিতিতে যখন কৃত্রিম নির্ভরতার সূত্রগুলো ক্রমশ হারাতে শুরু করেছি, তখন আর আত্ম-সংশোধনের চেষ্টাই আমরা করি না, কারণ আমরা অনেকেই হৃদয়হীন হয়ে সুখ পাই। এখন ধর্ষকাম-মর্ষকামের নিষ্ঠুরতা দেখাবার সবচেয়ে বিশ্বস্ত ক্ষেত্র তাই হয়ে উঠল পরিবার। অবশ্য উল্টোটাও দেখা যাচ্ছে। পরিবারকে গভীরভাবে আঁকড়ে সুরক্ষিত থাকার দৃষ্টান্তও অজস্র মিলছে। তবে এটাও স্বীকার করতে হবে যে, পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে পারিবারিক হিংসার এক একটি নির্লজ্জ ঘটনা। সবাই দেখছি, জানছি, শুনছি আর সহ্য করছি। এখনও সময় ফুরোয়নি। একটু অভিনয় ছেড়ে এই বন্দীদশায় আরেকবার চেষ্টা করি মানসিকভাবে মুক্ত হতে। বাড়ির সবাইকে সুস্থভাবে কাছে টেনে বলি,  'আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি'। তবে রিপুর থেকে মুক্তি পাওয়া এখন এত সহজ কি? উত্তর মেলে না।

5 comments: