Tuesday 21 April 2020

সার্ধ শতবর্ষে

'ক্লীবতার কাছে নেই ঋণ...'
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
(২২ এপ্রিল ১৮৭০ - ২১ জানুয়ারি ১৯২৪)
এমন একটা গল্প (হয়তো সত্যি) চালু ছিল অনেকদিন। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের গোড়ার বছরগুলির কথা। ফিনল্যান্ড তখন জার সাম্রাজ্যের অধীন। সেখানে একটি জনবহুল রেস্তোরাঁয় এক তরুণ একা একা বহুক্ষণ বসে থাকেন। কারও সঙ্গে তাঁর তেমন কথা নেই। এক বয়স্ক খদ্দের তা লক্ষ করে সেই তরুণের সঙ্গে ভাব জমান। সুযোগ মতো একদিন জিজ্ঞেস করেন, 'তোমায় তো কখনও এ তল্লাটে আগে দেখিনি। তা তুমি এখানে এসে চুপচাপ প্রায় সারাদিন বসে থাকো। কেন বলো তো?' সে যুবক মৃদু হেসে প্রশ্নটি এড়িয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে যান।

যেদিন থেকে সে যুবককে ওই রেস্তোরাঁয় আর কোনওদিনও দেখা যাবে না, ঠিক তার আগের দিন সন্ধ্যেবেলা সেই বয়স্ক লোকের প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি- 'আসলে আমি এখানে মন দিয়ে শুনি সকলে কী আলোচনা করেন, ভাবেন।' বিস্মিত চোখে প্রশ্নকর্তা জিজ্ঞেস করেন, 'কেন?'

- 'রাশিয়ায় আমি এক আগুয়ান বিপ্লবের স্বপ্ন দেখছি। এখানে বসে মানুষের কথা শুনে বোঝার চেষ্টা করছি বিপ্লবের সম্ভাব্যতাকে।'

পরদিন থেকে সে যুবককে আর সেই চত্বরে দেখা যায়নি।

এই যুবক ভ্লাদিমির ইলিচ উইলিয়ানভ। ফিরে এসেছিলেন রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডে। আত্মগোপন কালে ফিনল্যান্ড থেকে প্রাথমিক প্রস্তুতি নিয়েছিলেন বিপ্লবের। ১৯১৭'র নভেম্বর বিপ্লব হয়েছিল তাঁর নেতৃত্বে। তখন তিনি লেনিন নামে বিশ্বখ্যাত। সে এক যুগান্তকারী ঘটনা ও সময়।

কিন্তু প্রশ্ন হল, আজ তাঁর জন্মের সার্ধশতবর্ষে ও সোভিয়েত বিপ্লবের শতবর্ষ পরে তাঁকে আমরা কীভাবে স্মরণ করব? তাঁর প্রাসঙ্গিকতাই বা কোথায়?

অল্প কথায় বললে- তাঁর জীবনকালে সোভিয়েত বিপ্লবের প্রস্তুতিতে ও সোভিয়েত সমাজ গঠনে তাঁর উদ্ভাবিত চিন্তাবীজের মধ্যেই তাঁর প্রাসঙ্গিকতা লুকিয়ে আছে। যার মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হল কমিউনিস্ট পার্টির প্রসঙ্গ। আর সে বিষয়ে তাঁর অনুশীলন ও ভাবনাকে অন্ধভাবে অনুসরণ কর‍তে গিয়েই আজ সোভিয়েত পতন ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের চূড়ান্ত পশ্চাদপসরণ। এই স্বল্প পরিসরে বরং সেটুকুকেই বুঝে নেওয়া যাক।

'গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা' নামক যে শব্দযুগল আমরা কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালনা প্রসঙ্গে শুনি তার উদ্ভাবক লেনিন। কিন্তু সকলে ভুলে যান, জারের স্বৈরাচারী শাসনের অধীনে গোপনে বিপ্লবী কাজকর্ম পরিচালনার জন্য কেন্দ্রিকতাই ছিল সে সময়ে ফলপ্রসূ ও কার্যকরী একটি উপায়; যার গড়ে ওঠার ভিত্তিটি বরং হতে পারে গণতান্ত্রিক। তা কেমন? বলা হল, পার্টি সম্মেলন বা কংগ্রেসে নানা তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে যা উপলব্ধ বা গৃহীত হল, পরবর্তী পর্যায়ে তার ওপর পার্টি নেতৃত্বের পূর্ণ কমান্ড থাকবে। অর্থাৎ, পার্টির কেন্দ্র এরপর যা বলবে, তাই আপাত শিরোধার্য করতে হবে, যতক্ষণ না আবার পরবর্তী কংগ্রেস বা সম্মেলনে নতুন কোনও সিদ্ধান্ত বা নীতি গৃহীত হচ্ছে। কিন্তু, এই নিদান ছিল স্বৈরাচারী জারের শাসনে বিপ্লবকালীন পরিস্থিতির জন্যই। অথচ পরে, সর্বতোভাবে এই 'গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা'কেই সাধারণ নিয়ম হিসেবে এক মৌলবাদী উদ্দীপনায় মান্য করে নেওয়ার ফলে সমাজতান্ত্রিক দেশে ও অন্যত্র কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে ধীরে ধীরে গণতন্ত্রের মৌলিক শর্তগুলিই ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার অর্থ হয়ে দাঁড়াল, উচ্চ নেতৃত্ব তথা কেন্দ্রীয় কমিটি তথা পলিটব্যুরো তথা সাধারণ সম্পাদক- যার কথাই প্রথম ও শেষাবধি শিরোধার্য শুধু। আর এরই পরিণতিতে আমরা পেলাম অতীতে কাম্পুচিয়ায় পল পট বা আজকের উত্তর কোরিয়ায় কিম-জন-উঙ'কে। সর্বোচ্চ নেতৃত্বে থেকে মাওসেতুঙ'কেও তাই আওয়াজ তুলতে হয়েছিল- সদর দফতরে কামান দাগো।

অথচ সোভিয়েত বিপ্লবের পর পুঁজিবাদী দেশগুলো কিন্তু এই বিপদ বুঝে নিজেদের গণতন্ত্রের বনিয়াদকে আরও প্রসারিত করে। ১৯১৭-২০ সালে যেখানে সোভিয়েত ইউনিয়নকে অন্যান্য সব দেশের তুলনায় অনেক বেশি গণতান্ত্রিক ও কাঙ্ক্ষিত বলে বোধ হচ্ছিল, সেই দেশই কিন্তু ১৯৭০-৮০'র দশক থেকে প্রত্যক্ষত বদ্ধ, রুদ্ধ এক দমবন্ধ দেশে পরিণতি পেল। এর সঙ্গে সঙ্গে সে হারালো অর্থনীতির নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার তাৎপর্যকেও। লেনিনের জীবিতকালে 'ওয়ার কমিউনিজম' ও 'নিউ ইকনমিক পলিসি'- সময়ের পরতে এই দুই বিপরীতধর্মী অনুশীলনের মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন কিন্তু তখন নানান অর্থনৈতিক উদ্ভাবনের পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। পরে অর্থনীতির এই বৈচিত্র্যময় ধারার অনুশীলনটিও লুপ্ত হয়।

অর্থাৎ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক- এই দুই পরিসরেই লেনিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন যে যুগান্তকারী পট পরিবর্তন ও নতুন যুগের সূচনা করেছিল তা পরবর্তীকালে আর সজীব রাখা যায়নি। এর অন্যতম কারণ, যা ইতিহাসে বহুবার পরিলক্ষিত হয়েছে, তা এক কথায়: অমোঘ, মেধাবী ও প্রখর ব্যক্তিত্বের যান্ত্রিক ছায়া ও উচ্চারণ থেকে সময়ের অবগাহনে পরবর্তীকালে অনুরাগীদের বিযুক্ত হওয়ার সমস্যা। যে কারণে নিজের অনুরাগীদের দেখে এমনকি মার্কসকেও বলতে হয়েছিল: Thank God, I am not a Marxist.।

লেনিনকে যান্ত্রিকভাবে বোঝার মধ্যেই লেনিনবাদীদের সমস্যা লুকিয়ে। যদি তাঁরা বুঝতেন, লেনিনের 'গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা' কোনও আক্ষরিক বাধ্যবাধকতা নয়, বরং গণতন্ত্র অনুশীলনের একটা উত্তরণশীল পর্যায় মাত্র, তাহলে গণতন্ত্রের পরীক্ষায় কমিউনিস্ট আন্দোলনকে হয়তো এত ল্যাজেগোবরে হতে হত না।

মাত্র ৫৪ বছরের জীবনে, যার মধ্যে একটা বড় পর্যায় গেছে আত্মগোপন করে থাকা ও সাংগঠনিক কাজের খুঁটিনাটিতে, বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর মধ্যে সব থেকে বেশি লিখেছেন যা তৎকালীন সোভিয়েত প্রকাশনায় ৫৫টি সংকলনে বিধৃত হয়ে আছে। তিনি উল্টোপথে হাঁটা এক প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ, এক অত্যাশ্চর্য মানসচক্ষু দিয়ে বিশ্বকে শোষণমুক্ত করার দৃষ্টি অর্জন করে তাকে হাতেকলমে বাস্তবায়িত করে সদর্থক প্রয়াস রেখেছিলেন- একাধারে চিন্তক, দার্শনিক, জননেতা ও কর্মী, এ হেন যুগপুরুষ বিশ্ব ইতিহাসে বিরলতম। যতদিন পুঁজিবাদ আছে ততদিন তিনি প্রাসঙ্গিক- নানা অর্থে, নানা অনুশীলনে; তাঁকে বোঝার মধ্যে, তাঁর সঙ্গে তর্কে-বিতর্কেও।

লেনিন সম্পর্কে গান্ধী বলেছিলেন, 'বলশেভিক আদর্শের পেছনে যে অগণিত নরনারীর পবিত্রতম আত্মত্যাগ ছিল তা নিঃসন্দেহে সংশয়াতীত। এই আদর্শ পবিত্র হয়েছে লেনিনের মতো মহান মানুষদের আত্মত্যাগে যা কখনও বিফলে যাবে না।' (ইয়ং ইন্ডিয়া, ১৫ নভেম্বর ১৯২৮)।

2 comments:

  1. এইখানে লেখক ট্রটস্কি ও রোজা লুক্সেমবার্গের বয়ানগুলো ও রাজনৈতিক বিতর্ক গুলোকে বিবৃত করে রাজনৈতিক এই ডিসকোর্সকে আরো সম্প্রসারিত করতে পারতেন। পুরো লেখাটিতেই লেনিনের এক গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠি ধরা হয়েছে যেন উনি ঠিকই ছিলেন। এটা ঠিকই , সংগঠন পরিচালনার ক্ষেত্রে বাস্তবটা এমন এসে দাঁড়ায় যে আপ্তকথন পর্যায়ে ditto থিয়োরি দিয়ে কিছুই মেলানো যায় না , তবে চিন্তাভাবনার প্রসারতা যদি বিশ্ববীক্ষা থেকে পার্টিবীক্ষায় তার প্রাকটিশে এসে দাঁড়ায় 'ক্ষমতা' নামক বিশেষের কাছে সেই মনের 'অন্তর' পরাস্ত হতে বাধ্য। আর বিশ্ববীক্ষাও একটা প্লুরাল দৃষ্টিভঙ্গি, সিঙ্গুলার নয় - এইটা তখন কিন্তু ভাবা যেতো। সেকথাই বারংবার বুঝিয়ে দিয়েছেন ট্রটস্কি। তাই ওনার মৃত্যুর পরে আর সেই ফ্লেক্সিবিলিটি টা থাকলো না কমিউনিস্ট পার্টিতে , হয়ে গেলো এক বজ্রকঠিন শাসক দল। এটা গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার ফল ? কাজেই একটা ও একটাই গদগদচিত্তে ভক্তি তো একটা ভার্সন , অন্য ভার্সনগুলোকেও তথ্য সহকারে ডিসকোর্সে আনা উচিত। লেখক যদি এই মতামতটি কে একটু ব্যাখ্যায় আনেন।

    উত্তান বন্দ্যোপাধ্যায়।

    ReplyDelete
    Replies
    1. এই লেখাটিতে আমি কোনও ডিসকোর্সে যাইনি। সীমিত শব্দের লেখায় শুধুমাত্র তাঁকে সার্ধ শতবর্ষে স্মরণ করেছি। আর তাঁর একটি মৌলিক সৃজনকর্ম (গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা) নিয়ে সামান্য কিছু কথা বলেছি যা কমিউনিস্ট আন্দোলনের উত্থান-পতনের এক অন্যতম অনুঘটক। লেনিনের মৃত্যুর পর লেনিনবাদীরা কী করবেন তার দায় তাঁদেরই। সেখানে লেনিনের আর কিছু করার নেই। অতীতের ক্রিয়াকর্মে কী হলে কী হত সে বিচার আমার কাছে অর্থহীন কারণ অতীতে ফিরে যাওয়ার কোনও উপায় যখন নেই তখন আজ কী হতে পারে সেইটেই মূল ধর্তব্য। লেনিন সেখানে অনন্য, কারণ তিনি রাশিয়ার বাস্তব অনুষঙ্গে মার্কসবাদের বহু কিছুকে নতুন ভাবে অনুশীলন করেছেন। লেনিনের সার্ধ শতবর্ষে সেই সাহস ও সৃজন অনুশীলনটাই জরুরি মনে হয়।

      Delete