Monday 20 April 2020

নজরবন্দী জীবন

একনায়কের তথ্য ভাণ্ডার
সোমনাথ গুহ

এটা ভাবতে আশ্চর্য লাগে যে আমেরিকায় লকডাউন বিরোধী একটা ছোট বিক্ষোভ ছাড়া বিশ্বের প্রায় দুশোটি দেশের মানুষ আজ রাষ্ট্রের যে কোনও নির্দেশ নির্দ্বিধায় মেনে নিচ্ছে। এটাই যেন স্বাভাবিক, দ্য নিউ নরম্যাল। যুগ যুগ ধরে কষ্টার্জিত স্বাভাবিক অধিকারগুলির ওপর সাময়িক স্থগিতাদেশ আমরা মেনে নিয়েছি; বাকস্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা সব আমরা বিনা প্রতিবাদে, নীরবে রাষ্ট্রের এক কথায় স্বেচ্ছায় ত্যাগ করেছি। আমরা ঘরবন্দিত্ব মেনে নিয়েছি, আমাদের চলাফেরার ওপর যে বেড়ি লাগানো হয়েছে মেনে নিয়েছি, স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে আমাদের শিক্ষার অধিকার যে হরণ হচ্ছে তা মেনে নিয়েছি, কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে আমাদের রুটিরুজি যে বিপন্ন হচ্ছে তাও মেনে নিয়েছি, শান্তিপূর্ণ জমায়েতের ওপর নিষেধাজ্ঞা সেও আমরা মেনে নিয়েছি। আমরা কখন কোথায় যেতে পারব, কোথায় যেতে পারব না, কোন কাজটা করতে পারব, কোনটা পারব না, সব কিছুই হবে রাষ্ট্রের অঙ্গুলি হেলনে। 

এটা অভুতপূর্ব। আমাদের যাপনের ওপর রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আমরা মুখ বুজে মেনে নিয়েছি। আমরা কোনও প্রতিবাদ তো করিইনি বরং আমরা নিজেদের বোঝাচ্ছি, অন্যদেরও বোঝাচ্ছি যে যা করা হচ্ছে তা ঠিকই হচ্ছে, আমাদের স্বার্থেই হচ্ছে, আমাদের জীবনরক্ষার জন্য করা হচ্ছে। উদারনৈতিক গণতন্ত্রের পীঠস্থান পশ্চিম ইউরোপ, আমেরিকা, এমনকি আদর্শ কল্যাণমূলক রাষ্ট্র ডেনমার্ক থেকে কম্যুনিস্ট চিন, স্বৈরতান্ত্রিক রাশিয়া, মৌলবাদী ইরান, ফ্যাসিবাদ-প্রবণ গণতান্ত্রিক ভারত  এবং পূর্ব এশিয়ার রক্ষণশীল এবং কর্তৃত্ববাদী গণতান্ত্রিক দেশ- ছবিটা সর্বত্র এক। মানুষের এই স্বাভাবিক অধিকারগুলো যে হরণ করা হয়েছে এর জন্য কোথাও কোন উল্লেখযোগ্য বিক্ষোভ হয়েছে এমনটা শোনা যায়নি। ভারতে পরিযায়ী শ্রমিকরা ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য, ভালো আশ্রয়, খাদ্য, পরিবারের কাছে টাকা পাঠানোর জন্য ক্ষোভে ফেটে পড়েছে, কিন্তু লকডাউন তুলে নিতে হবে এই দাবি কিন্তু কোথাও করেনি। শুরুতে কিছু ধর্মীয় সম্প্রদায় নিষেধাজ্ঞা না মেনে জমায়েত করেছে কিন্তু ধীরে ধীরে মানতে বাধ্য হয়েছে যে তাদের ভালোর জন্যই এত কড়াকড়ি করা হচ্ছে।

করোনা ভাইরাসের বিষাক্ত ছায়া যদি সারা পৃথিবী জুড়ে বিস্তৃত না হত তাহলে কি মানুষ এত সহজে রাষ্ট্রের নিদান মেনে নিত? এই তো মাত্র তিন মাস আগে নাগরিকত্ব বিল নিয়ে বিভিন্ন শহরে, কলেজে পুলিশের সাথে প্রতিবাদীদের খন্ডযুদ্ধ হয়েছে। প্যারিসে প্রতি শনিবার ‘ইয়েলো ভেস্ট’ আন্দোলনকারীদের নিয়ম করে জমায়েত হয়েছে, চিলির রাস্তায় নারীরা নিরাপত্তার দাবিতে মুখর হয়েছে, হংকংয়ে চিনের খবরদারির বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে। সব নিস্তব্ধ, সবাই ঘরে ঢুকে গেছে। মৃত্যুভয়! সে বড় সাংঘাতিক ভয়। এর অর্থ তো এই যে শুধুমাত্র জীবনের ভয় দেখিয়ে রাষ্ট্র লাখো জনতাকে তার কর্মসূচিতে শামিল করতে পারে। আর যদি মারির ভয় প্রলম্বিত হতে থাকে তাহলে এই সব নিষেধাজ্ঞাও অন্তহীন ভাবে বলবৎ থাকতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) কিন্তু বারবার চেতাবনি দিচ্ছে যে প্রকৃতিকে মনুষ্য প্রজাতি গত কয়েক শতক ধরে এত নির্মম নিপীড়ন করেছে যে এইরকম অতিমারি বারবার আসতে পারে। আর এখনই তো নতুন কোনও মহামারি বা নতুন ভাইরাসের প্রয়োজন নেই কারণ কোভিড-১৯ যেখানে নিয়ন্ত্রণে আসছে সেখানেও সতর্ক করা হচ্ছে এর কিন্তু দ্বিতীয়, তৃতীয় ঢেউ আসতে পারে এবং সেগুলো আরও মারণঘাতি হতে পারে। প্রচলিত মিডিয়া এবং ডিজিটাল ও অ-ডিজিটাল সব সংবাদ মাধ্যমে যদি অষ্টপ্রহর এই মারি কত বিপজ্জনক ইত্যাদি ফাটা রেকর্ডের মতো বাজতে থাকে তাহলে সম্মতি নির্মাণ কী করে হয় সেটা জানার জন্য আর চোমস্কি পড়তে হয় না। মাপ করবেন, আমি কিন্তু কোনও চক্রান্তের কথা বলছি না। কোনও ঘটনা বোধগম্য না হলেই আমাদের সেটার মধ্যে একটা ষড়যন্ত্র খুঁজে পাওয়ার বাতিক আছে। আমি শুধু বলতে চাইছি, ক্ষমতাশালী মহল কোভিড-১৯ জনিত উদ্ভুত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে নিজেদের গুপ্ত অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়িত করতে চাইছে।

এই অ্যাজেন্ডার অন্যতম হচ্ছে ব্যক্তির সমস্ত কার্যকলাপের ওপর রাষ্ট্রের নজরদারি কায়েম করা। এটা লক্ষণীয় যে রাষ্ট্র যত কর্তৃত্ববাদী তারা তত ভালো করে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। এর সোজাসাপটা অর্থ হল, কোনও বিপর্যয়ের সময় মানুষ দাপুটে শাসকের ওপর বেশি আস্থা রাখে। মারির রাশ টেনে ধরার ক্ষেত্রে দক্ষিণ কোরিয়ার সফলতা উল্লেখ করা হচ্ছে। কোরিয়ার সফলতার অন্যতম কারণ হচ্ছে প্রত্যেক ব্যক্তি যাদের কোয়ারিন্টিনে পাঠানো হয়েছে তাদের বাধ্যতামূলক ভাবে একটা নজরদারি অ্যাপ ডাউনলোড করতে হয়েছে। এর মাধ্যমে কেউ নিভৃতবাস অমান্য করছে কিনা, নিজের পরিবারের সাথেও মেলামেশা করছে কিনা সেটার ওপর নজর রাখা হচ্ছে। মানুষ এটা স্বেচ্ছায় মেনে নিয়েছে, তারা মনে করেছে এটা রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন। তাদের কাছে প্রাইভেসির চেয়ে সামাজিক সুরক্ষা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই ধরনের সংস্পর্শ-সন্ধান (Contact-tracing) অ্যাপ বিভিন্ন দেশে নানা রূপে এসেছে, কিন্তু প্রত্যাশিত ভাবে পশ্চিমে সরকারের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এটা এখনও অত গ্রহণীয় হয়নি। ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করার ক্ষেত্রে চিন অনেক এগিয়ে। সেখানে প্রত্যেকের কাছে একটি কার্ড থাকে যেটা তার ব্যক্তিগত তথ্যের একটি ভাণ্ডার: যেমন সে বিদ্যুৎ, ফোন ইত্যাদির বিল সময় মতো মেটায় কিনা, সে ট্রাফিক আইন মানে কিনা, তার স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত যাবতীয় খুঁটিনাঁটি, তার সফর-ইতিহাস ইত্যাদি। এই কার্ডের তথ্যের ওপরেই নির্ভর করে সে রাষ্ট্রের কাছ থেকে কোনও পরিষেবা পাওয়ার যোগ্য কিনা, এমনকি সে ট্রেন বা উড়ানে কোথাও যেতে পারবে কিনা। ভারতে আধার, ব্যাংক একাউন্ট, মোবাইল সংযুক্তিকরণের মাধ্যমে আমাদের অনেক তথ্যই সরকারের কাছে বাক্সবন্দী হয়ে গেছে। ‘আরোগ্য সেতু’তে আমাদের কী কী রোগ আছে তা আমরা জানিয়ে দিচ্ছি, বাকিটা উন্নত হওয়া খালি সময়ের অপেক্ষা। একালের জনপ্রিয় চিন্তাবিদ য়ুভাল নোয়া হারারি বলছেন, এতদিন তো ব্যক্তির বাইরের কার্যকলাপের ওপর নজর রাখা হচ্ছিল, এখন তার শরীরের অভ্যন্তরে নজরদারি শুরু হয়ে গেল। আমার রক্তচাপ, সুগার, হার্টবিট, শরীরের তাপমাত্রা কত তা সরকার বাহাদুরের খাতায় লিপিবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। এই সব তথ্যের ভিত্তিতে ও অ্যালগরিদমের সাহায্যে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের সময় আমার ভ্রু কুঞ্চিত হচ্ছে না আমি আহ্লাদে গদগদ হচ্ছি তা আইটি সেলে বসে কেউ গোঁফে তা দিতে দিতে ঠিক নজর করছে।  বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবিষ্যতের মহামারিকে ঠেকানোর জন্য এই সব ডিভাইস নাকি এখন থেকেই প্রস্তুত করা প্রয়োজন।
বিল গেটস তো এক কাঠি ওপরে। ‘ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম’এ তিনি প্রস্তাব দিয়েছেন যে প্রত্যেকের কাছে একটা ডিজিটাল সার্টিফিকেট থাকা প্রয়োজন। এই সার্টিফিকেট হবে মাদার অফ অল সার্টিফিকেটস, যাতে ব্যক্তির সব তথ্য থাকবে। ‘সন্দেহজনক’ যদি কিছু থাকে তাহলে সে পরিষেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে। এর সাথে কোভিড-১৯'এ সে সংক্রামিত হয়েছিল কিনা, কিংবা তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠেছে কিনা, সেই তথ্যও থাকবে। যদি সে সংক্রামিত না হয়ে থাকে এবং তার মধ্যে ইমিউনিটি না গড়ে ওঠে তবে, দুঃখিত, সে উড়ানে উঠতে পারবে না, তার বিদেশ ভ্রমণ বাতিল। আফটার অল গরিব দেশ, যাদের এই রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা নেই, তাদের তো আমরা বিপদে ফেলতে পারি না- গেটস সাহেবের হিতোপদেশ। এইভাবে বিশ্বব্যাপী একটা তথ্যভাণ্ডার গড়ে উঠবে যাতে ২০ শতাংশ মানুষের ঠিকুজি-কোষ্ঠী নথিবদ্ধ থাকবে। আর কী চাই! এরাই তো এই ভোগবাদী সমাজের চালিকা শক্তি। বাকী ৮০ শতাংশ তো চিরকালই খরচের খাতায়। আমরা কি অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বব্যাপী এক সর্বগ্রাসী একনায়কত্বের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি?

2 comments: