ভবিষ্যতের মানবসম্পদ
বিনয় কৃষ্ণ পাল
বর্তমানে অনলাইন ক্লাসের বিভিন্ন পদ্ধতি দেখা যাচ্ছে:
১) অডিও বা ভিডিও করে ইউটিউব অথবা হোয়াটসআপ'এর মাধ্যমে তা সবাইকে পাঠানো বা শেয়ার করা। এই পদ্ধতিটি ডেমন্স্ট্রেটিং বলে আলোচনা ও অংশগ্রহণের অভাব থেকে যায়;
২) অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ভিডিও কনফারেন্সিং (জুম বা গো টু মিটিংয়ের অথবা অন্য কোনও এপ্লিকেশনের মাধ্যমে);
৩) অডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে ক্লাস;
৪) লেখা শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে ক্লাস।
করোনা সমসাময়িক পরিস্থিতিতে অনলাইন ক্লাসই আপাতত পড়াশুনার উপায়। অসংখ্য ছাত্রছাত্রী যেমন এতে মানসিক ভাবে অংশগ্রহণ করছে, একইভাবে শিক্ষক-শিক্ষিকারাও কাজের মধ্যে সময়কে অতিবাহিত করছেন ও কাজে লাগাচ্ছেন। ক্লাসরুম শিক্ষার সুবিধা হল, এখানে শিক্ষক ও ছাত্রের সরাসরি সাক্ষাৎ হওয়ার ফলে ছাত্র-শিক্ষকের ক্লাসরুম আচরণ, শরীরী ভাষা, বাক্যালাপ, তর্ক-বিতর্ক প্রভৃতির মাধ্যমে শিক্ষক ও ছাত্রের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্র তৈরি থাকে। শিক্ষাদানকে শুধু দেওয়া নয়, শিক্ষা ও জ্ঞান লেনদেনের প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা হয়। অর্থাৎ, শিক্ষা অর্জন শুধু ছাত্রছাত্রীদের নয়, শিক্ষকদেরও। মোবাইল বা কম্পিউটারের মনিটরে দেখতে পাওয়া ছোট ছোট মুখ একজন শিক্ষককে তার ছাত্র-ছাত্রীদের মন, আগ্রহ, অনাগ্রহ বুঝতে সাহায্য করবে না।
শিক্ষকতার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ছেলেমেয়েরা অনেক জটিল ও কষ্টকর পরিস্থিতিতে আমাদের সামনে তাদের সমস্যা নিয়ে আসে। তাদের সামনে বা পাশে বসে কিছুক্ষণ গল্প করা, মন দিয়ে তাদের কথা শুনে পরামর্শ দেওয়া অনেক সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যের কথা বলতে গিয়ে বিবেকানন্দ বলেছেন, শিক্ষা হল মানুষের আচরণগত পরিবর্তন। এই অনলাইন ক্লাস আর্থিক ভাবে সাশ্রয়ী হলেও তা যে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যকে পূরণ করবে তা বোধহয় আমরা হলফ করে বলতে পারি না। অনলাইন ক্লাসের ক্ষেত্রে প্রথমেই ধরে নিতে হয়, ছেলেমেয়েরা সংসদীয় আচরণে যথেষ্ট পটু, প্রত্যেকেই যে ক্লাসে পড়ছে সেই ক্লাসের সিলেবাস, বই, বিষয়বস্তু গ্রহণের জন্য প্রস্তুত, অন্যের প্রশ্ন বা সমস্যা শোনার পর নিজের সমস্যাও সহজেই বলবে, আলোচনায় অংশগ্রহণ করবে ও নিজের প্রয়োজন বুঝে নেবে। কিন্তু তা কতটা সম্ভব?
শিশু ও ছাত্রছাত্রীদের সামাজিকীকরণে প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তাই একক ভাবে বাড়িতে অনলাইন ক্লাস করার মাধ্যমে সমাজের বিস্তৃত মানুষের সাথে মেশার যে সুযোগ তা কোনও ছাত্রছাত্রীকে বৈষয়িক জ্ঞান লাভে সাহায্য করলেও চারপাশের পরিবেশ, মানুষজন ও সমাজের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে। এ প্রসঙ্গে লেখকের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র জীবনের কথা মনে করা যেতে পারে- কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকা সব সময় উৎসাহ দিতেন প্রশ্ন করতে, সমালোচনা করতে, ওনার ক্লাসে যে বিষয় নিয়ে পড়াতেন সেই বিষয় নিয়ে আমাদের কথা বলতে ও আলোচনা করতে। কোনও কোনও শিক্ষক কঠিন তত্ত্বগত বিষয় পড়াতে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারতেন, কে বুঝতে পারছে না, কারও মনে প্রশ্ন আছে কিনা। এ পাওয়া একটু শান্ত, লাজুক, পিছিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীদের কাছে পরম সৌভাগ্যের। অনলাইন ক্লাসের ভয়েস নোট বা বহু সংখ্যক ছোট ছোট মুখ একজন শিক্ষকের কাছে তার ছাত্রছাত্রীদের সমস্যা প্রকৃতভাবে তুলে ধরতে পারবে কি?
খবরের কাগজ খুললেই দেখা যাচ্ছে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য সহজেই চুরি হচ্ছে ও তা অন্য কোনও কোম্পানি বা প্ল্যাটফর্মে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ তো শিক্ষক-ছাত্রছাত্রীদের মতো সাধারণ মানুষের কাছে এক অতল গহ্বর, এর হাত থেকে নিস্তার কোথায় ও কিভাবে তা আমাদের জানা আছে কি? বেঙ্গালুরুতে নার্সিং কলেজে পাঠরত এক ভাইয়ের থেকে একটি ঘটনা শুনে প্রায় তাজ্জব বনে যাওয়ার কথা। সেখানে পাঠরত অধিকাংশই বাঙালি, অন্যদিকে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অধিকাংশই কন্নড়। তাই, ভাষাগত পার্থক্যের জন্য ইংরেজিকেই শিক্ষণ মাধ্যম হিসেবে নেওয়া হয়েছে। লকডাউনকালীন সময়কে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে কলেজ কর্তৃপক্ষ ঠিক করলেন অনলাইনে ক্লাস করানো হবে, সেইমতো জুমে সব ব্যবস্থাও করা হল। ক্লাসের সময়ে শিক্ষিকাকে উদ্দেশ্য করে বাঙালি কিছু ছাত্র বাংলা ভাষায় কিছু অকথ্য গালাগাল ওই প্ল্যাটফর্মে দিয়ে মজা নিতে থাকল। শিক্ষিকা ও কলেজ কর্তৃপক্ষ ওই ক্লাসের রেকর্ডিং দেখে ও বাংলা ভাষী ছাত্রীর মাধ্যমে বিষয়টি জানার পর ওই ক্লাস নেওয়া বন্ধ করে দিলেন। ছাত্র শিক্ষক ক্লাসরুম ব্যবস্থায় প্রায়শই এক অদৃশ্য উচ্চতার ক্রম দেখা যায়, যেখানে শিক্ষক তুলনায় ক্ষমতার উচ্চতর স্থানে থাকেন ও ছাত্রছাত্রীদের স্থান তার নিচে। শিক্ষাক্ষেত্রে এই ক্রম যতই প্রকট হবে, অনলাইনে প্রযুক্তির অপ-ব্যবহারও ততই বেশি হওয়ার সম্ভবনা।
বিগত কয়েক বছর ধরেই কেন্দ্রীয় সরকার শিক্ষাকে অনলাইনমুখি করার উদ্দেশ্য নিয়েই বেশ কিছু প্রকল্প নিয়েছে। করোনা পরিস্থিতি সেই উদ্যোগকে বাস্তবায়িত করতে কয়েক ধাপ এগিয়ে দিচ্ছে। হয়তো এর গভীর উদ্দেশ্য শিক্ষাক্ষেত্রে কর্মসংস্থান কমিয়ে সরকারি ব্যয় সংকোচন ও শিক্ষার মর্মবস্তুর পরিবর্তন ঘটিয়ে তাকে বাজার ও চাকরিমুখি করে তোলা। দেশের এক বিশাল সংখ্যক মানুষের হাতে স্মার্টফোন পৌঁছলেও, টেলিভিশন ও ইন্টারনেট সংযোগ সহ কম্পিউটার এসে পৌঁছয়নি। তাছাড়া প্রযুক্তিগত সমস্যা, বিভাজন ও বৈষ্যমের কথাও ভুলে গেলে চলবে না। প্রান্তিক স্তরের মানুষ তথা ছাত্রছাত্রীদের কাছে এই প্রযুক্তি না থাকার ফলে এক বিশাল সংখ্যক ছাত্রছাত্রী এ ক্ষেত্রে যে বঞ্চিত হচ্ছে ও হতে চলেছে তা সহজেই অনুমেয়। করোনা পরিস্থিতি বর্তমান শিক্ষাক্ষেত্রকে অনলাইনমুখি করলেও তা যদি শিক্ষাদানের ভবিষ্যৎ হয়ে দাঁড়ায় সে ক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীদের কিছু বিষয় বলে-বুঝিয়ে-আলোচনার মাধ্যমে হয়তো কিছু কাজের জন্য উপযুক্ত করে তোলা যাবে, কিন্তু তাদের ভবিষ্যতের দায়িত্বশীল নাগরিক ও প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
বেশ ভালো লাগলো।বর্তমান পরিস্থিতি খুব ভালো ভাবে প্রকাশ পেয়েছে লেখাটায়।আরো লেখার অপেক্ষায় রইলাম।
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো। আরো লেখার অপেক্ষায় রইলাম।
ReplyDelete