Wednesday 15 April 2020

করোনা চিত্র


পরিযায়ী শ্রমিক: সমস‍্যার একপিঠ মাত্র
সঞ্জয় মজুমদার

COVID-19 ঘিরে আমাদের দেশে যা কিছু ঘটছে তার দায় কারও একার উপর চাপানো ঠিক নয়। এটা পারস্পরিক দোষারোপ করার সময় নয়, রাজনীতির তো নয়ই। তবু দুর্ভাগ্যজনকভাবে দোষারোপ এবং রাজনীতি দুটোই চলছে এবং বেশ ভালো ভাবেই চলছে। সরকার বহু ক্ষেত্রেই তথ্য গোপন করছে, এইরকম সন্দেহ সাধারণের মধ্যে দানা বাঁধতে শুরু করেছে। খোদ মার্কিন মুলুক, যা করোনা সংক্রমণের ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছে,  সেখানেও চূড়ান্ত কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি চলছে।

আমাদের দেশে পরিযায়ী শ্রমিকদের যাতায়াত এবং জমায়েতের যা কিছু খবর সামনে আসছে তার কিছুটা হয়তো প্ররোচনামূলক বা গুজবের ফলশ্রুতিতে, তবে বেশির ভাগটাই মানুষ তাঁদের পুঞ্জীভূত উদ্বেগ ও আশঙ্কা থেকে আতঙ্কিত হয়ে করছেন। এর একটা কারণ বোধহয় পরিযায়ী শ্রমিকরা দলবদ্ধভাবেই থাকা বা ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। দশজনের মধ্যে তিনজনের বাড়ি ফেরার ইচ্ছে না থাকলেও, দলে ভিড়ে সেটা করতেই হয়। দিল্লি, বান্দ্রা এবং সুরাটের যা ছবি আমরা পাচ্ছি তা জনস্বাস্থ্যের নিরিখে নিঃসন্দেহে উদ্বেগের এবং চূড়ান্ত ক্ষতিকর। রোজগারের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, পকেটে টাকা-পয়সার অভাব, সংক্রমিত হওয়ার ভয়, ছোট অপরিচ্ছন্ন বাসস্থান, অভুক্ত দিনযাপন, কিংবা নিছকই বাড়ির টান- যে কোন‌ও কারণেই হোক এঁরা ফিরতে চাইছেন। সে ক্ষেত্রে প্রশাসনের একটা নিশ্চিত দায়িত্ব থেকেই যায়। হয় তাদেরকে বুঝিয়ে আশ্বস্ত করে আর‌ও কয়েকদিন সেখানেই আটকে রাখা, অথবা ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া। কার্যকরী সিদ্ধান্ত একটা নিতেই হবে।

বাড়ি ফিরতে চাওয়া শ্রমিকদের যেমন একটা বিরাট অংশ আছেন, তেমনি উল্টো দিকে, বেশ কিছু সংখ্যক শ্রমিক আছেন যাঁরা কিন্তু দলবদ্ধভাবেই ফেরার সিদ্ধান্ত নেননি। কারণটা অবশ্যই সেই রাজ্যের সরকারি ব্যবস্থাপনা, স্বেচ্ছাসেবক সংস্থা, এনজিও, স্থানীয় মানুষজন এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনেকটাই তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আপাতত সম্ভব হয়েছে। দীর্ঘ বছর ধরে আমার বাড়িতে কাজ করতে আসেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার সংগ্রামপুরের বাসিন্দা আজিজুল (মূলত খবরের কাগজ শিশি-বোতল লোহালক্কড় কিনে বিক্রি করেন)। আজিজুলের ছেলে মুম্বাইতে সোনার গয়নার কারখানায় কাজ করেন। ফোন করে জানতে পারলাম, কারখানার মালিক ব্যক্তিগত উদ্যোগে চল্লিশ জন কর্মীকেই মুম্বাইয়ের বিভিন্ন ফ্ল্যাটে এবং কারখানার একাংশ ইত্যাদিতে ভালো মতো থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। নিজেই গাড়ি চালিয়ে চাল ডাল তেল নুন পৌঁছে দিয়ে আসছেন। এরপরেও এঁদের একটা বড় অংশ, আগামীকাল বা কয়েক ঘণ্টা পরেই, কোথাও জমায়েত হয়ে বাড়ি ফিরতে চাইবেন না এমন নিশ্চয়তা দেওয়া যাচ্ছে না।

আরেকটা বিষয়, আটকে থাকা মানুষজনের মধ্যে শুধুমাত্র পরিযায়ী শ্রমিকরা আছেন, এটাই বা কেমন কথা! অজস্র মানুষজন অবস্থার ফেরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আটকে রয়েছেন। গন্তব্যে ফিরতে পারছেন না। কেউ পরিবার পরিজন সহ বেড়াতে গিয়ে আটকে রয়েছেন। কেউ মুমূর্ষু রুগী নিয়ে দক্ষিণ ভারতে গিয়ে আটকে রয়েছেন। প্রচুর ছাত্রছাত্রী তাদের হোস্টেল বা মেসবাড়িতে আটকে রয়েছেন। তাদের কথাটাও সামনে আনা প্রয়োজন। কিন্তু, সব মিলিয়ে এত কিছু ভাবতে গেলে লকডাউন তুলে দিতে হয়, ফলে সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং'ও মানার প্রয়োজন নেই, যা এই পরিস্থিতিতে অসম্ভব।  বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, ভারতে লকডাউনের সময়সীমা অনেক আগে থেকেই শুরু করা উচিত ছিল। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বারবার বলছেন, টেস্ট-এর (ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত) সংখ্যা যত বাড়ানো যাবে ততই করোনার বিরুদ্ধে লড়াই আমরা জোরদার করতে পারব। সরকারকেও এ ক্ষেত্রে প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করতেই হবে। তা না হলে কতজনের টেস্ট হয়েছে, কতজন সংক্রামিত হয়েছেন, চিকিৎসায় সাড়া দিয়েছেন কজন এবং শেষমেশ মারা গিয়েছেন বা সুস্থ হয়ে ফিরেছেন কতজন- এইসব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যত গোপন করা হবে ততই বিপদ বাড়বে। ফলে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করলেও কিছুতেই সচেতনতা আনা যাবে না এবং লকডাউনের প্রকৃত উদ্দেশ্য সার্থক হবে না। দিনের শেষে জনস্বাস্থ্য এবং অর্থনীতি, দুটোই মুখ থুবড়ে পড়বে। দৈনিক রোজগারের উপর ভিত্তি করে থাকা প্রান্তিক মানুষেরা যত বেশি কর্মদিবস হারাতে শুরু করবেন ততই হতাশা এবং হিংস্রতা তাঁদের মধ্যে জন্ম নেবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও লুটপাট করে খাওয়ার প্রবণতা বাড়বে।

এর সঙ্গে আর‌ও কিছু ছবি অস্বীকার করলে চলবে না। ধর্মীয় জমায়েত এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের জমায়েত ছাড়াও আমরা সাধারণ মানুষও দোকান বাজার রাস্তাঘাটে কারণে অকারণে অজস্র জমায়েত করেই চলেছি। বিভিন্ন মিডিয়াতে ক্রমাগত তার ছবি তুলে ধরা হচ্ছে। তবু হুঁশ ফিরছে না। পুলিশ প্রশাসনের শত চেষ্টা সত্ত্বেও মানুষজন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছেন। সম্প্রতি টেলিভিশন রিপোর্টে দেখা গিয়েছে, ক্যানিংয়ের বিডিও অফিসের সামনে কোনওরকম সরকারি ঘোষণা ছাড়াই, সম্ভবত গুজবের উপর ভিত্তি করে, কয়েক হাজার মানুষ সস্তায় চাল পাওয়ার আশায় লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।‌ ফলে জমায়েতের দায় কোন‌ও ব্যক্তি, রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে হাত ধুয়ে ফেলা যাবে না।

দাড়িপাল্লার একদিকে এখন করোনা নামক অতিমারিকেন্দ্রিক জনস্বাস্থ্য,  অন্যদিকে মানুষের রুজি-রোজগার ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অর্থনীতি। এই দুই পাল্লার ভারসাম্য রক্ষার দায় কার? অবশ্যই সিংহভাগটুকু সরকারকেই নিতে হবে, কোন‌ও সন্দেহ নেই। কিন্তু আমাদেরও রীতিমতো দায়িত্ব আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের পরামর্শে সরকার যা নির্দেশাবলী জারি করছে সেগুলো যতটা সম্ভব মেনে চলাটাই এই সময়ের দাবি। অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের জোগান আজকের তারিখ পর্যন্ত গোটা দেশে ঠিকই আছে। কেবল মানুষের কাছে সে সব পৌঁছনো সুনিশ্চিত করতে হবে।

চিকিৎসাকর্মী, পুলিশ বা প্রশাসনের কর্মী, ব্যাঙ্ক এবং পৌরকর্মী, প্রত্যেকেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছেন, যাঁরা নিজেরাও করোনা সংক্রমনের ভয়ে আতঙ্কিত। ইতিমধ্যেই আমাদের দেশ সহ গোটা পৃথিবীতে বেশ কয়েকশো চিকিৎসা ও পুলিশকর্মী করোনার প্রকোপে মারা গেছেন। আমরা না হয় ঝগড়াঝাঁটি ভুলে, ইগোর অত্যাচার পাশে সরিয়ে রেখে, এঁদের পাশে দাঁড়াই। আমাদের সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া করোনা মোকাবিলা কার্যত অসম্ভব এবং অবাস্তব।

No comments:

Post a Comment