কিছু অস্বস্তিকর প্রশ্ন
অশোকেন্দু সেনগুপ্ত
শিক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. সমীর ব্রহ্মচারী আমাদের কাজের একেবারে গোড়ায় রাজ্য সরকারের কাছে কিছু তথ্য চেয়েছিলেন। কিছু পেয়েছিলেন, কিছু পাননি। তিনি চেয়েছিলেন রাজ্যের মোবাইল টাওয়ারগুলির একটি মানচিত্র। তার পাশে রাখতে চেয়েছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থান সম্বলিত তথ্য। দুয়ের তথ্য মিলিয়ে দেখলে বোঝা সম্ভব হবে যে রাজ্যের কোথায়, কেন এবং কত প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র তথা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রয়োজন রয়েছে। তখন তো আমাদের অনেকেরই মনে হয়েছিল যে প্রস্তাবটি অভিনব এবং অনেকটাই অবাস্তব।
এমন আর একটি অভিনব প্রস্তাব তিনি দিয়েছিলেন; বলেছিলেন, এই রাজ্যের সরকারি কলেজগুলি নিয়ে গড়া হোক একটি Meta University (অনেকটা CSIR ধাঁচে)। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ আর গবেষণাগারগুলি জুড়ে দেওয়া হোক ইন্টারনেটের মাধ্যমে যাতে তার সুফল পেতে পারে রাজ্যের সব শিক্ষার্থী। রাজ্য শিক্ষা কমিশন চায়, এভাবে যেন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুযোগ নিয়ে এই রাজ্য দ্রুত দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে প্রথম সারিতে আসতে পারে। অনুমান করি যে, রাজ্য সরকার কমিশনের প্রস্তাবের কিছ মেনেছেন, কিছু মানেননি। কোনটা কতখানি মানলেন সরকারও জানায়নি, বিরোধীরাও জানতে চায়নি। লকডাউন সত্যকে চেনার ও বোঝার কিছু সুযোগ দিয়েছে আমাদের। এখন দেখছি, স্কুল-কলেজে অনলাইন লেখাপড়ায় তথা প্রযুক্তি ব্যবহারে জোর পড়েছে। যেদিন মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করলেন স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকবে ‘করোনা তাণ্ডব’ এড়াতে, সেদিন থেকে পড়াশোনা পুরোপুরি বন্ধ হতে পারত যদি না শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা লেখাপড়াটা হোক চাইতেন। তাদের চাওয়াতেই মূলত লেখাপড়া শুরু হল তবে তা হল টেলিভিশন সেট আর ইন্টারনে্টের মাধ্যমে, নতুন গড়ে ওঠা ডিজিটাল মঞ্চ থেকে।
অন্তত শিক্ষাক্ষেত্রে এই মঞ্চের ব্যবহার নতুন। অধ্যাপকরা ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমের সাহায্য নিয়ে পড়াতে শুরু করলেন। তার ভালোমন্দ বিচার-বিবেচনা শেষ হবার আগেই শিক্ষা দফতরের কর্তাদের মনে হল বুঝি, সব ঘোষণাই মুখ্যমন্ত্রী করবেন কেন? মুখ্যমন্ত্রী এর মধ্যে শিক্ষকদের শিক্ষাব্যবস্থা সচল রাখার আবেদন জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি সিদ্ধান্ত নেবার আগেই তিনি এই রাজ্যের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা স্থগিত করেছেন। শিক্ষা দফতরই বা পিছিয়ে থাকে কেন, শুরু হল যেন রেষারেষি। তাঁরাও শিক্ষকদের নির্দেশ দিলেন, ‘আগে বড়ো’। সেই সঙ্গে একটি টিভি চ্যানেলের সঙ্গে কথা সেরে ফেললেন মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাদানের জন্য। শিক্ষা দফতরের নিজস্ব প্ল্যাটফর্ম বন্ধ হল কার্যত। শিক্ষকরা তৈরিই ছিলেন, নেমে পড়লেন অনলাইন শিক্ষাদানে। এরপর শিক্ষা দফতর আরও একটি চ্যানেলের সঙ্গে আরও একটি ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রাথমিক ও উচ্চপ্রাথমিক স্তরের শিক্ষার আয়োজন করল।
আর যেন এড়িয়ে থাকা গেল না। কিছু প্রশ্ন, অন্তত এরপর, স্পষ্ট হয়ে সামনে এল। যেমন, অনেকেই মনে করলেন যে, এতে গ্রাম তথা দুর্গম অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের অসুবিধাই হল। প্রশ্ন উঠল, গ্রাম প্রধান এই দেশে কতজন শিক্ষার্থী এই ব্যবস্থার সুযোগ নিতে পারে? সবার কাছে স্মার্টফোন বা সর্বত্র তো ইন্টারনেট পরিষেবা নেই! তারা বঞ্চিত হবে কেন? মফস্বলের শিক্ষকরাই বা শিক্ষাদানের এমন সুযোগ পাবেন না কেন? আরও বড় যে প্রশ্ন সামনে এল তা হল এই যে, এতে কী শ্রেণিকক্ষ গুরুত্ব হারাল? এভাবে কী হাজার হাজার শূন্য শিক্ষকপদ আর পূরণ করার প্রয়োজন থাকবে না? অন্যদিকে প্রাক-প্রাথমিক তথা শিশুশিক্ষার কী হবে, তাও ভাবাল।
সব স্তরের সবার শিক্ষার দায় নিশ্চয় শিক্ষা দফতরের। তবু, শিশু আয়োগেরও কিছু দায় থাকে। দেখাশোনা তথা তদারকির দায়। তারা কী দেখবে না ? এতে সমাজের কল্যাণ হবে তো?
প্রশ্নগুলি যতই অস্বস্তিকর হোক, উত্তরগুলো কিন্তু একেবারে অজানা নয়। লকডাউন যেমন চিরদিনের জন্য নয়, তেমনই সমাজ জানে– সব দেশে ও সব কালে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম কখনই শিক্ষক ও শ্রণিকক্ষের বিকল্প হতে পারে না। তাই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার একটা আপৎকালীন ব্যবস্থা হতে পারে, চিরকালীন ব্যবস্থা হতে পারে না। যা অজানা তা হল, এই দুয়ের সমন্বয়-সাধন কোন পথে? এই সমন্বয় একান্ত জরুরি, তাই তার পথ সন্ধানও জরুরি। শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে কিছু সংকেত আছে, তবে তা যথেষ্ট নয়। এখন সময় এসেছে যাবতীয় সংকেতের মর্ম উদ্ধার করার।
No comments:
Post a Comment