শুধুই ঢক্কানিনাদ?
অর্ধেন্দু আর্য বন্দ্যোপাধ্যায়
অর্ধেন্দু আর্য বন্দ্যোপাধ্যায়
আজ মহালয়ার আনন্দমুখর সকাল।
অর্থাৎ, প্রকৃতিতে অত্যাচারকারী সত্তার ধ্বংসের জন্য ক্ষমতাশালী নারীশক্তির প্রতি
আহ্বান করার দিন। কিন্তু এই প্রথার কি কোনও যাথার্থ্য আজ আছে?
যাদবপুর, কামদুনি, কাটোয়া,
গাইঘাটা, পার্ক স্ট্রিট, মধ্যমগ্রাম, বারাসাত, হরিহরপাড়া, সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম,
বানতলা, ধানতলা সহ আরও কত শ্লীলতাহানির নাম যা সংবাদমাধ্যমে আসে না । শুধু
পশ্চিমবঙ্গে নয়, সারা ভারতে - দিল্লী, বদায়ুন, আমেদাবাদ, কোয়েম্বাট্যুর, ব্যাঙ্গালোর,
হরিয়ানার জিন্দে সর্বত্র এই বিভীষিকা ছড়িয়ে পড়েছে । National Crime Records
Bureau’এর রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গে ২০৪০টি ধর্ষণের
ঘটনা ঘটেছে । নারী নিগ্রহ ৩০৯৪২টি । পশ্চিমবঙ্গ ভারতের শীর্ষে বামফ্রন্ট আমল থেকে।
দেড় বছরের শিশু থেকে ষাট বছরের বৃদ্ধা সকল বয়সের মহিলারাই ধর্ষণকান্ডের শিকার হয়ে
চলেছেন । মহিলাদের প্রতি domestic violence ও human trafficking’এর কথা যদি ছেড়েও দিই তবে এই যে অদ্ভুত অবস্থা সারা ভারতে আজ কঠোর বাস্তব
তার কথা ভুলে গিয়ে পটকা ফাটিয়ে হুল্লোড় করে মহালয়া পালন করতে বিবেকে যন্ত্রণা হয়।
এখানে আমি rape victimদের
জীবনের কয়েকটি কথা বলতে চাইছি আজকের মাতৃপূজার সূচনালগ্নে। একজন ধর্ষিতা মানুষ
পরবর্তী তিনটি পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গিয়ে তবেই ন্যায়বিচার পেলেও পেতে পারেন
আমাদের সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় – পুলিশ, হাসপাতাল, আদালত। এছাড়াও থাকে বৃহৎ
সামাজিক পরিস্থিতির মধ্যে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই।
দায়িত্বে পুলিশের ভূমিকা
বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে যা হয় তা হল FIR লেখাতে না চাওয়া, বিচারপ্রার্থীকে
মানহানিকর কথা বলা, ভয় দেখানো এবং আপোস করে নিতে বলা। শামিনা শাফিক যিনি জাতীয়
মহিলা কমিশনের একজন সদস্যা তাঁর মতে এটা হয় ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে। উদাহরণ হিসেবে একটা
ঘটনার কথা মনে করাতে চাই। বিহারের সমস্তিপুর থেকে আসা একটি পরিবারের ১৩ বছরের
মেয়েকে মধ্যমগ্রামে তার বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে সাতজন মিলে ধর্ষণ ও হত্যার
চেষ্টা করে । পুলিশে রিপোর্ট লেখাতে গেলে দিনভর বসিয়ে রাখা হয় কিন্তু রিপোর্ট লেখা
হয় না । এই মেয়েকে আবার ঐ লোকগুলো ধর্ষণ করে কারণ তারা পুলিশের কাছে গিয়েছিল। কিন্তু
এইবারেও তাঁদের রিপোর্ট লেখা হল না । ভয় পেয়ে এই পরিবার চলে গেল এয়ারপোর্ট থানা
এলাকায় । ২৩শে ডিসেম্বর ধর্ষকদের একটি দল এই মেয়েটিকে ঘরের মধ্যে জীবন্ত আগুনে
জ্বালিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করে । এরপরে পুলিশ কী করে ? ২৬ ডিসেম্বর পুলিশ মেয়েটির
জবানবন্দী থেকে সবকিছু জানার পরেও ফরেন্সিক দল ডাকে না, তথ্যপ্রমাণ রক্ষার জন্য
ঘটনাস্থল সিল করে না, কিশোরীর দেহের টিস্যু তদন্তের জন্য ল্যাবরেটরিতে পাঠায় না।
তবে আশার কথা, শেষমেশ মেয়েটির পরিবার বিচার পেয়েছে এবং অভিযুক্ত ধর্ষণকারীদের ২০
বছরের কারাদণ্ড হয়েছে।
দ্বিতীয় হল হাসপাতাল যেখানে Medical Test হয়
প্রমাণ সংগ্রহের জন্য । ডাক্তারি শিক্ষার দ্বিতীয় বর্ষে ফরেন্সিক পড়ানো হয় কিন্তু
এমনভাবে তা হয় যেন তা শুধু কয়েকটি নম্বরের প্রশ্ন । এছাড়া আর কোন কোর্স নেই ।
ডাক্তারি শাখায় বলা হয়েছে যে এই ধরনের ক্ষেত্রে Victimকে
সন্দেহের চোখে দেখতে হবে নইলে সে তোমাকে ফাঁসাতে পারে । যেখানে শারীরিক চিকিৎসা
ছাড়াও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এই মানুষটিকে সমবেদনা জানিয়ে সুচিকিৎসা করার দরকার
সেখানে প্রথমেই সে ডাক্তারের কাছে সন্দেহের বিষয়। অনেক ডাক্তার তো এদের রুগী বলেই
মনে করে না শুধু যেন তথ্যপ্রমাণ, ঘৃণার নজরে দেখে। ফলে অত্যাচারিতের প্রতি যে
ব্যবহার করা হয় তা মর্মান্তিক ও অমানবিক, যেন সেই অপরাধী। ডাক্তাররা বেশীর ভাগ
ক্ষেত্রে মনে করেন যে যৌনাঙ্গের পরীক্ষা করাই যথেষ্ট কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে যেমন পায়ুধর্ষণের
ব্যাপার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। এছাড়া সারা শরীরের ক্ষতগুলির কোনও অন্তর্ভূক্তিকরণ হয় না
ফলে এই তথ্য যখন আদালতে যায় মনে হয় যেন Victimএর সম্মতি ছিল
। এই যে ধর্ষণের পরীক্ষা তারও কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম আমাদের দেশে নেই। তাই বিভিন্ন
ডাক্তার বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করেন। যেমন বর্তমানে আইনত two finger test নিষিদ্ধ হলেও অনেকে তা করে চলেছেন। অনেক ক্ষেত্রে সিনিয়র ডাক্তার
অত্যাচারিতকে গিনিপিগের মত ব্যবহার করে ছাত্রদের দেখান কিভাবে পরীক্ষা করতে হয়।
শেষে আসে আদালত। National Crime Records
Bureauএর রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১২ সালে আদালতে Pending Cases হল ১,০১,০৪১ যার মধ্যে বিচার হয়েছে ৩৫৬৩টি ক্ষেত্রে । ১১৪৪৬টি কেস তুলে
নেওয়া হয়েছে এবং ৮৬০৩২টি কেস বিচারাধীন। অর্থাৎ, শাস্তি পেয়েছে ৩.৫ শতাংশ। এটা যদি
বিগত ১০ বছরে দেখি তাহলে সংখ্যাটা কোথায় যাবে তা বোঝা যায় অনায়াসে।
দেশের ক্ষমতা যাদের হাতে আমরা
ভোটব্যবস্থার মাধ্যমে তুলে দিয়েছি তাঁদের প্রতিক্রিয়া দেখাটাও জরুরী । পশ্চিমবঙ্গের
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর বানতলাতে প্রতিক্রিয়া - এমন তো কতই ঘটে ।
বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী বলেন, এ তো ছোট ঘটনা । উত্তরপ্রদেশের অখিলেশ যাদব বলেন, গুগল
খুলে দেখতে । মুলায়ম সিংহ যাদব বলেন, ছেলেরা তো ছেলেই, ভুল করে মাঝে মাঝে ধর্ষণ
করে ফেলে, তার জন্য ফাঁসি দেবার কী আছে ? মহারাষ্ট্রের আর আর পাতিল বলেছেন, যেহেতু
গণমাধ্যমে অশ্লীলতা বাড়ছে তাই প্রতিটি বাড়িতে পুলিশ বসালেও ধর্ষণ রোখা যাবে না।
মধ্যপ্রদেশের বাবুলাল গাউর বলেন, ধর্ষণ মাঝে মধ্যে সঠিক কাজ । ছত্তিশগড়ের রামসেবক
পাইক্রা বলেন, ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ ধর্ষণ করে না, মনের ভুলে করে ফেলে । মাননীয়
প্রধানমন্ত্রীর অন্যতম ধর্মগুরু আশারাম বাপু দিল্লীর ঘটনায় মেয়েটিকেও দায়ী করেন।
আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত বলেন, ইন্ডিয়াতে ধর্ষণ হয়, ভারতে হয় না।
আজকের দিনে আমাদের দেশে
যেখানে মেয়েদের এই দশা সেখানে মহালয়া পালন করে ১২ কোটির হীরের প্যান্ডেল নির্মাণ
করা কোন মানবিকতার পরিচয়? নারীকে পূজা করতে হলে আগে মনুষ্যরূপী নারীকে করা দরকার
পরে মূর্তিরূপী। নয় কী? আজ সকাল থেকে ১৫টা চ্যানেল ১৫ রকমভাবে দেবী আগমন দেখাবে।
খবরের চ্যানেল আজ সকালে ভুলে যাবে সব কথা, বসিয়ে দেবে বাঁজা বুদ্ধিজীবী
সম্প্রদায়কে টিভির সামনে হারমোনিয়াম নিয়ে, বাজাও কীর্তন বাজাও কাঁসর আমাদের মহান
সংস্কৃতির। আমারা সাধারণ জনগণ পুব্বপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ করে বেড়াব যেখানে
জীবনের সত্তা প্রতিদিন লাঞ্ছিত হচ্ছে তাদের ভুলে গিয়ে ।
নীরদ সি চৌধুরী তাঁর A Sterile Intelligentsia প্রবন্ধে লিখেছেন ,
“Without a frank recognition
of the failure, no change in the direction of improvement can come about. ”
কীসের ব্যর্থতা ? তিনি বলেন,
“For something like seven
hundred years, we had been yearning for political independence and power, and
it came to us then. The realization of such an aspiration alone should have
released sufficient energy and idealism to bring about a regeneration and
reconstruction of our life. It should be added that until 1920, no Indian
nationalist leader thought that this task was less urgent and necessary than the
attainment of freedom from foreign domination. But by the time independence
came, that awareness had disappeared. So we got the opportunity, but failed to
make use of it.”
এ প্রসঙ্গে আমাদের বুদ্ধিজীবী
মহল ও আমাদের সম্পর্কে তাঁর ধারনা কী জানা দরকার -
“It is throwing the blame on
the leaders, on the politicians, on the parties… This reluctance to shoulder
the blame is, in itself, significant. Stubborn reluctance to accept
responsibility is always seen in weak character, who have lost self-confidence.
In British days, the Indian intelligentsia was both assertive and creative. It
has become almost wholly sterile today, and wholly defeatist. The member of the
class are retiring more and more into private life, turning their back on
public affairs, so that even public affairs have become a money-making racket
for just adventurers… ”
মানতে কষ্ট হলেও সত্যি
অস্বীকার করার দুঃসাহস মনে মনে কেউ দেখাতে পারবে কী? যেখানে ব্যবস্থাটাই পচে গেছে
সেখানে প্রতিবাদের সঙ্গে পুনর্গঠন করার ভাবনাও রাখা দরকার । যাই হোক, আমি কোন
হরিদাস পাল জ্ঞান দেবার । আমি শুধু একটা অবস্থা তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।
আজ মহালয়া । আজ থেকে ১ বছর
আগে এই দিনে আমার ব্লগ লেখা শুরু করেছিলাম । সে দিন থেকে আজ অবধি যা যা অনুভব
করেছি তাই লিখেছি প্রায় প্রতি মাসে, কিছু মাস লিখতে পারিওনি । এই সময়কালে অনেকজন
শুভেচ্ছা দিয়েছেন অনেকে সমালোচনা করেছেন আর বেশীরভাগ জন পড়ে দেখেনি । যদিও গুরুতর
কিছু লেখা আমি এখানে লিখিনি, ছোটখাট অনুভূতি মাত্র । আজও একটা অনুভূতি থেকেই লিখছি
তবে এটা আগেরগুলোর থেকে একটু আলাদা আর একটু গুরুত্বপূর্ণ । আমি মনে করি এই
ইন্টারনেটের মাধ্যম থেকে যেটুকু সামাজিক পরিসর পাওয়া যায় তাকে ব্যবহার করা দরকার
কিন্তু সঙ্গে এও মনে করি যে এই মাধ্যমে প্রকৃত commitments থাকে না। তাই যোগাযোগ
ও সামান্যতম মত গঠনের যে সুযোগ পাচ্ছি তার নির্যাসটুকু নিচ্ছি। স্বাধীন ভারতের
নাগরিকগণ একটু ভেবে দেখুন !
No comments:
Post a Comment