Thursday, 11 September 2014

পনজি স্কিমের গল্প

মহালুণ্ঠনের হদিশ পেতে

উত্তম দেব 

শুধু সারদা নিয়েই হইচই। অন্য মানি মার্কেটিং চক্রগুলি নিয়েও কেন বৃহত্তর তদন্ত হচ্ছে না ?
২০১৩'র এপ্রিলে সারদা কাণ্ড ফাঁস হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে শুধু সারদা গোষ্ঠীই নয়, অন্তত কয়েকশো বড়-ছোট মানি মার্কেটিং racket বাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে হাওয়া হয়ে গেছে। ২০০৬-০৭ সাল থেকে এই মানি মার্কেটিং ব্যবসার (ব্যবসা না বলে ধান্ধাবাজি বলা ভালো) শুরু।যারা কুখ্যাত পনজি স্কিমকে মডেল করে আমানতকারীদের কাছ থেকে টাকা তুলতো। বলতে দ্বিধা নেই,বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই এর বিস্তার। কিন্তু ২০১১ থেকে তৃণমূল সরকারের জামানাতেই মানি মার্কেটিংয়ের কারবার ক্যানসার সেলের মতো গোটা রাজ্যকে গিলে খায়। সারদার জালিয়াতি ফাঁস হয় ২০১৩র এপ্রিলে। সেই বছরের প্রথম তিন মাসে মানিমার্কেটিংয়ের জাল এপিডেমিকের মতো গোটা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। কাকদ্বীপ থেকে কোচবিহার- এক একটি জেলায় ৩০-৪০টি করে মানিমার্কেটিং চক্র গজিয়ে ওঠে। জেলাগুলির ব্লকে ব্লকে তাদের শত শত এজেন্ট টাকা তুলতে শুরু করে। রীতিমতো একটা হিড়িক পড়ে যায়। বড় বড় কোম্পানীর পাশাপাশি অনেক ছোট ছোট কোম্পানীও বিভিন্ন জেলা থেকে সাধারণ মানুষকে টুপি পরিয়ে টাকা তুলতে শুরু করে। কেউ ২, কেউ ৫, কেউ ১০, কেউবা ৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে চম্পট দেয়। ২০১০-১১-১২ তেও পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় বিভিন্ন থানাতে প্রতারিত আমানতকারীদের বহু অভিযোগ জমাও পড়ে। কিন্তু তখন সবাই জেগে ঘুমাচ্ছিল। অভিযোগকারীরা কোনও প্রতিকার পায়নি।
আজ যখন সারদা কেলেংকারীর সিবিআই তদন্তের সুবাদে জনগণ আঁচ পাচ্ছে যে সুদীপ্ত সেনের মতো ফেরেব্বাজের সঙ্গে হাত মিলিয়ে জনদরদী নেত্রী-নেতারা জনগণকে নিঃস্ব করে কী ভীষণ মহালুন্ঠন (ঘাপলার অংক ২২ হাজার কোটি টাকাও হতে পারে বলে অনুমান !) চালিয়েছে তখন ভুলে গেলে চলবে না একা সারদাই বাংলার মানুষের রক্ত চোষেনি শত শত সুদীপ্ত সেন মানি মার্কেটিংয়ের জাল পেতে আরও শত শত কোটি টাকা লুঠ করেছে। কিন্তু সেইসব অপরাধীদের ধরতে কিংবা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া শত শত কোটি টাকা উদ্ধারে সরকারের কোনও মাথাব্যথা নেই। এমনকী এই সমস্ত আর্থিক সংস্থাগুলির নিয়ামক প্রতিষ্ঠানগুলির ভূমিকাও সন্দেহের উর্ধে নয়। এখন পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষকে টু দি পয়েন্ট সব বুঝে নিতে হবে ---
১) কত টাকা এইসব টাকা লুন্ঠন চক্র বাজার থেকে তুলে নিয়েছে তার কোনও হিসেব নেই। ২) কতগুলি মানি মার্কেটিং racket বাজার থেকে সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে টাকা মেরে হাওয়া হয়ে গেছে, প্রশাসন কিচ্ছু জানে না। ৩) গায়েব হয়ে যাওয়া শতশত কোটি টাকা কোথায় ঘাপটি মেরে আছে, কোথায় কোথায় কীভাবে খাটছে, কেউ জানে না। ৪) মানি মার্কেটিং'এর দু-চার জন কারবারি ধরা পড়লেও বেশীরভাগই ধরাছোঁয়ার বাইরে। ৫) মানিমার্কেটিং চক্রের সঙ্গে রাজনীতির যোগ বলার অপেক্ষা রাখে না। শীর্ষ স্তর থেকে ব্লক স্তরে নেতাদের প্রশ্রয়েই মানিমার্কেটিংয়ের জাল বিস্তার।
৬) অভিযোগ, জেলা স্তরেও একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের বহু নেতা বিভিন্ন মানি মার্কেটিং চক্রের টাকা খেয়েছেন। ৭) মানি মার্কেটিং কারবারের রমরমার সময় গ্রামে-গঞ্জে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতারা মানি মার্কেটিং কোম্পানীগুলিতে টাকা রাখতে সাধারণ মানুষকে প্রলুব্ধও করতেন। ৮) মানুষের টাকা মেরে ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যাওয়া বহু মানি মার্কেটিং কোম্পানীর এজেন্টও ছিলেন একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের লোকেরা। শোনা যায়, এখন তাদের অনেকেরই প্রভূত সম্পত্তি। ৯)মানি মার্কেটিং সংস্থাগুলি যখন সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে, বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষকে সোনার হরিণের স্বপ্ন দেখিয়ে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা বাজার থেকে তুলছিল তখন সেবি, রিজার্ভ ব্যাংকের মতো নিয়ামক সংস্থাগুলির ভেতরেও যে ভূত লুকিয়ে ছিল, তারও আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ১০) সর্বোপরি, এখন যে সব মিডিয়া গলা ফাটাচ্ছে (বিশেষত, উৎপল দত্তের ভাষায় 'দুঃখবাজার পত্রিকা'), তাদের পাতার পর পাতা ভরে থাকত এইসব পনজি স্কিম ও জাপানি তেলের বিজ্ঞাপনে। এখন সকলেই সাধু সেজেছেন। 
অতএব শুধু সারদা নয়, পশ্চিমবঙ্গে সমস্ত মানি মার্কেটিং'এর নামে যে মহালুন্ঠন হয়েছে, সিবিআইকে দিয়ে তার বৃহত্তর তদন্তের দাবিতেও মানুষের রাজপথে নামা উচিত। তবে মজাটা হল, এখন সিবিআই'এর অধিকর্তা রঞ্জিত সিংহ'এরই চাকরি যাওয়া ও জেলে ঢোকার উপক্রম। কারণ, তিনি টুজি কেলেঙ্কারির চাইদের সঙ্গে দহরম মহরম করে ধরা পড়েছেন, এখন সুপ্রিম কোর্ট 'এর রায়ের অপেক্ষা শুধু। এ যে ঠগ বাঁচতে গাঁ উজাড়। 

No comments:

Post a Comment