অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
ভারতীয় অর্থনীতি কোন পথে তা
নিয়ে ধন্দ যতটা বেশি নিশানা ততটাই কম। গতানুগতিক যে যেমন বলেন সে ভাবেই বলে চলেছেন
বাস্তবতার দিকে না তাকিয়েই। এক পক্ষ যদি এখনও বলে চলেন বড় জমি অধিগ্রহণ করে বড় বড়
ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প গড়েই কর্মসংস্থান ও উন্নয়নের জোয়ার আসবে তবে আরেক পক্ষ
সরবে চেঁচিয়ে চলেছেন বিদেশি পুঁজি এসে সব নস্যাৎ করে দিল বলে। পারতপক্ষে এই দুই
প্রস্তাবই কয়েক দশক পেছনের আশা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি। আমরা বেশ কিছু কাল হল সেই
সময় পার করে এসেছি। তাই দেখা যাচ্ছে, অর্থনীতির তত্বকথা যেমন যেমনই হোক না কেন তার
গতিপথ চলেছে আপন নিয়মে, বহু পুরনো ভাবনা-চিন্তাকে অক্ষম করে দিয়ে।
যখন এক পক্ষ বিদেশি পুঁজির
অনুপ্রবেশ নিয়ে গলা ফাটিয়ে চলেছেন, বিশেষত খুচরো ব্যবসার আঙ্গিনায়, তখন নিঃশব্দে ও
কতকটা অপ্রতিরোধ্য গতিতে সারা বিশ্ব ও আমাদের দেশ জুড়ে থাবা বসাচ্ছে উদ্ধত,
দুর্নিবার ই-কমার্স। এর গতি সতত সঞ্চারমান- কারণ, জমি অধিগ্রহণ বা সরকারি আনুকূল্য
অথবা উৎপাদনের ওঠাপড়া বা বড় পরিকাঠামোর এর কোনও প্রয়োজন নেই। স্মার্ট ফোন বা
ডেক্সটপ খুললেই এদের নাগাল পাওয়া যায় আর বাড়িতে বসে অর্ডার দিয়ে বাড়িতেই ডেলিভারি
নিতে কার না পছন্দ করে। এ বছর ফ্লিপকার্ট ভারতে ই-কমার্স’এর ব্যবসায়ে ১ বিলিয়ন
ডলার বিনিয়োগের কথা ঘোষণা করতেই আমাজন এগিয়ে এসেছে ২ বিলিয়ন ডলারের ভাণ্ডার নিয়ে।
একটি সমীক্ষায় প্রকাশ, আগামী ২০২০ সালে ভারতবর্ষে ই-কমার্স’এর ব্যবসা গিয়ে দাঁড়াবে
৩২ বিলিয়ন ডলারে। বৃদ্ধির হারটা একবার কল্পনা করুন শুধু।
এরই পাশাপাশি
ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের বিকাশকে এখনও যারা অর্থনীতির আড়কাঠী মনে
করেন ও এই শিল্পের আবাহনকে আশু কর্তব্যকর্ম বলে সাব্যস্ত করেন, তাদের পোড়ামুখে ছাই
দিয়ে এই ক্ষেত্র পড়ে গেছে অনেক পিছনে। এ বছরই অর্থনৈতিক সমীক্ষায় পরিষ্কার জানানো
হল, ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার ১ শতাংশের আশেপাশে, যেখানে কৃষির
ক্ষেত্রে বৃদ্ধি ৪.৭ শতাংশ। ক্রমশ দেখা যাচ্ছে, অর্থনীতির চালিকাশক্তি আর
ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রের হাতে থাকছে না। কেন কীভাবে তা হল সে আলোচনা করা যাবে
কখনও।এই সরল সত্যটাকে অনেকেরই দেখেছি মেনে নিতে আপত্তি। তবে ম্যানুফ্যাকচারিং
শিল্পকে মহামহিম করে দেখানোর পেছনে যে একটা শঠতা ও মিথ্যাচারও কাজ করছে তাকে
অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প স্থাপনার নামে এক লপ্তে বড়
কৃষিজমি সস্তায় হাতিয়ে নেওয়াটাও এই মরণাপন্ন ক্ষেত্রটিকে চাগাড় দিয়ে তোলার একটা বড়
উদ্দেশ্য। এটা আজ পরিষ্কার বুঝে নেওয়ার সময় এসেছে যে অর্থনীতির রণাঙ্গনে ম্যানুফ্যাকচারিং
শিল্পের আর তেমন উল্লেখযোগ্য কোনও ভুমিকা থাকছে না। পরিষেবা ও কৃষি’ই অর্থনীতির
মুখ্য জীবনরেখা হিসেবে কাজ করবে আগামীতে।
এই পরিসরে এসেই আগামী দিনের
অর্থনীতি কোনদিকে ধাবমান তার একটা ছবি অস্পষ্ট হলেও মিলতে পারে ক্রমশ। অর্থনীতির
পুরনো আঙ্গিকটাই যেন ভেঙ্গে বসতে বসেছে। পরিষেবার অঙ্গনে এক ডিজিটাল পরিব্যাপ্তির
মধ্য দিয়ে নতুন আঙ্গিকের অর্থনীতির উদয় যেন সময়ের অপেক্ষা মাত্র। দেখতে পাচ্ছি,
ছোট বড় দোকানগুলোর জায়গা নিয়ে নিচ্ছে ই–শপিং’এর বিভিন্ন সাইট, বড় বড়
ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের জায়গায় ছোট ছোট ‘হোম ইন্দাসট্রি’ যেন অবধারিত ভবিতব্য,
‘স্টার্ট আপ’ হয়ে উঠছে যুবদের মূলমন্ত্র, আর সর্বোপরি, মুহূর্তের কোনও অভিঘাতে
পালটে যাচ্ছে অর্থনীতির যে কোনও গতিপথ। উদগ্রীব ভেঞ্চার ক্যাপিটাল বসে আছে মোক্ষম
ক্ষেত্রটিতে বিনিয়োজিত হবে বলে। ব্র্যান্ড’এর রস শুকিয়ে যাচ্ছে কোনও অজানা উদ্ভাবক
বা নব্য উদ্যোগপতির কাছে।
তবে আশঙ্কার জায়গাটিও নতুন
করে তৈরি হচ্ছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির মায়ামোহের কাছে বড় বড় পুঁজির ওস্তাদেরা কাত
হয়ে গেলেও মুনাফা লালসা ও লোভ তাদের নিয়ে যাচ্ছে সেই কৃষি ও প্রকৃতিভূমির কাছে
যেখানে এখনও অর্থের জোর ও পেশির আস্ফালন নির্ধারণ করে অর্থনীতির বাস্তবিক চলাচল। কর্পোরেট
দুনিয়া এখন তাই দৃষ্টি ফেলেছে কৃষি, জল, জঙ্গল ও জমির দিকে। অর্থনীতির যাবতীয়
রক্তপাত ও নীতি-নির্ধারণ তাই এখানেই অবয়বের পথে।
No comments:
Post a Comment