সায়ন্তন মাইতি
ওরে বাবা! এত কালো কেন? জুকারবার্গ তো নিজে থেকেই ফেসবুকটাকে নীল-সাদা
বানিয়ে রেখেছে। এমএস অফিসের ফণ্টটাও কী সুন্দর নীল-সাদা রঙের। পায়ের তলায় হাওয়াই চপ্পল থেকে মাথার উপর শরতের
আকাশ – প্রাকৃতিক কী অপ্রাকৃতিক সবই নীল-সাদা। তাহলে
ফেসবুক কেন কালো?
কাদের জন্য কালো হল? যারা ক্যাম্পাসে বসে মদ খায়? স্বল্প পোশাক পরে ঘুরে
বেড়ায়? যারা ‘কলচর’ এর মাথা খাচ্ছে? এদের জন্য
সবাই কালো করছে প্রোফাইল পিক?
ফেসবুকের কালো আসতে আসতে আবার স্বাভাবিক হয়ে আসছে ঠিকই। সমাজের কালো এখনো
যায়নি। দুই ছাত্রের গ্রেফতার হওয়াকে অনেকে আলো দিশারী ভাবতে পারেন। ভাবতে পারেন
আন্দোলনরত ছাত্র বনাম পুলিশের বৈরীতার ঝড় একটু হলেও উল্টো মুখ ঘুরল। ভাবতে পারেন, প্রসঙ্গান্তর
করার একটা ব্রহ্মাস্ত্র কর্তৃপক্ষের হাতে চলে এল। কিন্তু আমি ভাবছি, এতে কালির
পরিমাণ আরো বেড়ে গেল। প্রমাণিত হল, ১৬ই সেপ্টেম্বর থেকে অবস্থানরত ছাত্রছাত্রীরা
কোনো ভুল দাবী করে নি। প্রমাণিত হল, শ্লীলতাহানি বলে ‘দুদিন পরে আসার’ যে নির্দেশ
উপাচার্য দিয়েছিলেন, সেটা তার চরম অযোগ্যতা। প্রমাণিত হল, যে ঘটনাকে অঙ্কুরে বিনাশ
না করায় বর্বরতা এত দূর গড়ালো, প্রকৃতপক্ষে সেটা ঘটেছিল। আর সব থেকে বেশি কালি ছিটল শাসকদের
মুখে। সিভিল আর মেকানিক্যালের যে দুজন গ্রেফতার হয়েছে, তাদের উপর কোনো রঙের
ছিটেফোঁটা নেই। অথচ শাসকদল যেভাবে প্রথমে উপাচার্য, তারপর পুলিশকে সমর্থন করে
ঘটনায় রঙ লাগালেন, সেটাকে খাল কেটে কুমীর আনাই বলা চলে। প্রশ্ন উঠতেই পারে, এদের
ঢাকতে কি এত ‘বাঁচিয়ে চলা’ উপাচার্যের? আর যে ঘটনা সত্যি
ঘটেছে, তাকে নিয়ে কিছু না বলে দিনের পর দিন উপাচার্য আর ‘সংবেদনশীল’ পুলিশকে এত
সমর্থন কেন শাসক দলের? ২২ তারিখ পাল্টা মিছিলের আগের দিন শিক্ষামন্ত্রী আর শাসক আশ্রিত
ছাত্র পরিষদের প্রধানকে নিয়ে নিগৃহীতার বাড়ি যাওয়ার আগে অবধি ‘অ্যাপেল অফ
ডিসকর্ট’কে নিয়ে তো একটা কথাও শোনা যায় নি তাদের মুখে।
দুর্বলকে জব্দ করা তো খুব সহজ, তাই নিগৃহীতার বাবাকে পাল্টা মিছিলে টেনে নিতে
অসুবিধা হয়নি শাসকদের। কিন্তু সেই মিছিলে হতভাগ্য ভদ্রলোকের একটি মন্তব্য ছাড়া আর
কোনো বয়ান, শ্লোগান শুনে কিংবা প্ল্যাকার্ড দেখে মনেই হল না ছাত্রীর শ্লীলতাহানির
বিরুদ্ধে আদৌ এরা সরব। একটাই উপজীব্য বিষয়, প্রতিবাদীদের নিন্দা (মিছিলের
উদ্দেশ্য না-জেনে পা মেলানো মানুষদের কথা অবশ্য বাদ দিলাম)।
গত ২৪শে সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট কিছু নতুন নির্দেশিকা দিয়েছে। প্রথমে বলেছিল,
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরেই নাকি পুলিশ ক্যাম্প থাকবে। পরে এই নির্দেশ প্রায়
সাথে সাথেই পরিবর্তিত হয়ে ভিতর থেকে বাইরে এসেছে। বলা হয়েছে, বহিরাগতদের পরিচিতি
না জেনে ঢুকতে দেওয়া হবে না। এইটুকু শুনেই ‘হোক ক্যালানো’পন্থীরা আহ্লাদে
আটখানা। যেন বীর বিক্রমে ছাত্র আন্দোলন পরাস্ত করা হল। অথচ অনেক কলেজেই এই নিয়ম
আছে। বাড়তি কিছু নয় এটা। আমি আমার প্রাক্তন কলেজ স্কটিশচার্চে এখন ঢুকতে গেলেও
এতদিনের পরিচিত গেটরক্ষীদের কাছে খাতায় সই করে ঢুকি। আর নির্দিষ্ট জায়গায় বিক্ষোভ
দেখানোর আদেশ যে সুন্দর করে লঙ্ঘন করা হয়েছে, তা তো সবাই জানেনই। কর্তৃপক্ষ ২
নম্বর গেট শুধু খুলে দিতেই বাধ্য হয়নি, আন্দোলনকারীদের ছড়িয়ে পড়া আটকাতেও অপারগ।
অর্থাৎ, জনরোষের কাছে আইন
কিছুই নয়। কোর্টের তলব দরকার হলে পরিবর্তিত হতে পারে, কিন্তু অন্যায়ের বিরোধিতার
পরিবর্তন হয় না। বহিরাগত ছেড়ে দিলাম, অন্তর্গতদেরও আইডেণ্টিটি কার্ড দেখানো নিয়ম
হয়েছে। এ আইনের প্রতিবাদ ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। একজন ইংরেজীর অধ্যাপক ফেসবুকে
পোস্ট দিয়ে দিয়েছেন, তিনি পরদিন গেটের কাছে রাস্তার উপর বসে ওনার পরবর্তী ক্লাস
নেবেন। তবু ভিতরে ঢুকবেন না। আশা করব, এসব অন্ধ কানুনের ‘শীঘ্রপতন’ হবে, এর চিরস্থায়ীকরণ
একদল মানুষের ‘স্বপ্নদোষ’ হয়েই থাকুক।
অবশ্য হাইকোর্টের আগেই শিক্ষামন্ত্রী একটার পর একটা সমন জারি করেই চলেছেন।
আন্দোলনকারী ছাত্র-শিক্ষক এবং অন্যরা ভয় তো তাতে পায়ইনি, বরং এক একটা উক্তি তাদের
আরো তাতিয়ে তুলেছে, শেষ দেখে না ছাড়ায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করেছে। তবে শিক্ষামন্ত্রী এর
মাঝে কমিক রিলিফ দিতেও ছাড়েন নি। ওনার নির্দেশ, উপাচার্যকে পছন্দ না হলে ছাত্ররা
বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিয়ে অন্য কোথাও ভর্তি হতে পারে। যেন পঠনপাঠনের সুযোগ এমনই এক
বিরল প্রাপ্তি, যার ছাড়পত্রের লকেটটা ছাত্রদের সযত্নে ট্যাঁকস্থ করে রাখতে হবে আর
পরিচালনতন্ত্র অনুকম্পার দৃষ্টিতে ডিগ্রী ভিক্ষার্থীদের দিকে তাকিয়ে থাকবেন। কী
করুণ অবস্থা! .... আসল ব্যাপার কী জানেন? ছাত্ররা পালিয়ে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের খাবার
হজম দূরের কথা, গলা দিয়ে নামবে কিনা সন্দেহ। সকলের জ্ঞাতার্থে কয়েকটা পুরনো কথা
মনে করিয়ে দিচ্ছি। NAAC নিয়ে এই ভিসি-র নাক বেশ
উঁচু। NAAC আসার আগে গুচ্ছ টাকা ঢেলে লাইব্রেরী থেকে মেইন
গেট ঝকমকিয়েই ছাড়েননি, বিয়ে বাড়ির মত আলো দিয়ে ক্যাম্পাসটাকে সাজিয়েছিলেন। কোন কলেজে এসব ‘ন্যাকামি’ হয় কেউ জানে না। আবার ‘ন্যাকার্থে’ সেমিনার
ক্যান্সেল হয়েছে তাঁরই নির্দেশে। জীবনের কোনো বিশেষ দিনেও অভিজিৎবাবুর এত সাজো
সাজো রব ছিল কি? তবে এত অবধি তাও না হয় মানা গেল। উনি NAAC-এর পরিদর্শক কর্তাকে একটা
ট্যাব উপহার দিয়ে বসলেন। অনেকেই সেটা ভালো চোখে দেখেনি। তাদের অনুমান সত্যি করে
এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মাথা হেঁট করে ঠিক পরদিন পরিদর্শক সেটা ফেরতও দিয়ে দিলেন উপাচার্যকে।
এর ইঙ্গিত নিয়ে কারোর মনে সন্দেহ আছে কী? আর তাই যদি সত্যি হয়, তাহলে এটাও তো স্পষ্ট যে
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্যাটাস রক্ষার্থে ভিসি কেমন জুজুদর্শন করে বেড়ান। দুর্বলতা
তাহলে কোথায়?
হ্যাঁ, এই সফট পয়েণ্টটা ধরিয়ে দিতে চাইছি। ছাত্র পালালে এদের হালুয়া টাইট
হয়ে যাবে। বামন হয়ে চাঁদে হাত দিলে হাতের গৌরবের প্রতি অবসেসিভ হওয়াটা স্বাভাবিক।
অস্থায়ী উপাচার্য নিজের সিটের জন্য তেমনটাই হয়েছেন। ২৭শে সেপ্টেম্বর যাদবপুরের
পরিচালন সমিতি ছাত্রদের বিরুদ্ধে আইন ভাঙার মামলা ঠুকেছে। তাড়াতাড়ি ক্লাস শুরু
করার আর্জি জানাচ্ছেন রাজ্যপাল থেকে হাইকোর্ট প্রত্যেকে। এর পিছনে ছাত্রদের যেমন
স্বার্থ রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কিন্তু কোনো অংশে কম নয়। JU এর ট্যাগ ছাত্রদের কাছে যেমন লোভনীয়, তেমনি বিরাজমান গরিমায় ন্যূনতম
কালি ছেটাও কর্তৃপক্ষের কাছে জানহানিকর মানহানি। এটা সবসময় মাথায় রাখা দরকার।
পুজোর পরেই সেমিস্টার। ছাত্ররা প্ররোচনায় পা দিয়ে হঠাৎ সেই সময় যদি শৈথিল্য দেখিয়ে
পিছিয়ে আসে, তাহলে কিন্তু চরম অসুবিধার মুখে পড়বে তারাই। ক্লাস হল না, অথচ
পরীক্ষায় বসতে হবে। বরং পরীক্ষা বাতিল হলে সবার হবে। তবু একসাথে সবাই একই অবস্থায়
আছি – এই চিন্তা কারোর মধ্যে হতাশা আসতে দেবে না।
যাদবপুরের ইতিহাসে পরীক্ষা বাতিল এর আগেও হয়েছে। বস্তুত কোনো ক্ষতিই হবে না তাদের।
আন্দোলন থাকলে সুড়সুড় করে ব্যবস্থা হবে সেমিস্টারের। আর শিক্ষামন্ত্রীর কথা মেনে
নিলে কেউ যদি যেতে চায় যাক না। যাদবপুরের বিখ্যাত এবং বিদগ্ধ অধ্যাপক-অধ্যাপিকারা
ছাত্রদের পাশে আছেন। অন্তত আমি যেটকু জানি, প্রত্যেক ডিপার্টমেণ্টের শিক্ষকরাই
এগিয়ে এসেছেন। ছাত্রদের কেরিয়ার তৈরীর জন্য সাহায্য করতেও তাঁরা সবসময় পাশে
থাকবেন। বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজ্য সরকারের উদ্যোগে কারোর কেরিয়ার নষ্ট হওয়ার
উপক্রম হলে। ....তাহলে ভয় কিসের? ছেড়ে পালাও অন্য কোথাও। বিশ্ববিদ্যালয় নামক
প্রতিষ্ঠানটি বসে বসে মাইনে পাওয়ার কোনো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি নয়। ছাত্র না
থাকলে কর্তৃপক্ষ লাটে উঠবে। সেটা তারা ভালোমত জানেও।
তাই ছাত্রদের বারবার অনুরোধ করব, কোনোভাবে পিছিয়ে না আসতে। শাসক আর কর্তৃপক্ষ এখন সমার্থক হয়ে গেছে। ছাত্রদের সাথে
লড়াইয়ে জিতে গেলে এদের ঔদ্ধত্যকে আর ঠেকানো যাবে না। এদের বশ করতে পারলে ক্ষমতার অহঙ্কারে
এদের নৈরাজ্য বহু গুণ বেড়ে যাবে। ছাত্রদের মূল দাবী ভিসি-র পদত্যাগ। আগে সেটা হবে, তারপর
বাকী কথা।
No comments:
Post a Comment