Tuesday, 29 March 2022

স্কুল পোশাকের অর্থনীতি

স্কুল-পোশাকই কি শেষ পরিচয়?

প্রবুদ্ধ বাগচী

 

মূলধারার সংবাদপত্রের সাংবাদিকদের একটা বড় সীমাবদ্ধতা হল, তারা সরকারের সমালোচনা করে বিবিধ খবর ছাপা কিন্তু নানা ধরনের সরকারি প্রকল্প বা তার খুঁটিনাটি বিষয়ে সাধারণত খবর রাখার প্রয়োজন বোধ করে না অথচ, সরকারের সমালোচনার চেহারায় যে সব সংবাদ প্রকাশ পায়, তার জন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারি প্রকল্প বিষয়ে আরেকটু বিশদ তথ্য দেওয়ার দরকার পড়ে। তাই, রাজ্যের বহুল ও সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিকেও এমন সব খবর মাঝে মাঝে বেরয় যাতে প্রকট হয়, সরকারি দফতরের সবটুকু সংবাদ প্রতিবেদক নিজেও জানেন না। কিন্তু সরকার-বিরোধী খবরের নিজস্ব একটা বাজার আছে, প্রধানত সেগুলিই আদপে ‘খবর’- কোথায় কোন সরকার কী প্রকল্প ঘোষণা করল, সাংবাদিক মহলের বিবেচনায় সেগুলো নাকি সচরাচর খবর নয় ওগুলো নাকি পাঠক পড়তে চান না সংবাদপত্রের পাতায় পাঠকের নাকি দাবি, সরকারের ভুল ত্রুটি ও সমালোচনা ধরনের সংবাদ

সদ্য এই রাজ্যের পাবলিক ডোমেনে এমন একটা সংবাদ ঘুরপাক খাচ্ছে: রাজ্যের স্কুল শিক্ষা দফতর সব সরকারি ও সরকার পোষিত স্কুলের ইউনিফর্ম নিজেরাই তৈরি করে সরবরাহ করবে বলে নির্দেশ দিয়েছে তাতে বলা হয়েছে, প্রথমত পোশাকের রং হবে নীল-সাদা ও দ্বিতীয়ত তাতে সরকারের লোগো লাগানো থাকবে যাবতীয় বিতর্ক এই দুই বিষয়কে ঘিরে প্রথম প্রশ্ন, কেন নীল-সাদা? পরের প্রশ্ন, কেন লোগো? বলে রাখা প্রয়োজন, এই নির্দেশ না আসা পর্যন্ত এতদিন ইউনিফর্ম তৈরির অর্থ সরকারের ওই দফতরই বরাদ্দ করত, যা সমগ্র শিক্ষা মিশন (পূর্বতন সর্বশিক্ষা মিশন) মারফত স্কুলের কাছে আসত স্কুল তা তৈরি করিয়ে পড়ুয়াদের দিত বিনামূল্যে পরিবর্তিত ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয়ভাবে এই তৈরির প্রক্রিয়াটা চলবে যদিও বাস্তবে এত বড় রাজ্যে কেন্দ্রীয়ভাবে এটা পরিচালনা করা অসুবিধে, তার একটা বিকল্প ব্যবস্থাও ভাবা হয়েছে- যদিও নিয়ন্ত্রণটা নির্দিষ্ট স্কুলের বদলে স্কুল শিক্ষা দফতরের হাতে থাকবে

এই বদল কেন করা হল, তা নিয়ে নানা রকম মন্তব্য ভেসে বেড়াচ্ছে সংবাদপত্রেঅধিকাংশের মত, এটা নাকি কেন্দ্রীকরণের চেষ্টা কথাটা হল, রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থাটা তো একটা কেন্দ্রীয় কাঠামোর ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে- প্রতিটি ক্লাসের সিলেবাস এক, পাঠ্যবই এক- কেন্দ্রীয়ভাবে একই প্রশ্নপত্রে মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা নেওয়া হয়তাহলে পোশাক একরকম হলে মূল আপত্তি কোথায়? নীল-সাদা রংজুটি গত কয়েক বছরে রাজ্যের সরকারি রং হিসেবে একরকম স্বীকৃতি পেয়েছে, তাই পোশাকের রং নীল-সাদা হলে সমস্যা ঠিক কোথায়? নীল-সাদার বদলে যদি সবুজ-সাদা হয় তাতেও বিতর্ক বাঁধতে পারে; বস্তুত কোনও রঙের নির্বাচনই বিরোধ বা বিতর্কমুক্ত হবে, এমন ভাবা যায় না আর, সরকার পোশাক তৈরি করে দিলে তাতে সরকারি লোগো থাকলেই বা অসুবিধে কোথায়? পুলিশের সরকারি ইউনিফর্মে অশোকস্তম্ভের ব্যাচ লাগানো থাকে, সেনাবাহিনীর প্রতিটি শাখার পোশাকে সেই বিভাগের লোগো লাগানো থাকে, এটাই রীতি এই রাজ্যেও সবুজসাথীর সাইকেল বা কন্যাশ্রীর শংসাপত্রে ওই প্রকল্পগুলির লোগো ছাপানো থাকে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিটি প্রকল্পেও উপভোক্তাদের জন্য প্রকল্পের সরকারি লোগো ব্যবহার করা হয় রাজ্যের বিধায়ক বা কেন্দ্রের সাংসদ তাদের উন্নয়ন তহবিল থেকে কোনও প্রকল্প তৈরি করলে- রাস্তা, কালভার্ট, স্কুলের লাইব্রেরি, ক্লাসরুম, শৌচাগার ইত্যাদি- সেখানে সরকারি ফলক বসিয়ে দেওয়া হয় এমনকি কোভিডের টিকা নিলেও তার শংসাপত্রে প্রধানমন্ত্রীর ছবি মুফতে পাওয়া যায়তাহলে সরকারের অর্থে তৈরি পোশাকে সরকারি লোগো থাকলে তা নিয়ে এমন শোরগোল কেন, বোঝা মুশকিল।

অন্য আরও একটা কথা বলা হচ্ছে রাজ্যের সরকারি ও সরকার পোষিত প্রায় সাড়ে আট হাজার স্কুলের নানা রকম ইউনিফর্ম আছে, সবার জন্য একরকম সরকারি রঙের পোশাক হলে স্কুলগুলি মনে করছে তাদের স্বাতন্ত্র্যচিহ্ন লোপ পাবে ইউনিফর্ম নিশ্চয়ই স্কুলের এক ধরনের পরিচয়, মেনে নিতে আপত্তি নেই কিন্তু ইউনিফর্মের ওপরেও অনেক স্কুল তাদের ছাপানো ব্যাজ বা পোশাকের ওপর স্কুলের লোগো ব্যবহার করে, এগুলোও একভাবে স্কুলের পড়ুয়াদের চিহ্নিত করে সরকারের বর্তমান সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সরকারি পোশাকে সরকারি লোগো থাকলেও, সেটা ছাড়া স্কুলের আলাদা লোগো বা ব্যাজ ব্যবহারে কোনও নিষেধ নেই সরকারি পোশাকের ওপরেও স্কুল তাদের নিজস্ব লোগো লাগিয়ে নিতে পারে, নির্দিষ্ট ব্যাজ ব্যবহার করতে পারে- তারপরেও এই ব্যবস্থা কি স্কুলের স্বাতন্ত্র্যের ওপর খুব বড় ধরনের আঘাত বলে বিবেচিত হবে?

আসলে এই পর্যন্ত যা বলা হল তা গোটা বিষয়টার উপরিতলের কথা এই ভাবনার পেছনে একটা অন্য বিবেচনা আছে রাজ্যের স্কুলগুলির মোট পড়ুয়া সংখ্যা প্রায় এক কোটি পনের লক্ষ, এদের পোশাক পিছু বরাদ্দ বছরে ছশো টাকা হিসেবে স্কুলের পোশাক বাবদ সরকারকে ৬৯০ কোটি টাকা বছরে খরচ করতে হয় শিক্ষা দফতরের ভাবনাটা হল, এই বিপুল বাজারের পুরোটাই সরকারি উদ্যোগে ব্যবহার করা ১.১৫ কোটি পোশাক তৈরি করতে প্রয়োজন হয় প্রচুর কারিগর ও সেলাই জানা কর্মী রাজ্যের স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের যদি এই প্রকল্পে যুক্ত করা যায়, তাহলে এই বিপুল সরকারি অর্থের পুরোটাই তাঁরা তাঁদের উৎপন্ন পোশাকের একটা নির্দিষ্ট ও নিশ্চিত বাজারের মাধ্যমে নিজেদের কাছে ফেরত আনতে পারেন এতে নতুন কাজের সুযোগ যেমন আছে, তেমনি স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলি মুনাফা করলে গ্রামী অর্থনীতিতে তার একটা ইতিবাচক ছাপ পড়া অসম্ভব নয় বিশেষ করে, গত দু বছরের কোভিড পরিস্থিতি যেভাবে প্রান্তীয় মানুষদের জীবনযাত্রায় বিপদ ডেকে এনেছে, এই সিদ্ধান্ত তাতে কিছুটা সুরাহার পথ দেখাতে পারে- বছরে প্রায় সাতশো কোটি টাকা খুব একটা কম অর্থ নয়, সরকার এই নিশ্চিত বাজারের রাস্তা তাঁদের সামনে খুলে দিলে সেটা তাঁদের একটা বড় সহায়

আরেকটা তথ্য, হয়তো সর্বজ্ঞ সাংবাদিকরা জানেন না যে বেশ কিছু বছর ধরে সরকারি দফতরের বরাদ্দ অর্থ সরকারি সংস্থাগুলির মাধ্যমে খরচ করার একটা নীতি চালু আছে স্কুল শিক্ষায় মিড-ডে-মিল পরিচালনার ভার অনেক ক্ষেত্রে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর হাতে আইসিডিএসএর পুষ্টি প্রকল্পে খাদ্যশস্য সরকারি অত্যাবশকীয় পণ্য নিগম বা বড়-মাঝারি-ছোট সরকারি সমবায়ের মাধ্যমে কেনা হয় স্বাস্থ্য এবং নারী ও শিশু কল্যাণ দফতরের অধীন আশা ও অঙ্গনওয়ারী কর্মীদের পোশাক, অ্যাপ্রন সরবরাহ করে তন্তুজ ও মঞ্জুষা- দুটিই রাজ্য সরকারি সংস্থা প্রসঙ্গত বলা দরকার, এক সময় বাম আমলে গ্রামী তন্তুবায়দের সামনে বৃহত্তর বাজারের সুযোগ খুলে দেওয়ার লক্ষ্যে তন্তুজ বা মঞ্জুষা প্রতিষ্ঠানগুলি তৈরি হয়েছিল কিন্তু কালক্রমে পরিচালন ব্যবস্থার ত্রুটিতে প্রতিষ্ঠানগুলি কার্যত সাদা হাতিতে পরিণত হয়, বামফ্রন্টের শেষ পর্যায়ে তন্তুজ ও মঞ্জুষা ক্ষতিতে চলত গত কয়েক বছরে তন্তুজ বা মঞ্জুষার মতো প্রতিষ্ঠানগুলি ঘুরে দাঁড়িয়ে লাভের মুখ দেখছে কোভিড পরিস্থিতিতে গ্রামের স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে দিয়ে মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করিয়ে বহু সরকারি দফতর, হাসপাতাল তাদের পণ্য কিনে গোষ্ঠীগুলির কাজের আর্থিক বুনিয়াদকে কিছুটা পোক্ত করার চেষ্টা করেছে কেন্দ্রীয়ভাবে কলকাতায় ‘সরস মেলা’ আয়োজন করে এদের বিভিন্ন পণ্যকে বড় ক্রেতাদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে কার্যত স্কুল পোশাকের সঙ্গে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সংযুক্তি এই নীতিরই একটা অঙ্গ

এই প্রসঙ্গে বলা দরকার, রাজ্যে জীবিকার সংকট ও শিল্পের আকাল নিয়ে যে সব প্রশ্ন জনপরিসরে ভেসে বেড়ায় তার মধ্যে কিছু বিভ্রান্তি আছে আজ আমাদের অর্থনীতি যেভাবে যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে সেখানে খুব বড় মাপের শিল্প এসে প্রচুর জীবিকার সুযোগ খুলে দেবে এ প্রায় একটা মরীচিকা গিগ-অর্থনীতির নিজের নিয়মে বড় ও নিশ্চিত রোজগারের জায়গা প্রবলভাবে সংকুচিত ফলে, এর বিকল্প একমাত্র ক্ষুদ্র ও মাঝারি মানের শিল্প যাতে জীবিকা ও রোজগারের সুযোগ বেশি রাজ্যের স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলি সেদিক দিয়ে কিছুটা আশার আলো দেখাতে পারে, যাদের রোজগার বৃদ্ধির সঙ্গে গ্রামী মহিলাদের আর্থিক ক্ষমতায়নের বিষয়টাও জড়িত বাম আমলে যখন বড় শিল্পের জয়গান গাওয়া হচ্ছিল তখনও কিন্তু ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে কর্মসংস্থান হয়েছে সব থেকে বেশি গত এক দশকে বর্তমান রাজ্য সরকারও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছে সব মিলিয়ে যে বিষয়টা নিয়ে একটা একমুখি ভ্রান্ত বিতর্ক উস্কে দেওয়া হচ্ছে, এটা বেশ স্পষ্ট

যে সব স্কুল পুরোটাই সরকারি অনুদানে পরিচালিত, তারা শুধুমাত্র নিজেদের বিশেষ রঙের পোশাক দিয়েই নিজেদের স্বাতন্ত্র্যচিহ্ন আঁকড়ে রাখতে চান- ব্যাপারটা বেশ কৌতুকের! স্কুল মানে কি কেবল তাদের বিশেষ পোশাক? আর কিছু নয়? বৃহত্তর অর্থনীতির স্বার্থে তারা না হয় তাদের এই আবদার কিছুকাল মুলতুবিই রাখল শিক্ষার কি খুব বড় মাপের ক্ষতি হয়ে যাবে তবে? 

 

Sunday, 27 March 2022

বই ফই

কে বলে বইই সব?

অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়


সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের নিয়মিত বই পড়ার অভ্যাস নেই। কোনওকালেই ছিল না। তাই বইপড়া-লোকজনকে সমাজ বেশ সমীহের চোখে দেখে। 

প্রায় সকলেই এ-ব্যাপারে একমত হবেন, যে-সব মানুষ নিয়মিত বই পড়েন তাঁরা অবশ্যই পণ্ডিত, চিন্তাক্ষম এবং বুদ্ধিমান শ্রেণির অন্তর্গত। সমাজে তাঁদের মতামতের একটা প্রভাব আছে। অর্থাৎ, বই সমাজের মধ্যে একটি কাঁটাতার বিছিয়ে তাকে দুটি ‘অসমান’ ভাগে ভাগ করতে পেরেছে। তবে এইখানে একটা গণ্ডগোলও আছে। সেই সব মানুষ যাঁরা কেবলই রহস্য রোমাঞ্চ ভূত কিংবা আদিরসাত্মক গল্পের বইপত্তর পড়েন, তাঁরা ঠিক সেই অর্থে কুলীন পদবাচ্য হন না। কিন্তু যাঁরা কঠিন-কঠিন প্রবন্ধ-টাইপ অথবা যে-কোনও বিষয়ে দার্শনিক কথাবার্তা লেখা বইয়ের প্রতি ঝোঁক দেখান তাঁদের স্তর হয় অবশ্যই উঁচুতে। বাকিরা যেন উহ্যভাবেই থেকে যান নিচুতে। সুতরাং, বই পড়ে যাঁরা শ্রেণিহীন সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখেছেন, তাঁরাই আসলে প্রথমেই নির্মাণ করেছেন বইয়ের দুনিয়ার অন্তরে আরেকটি অমোঘ শ্রেণি বিভক্ত (শ্রেণি মর্যাদার ভিত্তিতে) সমাজ। 

অথচ বই পড়া বা না-পড়ার সঙ্গে চিন্তার কোনও সম্পর্ক নেই। যদি থাকত তাহলে তো গুটেনবার্গের আগে কেউ চিন্তাই করতে পারেনি আর তারপরে সকলেই চিন্তাবিদ হয়ে গিয়েছেন বলে স্বীকার করে নিতে হয়। শ্রুতি ও স্মৃতিকে তো তাহলে প্রথমেই অস্বীকার করতে হয়। কোডেক্স হোক বা ট্যাবলেট অথবা পুঁথি– সেখানে যে-চিন্তাজগতের সাক্ষ্য পাওয়া যায় তার বাইরেও তো অস্তিত্ব ছিল/আছে জগতের চিন্তার এক বিরাট-বিশাল প্রবাহের। সেই অসীম-প্রবাহ থেকে গৃহীত কয়েকটি সসীম-তরঙ্গকণার লিখিত রূপই হল গ্রন্থ। অর্থাৎ, চিন্তাই হল মূল– আর তাকে চিরস্থায়ী করার একটি উপায় হল লিপি। একইসঙ্গে এও বলা যায় যে, শুধু লিপি কেন, কৃষিকাজ-পশুপালন-ছবি-সঙ্গীত-নৃত্য ইত্যাদি সবই চিন্তার সেই বিপুল লহরি থেকে উঠে আসা জনমনের মন্থনে জারিত সংস্কৃতিরই প্রকাশ। সংস্কৃতি শুধু বইয়ের পাতাতেই আটকে থাকে না, অর্থাৎ, বই পড়েই কেবল সংস্কৃতিমনস্ক হয় না কেউ। তা হল জীবনযাপনের অঙ্গ। 

‘সংস্কৃতি’- যার অর্থ হল নতুন চিন্তার দ্বারা পুরনোর উৎকর্ষ সাধন বা সংস্কার করা অথবা একেবারে আনকোরা চিন্তাকেই জনসমক্ষে উদঘাটন করে মানবসমাজকে প্রগতির পথে ঠেলা দেওয়া। দুনিয়ার প্রত্যেকটি মানুষ একই বিষয়কে ভিন্নভাবে অথবা এক বা একাধিন নতুন বিষয়কেই সমাজের সামনে উন্মুক্ত করতে সক্ষম। এর ফলেই চিন্তাজগতে জগতের চিন্তার ভ্যারিয়েসনে গড়ে ওঠে জনসংস্কৃতি (এ-প্রসঙ্গে কলিম খানের ‘জ্ঞানের জগৎ ও জগতের জ্ঞান’ বিশেষ নজরটান)। তাহলে কেন বইপড়া ও শিল্প-করা লোকজনই কেবল সমাজের ‘বিশিষ্ট’ গোত্রভুক্ত হন, বাকিরা হন না?

আসলে চিন্তার ভ্যারিয়েসন শাসকের রাষ্ট্র শাসনের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। জনসমাজ যদি দু-একটি চিন্তার দ্বারা মোহিত হয়ে অভিন্নতার সূত্রে গ্রথিত হয় তবেই তাকে সুনিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আর তাই দুনিয়াতে ধর্মগ্রন্থের প্রণয়ন হয়েছিল। যারা সেখানে অন্য-অন্য ধর্মের কথা বলেছিল সেখানে শুরু হয়েছিল বিবাদ। আজও তা নিরবচ্ছিন্নভাবে চলছে। তবে তাতে চিন্তাস্রোত থেমে থাকেনি। ধর্ম ও তার বাইরেও নানা ভাবে নানা দেশে চিন্তার আত্মপ্রকাশ হয়েছিল। এইভাবেই মোটামুটি চলেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল অবধি। কিন্তু তারপরে দেখা গিয়েছিল এক অন্য সুর। চিন্তাকে বাঁধার অভিনব সব পন্থা। কেন না, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মানুষকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, গণতন্ত্রের যুগে প্রযুক্তিই হল এমন এক বিষয় যার দ্বারা চিন্তাকেও নির্দিষ্ট অভিমুখে নিয়ন্ত্রণ করে বিশ্বে একাধিপত্য কায়েম রাখা যায়। তাই শাসক প্রথমেই সমগ্র বিশ্বের মানুষকে কয়েকটি চিন্তার মধ্যেই আবদ্ধ রাখার ছক কষেছিল। বইয়ের ক্ষেত্রে যেমন গতানুগতিকতাকে প্রাধান্য দিয়েছিল, তেমনই নাচ-গান-সিনেমা-ছবি সর্বত্র একীকরণ (sameness) করার চেষ্টা শুরু করেছিল। 

কথায় বলে, 'স্বদেশে পূজ্যতে রাজা, বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে'। কিন্তু বিনয় ঘোষ স্পষ্টতই এর মধ্যকার মূল ত্রুটিটি দেখিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, 'ইতিহাসে দেখা যায়, স্বদেশে পূজিত হন রাজা এবং বিদ্বান প্রথমে রাজার পূজা করে পরে দেশপূজ্য হন।' সত্যিই তো সাধারণের কি সে-ক্ষমতা আছে যে সে নিজে থেকে কাউকে পূজাযোগ্য মনে করতে পারে? একেবারেই না। আবার রাজাও কি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, কাকে সম্মানিত করা হবে আর কাকে হবে না? পারেন না। আর তাইই রাজা নিজের স্বার্থরক্ষাকারী ও স্বার্থহানিকর নয় এমন পণ্ডিত সমাজকে পুষে থাকেন। সেই পণ্ডিত সমাজই বলে দেয় কোন চিন্তা সমাজের গ্রহণ করা উচিত আর কোনটা নয়। সেটাকেই রাজা ঢেঁড়া পিটিয়ে বিজ্ঞাপনের দ্বারা শ্রেষ্ঠ চিন্তা, শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ বলে বারেবারে প্রচার করেন। পুরস্কৃত করেন। আর বাকিগুলিকে চেপে দেওয়া হয়। এইভাবেই সমাজে প্রথমে বই পড়া লোকজনকে ‘এলিট’ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে উঁচুতে স্থান দিয়ে বাকি অংশকে নিয়ন্ত্রণের অঙ্ক কষা হয়। বলা হতে থাকে, এঁরাই সবচেয়ে বেশি বোঝেন, এঁদের কথাকে শিরোধার্য করাই সকলের কর্তব্য।

লক্ষ করবেন, ‘চেপে দেওয়া হয়’ বলেছি, এ-কথা বলিনি যে প্রকাশই করতে দেওয়া হয় না। ‘চেপে দেওয়া’ অর্থাৎ বিকল্প চিন্তার বিপ্রতীপে শাসকের পক্ষে যা মঙ্গলময় কেবল তারই ডঙ্কা সজোরে বাজানো ও বাজাতেই থাকা। একই প্রকারের সংস্কৃতির দ্বারা জনমনকে আচ্ছন্ন রাখা– সত্যজিৎ রায় যাকে ‘মগজধোলাই’ বলে দেখিয়েছিলেন। এ-প্রসঙ্গে দুজনের নাম মনে পড়ছে– একজন থিওডোর আডোর্নো ও অন্যজন ম্যাক্স হোরখেইমার। তাঁদের বিখ্যাত বই ‘ডায়ালেকটিক অফ এনলাইটেনমেন্ট’-এর তিন নম্বর অধ্যায় যার শিরোনাম– ‘দ্য কালচার ইন্ডাস্ট্রি: এনলাইটেনমেন্ট অ্যাজ মাস ডিসেপশন’। সেখানে তাঁরা বিস্তারিত ভাবেই ‘ফোক কালচার’কে খাটো ও গুরুত্বহীন করে রেখে ‘মাস কালচার’এর উৎপাদন ও ‘পপুলার কালচার’এর ব্যাপ্তির সমীকরণগুলিকে ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন, কীভাবে ধনতান্ত্রিক সমাজ নিজেদের প্রভুত্ব বজায় রাখতে মিডিয়াকে (টিভি, রেডিও ও নিউজপেপার-ম্যাগাজিন) ব্যবহার করে ‘এনটারটেইনমেন্ট’-এর নাম করে জনমস্তিষ্কে অভিন্ন রুচির ধারণাটিকে প্রোথিত করেছে। যারা এর বাইরে থেকেছে, হয় তাদের পাত্তা দেয়নি অথবা বলেছে প্রতিক্রিয়াশীল কিংবা সন্ত্রাসবাদী। মনে রাখা দরকার যে, বই (কিংবা ছবি-নাচ-নাটক-সিনেমা) যদি কেবলই জ্ঞানচক্ষু উন্মীলনের নিমিত্তে নির্মিত হত তাহলে সময়ে-সময়ে সেখানে শাসকদের তরফে ‘ব্যান’ লাগু হত না। সামান্য বই থেকে শাসকের কীসের ভয়? আসলে বই শুধুমাত্র সাদা পাতায় লেখা কালো অক্ষরমালা নয়– তা চিন্তার অস্ত্রও বটে। শাসক সেই অস্ত্রকেই নিজের পক্ষে ব্যবহার করতে চায়– পাঠক্রম তৈরি করেই হোক অথবা নিজের বিপদের আশঙ্কাহীন সৃষ্টি-কৃষ্টির পৃষ্ঠপোষকতা করেই হোক যাতে ‘ব্যান’ করে জনগণের চক্ষুশূল হওয়াও আটকানো যায়। 

বাংলার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছিল। ভারতের স্বাধীনতা ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যেহেতু প্রায় একই দশকের ঘটনা তাই এর প্রভাব এখানেও এসে লেগেছিল। এখানেও বাহুবলের পাশাপাশি রাষ্ট্রের অন্যতম আয়ুধ হয়েছিল বই। পশ্চিমি ধাঁচে এ-দেশেও সৃষ্টি করা হয়েছিল আকাডেমিক স্কলাস্টিসিজমকে। এই আকাডেমিক স্কলাস্টিসিজমকেই ধীরে-ধীরে ইন্টেলেকচুয়ালিটি বলে প্রচার করে বাংলার চিন্তাশক্তিকে অভিন্ন ধারায় ধাবিত করার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। অথচ বিনয় ঘোষ স্পষ্টাস্পষ্টি দেখিয়েছেন যে, জ্ঞানতপস্বীরা (স্কলার) বিদ্বৎজন (ইন্টেলেকচুয়াল) হতেও পারেন আবার নাও হতে পারেন। তিনি ‘বাংলার বিদ্বৎসমাজ’ বইতে লিখেছেন, 'অধীত ও অর্জিত বিদ্যা নিয়ে ‘স্কলার’ হওয়া যায়, ‘ইন্টেলেকচ্যুয়াল’ হওয়া যায় না। পুরোহিতের গুণ থাকা চাই, পুরোহিতের কর্তব্য করা চাই, তবে বিদ্বৎজন হওয়া সম্ভব।' এই পুরোহিতের কাজ কী? তা হল, সাধারণ মানুষের মন ও মননকে নিয়ে কাজ করে সমাজের চিন্তাকে প্রগতির পথে প্রভাবিত করা। উল্লিখিত এই 'চিন্তার উদ্রেক হয় প্রত্যক্ষ জীবনসংগ্রাম থেকে।' জীবনসংগ্রাম কেবল জীবিকা-সংগ্রাম নয়, এ কথা মনে রাখা দরকার। জীবন ও সমাজের ঘাত-প্রতিঘাতে চিন্তাতরঙ্গের সৃষ্টি হয়। ম্যানহাইম বলেছেন, ‘স্কলাস্টিক’ চিন্তা এরকম কোনও জীবন সমস্যার প্রত্যক্ষ ঘাত-প্রতিঘাত থেকে সৃষ্টি হয় না। সমাজ-জীবন থেকে সে-চিন্তা ক্রমে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, এমনকি প্রাকৃতিক জীবন থেকেও।'

এতদিন পরে যেন বিনয়বাবুর কথার প্রভাব একুশ শতকের বাংলায় দেখা যাচ্ছে। এই নতুন যুগে আগের পন্থায় মানুষের ওপরে আর নিয়ন্ত্রণ রাখা যাচ্ছে না। দড়ি আলগা হচ্ছে। স্কলার বা বিশিষ্টদের সঙ্গে সাধারণজনের ক্রমশ বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে। এতদিন ধরে কিছু আকাডেমিক স্কলারকে শাসকশ্রেণি মাথায় তুলে নেচেছিল ও প্রাকৃতজনকে সেই ছাঁচে ফেলে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করেছিল। চিন্তাশীলতার মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছিল। যার প্রমাণ বইমেলার সর্বত্র একই ধারার পুরনো চিন্তার (সেই উনিশ শতক, দেশভাগ, দাঙ্গা, নকশালবাড়ি, গ্রামশি, আলথুসার ইত্যাদি) বিপুল বই প্রকাশের মধ্যে দেখা যায়। কিন্তু ইন্টারনেটের যুগে এইখানে একটি বিপত্তি দেখা দিয়েছে। তথাকথিত বইপড়া ‘এলিট’-দের আর কোনও প্রভাবই সমাজে দেখা যাচ্ছে না। আকাডেমিক কচকচি ভরা বই বিক্রি কমছে। ফলে তাঁদের বাজার দরেও পড়তি। 

রাজনেতৃবর্গও ভোটের প্রচারে এঁদের না ডেকে ভুবন বাদ্যকরদের ডাকছেন। ফলে, এতদিনের ক্ষমতাভোগ করা এইসব ‘এলিট’রা এখন সেই পুরনো মাঠটিকে যেন আরও জোরে মুষ্ঠিগত করতে চাইছেন যাতে সমাজের উঁচুতে থেকে যাওয়া যায়। কিন্তু সমাজ বালির মতোই পিছলে যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে যে, অনেক সঙ্গীতশিল্পী সঙ্গীতজীবনের প্রথমভাগেই নতুন গান রচনার চেয়ে বই লেখাতে মন দিয়েছেন। কবিতা পড়ছেন, ফেসবুকে মাছরান্নার ছবি দিচ্ছেন। চলচ্চিত্রকারেরা বইমেলায় জনসংযোগের উদ্দেশ্যে এলোমেলো ঘুরছেন। বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই উন্নাসিকতা ও অবোধ্য পুরাতনী ভাষা ছেড়ে আমজনতার ভাষায় ফিরছেন। হাফ-দরজা খোলা পণ্ডিত ও নাট্য গবেষকরা পপুলার রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনাসভাতেও যেতে আর বিশেষ আপত্তি দেখাচ্ছেন না। আসলে সকলেই আবার যেনতেন প্রকারেণ নিজেদের কল্কে ফিরে পেতে চাইছেন। আজ ইন্টারনেটের সৌজন্যে যে-সব সাধারণজনেরা নিজেদের ভাষ্যে উঠে আসছেন, এরা আর সেগুলিকে ‘লো কালচার’ বলে দাগিয়ে দিয়ে নিজেদের কূল রক্ষা করতে পারছেন না। বং-গাই আকাশ ব্যানার্জী, ধ্রুব রাঠি অথবা কুণাল কাম্রা'রা গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে ও আনকোরা ‘কন্টেন্ট’কে সম্বল করে উঠে আসছেন। এখানে তথাকথিত বইপত্তর পড়ে ‘এলিট’ হওয়ার ধারণা প্রায় মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। সমাজে আবারও চিন্তাই মূল নিয়ন্ত্রক হয়ে দেখা দিয়েছে। কিছু ক্যাঅস হচ্ছে ঠিকই কিন্তু ভ্যারিয়েসন বাড়লে তো সেটাই হবার কথা, তাই না! প্রাদেশিক ভাষা ও গাঁ-গঞ্জের সংস্কৃতিও আমাজনের মতো নানা প্ল্যাটফর্মে জায়গা করে নিচ্ছে।

এখন আধুনিক, যুগোপযোগী ও নতুন চিন্তার দাপট ক্রমশ বাড়ছে। ‘ট্রেন্ড’ রোজ বদলে যাচ্ছে। এখানে বই যে মানুষকে পড়তেই হবে এমনটা আর নয়। বই না পড়েই তো মানুষ কৃষিকাজ শিখেছিল, চাকা আবিষ্কার করেছিল, গান গেয়েছিল, ছবি এঁকেছিল। বই- বাংলায় যা মাত্র উনিশ শতকের একটি ফেনোমেনন মাত্র- তার আগেও যেমন চিন্তা ছিল, এখনও আছে। মুক্তচিন্তা ও বাস্তবের মাটিকে ভিত্তি করে যা আগামীর দুনিয়াদারিতে মানুষকে লড়াই করার শক্তি ও পুষ্টি দেবে সেটাই হবে গণসংস্কৃতি। বই পড়ে আগেও বিপ্লব হয়নি, হবেও না। মানুষের কাছে যে-কোনও মাধ্যমেই যদি নতুন চিন্তার স্রোতকে পৌঁছে দেওয়া যায় ও মানুষ তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আগামীকে নির্মাণ করতে সক্ষমতা অর্জন করে তবে সেটাই হবে বিপ্লবের পরাকাষ্ঠা। 

পুরাতনী চিন্তার বইপড়া লোকজন এই নতুন দুনিয়ায় ব্রাত্য। নতুন চিন্তাই শাসন করবে আগামীকে, ফ্যাতাড়ুর বুদ্ধিমত্তাই হবে শাসনের মানদণ্ড। মনে হচ্ছে, বইয়ের বাইরে এসেই আগামী দিন যেন প্রকৃত শ্রেণিহীন সমাজ গঠনের তাল ঠুকছে। বইয়ের কাঁটাতার ভেঙে পড়ছে।


Friday, 25 March 2022

বখরার রাজনীতির অবসান হোক

এ রাজ্যে ভ্রাতৃঘাতী হিংসা কবে বন্ধ হবে?

অশোকেন্দু সেনগুপ্ত

 

আমরা একদা ছোট আঙারিয়া থেকে নেতাই কাণ্ডে বামফ্রন্ট সরকারের আচরণে বেজায় ক্ষুব্ধ হয়েছি।  তখন সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম নিয়ে আন্দোলন তুঙ্গে। আমরা যারা পথে ছিলাম, তারা সকলে তৎকালীন সরকারের পতন বা অপসারণ চেয়েছিলাম। আর এবার দেখছি রামপুরহাটের নৃশংস গণহত্যা। দেখছি টিভিতে, খবর পাচ্ছি সংবাদমাধ্যমে। তখন এসব ছিল না তেমন। এবার ঐ সংবাদমাধ্যমগুলোই জানাচ্ছে রাজনৈতিক নেতাদের ব্যাখ্যা-টীকা। আমরা তা গ্রহণে প্রস্তুত কী? মানুষকে হত্যা করা হয়েছে সে কি কোনও রাজনৈতিক ক্রিয়া বা প্রতিক্রিয়ায়?

কেউ বলছেন, চাই বিচারবিভাগীয় তদন্ত, কেউ বলছেন রাষ্ট্রপতির শাসন লাগু হোক, কেউ চাইছেন সিবিআই তদন্ত। খবরে প্রকাশ, মহামান্য কলকাতা হাইকোর্ট ইতিমধ্যেই সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। রাজ্য সরকার সিট গঠন করেছে। আই সি/ এসডিপিও'কে সাসপেন্ড করা ও সরানো হয়েছে। অনেকটা দেরিতে হলেও, তৃণমূলের ব্লক সভাপতি আনারুলকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত মোট ২২ জন গ্রেফতার হয়েছে। যথেষ্ট হল কী? সরকারের ভূমিকায় অধিকাংশ মানুষ কিন্তু সন্তুষ্ট নন।

কেন বলছি অধিকাংশ? তা বুঝতে কিছু প্রশ্ন রাখি সামনে। কেন প্রতিবাদ ধ্বনিত হচ্ছে না দলীয় কর্মীদের কণ্ঠে? মূল নায়ক বলে মুখ্যমন্ত্রী যাকে চিহ্নিত করেছেন সেই আনারুলকে গ্রেফতার করতে যারা বাধা দিয়েছে, তারা কারা? আনারুলদের মতো লোকেদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ দল। কেন? কারা এমন চক্রান্ত করতে পারে? বারে বারে পুলিস ব্যর্থ, তবু কেন পুলিশমন্ত্রী সেই বাহিনীতেই (যারা মৃতের সঠিক সংখ্যাও বলতে পারে না) আস্থা রাখছেন?

এ কথা তো অনস্বীকার্য এবং দিনের আলোর মতো স্পষ্ট যে, পঞ্চায়েত ও পৌরসভাগুলিকে কেন্দ্র করে বিস্তৃত ও গভীর এক দুর্নীতি চক্র এ রাজ্যে প্রবল শক্তিধর হয়েছে। সেই সুত্র ধরেই রামপুরহাটেও বেআইনি বালি ও পাথর উত্তোলনকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন ধরে এক মাফিয়া চক্র শাসক দল ও প্রশাসনের সহযোগিতায় ক্রমেই মহীরূহ হয়ে উঠেছে। তাই, সামান্য ডাক-মাস্টার থেকে ভাদু শেখ রাতারাতি হয়ে ওঠে এলাকার ত্রাস ও ধনপতি; একদা রাজমিস্ত্রী আনারুল মাত্র এক দশকেই প্রাসাদোপম বাড়ি হাঁকিয়ে নিমেষে হয়ে ওঠে এলাকার অর্থ ও ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিপতি। পুলিশ ও প্রশাসন তার হুকুমেই নড়েচড়ে। তার অধীনে থাকা ৯টি পঞ্চায়েত এলাকায় বিরোধীরা ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে কোনও প্রার্থী দাঁড় করানোর সাহস পর্যন্ত পায় না। এসব কি তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের কেউ জানতেনই না? কেউ সে কথা বিশ্বাস করবেন? তাই খুব স্বভাবিক, আঁটুনি যখন বজ্র সম তখন তার ফস্কা গেরোও থাকবে। ভিত্তি যখন লুঠপাট, তখন তার বখরা নিয়ে হাঙ্গামাও হবে, আর তা গণহত্যাতেও গড়াতে পারে। তাইই হয়েছে।

মহিলা ও শিশু-সহ বহু মানুষকে খুন করে তারপর আগুনে ঝলসানো হয়েছে। এই গণহত্যার কোনও নিন্দাই যথেষ্ট নয়। তবু বলি, ৩৫৫/৩৫৬ নয়- চাইছি রাজনীতির ঊর্ধে উঠে এমন হত্যালীলার চিরতরে অবসান। মানতে হয় যে এ আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সমস্যা। সেই সমস্যা মেটাতে বাংলার মানুষকেই এগোতে হবে। রাজ্যপাল মহোদয় কিছু করতে পারবেন না। তিনি নাক গলাচ্ছেন কেন (তিনি কি গোপাল গান্ধী হতে পারেন!)? তবুও মেনে নেওয়া যেত, যদি তিনি আগেও বিজেপি নামের কৃষক হত্যাকারী দলটির পাশে দাঁড়াতে ব্যস্ত না হয়ে উঠতেন। তাঁর নিরপেক্ষতাই যে আজ প্রশ্নচিহ্নের মুখে! 

রাজনীতির ঊর্ধে উঠে কিছু চাওয়ার দিন কি বিদায় নিয়েছে এই বঙ্গ থেকে? আমরা ভুলি কেমনে যে এই বাংলাতেই একদা জন্ম নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, কর্মে বিস্ময়ের ঢেউ তুলেছেন বিদ্যাসাগর- তবে কেন কেবল ধান্দাবাজির রাজনীতিতে ডুব দেব? কেন এ দেশে এত ধরাধরির রাজনীতি? চাকরির লোভে মেধা থেকে প্রাকৃতিক সম্পদ বেচে দেব কেন? জিডিপি বাড়াতে দেশের অগুন্তি মানুষকে কালো ধোঁয়ার বিষে চোবাব কোন অধিকারে? যারা এই ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্ত চাইছেন তারা কি দেখেননি 'হিজাব' ও অন্য নানা মামলায় বিচার বিভাগের ভূমিকা? রাধাবিনোদ পালেদের দিন গিয়াছে, বর্তমানে প্রশাসন ও বিচার বিভাগের বড় এক অংশ সর্বদা সরকারের পাশে থাকাটাই শ্রেয় জ্ঞান করে। আর সরকার?

রাজ্য সরকারের কথা বলি আগে। এই সেদিন রিজওয়ানুর হত্যাকাণ্ডে জ্ঞানবন্তর ভূমিকা দেখেও এই সরকার তার হাতেই তামাক খেতে চায় কেন? এই সেদিনও সরকারের প্রধান একটা ব্যঙ্গচিত্র পর্যন্ত সহ্য করতে পারলেন না! দায় কার? এই রাজ্য সরকারের ওপর ভরসা রাখতে পারি কই? হয়তো এও সত্য যে, এই মুখ্যমন্ত্রীকেই এখনও বাংলার মানুষ সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন। বিকল্পে ভরসা নেই।

ভরসা রাখতে পারি না কেন্দ্রের সরকারের ওপরও। দাভোলকর থেকে স্ট্যান স্বামী- প্রতিটি মৃত্যুর জন্য তাদের দায় মানতেই হয়। গুজরাত দাঙ্গা থেকে লখিমপুর- কোনও ঘটনাতেই তারা দায় অস্বীকার করতে পারে না।

একটাই অনুরোধ, দয়া করে লাশের রাজনীতি করবেন না কেউ। দয়া করে ভুলবেন না, যাদের প্রাণ গেল তারা আমার-আপনার সন্তান।

 

Thursday, 24 March 2022

বগটুই: এ কোন নিকষ অন্ধকার?

‘পুড়ছে পুড়ছে ব্রহ্মাণ্ড পুড়ছে...’

সোমনাথ গুহ


সকালবেলায় সংবাদপত্রে জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাওয়া ঘরবাড়ি দেখে প্রবাদপ্রতিম চিত্র পরিচালকের বিখ্যাত ছবির সেই হাহাকার মনে পড়ে যাচ্ছিল। বগটুই গ্রামের দগ্ধ হয়ে যাওয়া লাশগুলো মধ্যরাতে বিভীষিকা হয়ে নিদ্রায় হানা দেয়। নারী পুরুষের কান্না দিনরাত কানের কাছে একটা ঘ্যানঘ্যানে রিংটোনের মতো বেজে চলে। ভ্যান ভর্তি জিনিসপত্র নিয়ে ভিটেমাটি ছেড়ে মানুষের প্রস্থান দেখে মনে হয় এ যেন এশিয়ার ইউক্রেন- যুদ্ধ বিধ্বস্ত এলাকা থেকে মানুষ পলায়ন করছে। আলুথালু বেশে শোকে বিহ্বল নারীর কাতর অনুযোগ বারবার স্মৃতিতে ফিরে আসে- এ কোন রাজ্যে বাস করছি আমরা? কাকে মানুষ উপুড় করে ভোট দিয়ে তৃতীয় বার মসনদে বসাল? 

সাফল্য তৃণমূল কংগ্রেসের মাথায় চড়ে গেছে। নির্বাচনে ড্যাং ড্যাং করে জিতে যাবার পর তারা এখন হাতির পাঁচ পা দেখছে। তারা যেন বাংলার নবাব আর পুরো রাজ্যটা তাদের জায়গির। বিরোধীদের ঠুসে দিয়ে তারা এখন নিজেদের মধ্যে রক্তের হোলি খেলায় মেতেছে। দলের মধ্যে যার যত জোর তার তত কামাই। মধ্যযুগের মতো বিভিন্ন এলাকা ওয়ারলর্ডদের মধ্যে ভাগ করা- তাদের অধীনে অসংখ্য তোলাবাজ যারা ঐ প্রভুদের নিয়মিত নজরানা দেয়। সম্পদ তো সীমিত, তা নিয়ে কামড়াকামড়ি চলে। উপঢৌকনে ঘাটা পড়লে প্রভু একজনকে হটিয়ে আরেকজনকে তুলে আনে; নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে তাদের পরস্পরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। যে তাদের কথা শুনবে না, বিরোধিতা করবে, তারা খালাস! তারপর বলবে, চোপ সরকার চলছে! পার্টি এর সঙ্গে যুক্ত নয়, ওসব পারিবারিক বিবাদ, আত্মহত্যা, গভীর ষড়যন্ত্র, বাংলার বদনাম করছে! কার্টুনের চরিত্রের মতো নেতারা টিভির সামনে হাজির হয়, মুখ দেখে মনে হয় ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানে না। মানুষকে তারা বোকা ভাবে; ভাবে ভেড়ার দল, যা বোঝাব তাই বুঝবে। যে নেতার নিজের মস্তিষ্কে অক্সিজেন কম, সে বড় নেতার পাশে বুড়ো খোকার মতো মাথা নাড়ায় আর টিভি-বিস্ফোরণের তত্ত্ব দেয়। তারা জানে না মানুষ সব দেখছে, বুঝছে, যখন রাজনৈতিক প্রত্যাঘাত করবে পালিয়ে কুল পাবে না। সে অভিজ্ঞতা এ রাজ্যে কংগ্রেস ও সিপিএমের যথেষ্ট হয়েছে।

ভেবে দেখুন, আনিশ খানের মৃত্যু হয়েছে ১৯ ফেব্রুয়ারি; মাত্র দু' সপ্তাহ বাদে পূর্ব বর্ধমান জেলার বাবুবাগ এলাকার ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে সতের বছরের কিশোরী তুহিনা খাতুনকে দিনের পর দিন সর্বসমক্ষে লাঞ্ছনা ও যৌন হেনস্থা করে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করল ওই এলাকার কাউন্সিলার বশির আহমেদ। তুহিনার কাহিনি কোনও অংশে হাথরসের থেকে কম নৃশংস? তুহিনা তাঁর দুই দিদি ঝর্ণা বিবি ও কুহেলি বিবির সাথে থাকতেন। দিদিদের স্বামীরা কাজের সূত্রে অধিকাংশ সময় বাইরে থাকতেন। তুহিনার মা নেই, বাবা ধনাই শেখ দ্বিতীয় বিবাহ করে খাগরাগড়ে থাকেন; তিনি নিয়মিত মেয়েদের খোঁজখবর রাখেন। ধনাই বশিরের বিরোধী গোষ্ঠীর লোক। বশির পৌর নির্বাচনের টিকিট পাওয়ার পর শুরু হয় ওই তিন বোনের ওপর অত্যাচার। বাড়ির সামনের দেওয়ালে তিন বোনের ছবি আঁকা হয়। ঐ ছবির ওপর বশিরের ছেলেরা হাত বোলায়, চুমু খায়, সোহাগ করে, যৌন ইঙ্গিত করে, কুৎসার বন্যা ছোটায়। বশিরের বিজয় মিছিল থেকে তুহিনাদের বাড়ির সামনে বোমা মারা হয়। লোহার গেট ভেঙে তিন বোনকে চুলের মুটি ধরে ঘর থেকে বার করে আনে। ‘খেলা হবে’র তালে তালে তাঁদের নিগৃহীত করা হয়। তার ঘণ্টা খানেক বাদে তুহিনা গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ে। চোদ্দো জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে, মাত্র পাঁচ জন ধরা পড়েছে। বশির পুলিশের খাতায় ফেরার; অথচ সে কাউন্সিলার হিসাবে শপথ নিয়েছে! সেটাই তো হবে, তার মাথার ওপর তো নাকি মন্ত্রীর হাত রয়েছে! এরপরেও বলা হবে এ রাজ্যে মহিলারা নিরাপদ, ওসব শুধু ইউপিতে হয়! 

অবশ্য কে নিরাপদ এখানে? সদ্য নির্বাচিত কাউন্সিলার যাঁরা জনতার ভোটে সদ্য নির্বাচিত হয়েছেন তাঁরাই নিরাপদ নন! ১৩ মার্চ একই দিনে রাজ্যের দুই এলাকায় দুজনকে গুলি করে হত্যা করা হল। পানিহাটিতে অনুপম দত্তের হত্যা তো হিন্দি সিনেমার চিত্রনাট্য। ভর সন্ধ্যাবেলায় সিসিটিভি দ্বারা সুরক্ষিত এলাকায় আততায়ী সটান হেঁটে এসে স্কুটারের ওপর বসে থাকা এলাকার জনপ্রিয় প্রতিনিধিকে পিছন থেকে গুলি করে হত্যা করে। যতদূর জানা যায়, অনুপম দৃঢ়চেতা মানুষ ছিলেন। অবৈধ কারবার, প্রমোটারি এসব বরদাস্ত করতেন না। কিন্তু দলটাতে তো এখন এইসব লোকেরই রমরমা। যত বেআইনি কাজে সঙ্গত দেবে তত তোমার পিছনে লোক বাড়বে, পার্টি মুখে হরির নাম গাইবে কিন্তু তলায় তলায় তোমাকেই মদত দেবে। অনুপমরা লাশ হয়ে যাবে, নেতারা নাকিকান্না গাইবে। 

অনুপম দত্তের মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে ঝালদা পৌরসভার দু' নম্বর ওয়ার্ডের বিজয়ী কাউন্সিলর কংগ্রেসের তপন কান্দুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। অভিযোগ, কংগ্রেসের এই নির্বাচিত প্রতিনিধিকে ক্রমাগত চাপ দেওয়া হচ্ছিল তৃণমূলে জয়েন করার জন্য। এই ব্যাপারে স্থানীয় থানার আইসি'র বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ, তিনি নাকি তপনবাবুকে লাগাতার চাপ দিয়েছেন দল বদলানোর জন্য। এই আইসির বিরুদ্ধে এখনও কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। নেতাদের তোতাপাখির বুলি: এটা পারিবারিক বিবাদ। 

তারপর রামপুরহাটের এই ভয়ানক ঘটনা। কজন মারা গেছেন? সরকার বলছে আট, অন্য সূত্রে দশ। তাহলে দাঁড়াল, দু' মাসের মধ্যে পাঁচটি ভয়ঙ্কর ঘটনা, প্রতিটি রাজনৈতিক। আর বলা হচ্ছে, গত দু' সপ্তাহে ১৬ জন খুন হয়েছেন রাজ্যে, যার মধ্যে ১২-১৩টি রাজনৈতিক খুন। সরকারের ধরাবাঁধা প্রতিক্রিয়া হচ্ছে: 

        (১) সিট গঠন করো এবং সেটা এমন একজন কুখ্যাত অফিসারের নেতৃত্বে যিনি রিজওয়ানুর কাণ্ডে অন্যতম মূল অভিযুক্ত ছিলেন;

        (২) কিছু পুলিশ কর্মীকে, মূলত নিচু তোলার, ক্লোজড করো;

        (৩) ওসি, আইসি'কে ছুটিতে পাঠিয়ে দাও, স্থানান্তরিত করো আর না হয় তাঁদের উড়ে বেড়াতে দাও;

        (৪) সিবিআই'এর দাবির প্রবল ভাবে বিরোধিত করো;

        (৫) ষড়যন্ত্র, পারিবারিক বিবাদ ইত্যাদি বলে প্রথম থেকেই তদন্তকে প্রভাবিত করো, ভুল পথে পরিচালিত করো। 

এই জমানায় পুলিশ কর্তারা ক্যারিকেচার মাত্র, সব ‘হার মিস্ট্রেস ভয়েস’। এঁদের দেখে করুণা হয়! দুঁদে সব আইপিএস, কত পরিশ্রম করে সেই জায়গায় গেছেন, এখন প্রতি মুহুর্তে শেখানো বুলি আউড়ে ঢোক গিলতে হয়। এঁরা করবেন ঘটনার তদন্ত! সিট তো একটা জোক! রাতের অন্ধকারে আনিশের লাশ আনতে গিয়েছিল, তাঁদের পরিবারকে কোনও খবর না দিয়ে। নেহাৎ পাড়ার লোক সজাগ ছিলেন বলে আটকে দিয়েছেন। কী উদ্দেশ্যে গিয়েছিল তারা? কোনও উত্তর নেই। এক মাসের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেওয়ার কথা। ফরেনসিক রিপোর্ট জমা দেওয়ার কথা। কোথায় কী? সব ঢুঁ ঢুঁ! আদালত আরও এক মাস সময় দিয়েছে। কিন্তু কোনও আশা আছে কি? প্রতিনিয়ত যে হারে খুনখারাপি হচ্ছে, তাতে আনিশ হারিয়ে যাবেন। বিচার পাবেন না। এক বলিষ্ঠ, প্রতিবাদী যুবক দালালদের কাছে মাথা নোয়ালেন না, তাঁর জানটা চলে গেল। কোনও প্রতিকার নেই। বিরোধী দলগুলোও ঠুঁটো জগন্নাথ। 

তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর তৃণমূলের স্বৈরাচারী রূপ নগ্ন হয়ে গেছে। দলের বাইরে বিরোধীরা যত হীনবল হবে, দলের মধ্যে বখরা নিয়ে তত খুনোখুনি হবে। এ যেন অমোঘ নিয়তি! যত দিন যাচ্ছে, বিজেপির সাথে এই দলটার পার্থক্য ক্ষীণ হয়ে আসছে। এখন তারা একইরকম ভাবে অসহিষ্ণু, কোনও রকম প্রতিবাদকে বরদাস্ত করে না। বাংলার মানুষের ভোগান্তি আছে। আইনশৃঙ্খলার আরও অবনতি হবে। পরের বছরের পঞ্চায়েত নির্বাচনের কথা ভাবলে শিউড়ে উঠতে হয়। রক্তগঙ্গা বইবে বাংলায়?

পুনশ্চ: খুনখারাপি জারি আছে। এরই মধ্যে (বুধবার রাতে) নদীয়ার হাঁসখালিতে তৃণমূল নেতা সহদেব মণ্ডলকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তিনি হাসপাতালে ভর্তি। তাঁর স্ত্রী পঞ্চায়েত সদস্যা। যে হারে চলছে, দলটা ঝাড়ে বংশে উজাড় না হয়ে যায়। ওদিকে আজ বৃহস্পতিবার সকাল এগারোটায় তৃণমূলের এক প্রতিনিধি দল অমিত শাহ'র সাথে দেখা করছে। 

হচ্ছেটা কী? কোনও নতুন সমীকরণ?


Wednesday, 23 March 2022

সুনন্দ সান্যাল

এক অবিচল প্রতিস্পর্ধী স্বর

অশোকেন্দু সেনগুপ্ত

 

মন ভালো নেই। চলে গেলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সমাজকর্মী অধ্যাপক সুনন্দ সান্যাল। 

সামান্য এই কয়েকটি শব্দ দিয়ে আমার মানসিক দুরবস্থা বোঝাবো এমন শব্দশিল্পী আমি নই। আরও কিছু কথা বলতেই হয়। বলতেই হয়, প্রাথমিক শিক্ষা  নিয়ে সুনন্দবাবুর সঙ্গে মতান্তরের কথা। 'আজকাল' পত্রিকায় সে বিতর্কে আমার মতো অনেকেই অংশ নিয়েছিলেন। তাঁদেরই অন্যতম সুনন্দবাবু। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, বাঙালি ছেলেমেয়েরা যে চাকরি ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে তার প্রধান কারণ  ইংরেজি না-শেখা। এমন বিশ্বাস আমার ছিল না। বিরুদ্ধে আছি জেনেও, বা মতান্তর থাকা সত্ত্বেও, কদাচ মনান্তরের সুযোগ দেননি তিনি।
 

কেবল কি সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম ও জঙ্গলমহল আন্দোলনে বারবার গিয়েছি একসঙ্গে? গিয়েছি আরও অনেক জায়গায়। হেঁটেছি একসাথে বহু পথ।  কাকলি ঘোষদস্তিদার বা কবীর সুমনের নির্বাচনী প্রচার, ভূমিরক্ষা কমিটির সভা, টিভির টক শো- কোথায় যাইনি; কত জনসভা,পথসভা, কত মিছিল করেছি। সিঙ্গুরে এক জনসভায় অনেক সময় নিয়ে বললেন তিনি, সম্ভবত তা পছন্দ হয়নি মাননীয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। মমতা ছিলেন সে সভার মূল আকর্ষণ। 
 

তিনি যে ভালো বক্তা ছিলেন এমন নয়। তবু মানতেই হবে যে মানুষ তাঁর কথা শুনতে আগ্রহী ছিlলেন।
নতুন সরকারের আমলে একই কমিটিতে কাজ করার সুযোগ এসেছে। তাঁর নেতৃত্বে ২০১১'এ গঠিত হয় রাজ্যে উচ্চশিক্ষা প্রসারে এক্সপার্ট কমিটি। তার আগেই বিধাননগর পুরসভায় আমরা দুজনেই পরামর্শদাতার ভূমিকায়; সে কমিটির প্রধান ছিলেন দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। পুরসভার পক্ষ থেকে চেষ্টা হল 'পুরশ্রী'র মতো একটি পত্রিকা প্রকাশ ও একটি লাইব্রেরি গঠনের। পত্রিকা প্রকাশের দায়িত্ব নিলেন সুনন্দবাবু। পুরসভার বিরোধী দলনেত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের কাউন্সিলরদের অপদার্থতা ও অযোগ্যতার কারণে তা আর তেমন এগোল না।

 
তিনি যেমন 'গণ পরিষদ' গঠন করেন, তেমন আমাদের 'ফ্রেন্ডস অফ ডেমোক্রেসি' গঠনেও অভী দত্ত মজুমদার বা দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতোই সক্রিয় হয়েছেন। একদা ছাত্র পড়িয়েছেন, লিখেছেনও অনেক। শিক্ষা আন্দোলন, সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম ও জঙ্গলমহল আন্দোলনে বারবার ছুঁটে গিয়েছেন। তাঁর লেখায় জেগে ওঠে পাঠকের প্রতিবাদ ও 'দৈনিক স্টেটসম্যান' (মানস ঘোষের সম্পাদনায়)।

স্ত্রী বিয়োগ ও চিকনগুনিয়ায় আক্রান্ত হবার পর তিনি গণ আন্দোলন থেকে সরে যান বলা বোধহয় ঠিক নয়। সেই অসময়ে বুদ্ধিজীবী মঞ্চের দায়িত্ব নিলেন সুনন্দবাবু। বর্তমান এই সরকার তাঁর সঙ্গে যে আচরণ করে তাতেও কষ্ট পেয়েছেন নিশ্চয়। 
 
এই মানুষটি, যিনি কদাচ কোনও লোভে পা দেননি, যে কোনও অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ জানাতে কুন্ঠিত হননি, তাঁকে ভোলা যায় না, যাবে না। 


Sunday, 20 March 2022

অর্থনীতির ভোলবদল

বেকারত্ব কি সত্যি বাড়ছে 
নাকি কর্মজীবীর আয় কমছে!

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

বহু বিজ্ঞ ও পণ্ডিতজনদের দেখছি, তাঁরা বড় ব্যাকুল হয়ে আতসকাঁচের নিচে নানাবিধ তথ্য সমবেত করে ভারতীয় অর্থনীতির নানারকম অবস্থা (ভাল বা মন্দ) বর্ণনা করে চলেছেন। তাঁদের বলা ও বিশ্লেষণে বাস্তবতার ছবিটি বেশ ভালরকমের অধরা। আসলে এইসব প্রাপ্ত তথ্যগুলিকে কেন্দ্র করে যে এক বহুবিধ সম্ভাবনা ও মাত্রা নির্মিত হয়ে চলেছে, সংক্ষেপে, রাজনৈতিক-অর্থনীতির এক নবজন্ম সূচিত হচ্ছে, সে দিকে বিশেষ কারও দৃকপাত নেই। যেমন ধরা যাক, সদ্য প্রকাশিত CMIE-এর তথ্যে প্রকাশ, ভারতে ফেব্রুয়ারি ২০২২’এ বেকারত্বের হার ৮.১ শতাংশ। গত জুন ২০২১’এ এই হার ছিল ৯.১৭ শতাংশ, যা প্রতি মাসে ওঠানামা করতে করতে গত ফেব্রুয়ারি মাসে এসে ৮.১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বেকারত্বের এই হার দেখে সরকার-বিরোধীরা রে রে করে উঠছেন, ধ্বস্ত অর্থনীতি! আর সরকারপন্থীরা বলছেন, আমরা ক্রমেই ভালোর দিকে যাচ্ছি। স্বীকার করে নেওয়া ভাল, আজ অর্থনীতির (ডিজিটাল নির্ভর গিগ অর্থনীতি) এমন হাজারও গতিমুখ তৈরি হয়েছে যে, কোনও এক মুহূর্তে সামগ্রিক ভাবে ভাল-মন্দের নিদান দেওয়া একেবারেই অসম্ভব। দেখা যাবে, অর্থনীতির কোনও একটা ক্ষেত্র যখন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তখন অন্য একটি গতিমুখে সমৃদ্ধি পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাহলে যে ক্ষেত্রগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সেখানে কর্মরত মানুষজনের অবস্থার বিচার আমরা কীভাবে করব? এখানেই এসে পড়ছে আধুনিক ভূষণে জনকল্যাণের রাজনীতি যা সামগ্রিক ভাবে বিপর্যস্ত মানুষজনকে অর্থনৈতিক ভাবে কিছুটা ঠেকা দিয়ে রাখতে সমর্থ বলে সাব্যস্ত হচ্ছে! বলাই বাহুল্য, এ দেশে সেই অনুশীলনের প্রাবল্য এখন উর্ধ্বমুখি।

আরেকটু গভীরে যাওয়া যাক। CMIE-এরই আরও একটি বিস্তৃত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশে সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর ২০২১’এ পুরুষদের মধ্যে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে বেকারত্বের হার সব থেকে বেশি: ৬৯.৭৫ শতাংশ। ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে এই হার ৪২.১৪ শতাংশ। এরপর দেখা যাচ্ছে, ২৪-উর্ধ্ব বয়সীদের মধ্যে বেকারত্বের হার ক্রমেই কমে আসছে। ৪০ থেকে ৪৪ বছর বয়সীদের মধ্যে বেকারত্বের হার সব থেকে কম: ০.১৬ শতাংশ। অর্থাৎ, পুরুষদের মধ্যে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কোনও না কোনও কাজে তাদের এক বড় অংশ নিয়োজিত হয়ে পড়ছে, যদিচ, অত্যাল্প মজুরি ও অনিশ্চিত যাপনের ষোলআনাই সেখানে বিদ্যমান। এই হল আজকের গিগ অর্থনীতির উদার ক্ষেত্র যেখানে অফুরান কাজ কিন্তু চাকরির সুরক্ষা নেই। চাইলেই কোথাও না কোথাও একটা কাজ জুটে যাবে বটে কিন্তু সেখানে কতদিন অথবা কত মজুরির বিনিময়েই বা, এই প্রশ্নগুলি অতীব বাস্তব। উল্লেখ্য, এই তথ্যরাশিতে বয়স অনুসারে দু’ ধরনের বেকারদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে: এক) যারা কর্মহীন এবং কাজ খুঁজছেন; দুই) যারা কর্মহীন ও কাজ করতে ইচ্ছুক কিন্তু কাজের সন্ধান করছেন না। অল্প বয়সের কারণে অনেক পরিবারেই পুরুষদের লেখাপড়া ও ‘ভাল চাকরি’ জোগাড়ের ওপর জোর দেওয়া হয়, যে কারণে, কাজ করতে ইচ্ছুক হলেও উপযুক্ত যোগ্যতা ব্যতীত অনেকেই তেমন ভাবে কাজের সন্ধান করে না।

মহিলা বেকারত্বের ছবিটিও তদুরূপ তবে খানিক ভিন্নধর্মী। বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য, ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের মধ্যেই বেকারত্বের হার সব থেকে বেশি: ৯৪.৮৬ শতাংশ। আর কর্মহীনতার হার সব থেকে কম ৬০ থেকে ৬৪ বছর বয়সী মহিলাদের মধ্যে: ১.১২ শতাংশ। এ প্রসঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে, উপরে উল্লিখিত দু’ ধরনের কর্মহীনদের মধ্যে ‘কর্মহীন ও কাজ করতে ইচ্ছুক কিন্তু কাজের সন্ধান করছেন না’ এমনতর জনসংখ্যা মহিলাদের মধ্যে বিপুল ভাবে বেশি। শুধু বেশি বললে কথাটা ফুরচ্ছে না, বাস্তবতা হল, মহিলারা ‘যারা কর্মহীন এবং কাজ খুঁজছেন’ তাঁদের থেকে ‘কাজের সন্ধান করছেন না’ মহিলারা সংখ্যায় বহু গুন বেশি। আমাদের দেশে মহিলাদের ঘরের বাইরে কর্মে নিয়োগের ব্যাপারে সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধ এখনও প্রবল ভাবে বিদ্যমান।

মোদ্দা কথায়, কোভিড পরিস্থিতি ও লকডাউনের বিপন্ন সময় এবং তার অনুসারী অর্থনীতিগত বিপর্যয়ের কথা বাদ দিলে, সাধারণ ভাবে, বেকারত্বের সমস্যা আজ আর তেমন মারাত্মক কোনও সমস্যা নয় (এই কথাটি শুনলে অবশ্য অনেক বড় পণ্ডিতই আমার দিকে রে রে করে তেড়ে আসবেন)। এর কারণ, পরিবর্তিত রাজনৈতিক-অর্থনীতি এবং গিগ অর্থনীতির উদয়, যেখানে প্রভূত কাজের সুযোগ বিদ্যমান; যদিও প্রখর বাস্তবতা হল, সেই সব কাজে প্রাপ্ত মজুরি বা সামাজিক সুরক্ষা যথেষ্ট নিম্নমানের এবং কাজের নির্ঘন্টেরও কোনও মা-বাপ নেই। এই প্রেক্ষাপটেই তাই, আমরা ‘গ্রেট রেজিগনেশন’এর মতো প্রবণতাকে কখনও কখনও যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠতে দেখছি যখন দলে দলে কর্মরত মানুষেরা তাদের নিজ নিজ কাজের দফতরে ইস্তফা দিয়ে বেরিয়ে আসছেন। তাদের কেউ কেউ হয় নতুন কাজে যোগ দিচ্ছেন যেখানে মজুরির হার অপেক্ষাকৃত ভাল অথবা নিজেরাই ছোট ছোট উদ্যোগপতি হয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন। বলার কথা এই, এমনতর এক রাজনৈতিক-অর্থনীতিগত পরিস্থিতির আজ উদয় হয়েছে যেখানে কাজ পাওয়া ও হারানোর সম্ভাব্যতা দুইই বেশ প্রকট। সাবেক অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিবিদরা এই নবতর প্রবণতা ও বাঁকগুলিকে বুঝেই উঠতে পারছেন না। তাই, বরাবরের মতো গতানুগতিক কিছু বিশ্লেষণে নিজেদের আবদ্ধ রেখে দায় সারছেন।

অল্প কথায়, সবটা মিলিয়ে আমাদের দেশে ও অন্যত্র এমন এক রাজনৈতিক-অর্থনীতির বাতাবরণ তৈরি হয়ে চলেছে যেখানে গিগ অর্থনীতি ভিত্তিক বহু কাজের সুযোগ ও প্রাপ্তি অনায়াস হয়ে উঠছে কিন্তু আয়ের মান মোটেই আশাপ্রদ নয়। সে কারণে, নিরলস পরিশ্রম করে যে অর্থপ্রাপ্তি একজন শ্রমিক বা কর্মচারীর জুটছে, তাতে তাঁর দিনযাপন মোটে ভাল হচ্ছে না। ফলে, সরকারের তরফ থেকে নানা ধরনের জনকল্যাণ প্রকল্পের আজ এত চাহিদা ও রমরমা যেখানে প্রাপ্তির কোটাটা আরও কিছুটা ভরিয়ে দেওয়া যায়। ফলত, জাতপাত-ধর্মের বেড়াজাল ডিঙিয়ে জনকল্যাণের অর্থনীতি ও রাজনীতিই আজ প্রধান চালিকা শক্তি হয়ে উঠছে। সেই সঙ্গে ব্লকচেইন প্রযুক্তির উত্থান অর্থনীতির লেনদেনকে রাষ্ট্রের গহ্বর থেকে মুক্ত করে এক নতুন পথে নিয়ে ফেলছে।

মোটের ওপর, এইসব কারণে রাজনৈতিক দল সমূহ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা আজ এক সামগ্রিক চ্যালেঞ্জের মুখে। কোন দল ক্ষমতায় গিয়ে বাস্তবে কতটা জনকল্যাণমূলক কার্যসূচিকে বাস্তবায়ন করতে পারছে- তার ওপরেই তাদের জনপ্রিয়তা এবং আরোহন-অবরোহনের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। সেই রাজনৈতিক দলই আজ গ্রাহ্যতা পাবে যারা শিক্ষা-স্বাস্থ্য সহ মানুষের মৌলিক সামাজিক-অর্থনৈতিক চাহিদাগুলি (খাদ্য, বিজলি, পানি, আবাস) অনেকাংশে পূরণ করতে সক্ষম। যে কারণে, আপ’এর মতো একটি নতুন দল নিজস্ব কোনও শাখা সংগঠনের (ট্রেড ইউনিয়ন, কৃষক সংগঠন, ছাত্র-যুব ফ্রন্ট) অস্তিত্ব ছাড়াই বিস্তৃত উপায়ে প্রায় সারা দেশ জুড়েই জনতার আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়ে উঠছে এবং এক নতুন পথের দিশারী হয়ে দেখা দিচ্ছে। কারণ, তারা এমন এক ‘মডেল অফ গভর্নেন্স’এর রূপকল্প শুধু কথায় নয়, অনুশীলনেও করে দেখাতে সক্ষম হয়েছে যা আপামর সাধারণ মানুষের মধ্যে এক আলোড়ন তুলেছে। বলাই বাহুল্য, পঞ্জাবে তাদের বিপুল জয়ের পিছনে দিল্লি সরকারের ‘মডেল অফ গভর্নেন্স’এর বিশাল প্রভাব কাজ করেছে। শুধু আমাদের দেশেই নয়, অন্য বহু দেশেও এমনতর নতুন নতুন দল ও নতুন নতুন নেতা এসে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই রাজনীতির পরিসরে জায়গা করে নিচ্ছে।

অর্থাৎ, উত্থিত পরিস্থিতি ক্রমেই এক নতুন চক্রের জন্ম দিচ্ছে। বাস্তবতা হল, একদিকে গিগ অর্থনীতি কাজের এক অপার ভুবন গড়ে তুলছে, অন্যদিকে আপামর জনসাধারণের কর্মক্ষেত্রে গড় আয় নিম্নমুখি হয়ে চলেছে। শ্রমজীবী মানুষের এই বিপর্যস্ততা ও অনিশ্চিতির মোকাবিলাতেই আজ জনকল্যাণ অর্থনীতির বাধ্যত উত্থান। যে কোনও রাজনৈতিক দলকেই আজ ক্ষমতায় আরোহন করতে হলে বা সেখানে টিকে থাকতে গেলে জনকল্যাণের সৃজনশীল ও প্রয়োজনীয় কর্মকাণ্ডকে উশুল করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। বহু কথিত, ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম প্রণয়নের দিকে এ এক যাত্রা বটে। অথবা হতে পারে: Universal Basic Income in kind and partially in cash