Saturday 27 February 2021

পিএম কিষাণ নিধির জুমলা

কৃষিকথার আসর

প্রবুদ্ধ বাগচী


রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের দিনক্ষণ অবশেষে প্রকাশ্যে এল। গত কয়েক মাস ধরে প্রচুর ইস্যু হুস হুস করে উঠে আসছিল জনপরিসরে, ঠিক যেমনভাবে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বিমানঘাঁটি থেকে আকাশে উড়ে যায় বিমানগুলো। তার বেশিরভাগই অবশ্য জোলো। কোন দল থেকে কে অন্য দলে নাম লেখাল, কোন কোন টালিগঞ্জের চিত্রতারকা পতাকা হাতে নিয়ে সুবিধেমতো দলে ভিড়ছে ও ভোটপ্রার্থী হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করছে, কার বাড়িতে গোয়েন্দা দল অভিযান চালাল, কোন উঠতি ‘রামপন্থী’ সুন্দরী নেত্রী কোকেন নিয়ে বমাল ধরা পড়ল ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের নাম ফাঁস করে দিল ইত্যাদি ইত্যাদি। 

কিন্তু এর মধ্যে মাঝে মাঝে যে অন্য কথা নেই তা নয়। কিন্তু এইসব ইস্যু বেশিদিন স্থায়ী করে জনমানসের ডিভিডেন্ড নেওয়া মুশকিল। রাজ্যের সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনও অভিযোগ এখনও প্রমাণ করা যায়নি। গরু পাচার বা কয়লাকাণ্ডের কথা বলে যতই বাজার গরম করা হোক, গরু পাচার বিষয়ে বিএসএফ আধিকারিকদের নাম এসেছে, আর সীমান্তে পাচার বন্ধ করার দায় সরকারিভাবে তাদের ওপরেই ন্যস্ত, তাই কেন্দ্রের সরকার এর দায় ঝেড়ে ফেলতে পারে না। কয়লা কাণ্ডের তদন্তভার সিবিআই'এর হাতে, কেন্দ্রীয় প্রভুদের বরাভয় থাকলেও এমন কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য এখনও তারা বার করতে পারেনি যা নিয়ে শোরগোল হতে পারে। আমফানের ত্রাণ বরাদ্দ নিয়ে হাইকোর্টের নির্দেশে সিএজি অডিট করছে, এখনও তেমন কিছু গুরুতর বেনিয়ম প্রকাশ্যে আসেনি। ফলে, সবটাই ভাসা ভাসা। বরং, যে দুটো ইস্যু ইদানিং পরিযায়ী নেতারা এসে এখানে ওখানে বলে বেড়াচ্ছেন তার একটা হল, প্রধানমন্ত্রী কিষাণ সম্মান নিধি। এই প্রকল্প  রাজ্যে চালু না হওয়ায় এই রাজ্যের কৃষকরা বড় দুর্বিপাকে আছে, এমন ভাব করা হচ্ছে। আর তারা রাজ্যে ক্ষমতায় এলে প্রথম মন্ত্রীসভার বৈঠকেই সেটা চালু করে দেবেন, এমনকি রাজ্যের কৃষকদের বকেয়া টাকাও দেবেন এমন সব প্রতিশ্রুতির ফুলকি উড়ছে। পিএম কিষাণ নিধি কী এমন সাত রাজার ধন এক মানিক, যে ওইটা পেলেই রাজ্যের সব কৃষকদের মুখে চওড়া হাসি ফুটে উঠবে?

বছরে মাত্র ছ’ হাজার টাকা পেলে রাজ্যের কৃষকরা বর্তে যাবেন, ব্যাপারটা কি তাই? এতটাই সহজ সব? প্রথম কথা হল, কেন্দ্রের এই কৃষি কল্যাণ প্রকল্পের সূচনা হয়েছিল ২০১৯-এর ফেব্রুয়ারি মাসে, মূলত আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে। এই রাজ্যে তার আগে থেকেই ‘কৃষক বন্ধু’ প্রকল্প চালু হয়ে গিয়েছিল (ডিসেম্বর ২০১৮) এবং তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে অ্যাপের মাধ্যমে কৃষকদের নথিভুক্তির কাজ চলছিল। রাজ্যের প্রকল্পটির গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, এই রাজ্যের জমির চরিত্র মাথায় রেখে মূল জমি মালিকদের পাশাপাশি ভাগে চাষ করা বর্গাদারদেরও এই প্রকল্পের মধ্যে আনা হয়। প্রাথমিকভাবে আর্থিক অনুদানের পরিমাণ ছিল বছরে পাঁচ হাজার টাকা যা দুটি ভাগে দেওয়া হয়- একটি রবিশস্যের সময় অন্যটি খরিফ শস্যের সময়। সাম্প্রতিক রাজ্য বাজেটে তা বাড়িয়ে কেন্দ্রের প্রকল্পের সমান অর্থাৎ বাৎসরিক ছ’ হাজার টাকা করা হয়েছে। আর রাজ্যের প্রকল্পটির আরও দুটো দরকারি দিক আছে। একদিকে সর্বাধিক একর পিছু কৃষিজমির জন্য পরিবার পিছু ছ’ হাজার টাকা বার্ষিক অনুদান ছাড়াও কারওর এর থেকে কম জমি থাকলেও তিনি আনুপাতিক হারে অনুদান পেতে পারেন কমপক্ষে বার্ষিক এক হাজার টাকা- একেবারে প্রান্তীয় চাষিদের পক্ষে এটা সুবিধে। অন্যদিকে, এই অনুদানের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে একটা জীবনবীমা- অনুদান প্রাপকদের মৃত্যু হলে (এমনকি তিনি আত্মঘাতী হলেও ) তার পরিবার দু' লক্ষ টাকা বীমার অর্থ পাবেন। 

কেন্দ্রীয় প্রকল্পে এই দুটোর কোনওটাই নেই। ফলে, সুবিধের বিচারে রাজ্যের প্রকল্প কৃষকদের কাছে বেশি আকর্ষণীয়। কারণ, এই রাজ্যে ভাগচাষীর সংখ্যা বেশি, কেন্দ্রীয় প্রকল্পের অর্থ তাদের পাওয়ার কোনও সুযোগ নেই। এছাড়া এই রাজ্যে ফসল বীমার জন্য যে ‘বাংলা শস্যবীমা’ প্রকল্প আছে সেখানে বাণিজ্যিক ফসল ছাড়া (আলু, আখ) অন্য সব ক্ষেত্রে বীমার প্রিমিয়াম সরকার নিজেই বহন করছে। দেশ জুড়ে যে ‘প্রধানমন্ত্রী ফসল বীমা যোজনা’ চলে তাতে এই সুবিধে নেই। ফলে, বছরে মাত্র পাঁচ বা ছ’ হাজার টাকা পেলে একজন কৃষকের কতটা উপকার হতে পারে, এই প্রশ্নটাকে যদি আমরা সরিয়ে রাখি, তাহলে কিন্তু দেখা যাবে কৃষকের আয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে ও তাঁকে কিছুটা সরকারি সুবিধে দানের ক্ষেত্রে রাজ্যের প্রকল্পটি বেশি ভাল আর তার আওতার মধ্যে অনেক বেশি কৃষক আসতে পারেন, আসছেনও। কেন্দ্রীয় প্রকল্পে অনুদান পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রাপকের নামে জমি মিউটেশনের নথি আবশ্যক; রাজ্য সরকার সম্প্রতি তাদের প্রকল্পের ক্ষেত্রে নিয়ম আরও সরল করে মিউটেশন আবশ্যিক না রেখে কৃষকের নিজের ঘোষণাপত্র থাকলেই অনুদান দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। সন্দেহ নেই, এতে রাজ্যের কৃষকদের হয়রানি কমবে। 

কিন্তু কথাটা হল, আর সব কিছু ছেড়ে এই বিশেষ পিএম কিষাণ নিধি প্রকল্প নিয়ে কেন্দ্রের শাসক দল যে রাজ্যে জোরদার প্রচার চালাচ্ছে তার যৌক্তিকতা ঠিক কতটা? তারা যে রাজ্যের কৃষকদের এই প্রকল্প থেকে বঞ্চিত করার অভিযোগ তুলছে তাই বা কতদূর সত্যি? রাজ্যের সরকার কেন্দ্রের এই প্রকল্প মেনে নিলে ভাল হত বা খারাপ হত সেই বিতর্কে জড়িয়ে লাভ নেই কিন্তু একই দফতরের একই ধরনের সরকারি অনুদান দুই সরকারের থেকেই পাওয়া যায় কি না সেই বিষয়ে কিন্তু যথেষ্ট সংশয় আছে। সচরাচর অন্য সরকারি অনুদানের ক্ষেত্রে এই বিধিনিষেধ থাকে। তেলেঙ্গানা রাজ্যে ‘রায়ত বন্ধু’ ও ওড়িশায় ‘কালিয়া’ প্রকল্প কিন্তু পিএম কিষাণ নিধি চালু হওয়ার পরে তার সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে, ফলে একই উপভোক্তা একসঙ্গে দুটো সুবিধে পাচ্ছেন না। তাহলে যদি এই রাজ্যের কৃষকদের দুটোর মধ্যে বেছে নিতে হয় তাহলে রাজ্যের প্রকল্পে স্পষ্টভাবে বাড়তি সুবিধে তারা পাচ্ছেন। 

এইবার দেখা যাক অন্য একটা বিষয়। এই রাজ্যের কৃষকদের আয় বৃদ্ধি নিয়ে যাদের খুব দুর্ভাবনা করতে দেখা যাচ্ছে, তাদের পরিচালিত সরকারের অধীন কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রকের হিসেব বলছে বর্তমান আর্থিক বছরে (২০২০-২১) তারা পিএম কিষাণ নিধির জন্য বরাদ্দ অর্থ পুরোটা খরচ করে উঠতেই পারেনি। খরচ না হওয়া অর্থের পরিমাণ দশ হাজার কোটি টাকা। আরও মজার কথা হল, আগামী আর্থিক বছরের (২০২১-২২) বাজেটে এই প্রকল্পে বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। মাত্র দু' বছর যে প্রকল্পের বয়স, তার তৃতীয় বছরেই এই বাজেট বরাদ্দ হ্রাস খুবই আশ্চর্যের। 

এর পরেও কথা আছে। এই রাজ্যের কৃষকদের জন্য যারা  ইদানিং বড্ড বেশি চোখের জল ফেলছেন তাদের কি জানা আছে যে তথ্যের অধিকার আইনে করা এক প্রশ্নের উত্তরে খোদ সরকার জানিয়েছে, প্রকল্পটির প্রায় ১৩৬৪ কোটি টাকা চলে গিয়েছে ভুল লোকের কাছে! কৃষি মন্ত্রকের তথ্য বলছে, যারা এই সুবিধা পেতে পারে না এমন ২০ লক্ষ ৪৮ হাজার কৃষিজীবী টাকা পেয়েছেন যাঁদের মধ্যে অধিকাংশই (৫৫.৫৮ শতাংশ) আয়কর দেন, আর বাকিরা প্রকল্পের অন্যান্য শর্ত পূরণ করেন না। প্রকল্পের নিয়মানুযায়ী প্রতি চার মাসে ২০০০ টাকা করে (বছরে ৬০০০ টাকা) সরাসরি সেই কৃষকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা পড়ার কথা যাঁর জমির পরিমাণ ২ হেক্টরের থেকে কম; মাসে ১০,০০০ টাকার বেশি পেনশন পেলে বা আয়কর দিলে এই অনুদান পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু অনুদান তারা পেয়েছেন। সম্প্রতি শেষ হওয়া সংসদের অধিবেশনে কেন্দ্রের কৃষিমন্ত্রীও স্বীকার করে নিয়েছেন, পিএম কিষাণ নিধির প্রচুর অর্থ প্রকৃত প্রাপকদের বাইরে ভুল লোকের কাছে চলে গেছে। তামিলনাড়ুতে সাড়ে পাঁচ লক্ষ ভুয়ো প্রাপকদের কাছে চলে গেছে ১২৬ কোটি টাকা, অনুদান পাইয়ে দেওয়ার জন্য কাটমানি দেওয়া হয়েছে প্রায় ৫০ কোটি টাকা। ফলে, আমাদের রাজ্যকে ‘সোনার বাংলা’ করে তোলার জন্য যারা দু' বেলা মঞ্চে মঞ্চে ভাষণ দিয়ে বেড়াচ্ছেন, যাদের মুখে কেবলই পিএম কিষাণ নিধির গুণপনা, সেই বিশেষ প্রকল্পটির পারফরম্যান্স যে খুব বুক বাজিয়ে বলার মতো নয় এটা একরকম পরিষ্কার।

পশ্চিমবাংলার মতো কৃষিভিত্তিক রাজ্যে কৃষকের সব সংকটের সমাধান হয়ে গেছে, এ কথা কেউই বলে না। তাছাড়া সারা দেশেই কৃষির সংকটের মূল কারণ চাষের খরচ বেড়ে যাওয়া, চাষের অন্য সরঞ্জামের ব্যয় বৃদ্ধি, উপযুক্ত কৃষি ঋণ না পাওয়া, ফসলের উপযুক্ত মূল্য না পাওয়া ইত্যাদি। এইসবের বেশির ভাগেরই কারণ কেন্দ্রীয় নীতি- সারের ওপর ভর্তুকি কমিয়ে দেওয়া, নিয়মিত অনিয়ন্ত্রিতভাবে ডিজেলের দাম বাড়িয়ে সেচের খরচ বাড়িয়ে তোলা, এসব কৃষক বিরোধী পদক্ষেপ তারাই করে চলেছে। আর সমস্ত রাজ্যকে অন্ধকারে রেখে সংসদীয় রীতিনীতি বিসর্জন দিয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে দানবীয় কৃষি বিল আনায় সারা দেশে যে অভূতপূর্ব চলমান কৃষক আন্দোলনের সৃষ্টি হয়েছে, ‘গদি মিডিয়া’র প্রবল চেষ্টা সত্ত্বেও তা ক্রমশ এক কিংবদন্তী গণআন্দোলনের জন্ম দিচ্ছে। সেখানে মূল চালিকাশক্তি দেশের শয়ে-শয়ে কৃষক সংগঠন যারা দেশের কেন্দ্রীয় সরকারকে আর বিশ্বাস করতে রাজি নন। এইরকম বিধি বাম অবস্থায় রাজ্যের কৃষকদের সামনে একটা মাত্র অনুদান-প্রকল্পকে সর্বরোগহর বটিকা হিসেবে ঝুলিয়ে রাখা  আসলে সেই মাটির মানুষগুলির প্রতি এক ধরনের নির্মম রসিকতা নয় কি? 

অবশ্য এই ধরনের মিথ্যাচার একমাত্র তাদেরই মানায় !


No comments:

Post a Comment