Sunday, 21 February 2021

গণতন্ত্রের সলিল সমাধি

ভারতে ম্যাকার্থিবাদের পুনর্জন্ম

শোভনলাল চক্রবর্তী

 

টুলকিট শেয়ারের ঘটনায় পরিবেশকর্মী দিশা রবি, নিকিতা জেকব ও শান্তনু মুলুকের গ্রেফতারি দেশ জুড়ে আলোড়ন তুলেছে। গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে আমেরিকা তোলপাড় করা ম্যাকার্থিবাদ সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের রাজনীতিতে এবং সমাজ জীবনে ক্রমশ শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে চলেছে। কী ছিল ম্যাকার্থিবাদের মূল ভাবনা? বিরোধী যে কোনও ব্যক্তি বা সংগঠন বা দলকে হেনস্থা করতে দ্বিধাহীন কণ্ঠে মিথ্যা অভিযোগ করে যাও, কুৎসা প্রচার করো এবং কুৎসা প্রচারের জন্য কারও কাছে জবাবদিহি করার চিন্তা মনে স্থান দিও না। ১৯৫০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি 'লিঙ্কন দিবস'এ আমেরিকার পশ্চিম ভার্জিনিয়ায় রিপাবলিকান পার্টির মহিলা সদস্যদের একটি সভায় সেনেটর জোসেফ ম্যাকার্থি ভাষণের মাঝপথে হঠাৎই পকেট থেকে একটি কাগজ বের করে বললেন, 'আমার কাছে একটি নামের তালিকা আছে। যে তালিকায় কমিউনিস্ট পার্টি ও রুশ গুপ্তচরদের একটি নেটওয়ার্কের ২০৫ জনের নাম আছে যারা স্টেট ডিপার্টমেন্টে চাকরি করছে।'  ম্যাকার্থির এই কথা আগুনে ঘি দেওয়ার কাজ করল। প্রচারমাধ্যমের সাহায্যে গোটা আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ল ওই তালিকার খবর। 

সেই ঘটনার ৭১ বছর পর আজকের ভারত। এ এক অদ্ভুত অবস্থা দেশে। সর্বশক্তিমান রাষ্ট্র আজ ভীত এবং সন্ত্রস্ত। আর এই ভীতি থেকেই জন্ম নিচ্ছে হঠকারিতা, গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে নস্যাৎ করার প্রবণতা। 

বলাই বাহুল্য, বিশ্বের বৃহত্তম সংসদীয় গণতন্ত্র এই ভারতে একটি সংবিধান আছে। এবং সেই সংবিধানে দেশের মানুষের জন্য কিছু মৌলিক অধিকার লিপিবদ্ধ রয়েছে। ভীত, সন্ত্রস্ত রাষ্ট্র এখন মনে করছে দেশের সংবিধানে স্বীকৃত 'নাগরিক অধিকার' রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে এক বিপদজনক ধারণা। এতদিন প্রকাশ্যে এ কথা বলেননি রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা, কারণ দেশের ১৩৮ কোটি মানুষ ও বিশ্ব দরবারে গণতন্ত্রের মুখোশটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর ওই মুখোশটাকেই ধ্রুব সত্য মনে করে দেশের একটা বড় অংশের মানুষ প্রকৃত গণতন্ত্রের মূল ধারণাটাই ভুলে যেতে বসেছেন। সেটা টের পেয়েই এখন মুখ আর মুখোশের ভেদাভেদ ভুলে পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলছেন যে প্রতিবাদী কৃষকরা 'পরজীবী' এবং তাঁদের যাঁরা সমর্থন করছেন তাঁরা 'আন্দোলনজীবী'। এই আন্দোলনজীবীদের পেছনে বিদেশি শক্তির হাত আছে এ কথাও তিনি বলেছেন, একই নিঃশ্বাসে উচ্চারণ করেছেন শহুরে নকশাল ও মাওবাদীদের কথা। যে প্রধানমন্ত্রী দাঙ্গা ব্যতীত আর কোনও কিছুর নেতৃত্ব দেননি, তিনি মসনদে বসে তাঁর মতো করে বুঝেছেন যে, যাঁরা নিপীড়িত মানুষের লড়াইয়ের সামনের সারিতে, তাঁদের মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন করার সহজ উপায় তাঁদের গায়ে 'দেশদ্রোহী'র তকমা দিয়ে দেওয়া। আর এই কাজে তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে ম্যাকার্থিবাদকে আঁকড়ে ধরবেন সেটাই স্বাভাবিক। 

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক থেকে দুটি রাজ্যে ঘোষণা করা হয়েছে যে, কে বা কেউ যদি দেশদ্রোহী কোনও পোস্ট করেন তবে তা নাগরিকদের মধ্যে নিয়োজিত ভলান্টিয়াররা যথাস্থানে জানিয়ে দেবেন। এই ঘোষণা এক কথায় মারাত্মক। নাগরিককে সহ-নাগরিকের বিরুদ্ধে হিংসায় প্ররোচনা দেওয়ার সামিল। সাত দশক গণতন্ত্রে বসবাসের পর যে বাস্তবে নাগরিকদের ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে, তা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। এই একই কায়দায় ম্যাকার্থি মার্কিন জনগণের মধ্যে একটি খাড়া দেওয়াল তৈরি করেছিলেন। তবে ইতিহাস ম্যাকার্থিকে ক্ষমা করেনি। আসলে, প্রতিবাদ প্রতিরোধকে রাষ্ট্র সর্বকালে, সর্বক্ষণে ভয় পেয়ে এসেছে। আজ ভারতবর্ষে যাঁরা মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকারীকে গুরু মানেন, তাঁরা দেশদ্রোহী নন। দেশদ্রোহী তাঁরা, যারা আদিবাসী, দলিত, নিপীড়িত মানুষের কাছের মানুষ, যারা সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের মানুষের অধিকার রক্ষায় সদা তৎপর। 

দেশদ্রোহী- এই শব্দটির কোনও আইনগত ভিত্তি নেই। এখনও পর্যন্ত কে যে ঠিক দেশদ্রোহী এটাই সংজ্ঞায়িত নয়। কেউ যদি মুলস্রোতের বাইরের রাজনীতি করেন তাহলেই কি তিনি দেশদ্রোহী বলে চিহ্নিত হবেন? এসবের কোনও ঠিক নেই। ভারতের সংবিধান যেহেতু এখনও মুক্তচিন্তার অধিকারের সঙ্গে বাকস্বাধীনতার কথাও বলে থাকে, তাই দেশের শীর্ষ আদালতের পক্ষেও দেশদ্রোহী কে, সেই বিচার করা সহজ হবে না। ইনফরমেশন টেকনোলজি আক্ট ২০০০-এর ৬৬(এ) ধারা বিলোপের সময় শীর্ষ আদালত নির্দেশ দিয়েছিল, যে কোনও আক্রমণাত্মক কিংবা বিরক্তি উৎপাদক মন্তব্যই হিংসায় ইন্ধনকারী মন্তব্য হিসেবে গ্রাহ্য হতে পারে না। স্পষ্টতই এটা একটা সূক্ষ্ম বিচারের প্রশ্ন, অর্বাচীন নাগরিকের পছন্দ অপছন্দের ব্যাপার নয়। সাধারণ মানুষ সচেতন হোন বা না হোন, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানে যে দেশ-বিরোধিতা কিংবা রাষ্ট্র-বিরোধিতাই বিবেচ্য বিষয় হলে তা কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মতাধীন হতে পারে না, তার ভিত্তি একান্ত ভাবেই আইনের উপর। সে ক্ষেত্রে নতুন নির্দেশিকার উদ্দেশ্য শুধু নাগরিককে নাগরিকদের পেছনে লেলিয়ে দেওয়া। 

ম্যাকার্থিবাদের পথে হেঁটে দেশের সরকার আজ এক গুরুতর অস্ত্র তুলে দিচ্ছে কিছু মানুষের হাতে, স্বনিযুক্ত সমাজপুলিশের হাতে- যাঁরা গরুর মাংস খাওয়া থেকে শুরু করে কৃষক আন্দোলনের প্রতি সমর্থন, যে কোনও কিছুকেই দেশদ্রোহিতা বলে দাগিয়ে দিতে প্রস্তুত। সমাজবিরোধী, অপরাধী কিংবা প্রতিহিংসাপরায়ণ ব্যক্তিও যে কোনও অপছন্দের লোককে অবলীলায় এই অছিলায় অভিযুক্ত করতে পারবেন, বিপদে ফেলতে পারবেন। এটা পরিষ্কার যে কেন্দ্রীয় সরকার যা চাইছে তা হল জঙ্গলরাজ। কোনও সুস্থ সমাজ এমন নির্দেশিকায় চলতে পারে না। ম্যাকার্থির ভারতীয় অনুগামীরা আসলে 'বিরোধী মুক্ত ভারতের' ভাবনাকে বাস্তবায়িত করতে রাষ্ট্র ও দেশবাসীকে দেশদ্রোহিতার ভূত দেখিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে চাইছেন।

 

3 comments:

  1. খুব ভাল চিন্তা উদ্রেককারী লেখা। তবে একটা প্রশ্ন - রাষ্ট্র ও পার্টি কি এক? রাষ্ট্র একটা ব্যবস্থাপনা। শাসকদলের গায়ে তা সেঁটে যায়। ভয় পায় শাসকদল। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে বিরোধীদের দমন করে। এই ব্যবস্থাপনাকে বদল করতেই তো বামপন্থীরা রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে চায়।

    ReplyDelete
  2. একটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করেছেন আপনি। আপনাকে ধন্যবাদ।আসলে আজ দিল্লির মসনদে বসে আছেন যাঁরা, তাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়াটাকেই সংবিধানের প্রতি বৈধতা বলে ভেবে বসে আছেন, যেটা ভুল। ঠিক এই শিরোনামে "দলই রাষ্ট্র, রাষ্ট্রই দল"- আমার একটি লেখা আছে। অন্যত্র লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে। যদি আপনি আগ্রহী হন লেখাটি আপনাকে পড়াতে পারি। শুভেচ্ছা ও নমস্কার

    ReplyDelete
  3. এখানে ম্যাকার্থিবাদের কথা বলা হয়েছে। আমেরিকান সমাজ এক দশকের মধ্যে সেই ম্যাকার্থির ভূতকে তাড়াতে পেরেছিল। কিন্তু রাশিয়া স্থালিনের ভূতকে এখনও তাড়াতে পারে নি। ভারতের গণতান্ত্রিক ভিত্তি কতটা মজবুত? এখানে স্বৈরাচার কায়েম হলে কতদিন আমাদের পস্তাতে হবে, ভাবনা সেটাই।

    ReplyDelete