Wednesday 10 February 2021

একুশের ডাক

এ লড়াই গভীর ও প্রশস্ত

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 

কিছুটা অভিনব তো বটেই। এ রাজ্যে আগত বিধানসভা নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে যখন টিআরপি লোভী গোদি মিডিয়া দল-বদলের অতি-নাটকীয় দৃশ্যপর্ব তৈরি করে এক রুদ্ধশ্বাস টি-২০ ম্যাচের আবহ নির্মাণে ব্যস্ত, যেন মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার কোনও মূল্যই কোথাও নেই, তখন এইসব হুল্লোড় ছাপিয়ে উঠে জীবনের নানা ক্ষেত্রের বেশ কিছু নাগরিক এগিয়ে এলেন জনগণের দাবি সনদ নিয়ে। মানুষের জীবনযাপন, রুজি-রোজগার ও দাবিদাওয়া ব্যতিরেকে জননির্বাচনের যে কোনও মূল্যই নেই, সেই কথাটি গোদি মিডিয়ার লম্ফঝম্ফ পেরিয়ে বেশ জোরালো ভাবে শোনা গেল নাগরিকদের কন্ঠেও। কথায় কথায় এল, দেশকাল, সুখ-দুঃখ, বিপদ-আপদের অতি প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ ও বিষয়আশয়। বলাই বাহুল্য, এমনতর কোনও উদ্যোগ আমাদের পাথেয় হয়ে উঠতে পারে নিঃসন্দেহে।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতার মৌলালি যুব কেন্দ্রে যে নাগরিক কনভেনশন হয়ে গেল তা নিঃসন্দেহে এ রাজ্যের নির্বাচনী আবহে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। কারণ, এই প্রথম রাজনৈতিক দল ব্যতিরেকে নাগরিকদের একটা অংশ জনসমাজের কাছে পেশ করলেন ২০২১’এর বিধানসভা নির্বাচনের দাবিসনদ। স্বার্থগন্ধ লালায়িত নেতাদের দল-বদল ভিত্তিক নয়, অথবা নেতা-নির্ভর, পার্টি-নির্ভর অসহায় মানুষের ভোটবাজি নয়, ধর্ম-বর্ণ-জাতপাতের বিভাজনের অঙ্কে নয়, বরং আজকের সময়ের অভীপ্সাকে বুঝে এমন দাবি সনদ নিয়ে নাগরিকদের সোচ্চার হওয়া উচিত যা তাদের জীবন-জীবিকা ও বেঁচে থাকার পরিসরে রসদ জোগাবে। হতে পারে, এই দাবি সনদ চূড়ান্ত নয়, তা কখনও হয়ও না, কিন্তু এ এমন এক প্রয়াস যা নির্বাচনের পরেও রাজনৈতিক দলগুলির চৌহদ্দির বাইরে থেকে উত্থাপিত করে যাবে জনতার দাবি। সে অর্থে এই প্রয়াসের শুরুয়াত অনেক আশার প্রতিশ্রুতি নিয়ে হাজির।

শুরুর কথায় তাই দাবি সনদ স্পষ্টতই বলেছে, ‘... নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, ততই আমরা দেখতে পাচ্ছি, মানুষের দৈনন্দিন আলোচনার বিষয়গুলোকে দূরে সরিয়ে দিয়ে তাঁদের মনে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে সাম্প্রদায়িকতার বিষ, ছদ্ম জাতীয়তাবাদের নেশা ইত্যাদি। দলবদলের হিড়িক ও ক্ষমতা দখলের আগ্রাসী অভিযানের শোরগোল নির্বাচনকে আইপিএলের খেলায় পরিণত করে ফেলতে চাইছে। এমন এক পরিস্থিতিতে, যখন সাধারণ মানুষের কথা বলার পরিসর সংকুচিত করে তোলা হচ্ছে, তখন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির একটি অনুশীলন হিসেবে আমরা, নাগরিক সমাজের বিভিন্ন লোকেরা, অধিকার আন্দোলন ও প্রগতিশীল সমাজ পরিবর্তনের রাজনীতির বিভিন্ন লোকেরা, সমাজের নানা সহনাগরিকদের সঙ্গে মতামত আদানপ্রদানের কাজটাকে একটা দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করি।’ বোঝাই যাচ্ছে, এই অনুভব ও অনুশীলন এক নির্বাচনে চলে যাওয়ার নয়। এ এমন এক নবতর উদ্যোগ যা আগামী দিনে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির অনুষঙ্গে এক প্রাত্যহিক যোগ হিসেবে থেকে যাবে। নাগরিক কনভেনশনের মেজাজেও সে কথা উচ্চারিত হল।

অন্যতম বক্তা মৌসুমী ভৌমিক খুব তাৎপর্যপূর্ণ একটি কথা সেদিন বললেন- আমি এখানে কী আর বলব, কারণ, আপনারা তা জানেন। অর্থাৎ, এমন এক সমাবেশে তিনি বলছেন যেখানে একটি প্রাথমিক সহমত ইতিমধ্যেই বিরাজমান। এ কথার গুরুত্ব এখানেই- আরও বহু মানুষের কাছে যেতে হবে, যেখানে সহমত নেই, অথবা বহু প্রশ্নে সহমতগুলি ভেঙ্গে যাচ্ছে। ঘোরতর বিপদটা সেখানেই। মানুষের পুরনো বোঝাপড়াগুলি দ্রুত ভেঙ্গে যাচ্ছে, যেন নিমেষে পরিজন-প্রতিবেশীরা শত্রু বনে যাচ্ছেন। তা আরও স্পষ্ট হল সামিরুল ইসলামের বক্তব্যে। তিনি এক অসহায়তা প্রকাশ করলেন যেখানে গ্রামের মানুষেরা উদারচেতা, মানবিক মানুষদের যেন ভুলে যেতে চাইছেন; আপন করে নিতে চাইছেন বিভাজনকারী ও উস্কানিদাতাদের। এখানেই কঠিন-কঠোর লড়াইয়ের প্রাসঙ্গিকতা। যেভাবে উত্তাল কৃষক আন্দোলনের অভিঘাতে ২০১৩’এর মুজফফরপুরনগরের দাঙ্গার স্মৃতিকে পিছনে ঠেলে আজ আবার নতুন করে নির্মিত হচ্ছে জাঠ-মুসলমান ঐক্য, খসে পড়ছে সমস্ত বিভাজনের পোশাকগুলি, সেভাবেই আমাদেরও এ রাজ্যে ইতোমধ্যে চওড়া হওয়া বিভাজনের ফাটলগুলিকে জুড়ে দিয়ে শ্রমজীবী মানুষের ঐক্যকে সুনিশ্চিত করতে হবে। আর সে কাজে সফলতা আসতে পারে যদি জীবন-জীবিকা ও স্বাধীন ভাবে বাঁচার মুদ্দাগুলিকে আঁকড়ে ধরে শ্রমজীবী মানুষ নিজেদের আত্ম-অধিকারের লড়াইকে সন্নিবদ্ধ করতে পারে। তা যে সম্ভব তা দেখা গেছে গত বিহার নির্বাচনের সময় যখন বিভাজন ও ধর্মের রাজনীতির বিপক্ষে জনতার দাবিদাওয়াকে নিয়ে এককাট্টা হয়ে একটা প্রবল লড়াই গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল। সেই লড়াইয়ের সারমর্মকে দীপঙ্কর ভট্টাচার্য নাগরিক কনভেনশনে খুব সুন্দর ভাবে উপস্থাপনা করলেন এই বলে যে, বিহারে হয়তো সাম্প্রদায়িক ও বিভাজনকারী শক্তিকে অল্পের জন্য গদিচ্যুত করা যায়নি, কিন্তু সেখানে তৈরি হয়েছে বিভাজনকারীদের একটি দুর্বল সরকার যার বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান এক সবল বিরোধীপক্ষ। এও অত্যন্ত ইতিবাচক ঘটনা নিঃসন্দেহে।

কিন্তু এ রাজ্যে এখনও যেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ তা হল, গত কয়েক বছরে প্রবল ভাবে উঠে আসা বিভাজনকারী শক্তিকে কোন কার্যকরী উপায়ে রোখা যেতে পারে তা অনুধাবন করা। এই শক্তি উত্তর ভারতে ইতোমধ্যে কৃষক আন্দোলনের অভিঘাতে যথেষ্ট পর্যদুস্ত ও বিব্রত। সেখানে তাদের বিভাজনের রাজনীতিকে পরাস্ত করে জনতা নির্মাণ করেছেন এক নতুনতর ঐক্য। তা আগামী নির্বাচনগুলিতেই স্পষ্টত বোঝা যাবে। এ রাজ্যের পরিপ্রেক্ষিতে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু বুঝতে হবে, আপাতত উত্তাপ-সহায়ক মাত্র। কারণ, এখানের মাটিতে যতক্ষণ না বাস্তবত বিভাজনের পক্ষে ভেসে যাওয়া জনতার এক বড় অংশকে আবারও ঐক্যের শক্ত জমিতে ফিরিয়ে নিয়ে আসা যাচ্ছে ততক্ষণ উত্তর ভারতের এই কৃষক আন্দোলন আমাদের মনে আশার সঞ্চার করবে বটে কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে এ রাজ্যের জমিকে উর্বরা করতে হবে এখানকার বাস্তব দাবিদাওয়া, আন্দোলন ও টানাপোড়েন থেকেই। সেই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি কীভাবে হবে ও কোন পথে, তা অবশ্যই চর্চা ও অনুশীলনের বিষয়।

বুঝতে হবে, উগ্র রক্ষণশীলতা ও বিভাজনের রাজনীতি সাম্প্রতিক সময়ে যে শক্তি সঞ্চয় করেছে তা এ রাজ্যের মাটি থেকেই। শুধুমাত্র মিথ্যা প্রচার করে তারা এই ভূমি প্রস্তুত করেছে, এ কথা বললে সত্যের অপলাপ হবে। এ মাটিতেই রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির নানা স্তরে হিংসা, বিপন্নতা ও রাজনৈতিক জোতদারির প্রখর বয়ান এমন ভাবে প্রোথিত হয়েছে যে তার বিপ্রতীপেই আরেক হিংসা-ভিত্তিক রাজনীতির উদয় হয়েছে। এ শুধু আমাদের রাজ্যে নয়, গোটা দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তাই বাস্তবতার ময়দানে নেমে হোঁচট খেতে হচ্ছে- দেখা যাচ্ছে, ঘৃণা ও বিভাজনের ভাবনা ও অনুশীলনে জনতার একটা বড় অংশ সায় দিচ্ছে। এ বড় ভয়ঙ্কর দিক। এই কথাটিই সম্ভবত সামিরুল ইসলাম বলতে চেয়েছেন। বুদ্ধিজীবীসুলভ ঔদ্ধত্য ও বিশ্লেষণের আত্মগরিমা নিয়ে এই কঠিন বাস্তবতাকে মোকাবিলা করা অতএব দুষ্কর।

তাই, পুরনো চিন্তার ক্লেদকে অতিক্রম করে, উদারতার মুখোশে লুকনো রক্ষণশীলতা ও স্বার্থান্বেষী প্রয়াসকে ভেঙ্গে ফেলেই প্রকৃত অর্থে আজ ধর্মীয় উন্মাদনার আড়ালে ধেয়ে আসা হিংসাত্মক রাজনীতিকে সর্বাত্মক ভাবে মোকাবিলা করা যাবে। নাগরিক কনভেনশনে সুজাত ভদ্র খুব সঠিক ভাবেই বলেছেন যে আজ দেশের সংবিধান আক্রান্ত, বিপন্ন দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো। ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের প্রাণভোমরাকেই মেরে ফেলতে উদ্যত আজকের আগ্রাসী দিল্লির শাসক। এরা যদি এ রাজ্যে সত্যি সত্যি ক্ষমতাসীন হয়ে যায় তবে তার থেকে ভয়ঙ্করতম আর কিছু হতে পারে না।

তাই সকলের আওয়াজ: রুখতে হবে। ধর্মের রথে আগুয়ান এই উগ্র রক্ষণশীল শক্তিকে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে পরাজিত করতে হবে। শুধুমাত্র সেটুকু নয়, তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষদাঁতকেই ভেঙ্গে দিতে হবে। সে এক গভীর ও প্রশস্ত লড়াই। সে লড়াইয়ে জনগণের দাবি সনদ এক অন্যতম হাতিয়ার। বিধানসভা নির্বাচন হোক এই দাবি সনদের ওপর, ধর্মের ভেদাভেদের ওপর নয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কাজের অধিকার, শ্রমজীবী মানুষের অধিকার, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, নাগরিক নিরাপত্তা- এই হোক আগামী নির্বাচনের আসল মুদ্দা।

তাই, নাগরিক কনভেনশন আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় এক বিপুল গণ সমাবেশের ডাক দিয়েছে যেখান থেকে জনগণের দাবি সনদ ছড়িয়ে পড়বে রাজ্যের প্রতিটি প্রান্তরে। লড়াই কঠিন কিন্তু জয় সম্ভবত নিশ্চিত। 

  

2 comments:

  1. Rightly analysed.I have enjoyed

    ReplyDelete
  2. নতুন রা একটু কম বোঝে।তবুও ঠিক আছে।আমাদের লিখতে উৎসাহ দেবার জন‍্যে আপনারা সাথে থাকুন।

    ReplyDelete