Saturday 6 February 2021

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি

উত্তরণ নাকি রূপান্তর

অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়


পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি এখন এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের শরিক। এই প্রথম রাজ্য-রাজনীতিতে বহু দলীয় নির্বাচনের আঙ্গিক যথেষ্ট জোরালো হয়ে দেখা দিয়েছে। এর আগে অবধি দুই যুযুধান পক্ষের ভোটযুদ্ধের সাক্ষী ছিল এ রাজ্য– কংগ্রেস-সিপিএম কিংবা সিপিএম-তৃণমূল। আর এখন সিপিএম-কংগ্রেস জোট, তৃণমূল, বিজেপি- এক ত্রিস্তরীয় নির্বাচনী পরীক্ষার সময়কাল আসন্ন। এছাড়াও আরও যে দুটি সম্ভাবনার কথা অহরহ প্রচারিত হচ্ছে তার একটি হল, বিজেপি যদি আগামী নির্বাচনে ব্যালট-যুদ্ধ জিততে পারে তবে কেন্দ্র-রাজ্যে একই সরকারের নজিরও পশ্চিমবঙ্গ বহু দশক পরে দেখতে পাবে। দ্বিতীয়টি হল, যদি বিজেপির বিরুদ্ধে কংগ্রেস-সিপিএম-তৃণমূল ইত্যাদি একটি মহাগঠবন্ধন হিসেবে প্রতিরোধের দেওয়াল তুলতে পারে তাহলে সেও হবে এক অনন্য নজির। সুতরাং, রাজ্য-রাজনীতির এক যুগ-সন্ধিক্ষণে সকলে অপেক্ষমান।

অনেকে বিজেপিকে ফ্যাসিবাদী শক্তি হিসেবে শনাক্ত করেছেন। তার যথেষ্ট কারণও আছে- নোটবন্দি, ৩৭০ ধারা, রামমন্দির, সিএএ-এনআরসি, কৃষি আইন ইত্যাদি একপেশে সিদ্ধান্তের তালিকা নিতান্ত কম নয়। তবুও বিজেপিকে এখনও ফ্যাসিবাদী শক্তি বলা যায় না। বরং সম্ভাব্য ফ্যাসিবাদী দল বলা যেতে পারে। কেননা ভারতবর্ষের পুঁজিতন্ত্র এখনও সেই পর্যায় অতিক্রম করেনি যা একটি রাজনৈতিক দলকে সম্পূর্ণ ফ্যাসিবাদী দলে পরিণত করতে পারে। এ ক্ষেত্রে ভারতের বড় পুঁজি বনাম ছোট ও মাঝারি পুঁজির মধ্যে থাকা অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব এটাকে ঠেকিয়ে রেখেছে। তাই বড় পুঁজি এখন সর্বাগ্রে ছোট ও মাঝারি পুঁজিকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছে। আর তার ফলেই নানা ধরনের জনবিরোধী সিদ্ধান্তের রব হামেশাই উঠছে। পশ্চিমবঙ্গের জনমনে কি বিজেপি দলের এই সর্বভারতীয় চেহারা ধরা পড়ছে না– এ প্রশ্ন নিতান্তই বালখিল্যতা। অবশ্যই ধরা পড়ছে কিন্তু অসহায়ত্ব ও নিরুপায় বলে যে দুটি শব্দ বাংলা শব্দকোষে আছে তাই-ই এখন আমজনতার হৃদকোষেও মোটা হয়ে ফুটে উঠেছে ।

এর আগে দীর্ঘ ৩৪ বছরের বাম-শাসনের অবসান ঘটানো ছিল আরও একটি ঐতিহাসিক নজির। তা সম্ভব হয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে। ইতিহাস মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই বৈপ্লবিক দৃষ্টান্তের কথা বিস্মৃত হবে না– তিনি অবিস্মরণীয় হয়ে থেকে যাবেনই। কিন্তু হাল আমলের সব থেকে বড় সমস্যা হল অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতাবাদ। রাজ্যে সংগঠিত ব্যবসা-বাণিজ্য-শিল্পের দরুণ আগতপ্রায় কর্পোরেট বড় পুঁজির সংখ্যা প্রায় শূন্যের কাছে। ফলে, বড় লগ্নি ব্যতিরেকে ছোট-মাঝারি-অসংগঠিত ক্ষেত্র নির্ভর অর্থনৈতিক দোলাচলে বাংলার পুঁজিপতি শ্রেণির মধ্যেও দুটি বর্গ আভাসে বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বহুদিন। বাম-আমলে বড় পুঁজির কাছে একটা আপাত শান্তি বজায় ছিল, যা এখন আর নেই । ফলে, একদল পুনর্বার বাম-শক্তিকে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে ঠিকই, কিন্তু জনসমর্থনের নিরিখে বামপন্থা তথা বামপন্থীরা এখন এতটাই মুখ থুবড়ে পড়েছে যে বিজেপির উত্থান সেই ফাঁকতালে ধীরে ধীরে স্পষ্টতর হয়ে উঠেছে। আর এখানেই বাংলার আরেক দল পুঁজিপতি শ্রেণি সমর্থন জাহির করছে। 

অন্যদিকে, বিজেপি দলটি ঠিক যে যে প্রশ্নে তৃণমূল সরকারকে আক্রমণ করছে, অর্থাৎ দুর্নীতি, তোলাবাজি ও পরিবারকেন্দ্রিকতা, তাকে প্রতিহত করে বিজেপির জাতীয় চরিত্রের বিশ্লেষণ জনগণের সম্মুখে হাজির করার পালে হাওয়া লাগাতে তৃণমূল পারছে না। কেননা মতাদর্শগত বিচারে কংগ্রেসি মানসিকতার একটা আলোছায়াময় জাতীয়তাবাদী জনদরদি চরিত্র ছাড়া তৃণমূলের অন্য অবস্থান সবিশেষ নেই, যেখানে বামপন্থীদের মতোই বিজেপি আরএসএস সমর্থিত একটি ক্যাডারভিত্তিক রেজিমেন্টেড দল। ফলে, লড়াইটা মোটেই সমানে-সমানে নয়। পক্ষান্তরে রাজ্যের বামপন্থী দলগুলি জাতীয় স্তরে ঘটে চলা বৃহৎ আন্দোলনগুলির প্রেক্ষিতে যে সম্ভাবনাময় প্রতিশ্রুতি নিয়ে নিজেদের প্রাসঙ্গিক করে তুলবে রাজ্য-রাজনীতিতে সে প্রচেষ্টাও অতীব ক্ষীণ। অতএব, সম্ভাব্য ফ্যাসিবাদী চরিত্রের বিপরীতে যে এক গণতান্ত্রিকতার প্রতিভূ প্রকট হবে– তা এখন নিতান্তই অসম্ভব। আর এভাবেই বিজেপি বাংলায় বর্ধিষ্ণু দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে।

অনেকে বলাবলি করছেন, একুশে রাম ছাব্বিশে বাম ইত্যাদি। কিন্তু এসব ভাবনা যে কতটা দিবাস্বপ্ন তা ত্রিপুরার মতো রাজ্যগুলিকে দেখলেই অনুধাবন করা যায়। সিপিএম–বিজেপি দুটি দলই রেজিমেন্টেড। ফলে, সাংগঠনিক দৃষ্টিভঙ্গি দুটি দলেরই যথেষ্ট পাকা। সেখানে যদি বিজেপি আগামী নির্বাচনে একবার জিতে যায় তবে বাংলার রাজনীতিতে সিপিএম নামক দলটির আর আদৌ অস্তিত্ব থাকবে কিনা সেটাই সংশয়ের বিষয়। এখানে মতাদর্শগত ফারাকের চেয়েও বড় কথাটা হল সমাজ-অর্থনীতির চরিত্র বদলে। আসলে এখন পুঁজিপতি শব্দটির অভিধানিক পরাকাষ্ঠা কোনও ব্যক্তিবাদকে সূচিত করে না, বরং তা কর্পোরেট বা যৌথবাদে পরিণত হয়েছে। সেখান থেকে রামের বদলে বামের কতটা সুবিধা হবে, তা নিঃসন্দেহে ভাবনার বিষয়।

পুঁজিবাদ সদাসর্বদা জাতীয়করণের মধ্যে দিয়ে নিজেদের অবস্থান বদলাচ্ছে। ফলে, তা এখন দেশের উৎপাদন ও বন্টন ব্যবস্থাকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে যাতে একচেটিয়া মালিকানা তাতে প্রতিষ্ঠিত হয়। আর বামপন্থী দলগুলি এখানে কেবলই নতুন প্রযুক্তির বিরোধিতা থেকে মূল্য-নির্ধারণের প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজেদের খাড়া করতে চাইছে। তারা শ্রমিকশ্রেণির মুক্তির স্বার্থে কার্যকলাপ প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। সে-কারণে তারা সংশোধনবাদীদের কায়দায় পুঁজিতন্ত্রের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে অস্বীকার করে ও বৈপ্লবিক চেতনার বিকাশের মাধ্যমে এই দ্বন্দ্বের নিরসন ঘটিয়ে শ্রমিক আন্দোলনকে জাগ্রত করার ভাবনায় একেবারে জল ঢেলে দিয়েছে। ফলে, বর্তমানে বামপন্থীদের যে রূপ প্রতিভাত তা সংস্কারবাদী আন্দোলনের একটি উপভাগ ছাড়া আর কিছুই নয়। পুনর্বার ক্ষমতা দখলের উন্মাদনায় তারা ভবিষ্যতের সমাজ বদলের স্বপ্নকে স্থগিত করেছে এবং হারিয়েছে জনসমর্থন, এমনকি পার্টি মেম্বারের সংখ্যাতেও হ্রাস পেয়েছে যুবাদের পরিমাণ। নতুন নেতৃত্বের মুখ প্রায় আর একটিও অবশিষ্ট নেই। অপ্রাসঙ্গিকতা ছাড়া অন্য কোনও কিছুই যেন তাদের জন্য বাকি নেই।

অথচ বামপন্থা শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের প্রেক্ষিত ছিল না। এটি একটি মানসিকতা, একটি ভাবাদর্শ। দীর্ঘ ৩৪টি বছর এ রাজ্যে একটি বামপন্থী দলের শাসনের পরেও আজ এমন দশা কেন হল যে তা একটি সাম্প্রদায়িক ও ফ্যাসিবাদী দলকে উঠে আসার পক্ষে মদত দিল? অনেকে এখানে তৃণমূলের কথা বলেন কিন্তু ৩৪ বছর ধরে যদি চেতনার লড়াই বামপন্থীরা লড়ত তাহলে কি মাত্র ১০ বছরেই সেই দুর্গ এমন চৌচির হতে পারত? আসলে এ রাজ্যে বামপন্থা শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলের রঙ হয়েই প্রথম থেকে বিদ্যমান ছিল, সেখানে মানুষের অন্তর্জগতের পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন সমাজব্যবস্থা তৈরির প্রায় কোনও আগ্রহ ছিল না। তাই প্রথম থেকে কেন্দ্রের সরকারের সঙ্গে নানা আপসমুখি ভূমিকায় বাম জমানার অবস্থান লক্ষ করা যায়। এখানেই তাদের মূল ব্যর্থতা। ফলে, মানুষের কাছে এই বামপন্থার ধারা অন্যান্য ডানপন্থার চেয়ে খুব কিছু আলাদা নয়।

কিন্তু মানুষ সবসময় একটি বিকল্প চায়। আর এখন রাজ্য-রাজনীতিতে কোনও দলই প্রায় আর বিকল্পের সন্ধান দিতে পারছে না। সকলেই যেন হাত তুলে নিয়েছে, সকলেই অপারগ। আর এখানেই আগামী নির্বাচন একটি সময়ের অপেক্ষায় পরিণত হয়েছে। রাজ্য-রাজনীতির এই চেহারা উত্তরণও নয়, রূপান্তরও নয়– কেবলই ভাষান্তর। সকলেই জানে কোনও কিছুরই পরিবর্তন হবে না– রাজা আসবে রাজা যাবে, পোশাকের আর মুখোশের রঙ বদলাবে; সাধারণজনের মেজাজে থাকবে একটাই ভাবনা: সব 'ঝুট হায়! সব ঝুট হায়!'

 

No comments:

Post a Comment