Tuesday 23 February 2021

উন্নয়ন ও গণতন্ত্র

শিক্ষা বিনে কল্যাণমুখি অর্থনীতি হয় না!

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়


উন্নয়ন রাজনীতি ছাড়া হয় না। আবার রাজনীতির জন্য উন্নয়ন হয় না। এই দুইয়ের দু' মুখো টানের মধ্যে মানুষের প্রতিদিনের বেঁচে থাকা। তার মধ্যেই মানুষকে বেছে নিতে হয় গণতন্ত্রে তাঁর প্রতিনিধি। তাঁর বিশ্বাস, অভিজ্ঞতা ও বিচার বোধ থেকে তিনি ভোট দেন। এইখানেই পার্থক্য ঘটায় শিক্ষা। শিক্ষা তো বাঁচার জন্য এবং যাপনের জন্য। বাঁচার প্রশ্নে মানুষ যাঁকে চান, যাপনে তিনি তাঁর আশা পূর্ণ করতে পারেন না অনেক সময়েই। তাই দুই ধারার ভাবনায় দুই ধারার চিন্তা থেকে মানুষ বেছে নেন তাঁর চাওয়া। 

যে বেকার সে কাজ পেলেই ভোট দেবে। যে চাকরি করে সে কর্মস্থলে বেতন বৃদ্ধি ও সুযোগ সুবিধার প্রশ্নে তার আন্দোলনের প্রতিনিধি খুঁজে নেয়। তেমনই ব্যবসায়ী, কৃষক, শ্রমিক, শিল্পপতি নানা শ্রেণির জীবিকার মানুষ দেখেন তাঁর জীবিকার প্রয়োজন মেটাতে কাজে লাগে কে? কে তাঁর উন্নতির সহায়ক। এখানে সকলেই নিজ উন্নতির প্রয়োজন দেখে ঠিক করে নেয় প্রতিনিধি। প্রতিনিধি দেখেন তাঁর সংখ্যাগরিষ্ঠ অনুগামী কী চাইছেন। অনুগামীদের চাওয়া এবং দাবি প্রতিনিধিকে লড়াই এবং আন্দোলনের পথ ঠিক করে দেয়। একই সঙ্গে প্রতিনিধির ভাবনা চিন্তা অনুগামীকে টেনে নিয়ে আসে। প্রতিনিধি এবং অনুগামী উভয়েরই কাজ হয়ে পড়ে সামনের বাধাগুলিকে দূর করা। বেঁচে থাকা এবং বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে চলার এই প্রক্রিয়াটাই জন্ম দেয় রাজনীতির। যে সমীকরণের মধ্যে দিয়ে কতকগুলো মানুষ যূথবদ্ধ হয় এবং নিজেদের ভালোর জন্য এগিয়ে যাওয়ার পথ খোঁজে সেটাই রাজনীতি। যে কাঠামোর মধ্যে ভালো থাকার চিন্তাগুলোকে সাজানো যায় সেটাই রাজনৈতিক মত ও পথ ঠিক করে দেয়। 

এসব কিছুর মধ্যে যেহেতু প্রত্যেকেই বেঁচে থাকা এবং এগিয়ে যাওয়ার জন্য সমবেত হয়েছে তাই রাজনীতির মূল শর্ত হল উন্নতি সাধন। যে গোষ্ঠী উন্নতি করার জন্য যে মতে বিশ্বাস করে, সেই গোষ্ঠী রাজনীতির পথ হয় সেইরকম। বিশ্বাসের প্রকরণ। তাই মত নানা রকমের। নানা রকমের পথ। মত ও পথের দ্বন্দ্ব তাই অনিবার্য। যে শিক্ষা অনিবার্য দ্বন্দ্বের মধ্য থেকে আনতে পারে সমন্বিত ভাবনা সেই রাজনৈতিক শিক্ষা জন্ম দিয়েছে গণতন্ত্রের। এর আগে যতগুলি রাজনৈতিক কাঠামো ছিল সেখানে সব কিছুই কোনও একটি শ্রেণি দ্বারা তার মতো ভাবনায় যেটি তাঁর মতাদর্শে বিশেষভাবে গ্রহণযোগ্য সেই পথে সমাজ গঠনের কথা ভাবা হয়েছে। কিন্তু একমাত্র গণতন্ত্র সর্বশ্রেণির প্রতিনিধির সমন্বয়ে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অবকাশ রেখেছে। শাসক তার নিজের কোনও ভাবনা চাপিয়ে দিতে চাইলেও সেটি কার্যকর করতে বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনার মধ্যে দিয়ে রূপ দিতে বাধ্য হয়, নইলে বিরোধীদের আন্দোলনের মুখে পড়ে। সাধারণ মানুষের কাছে বহু মতের মধ্যে নিজের প্রয়োজন ও পছন্দে নিজের প্রতিনিধি খুঁজে নিয়ে রাজনীতির গতিমুখ নির্দিষ্ট করে দেয়। চাপিয়ে দেওয়া স্লোগান সর্বস্ব রাজনীতি থেকে ধীরে ধীরে মানুষ সরে যায়। তার উন্নতির ঠিকানা যেখানে সেখানেই সে নাম লেখায়।

সমাজের পরিস্থিতি একরকম থাকে না। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম সংকট সামনে এসে দাঁড়ায় মানুষের সামনে। কখনও সেটা বেঁচে থাকার, কখনও উন্নতির, কখনও আরও উন্নতির, কখনও যাপনের প্রশ্নে মানুষ ঠিক করে নেয় কেমন সমাজ চাইছে। সেখানে জীবিকা অর্জন থেকে শুরু করে নানাবিধ নিত্য জীবনের ইস্যুগুলিতে কীভাবে সুযোগ-সুবিধা পেতে চায় তার ভিত্তিতে সে কোনও এক দলের অনুগামী হয়ে ওঠে। আবার কেউ কেউ তার স্থির নিরাপদ জীবনে কোন পথে উন্নতির জোয়ার আসতে পারে ভেবে মত-পথের পরিবর্তন পছন্দ করে। আবার কেউ কেউ তার নিজের জীবনাদর্শের দিক থেকে নিজের যাপনকে একসূত্রে বাঁধতে চায়। তাই যে স্বপ্ন সে এঁকেছে অন্তরে, তার উদ্গাহনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করে। এইসব প্রচেষ্টার উদযাপনের মধ্যেই মানুষের রাজনীতি। বুঝে হোক কিংবা না বুঝে হোক, মানুষ বেঁচে থাকার প্রশ্নে, উন্নতির আকাঙ্ক্ষায় কিংবা যাপনে তৃপ্তি পেতে যা চায় তার মধ্যেই থেকে যায় তার রাজনীতির সুপ্ত বীজ। ক্রমে চলার পথে আত্মবিকাশের হাত ধরে সেই বীজ তার চেতনায় তাকে একটি রাজনীতির অনুসারী করে তোলে। তার চেতনার উন্মেষ হয় শিক্ষার মধ্যে দিয়ে। সেখানেও বেঁচে থাকার জন্য জীবিকা অর্জনের শিক্ষা, উন্নতি করার জন্য জাগতিক সমস্ত বাধা উত্তরণের শিক্ষা এবং যাপনের জন্য নিজেকে দেখার এবং চেনার চেষ্টা করার শিক্ষা তার বিকাশের পথ বাছাই করতে সাহায্য করে। মতামত গঠনে প্রভাব ফেলে। এ থেকেই সে সিদ্ধান্ত নেয়। 

তাই জীবনে বেঁচে থাকা, উন্নতি এবং যাপনের প্রশ্ন-উত্তরগুলো মানুষ খুঁজে নেন শিক্ষার মধ্যে দিয়ে আর সেই উত্তরগুলো গড়ে তোলে সেই সমাজের রাজনীতি। যে সমাজের শিক্ষা যেমন তার রাজনীতি তেমন। কারণ, মানুষ যে বিষয়গুলিকে গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার দেন এবং মৌলিক শর্ত হিসেবে বেঁচে থাকা, উন্নতি ও যাপনের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় তার থেকে মুক্তি দেয় যে মত ও পথ সেটাই রাজনীতির পথ তৈরি করে দেয়। আর এই মুক্তি খুঁজে দেয় শিক্ষা। শিক্ষা বেছে নিতে শেখায়। মানুষ সাম্প্রদায়িক হবে না অসাম্প্রদায়িক হবে, বামপন্থী হবে না ডানপন্থী হবে, পুঁজিবাদের অনুসারী হবে নাকি সাম্যবাদ চাইবে, ক্ষমতার তন্ত্রকে পছন্দ করবে নাকি গণতন্ত্রকে পছন্দ করবে, সব কিছু কিন্তু মানুষই ঠিক করেন তাঁর শিক্ষার ভিত্তিতে। যার যেমন শিক্ষা তাঁর তেমন বোধ, তাঁর তেমন চেতনা। তাঁর কাছে তেমন অগ্রাধিকার এবং পছন্দ যার ভিত্তিতে গড়ে উঠবে রাজনীতি। 

মানুষের এই শিক্ষা সমাজের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নির্মাণ করে। কে করবে নির্মাণ? নেতৃত্বের প্রশ্নে ক্ষমতা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে যায়। শিক্ষা চেতনা তৈরি করে বলেই শিক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করাটা রাজনীতির অঙ্গ হয়ে যায়। অর্থাৎ, যাকে নিয়ে উত্তরণের শক্তি অর্জন করা সেই শক্তিকেই করায়ত্ত করে ক্ষমতাকে পেতে চায় মানুষ। তখন রাজনীতি আর উন্নতির রাজনীতি থাকে না। রাজনীতি হয় দমনের। সেটা যে তন্ত্রই হোক। তখন নতুন আরেক প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়ায়। ক্ষমতার রাজনীতির হাত থেকে মুক্তি পাব কীভাবে? তখনই সকল মানুষের ক্ষমতা গড়ে তোলা খুব প্রয়োজন হয়। সহমতের ভিত্তিতে কাজ করতে গেলে সকলকে সহ-ক্ষমতার ভিত্তিতে এক আসনে উপনীত হতে হয়। নইলে একের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হলে অনিবার্যভাবে দমন তখন নিত্য বাস্তব এক সমাজ লক্ষণ হয়ে দাঁড়ায়। এই মানুষের সভ্যতার লক্ষ্যই হল সকলকে সক্ষম করে তোলা এবং আরও বেশি স্বাধীনতার ভিত্তিতে সকলকেই এক আসনে এনে রাখা। আদর্শ রাজনীতি সেটাই যা সকলকে সক্ষম এবং একাসনে আনার কথা বলে।

কিন্তু কীভাবে? কল্যাণবোধের মাধ্যমে। কল্যাণ কখনও শুধুমাত্র নিজের জন্য করা যায় না। অন্যের উন্নতির প্রশ্নে নিজেকে সংযুক্ত করতে পারলে তবেই কল্যাণ সাধন হয়। রাজনীতি যতই দমনমূলক হোক তাকে প্রশ্নের মুখে, চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তেই হবে। তাই পশ্চাতে ফেলেছ যারে পশ্চাতে টানে সে- রাজনীতিতে এটাও অবশ্যম্ভাবী। তাই ওঠানামা থাকবে। সেটা কেবলমাত্র ক্ষমতা দখল আর প্রস্থান নিয়ে নয়। ক্ষমতায় যিনি আছেন তার প্রতিদিনের কাজে তিনি কতটা দমনমূলক আর কতটা কল্যাণময় তার থেকেই ঠিক হয়ে যায় কতটা প্রতিরোধের সম্মুখীন হবে আর কতটা সমর্থন কুড়োবে। প্রতিরোধ করবে যে সমর্থন করবে সে। সেই একই মানুষ বদলে যায় যখন তার জীবিকা, উন্নতি বা যাপনের প্রশ্নে সে নিজের অবস্থান পরিবর্তন করে ফেলে। তাই সেই মানুষ যত ব্যক্তিকেন্দ্রিক হবে ততই সে তার উন্নতিকে চাইবে আর সেই মানুষটি যত ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা ত্যাগ করে সমকেন্দ্রিক হবে, সমাজমুখি হবে, ততই সেই মানুষটি সকলের কল্যাণমুখি হবে। তাই সমাজে যত বেশি মানুষ ব্যক্তিকেন্দ্রিক সেখানে ব্যক্তি কেন্দ্রিক রাজনীতি জন্ম এবং চর্চা হবে। আর যে সমাজে বেশি মানুষ সমকেন্দ্রিক সম্ভাবনায় সম ভাবনায় চলার চেষ্টা করবে সেখানে তত বেশি কল্যাণমুখী রাজনীতির জন্ম নেবে। এই ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি জন্মদায়ক উন্নতির পথ আর সমকেন্দ্রিক সম ভাবনায় কল্যাণমুখি রাজনীতি জন্ম দেয় উন্নয়নের পথ। উন্নতির মধ্যে দিয়ে উন্নয়নের পথ খোঁজা তাই খুব জরুরি। 

অর্থাৎ, এমন অর্থনীতি চাই যেখানে ব্যক্তির উন্নয়নের মধ্যে দিয়ে সমষ্টির বিকাশ ঘটবে। সেই লক্ষ্য নিয়ে যে সমাজ চলবে তার রাজনীতিই ঠিক করে দেবে ক্ষমতার কল্যাণমুখি বণ্টন, এক কথায় যাকে বলে সাধারণের ক্ষমতায়ন। সেটা সমানভাবে হতে চাই যে শিক্ষা, তার প্রয়োজন সবার আগে। তবেই সমাজে কল্যাণমুখি ভাবনার জন্ম নেবে, চর্চা হবে এবং বিকাশ হবে এক নতুন সমাজের।


No comments:

Post a Comment