অথ টিকা-কাহিনি
প্রবুদ্ধ বাগচী
কোভিড-এর ভয়াবহ আশঙ্কা আর বিপর্যয় নিয়ে সদ্য যে-বছরটাকে আমরা ফেলে এলাম, তার একেবারে শেষ পর্বে আশার আলো ছিল একটাই যে সারা দুনিয়া জুড়েই রোগটির প্রতিষেধক আবিষ্কারের প্রয়াস একটা ইতিবাচক পর্যায়ে পৌঁছেছে। বেশ কিছু দেশ গত বছরেই প্রতিষেধক টিকার ব্যবহার শুরু করে দিয়েছিল, আমাদের দেশে তার শুভ সূচনা হয়েছে এক পক্ষকাল আগে। হয়তো এত অল্প সময়ের মধ্যে কোনও সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তের দিকে ঢলে পড়া সমুচিত নয়। তবে পাশাপাশি এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই, সকাল অনেক সময়ই জানিয়ে দেয় আমাদের দিনটা কেমন যাবে।
একটা কোনও রোগকে কেন্দ্র করে মহামারি বা অতিমারি অবস্থা তৈরি হওয়ার ঘটনা এই যে প্রথম হল এমন নয়। এর আগেও অনেক মারণ রোগ মানুষের সভ্যতাকে আক্রমণ করেছে, বহু মানুষের প্রাণ কেড়েছে- আবার বিজ্ঞানীদের মেধা ও নিষ্ঠার কাছে পরাজিত হয়ে সে সব জীবাণু পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছে। স্মল পক্স, ডিপথেরিয়া, কলেরা, প্লেগ, এমনকি অনেকাংশে যক্ষ্মা আজ আর কোনও মানুষের শরীরের পক্ষে দুষ্টগ্রহের মতো উৎপাত নয়, তাঁদের প্রাণ সংশয়ের কারণ নয়, সহজেই তাঁদের আমরা নিরাময় করে তুলতে পারি। কিন্তু কোভিড-১৯ চরিত্রে কিছুটা আলাদা। কেননা, একই সময়ে সারা দুনিয়ায় সে তার সাম্রাজ্য ছড়িয়ে ফেলেছে এবং এই প্রথম একটা রোগের আশঙ্কায় সারা পৃথিবী প্রায় বছরখানেকের জন্য একরকম থমকে রয়েছে, যার আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক প্রভাব সুদূরপ্রসারী। কথাটা আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও সমানভাবে সত্যি।
গত প্রায় এক বছর ধরে সারা দেশ গৃহবন্দী। আর্থিক কাজকর্ম হয় বন্ধ, নয়তো শ্লথগতি। বহু মানুষ কাজ হারাচ্ছেন, বহু মানুষ ছটফট করছেন কবে এই রাহুর প্রকোপ থেকে তাঁরা মুক্তি পাবেন। অনেকেই বেপরোয়া হয়ে রোগের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে বেরিয়ে পড়ছেন রুটি-রুজি-জীবিকার সন্ধানে। এই সময়কালে দেশে যখন টিকা দেওয়ার কর্মসূচি নেওয়া হল, সাধারণ বুদ্ধিতে মনে হয় দেশের আমজনতার পক্ষে এটা একটা স্বস্তির খবর। কিন্তু পাশাপাশি এটাও প্রশ্ন তুলে দেয়, টিকা দেওয়া শুরু হওয়ার পনের দিন কেটে যাওয়ার পরেও টিকা নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা কিছুতেই প্রার্থিত সংখ্যায় পৌঁছতে পারছে না। সরকারি উদ্যোগে বিনামূল্যে টিকা দেওয়ার কর্মসূচি চললেও অনেকেই তাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন, প্রতিদিনই আমরা শুনতে পাচ্ছি টিকা নেওয়ার হার যথেষ্ট কম। এমনটা ঘটল কেন? কোথাও কি একটা বিশ্বাসযোগ্যতার সমস্যা ঘটছে?
বিষয়টা একেবারে ফেলে দেওয়ার নয়। ভাবনাটা নাছোড়বান্দা হয়ে পায়ে পায়ে ঘোরে আরও এই কারণে যে মানুষ তো এতদিন রোগের আক্রমণের ভয়ে সিটিয়ে ছিলেন, নিজেদের আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করেও নিজেরা ঘরে বন্দী ছিলেন অথবা নিতান্ত জীবিকার প্রয়োজনে দিনের পর দিন প্রবল সতর্কতা ও আশঙ্কা নিয়ে পথে বেরিয়েছিলেন; তাহলে আজ যখন তাঁদের সামনে একটা প্রতিকারের পথ এসে দাঁড়িয়েছে তাকে তাঁরা এড়িয়ে যাচ্ছেন কোন বিচারে? যদি চাহিদা ও জোগানের সাবেকি তত্ত্বের কথা ভাবি তাহলে তো টিকার চাহিদা যথেষ্ট থাকার কথা এবং এই মুহূর্তে জোগানের কোনও অসুবিধে নেই। তবে সমস্যাটা কোথায়? সম্ভবত এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের একটু পিছিয়ে যেতে হবে, আর সেই সঙ্গে আরও একবার নজর রাখতে হবে বিগত সময়ে আমাদের দেশের রাজনীতির পটভূমির দিকে।
গত ছয়-সাত বছর ধরে আমাদের দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা যাদের হাতে কুক্ষিগত তারা তাদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক শাখা-প্রশাখা এবং অনুগত প্রচারমাধ্যমের সহায়তায় যে কাজটা করতে অনেকটাই সক্ষম হয়েছে তা হল- গোটা দেশ জুড়ে একটা বিজ্ঞান-বিরোধী (পড়ুন অবৈজ্ঞানিক) মতাদর্শ ছড়িয়ে দিতে পারা যা সফল হয়েছে ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারের প্রতি মানুষের যুক্তিহীন আস্থা তৈরি করতে। এমনিতেই আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনায় কোনওদিনই বলীয়ান ছিলেন না; তবু শিক্ষার বিস্তার, আংশিক চেতনার উন্নয়ন এবং কিছুটা বিশ্বায়নের সামাজিক প্রভাবে একশ্রেণির মানুষ আলোকিত হয়েছিলেন। কিন্তু গত কয়েক বছরে এই পিছিয়ে থাকা অংশের পিছিয়ে থাকাকে আরও স্থায়ী করার পাশাপাশি ওই আলোকিত অংশকেও অন্ধকারের দিকে টেনে আনা হয়েছে খুব কায়দা করে। গণেশের মাথার মধ্যে প্লাস্টিক সার্জারির বিজ্ঞান খুঁজে পাওয়া, পুষ্পক রথের মধ্যে যুদ্ধ বিমানের প্রযুক্তি আবিষ্কার কিংবা মহাভারতের সঞ্জয়-কথিত ধারাবিবরণীর মধ্যে ইন্টারনেটের উপস্থিতির প্রচার- এগুলো নিছক রাজনীতির নেতাদের মস্করা বলে ধরা ভুল। এর পেছনে আছে স্পষ্ট একটা দুরভিসন্ধি- নিকষ তামসিকতাকে সামাজিক রাজনৈতিক প্রামাণ্যতা প্রদান। দেশের কোনও কোনও রাজ্যের পাঠ্যসূচিতেও এই ধরনের আষাঢ়ে গপ্পোকে স্থান দেওয়া হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। বলা বাহুল্য, এটা একটা সংগঠিত প্রয়াস।
আমরা কেউই ভুলিনি, করোনা-সংক্রান্ত লকডাউনের গোড়ার দিকে জনতা কার্ফু নামে তালি বা থালা বাজানোর পরামর্শ, রাতের এক বিশেষ প্রহরে নিষ্প্রদীপ থাকার নিদান- ঘটা করে সারা জাতির উদ্দেশে এইসব বিজ্ঞান-বিরোধী নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এমন একটা ভাব করা হয়েছে যে ব্যক্তি-বিশেষের হাতযশেই নাকি দেশব্যাপী এই অতিমারির নিরসন সম্ভব; জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াইটা নাকি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের মতোই কুরু-পাণ্ডবের দ্বৈরথ। ইতিমধ্যে খুচরো নেতারা কেউ কেউ খোদ রাজধানী দিল্লির বুকে গোমূত্র-পার্টির আয়োজন করে প্রচার করেছেন, গোচোনা খেলেই নাকি কোভিড সেরে যায়, কেউ কোনও বিশেষ পাঁপড়ের বিজ্ঞাপন করেছেন কোভিড প্রতিষেধক বলে। এর প্রতিটিই একটা বিশেষ লক্ষ্যে পরিচালিত, দেশের মানুষ যাতে বৈজ্ঞানিক সত্যের ধারেকাছে না মাড়ান। অথচ যারা একটু আধটু সংবিধানের খবর রাখেন তাঁরা জানেন, বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাধারাকে প্রেরণা জোগানো আমাদের সংবিধানের নির্দেশাবলীর (ডাইরেক্টিভ প্রিন্সিপাল) অন্তর্ভুক্ত। চুলোয় যাক সংবিধান!
আমাদের আরও একটু মনে করে দেখতে হবে, টিকা নিয়ে সারা পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশেও যখন গবেষণা চলছিল, সংবাদমাধ্যমে বারবার উঠে আসছিল নানা খবর, প্রতিবেদন, তখনও কিন্তু কোনও বিজ্ঞানকর্মী বা গবেষকের নাম আমাদের সামনে সেভাবে আসেনি যেভাবে ও যতটা প্রচার করা হয়েছিল ‘আত্মনির্ভরশীল ভারত’এর মতো এক ‘খায় না মাথায় মাখে’ তত্ত্ব। টিভির সামনে আমরা সমানে দেখে চললাম রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী অথবা আমলার মুখ, কোনও গবেষক বিজ্ঞানীদের নয়। একটা সময় এমন প্রচারও হল যে স্বাধীনতা দিবসের দিনেই নাকি ভারতে টিকাপ্রদান কর্মসূচি চালু করে দেওয়া হবে। বিজ্ঞান নয়, নিবিড় গবেষণা নয়, এক ভুয়ো জাতীয়তাবাদী অস্মিতার আস্ফালন- বিজ্ঞান যাকে কোনওমতেই অনুমোদন করে না।
অবশেষে টিকা এল। তা নিয়েও ঘোর সংশয়। কোভিশিল্ড না কোভ্যাক্সিন। কার তৃতীয় ট্রায়াল এখনও পরীক্ষিত নয়, কার আবার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে বেশ কিছু মানুষ মারা গেছেন। সরকারের ভাষ্য লোকে আর তেমন বিশ্বাস করছেন না, সরকারকে ঘিরে অনেক প্রশ্ন আছে। কিছুটা স্তিমিত হয়ে আসা করোনা মহামারির পরিপ্রেক্ষিতে তড়িঘড়ি এই টিকার প্রচলন ও এ বছরের কেন্দ্রীয় বাজেটে তার জন্য ৩৫০০ কোটি টাকার সংস্থান নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। এর পিছনে অনেকেই বাহুবলী নেতার বাহাদুরি আদায় ও কর্পোরেট স্বার্থ- এই দুইয়ের জুতসই ককটেল খুঁজে পাচ্ছেন।
অন্যদিকে টিকা নিয়ে অবৈজ্ঞানিক ধারণাকে আঁকড়ে আছেন অনেকেই। এমনকি চিকিৎসকদের একটা মহল অবধি কোভ্যাক্সিন নিয়ে প্রতিরোধ করেছেন দিল্লির এইমস'এ। তাঁরা প্রশ্ন করেছেন আত্মনির্ভরতার বেলুন ঝুলিয়ে এই টিকা দেওয়া কতটা নিরাপদ। এই বিতর্ক তো উপেক্ষা করার নয়। খেয়াল রাখা দরকার, এই মুহূর্তে প্রথম দফায় মূলত স্বাস্থ্যকর্মী চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত কর্মী-আধিকারিকরা টিকার আওতায় রয়েছেন। এদের মধ্যে যদি টিকা নিয়ে সংশয় ও আড়ষ্টতা থাকে তার প্রভাব পড়বে পরের পর্যায়ে। টিকা নিয়ে এই দুরকম জিজ্ঞাসা- যার একদিকে স্পষ্ট অবৈজ্ঞানিক মানসিকতা, অন্যদিকে টিকার গুণগত মান নিয়ে ভাবনা- তার সবটাই ঘনিয়ে উঠেছে কেন্দ্রীয় সরকারের অভিসন্ধি ও অপরিণামদর্শী মানসিকতার পথ বেয়ে। এই সংশয় আর তার প্রতিকারের দায় একান্তভাবেই তাদের।
No comments:
Post a Comment