Tuesday, 28 April 2020

শিক্ষার হাল

কোভিড১৯ শিক্ষার সমস্যাকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলছে
সঞ্জয় মজুমদার
করোনা সন্ত্রাসের তৃতীয় পর্যায়, লকডাউন ৩.০, আমাদের দেশে কড়া নাড়ছে। এর মানে ২৫শে মার্চ ২০২০ থেকে শুরু করে গোটা এপ্রিল মাস, তারপর মে মাস, এবং জুন মাসের প্রথমার্ধ পর্যন্ত জমায়েত করে পড়াশোনা করা, মানে ক্লাসরুম লেকচার বলতে যা বোঝায়, সম্পূর্ণ বন্ধ। অর্থাৎ, মার্চ মাসের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে শুরু করে জুন ২০২০'র প্রথমার্ধ- পরিষ্কার তিন মাস প্রথাগত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদান পদ্ধতি স্তব্ধ। বারো মাসে তিন মাস, মানে একটা গোটা শিক্ষাবর্ষের এক-চতুর্থাংশ হাতের বাইরে চলে গেল এবং তা দুই-চতুর্থাংশে যে পৌঁছবে না, এমন আশ্বাসবাণী অতি বড় দুঃসাহসীও এই অবস্থায় শোনাবেন না।

সব পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মানে মুকুল বা মন্টেসরি থেকে আরম্ভ করে অতি উচ্চ-গবেষণাধর্মী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যন্ত সর্বস্তরেই এই তিন থেকে চার মাসের অপূরণীয় ক্ষতির অবশ্যম্ভাবী প্রতিফলন পরবর্তী শিক্ষাবর্ষগুলোতে পড়বেই। তিন থেকে চার মাস পড়াশোনা বন্ধ মানে মূল কার্যকরী সময়টাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া। যাঁরা শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা জানেন, এ এক অপূরণীয় ক্ষতি। কোনওভাবেই একে সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। এ বিষয়ে সরকারের উচ্চশিক্ষা দফতর কী পদক্ষেপ নেবেন বা সিদ্ধান্তের কথা শোনাবেন, তার জন্য দেশব্যাপী সকলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। ইতিউতি অনেক কিছুই শোনা যাচ্ছে। পরীক্ষা হতেও পারে নাও হতে পারে। হলে কেমন ভাবে হতে পারে, না হলেই বা ফল প্রকাশ কীভাবে হতে পারে, এইসব। পর্বত প্রমাণ চাপ যে দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছে, এটা একপ্রকার নিশ্চিত সবার কাছে। কিন্তু কিছু করারও নেই। মানুষ আগে প্রাণে বাঁচবে তারপর তো পড়াশোনা। কিন্তু আলোচনার গণ্ডি শহর ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থায় আটকে রাখলে শিকড় ছেড়ে গাছের মাথায় জল দেওয়ার মতো হবে। আমাদের দেশের ৭০ শতাংশ কিন্তু গ্রামীণ অর্থনীতির উপরে দাঁড়িয়ে আছে। কাজেই, সত্যান্বেষী হতে হলে শহর ছেড়ে গ্রাম-ভারতের চৌহদ্দিতে ঢুকতেই হবে।

করোনা ভাইরাসের আক্রমণ বা উদ্ভূত পরিস্থিতি ২০১৯-এর নভেম্বরে চীন থেকে শুরু হলেও বেশ বোঝা যাচ্ছে, এই অবস্থা পৃথিবী জুড়ে চলবে বেশ দীর্ঘ সময় ধরে। করোনা ভাইরাসের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে আমাদের সময় লাগবে। কিন্তু শুধু  *CO* rona *VI* rus- *19* বা সংক্ষেপে COVID-19 এর উপর ভারতের শিক্ষাব্যবস্থার বাস্তব পরিস্থিতির দায় চাপিয়ে দিলে প্রকৃত সমস্যাগুলোকে বোঝা যাবে না। COVID-19 পূর্ববর্তী গ্রাম-ভারতের দিকে একটু তাকালে অনেক কিছু চোখে পড়বে, যার মধ্যে অন্যতম মধ্যপথে পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়া বা স্কুল ড্রপ-আউটের সমস্যা এবং বলা ভালো প্রাথমিক শিক্ষার অঙ্গনে পৌঁছতেই না পারা। এই বিষয়ে 'একক মাত্রা'র 'একাকিত্ব' সংখ্যায় কিছু সমস্যার কথা উল্লেখ করেছিলাম উপযুক্ত তথ্য সমেত। যখন করোনাকে ঘিরে ইদানীংকালে আমাদের দেশে, সব কিছুর সাথে পড়াশোনা রসাতলে গেল বলে রব উঠেছে, তখন আবার এই প্রসঙ্গের অবতারণা করতেই হল।

National Family Health Survey-3 (NFHS-3)-র তথ্য অনুযায়ী আমাদের দেশে ৬ থেকে ১৬ বছর বয়সী জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশ প্রাথমিক শিক্ষা লাভের আশায় বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। ১৪ শতাংশ শিশু কখনও বিদ্যালয়ের সীমানায় আসতেই পারে না এবং ১১ শতাংশ বিভিন্ন কারণে পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। তার মানে ২৫ শতাংশ প্রাথমিক শিক্ষার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, যাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সরকারি স্তরে পর্যায়ভিত্তিক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার কথা এখনও জানা নেই। এই শিশুরা সরকারের খাতায় চিরস্থায়ী অশিক্ষিত হিসেবেই রয়ে যাচ্ছে, যাবেও। আর যে ৭৫ শতাংশ প্রাথমিক শিক্ষার বৃত্তে আসতে পারল, তাদেরই বা কার্যকরী শিক্ষা বা ন্যূনতম বিদ্যা বর্তমান পরিকাঠামোয় কতটুকু অর্জন হচ্ছে, যা কিনা পরবর্তীকালে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে কাজে আসতে পারে, সরকারি স্তরে তারও কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। হলে হবে, না হলে না হবে- এইরকম একটা ভয়ঙ্কর নীতিতেই দেশ চলেছে। অনিবার্য ফলস্বরূপ, ২০০০ সালের মধ্যে Universal Primary Education (UPE)-র যে স্বপ্ন সরকারি স্তরে দেখানো হয়েছিল, তা স্বপ্নই রয়ে গেল। এরপর রাষ্ট্রপুঞ্জ'এর স্পষ্ট নির্দেশিকা ছিল, ২০১৫ সালের মধ্যে ১০০ শতাংশ ছেলেমেয়েকে প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় আনতে হবে। অর্থাৎ, ১০০ শতাংশই প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডি সম্পূর্ণ করবে, যা কিনা সরকারি হিসেবে অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। আরও পাঁচ বছর পেরিয়ে আজ ২০২০ সালের এপ্রিল মাস চলছে। আমরা করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করছি। ভারতের প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়ক যে তথ্য ও বিষয়গুলো এতক্ষণ সামনে আনার চেষ্টা করলাম,  সে সব কিন্তু করোনা অতিমারী-র অনেক আগের। জনস্বাস্থ্য, অতিমারী কিংবা প্রাকৃতিক বিপর্যয় ইত্যাদি কোনও অজুহাতেই এই সার্বিক ব্যর্থতাকে আড়াল করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোগকে দূরেই সরিয়ে রাখলাম, যার হিসেব পরে কখনও হবে।

অতিমারী-র প্রকোপে আজ পৃথিবী দিশেহারা। ভারতের প্রাথমিক শিক্ষাঙ্গন তার বাইরে অবশ্যই নয়। যে আলোচনা চলছিল তার কারণগুলো একটু দেখে নেওয়া দরকার। কেন ৬-১৬ বছরের ২৫ শতাংশ শিক্ষাপ্রার্থী প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডিতে ঢুকতে পারছে না বা পারছিল না? 'পারছিল না' এই শব্দবন্ধনী ব্যবহার করলাম জেনে-বুঝেই। কারণ, পৃথিবীটা এখন করোনা পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী পর্যায়ে ভাগ হয়ে গেছে। যাই হোক, মোটা দাগে, প্রথাগত ও প্রথাবিহীন শিক্ষাক্ষেত্রে স্কুল ড্রপ-আউটের কারণগুলো ছিল এইরকম:

১) বাবা-মায়ের শিক্ষাস্তর;
২) পারিবারিক আয়;
৩) পারিবারিক পরিস্থিতি;
৪) সামাজিক অবস্থান;
৫) ধর্মীয় গোঁড়ামি;
৬) লিঙ্গ বৈষম্য;
৭) বিদ্যালয়ের দৈন্যদশা;
৮) পর্যাপ্ত দক্ষ শিক্ষকের অনুপস্থিতি;
৯) গুটিকয়েক শিক্ষকের উপরে পড়ানো ছাড়াও ক্রমবর্ধমান প্রশাসনিক কাজের চাপ;
১০) দারিদ্র্য ও অপুষ্টি।

খুঁজলে আরও অনেক যুক্তিযুক্ত কারণ নিশ্চয়ই বেরবে কিন্তু সে সব নিয়ে আলোচনার আপাতত দরকার নেই। বলার বিষয় এটাই, এই সমস্যাগুলো করোনা অতিমারীর আগেও ছিল এখনও আছে এবং করোনা পরবর্তী সময়ে সরকারি ও বেসরকারি স্তরে সময়োপযোগী যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে দেখা দেবে। কারণ, করোনা উদ্ভুত পরিস্থিতিতে গ্রামে ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিকদের কর্মহীনতা ও বেরোজগারির ঢেউ আর্থিক বৈষম্যকে অবধারিত বাড়িয়ে তুলবে। ফলস্বরূপ, উপরে উল্লেখিত ঐ ২৫ শতাংশের পরিমাণ আরও বাড়বে। বিপুল পরিমাণ মানবসম্পদ আমরা হারাব।

এই ব্লগে আগের একটি লেখায়, লকডাউন চলাকালীন পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। পরিস্থিতি প্রতি মুহুর্তে পরিবর্তনের ঢেউতে বেসামাল হচ্ছে। পরবর্তী আলোচনায় গ্রাম-ভারতে প্রাথমিক শিক্ষা সহ অন্যান্য বিষয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অবশ্যম্ভাবী প্রয়োগকে বাস্তব পরিস্থিতিতে বিচার করে আলোচনার চেষ্টা করব।

Monday, 27 April 2020

ষড়যন্ত্রের গল্প!

করোনা তাণ্ডব
অশোকেন্দু সেনগুপ্ত
- এটা কী তবে কোনও ষড়যন্ত্র?

বিল গেটস নাকি ২০১৫ সালেই জেনেছিলেন করোনা ভাইরাস এক মহামারী  হয়ে আসছে পৃথিবীতে। তিনি আমাদের সতর্কও করেছেন আবার তার সংস্থা এ সম্পর্কিত যাবতীয় জ্ঞানের 'পেটেন্ট'ও নিয়ে ফেলেছে। এ কী দূরদৃষ্টি  না ষড়যন্ত্র?  যদি বলি দূরদৃষ্টি তবে বলতেই হয় যে, মহামতি ট্রাম্পেরও দূরদৃষ্টি কম নয়। তিনি ধরে ফেলেছেন যে এমন মারণ ভাইরাস তৈরি হয়েছে চীনে আর তার অতি তৎপর গোয়েন্দাবাহিনী বা কম কীসে? তারা হার্ভার্ডের অধ্যাপক চার্লস লাইবারকে গ্রেফতার করেছে। অধ্যাপকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনিই নাকি চীনের হাতে এই ভাইরাস সৃষ্টির কৌশল তুলে দিয়েছেন,  পাচার করেছেন রাসায়নিক যুদ্ধের এই মারণাস্ত্র।

তবে, ট্রাম্প সাহেব এর আগে লিবিয়া, তারও আগে গড্ডাফির বিরুদ্ধেও রাসায়নিক যুদ্ধের ষড়যন্ত্রের  অভিযোগ এনেছিলেন, কিন্তু তা প্রমাণ করতে পারেননি। তা না পারলেও তিনি পৃথিবীতে  সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াতে সফল হয়েছিলেন বেশ কিছুটা। বাকিটুকুর দায়িত্ব নিলেন নরেন্দ্রভাই। দুজনেই জনসমর্থন পেয়ে ক্ষমতায় এসেছেন এবং ক্ষমতায় না এলে নেতা চেনা যায় না এমন গুজবকে সত্য প্রমাণে ব্যস্ত হয়েছেন। এরা এখন গণতন্ত্র ধ্বংসে ব্যস্ত। কেউ কেউ বলছে ওদের একজন যদি ঢ্যামনা তো অন্যজন ঢেমনি। কে ঢ্যামনা, কে ঢেমনি তা আমি জানি না অবশ্য। কিন্তু জানি তাদের ভারি মিল। একজন যেই প্রশ্ন তুললেন হু'র কার্যপদ্ধতি নিয়ে অন্যজন তারপরই বলে দিলেন হু-কে আর অর্থ সাহায্য দেবে না তারা। ট্রাম্প-অনুরাগী সংবাদমাধ্যম তো আগেই হু-র ডিরেক্টর জেনারেলকে ডিক্টেটর জেনারেল বলে হু-র সমালোচনা শুরু করে দিয়েছিল; করবে না কেন- ভদ্রলোক যে আমেরিকার পছন্দের প্রার্থীকে ভোটে হারিয়ে ঐ পদে এসেছেন। এ তো অন্যায়! তাই ভদ্রলোকের অপরাধের শেষ নেই। ট্রাম্প এখন তাঁর অপরাধের কাহিনি বলে চলেছেন- হু নাকি (মার্কিন বাজারের স্বার্থ না দেখে) চীনের স্বার্থ দেখছে বেশি। অভিযোগ গুরুতর। এদিকে লোক মরছে হাজারে হাজারে,  আমেরিকাতেও। তা মরুক, বাজার বাঁচলেই হল। একে কী মানুষের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলা যাবে না? এই ষড়যন্ত্রে কী মোদিভাই আছেন? তা জানি না। তবে তার দল যে আছে তা কে না জানে? তার দলেরই তো কেউ কেউ অতি উৎসাহে ঘন্টা, কাসর বাজাতে বাজাতে বলে বসল, 'আসছে বছর আবার হবে।' তাই হবে বুঝি!

আমার বাড়ির রাঁধুনি অবশ্য ষড়যন্ত্রের  কোনও খবর জানত না। এ বিষয়ে তার কোনও আগ্রহও নেই। বেচারা লকডাউনে বন্দী হয়ে আমার বাড়ি আসতে পারে না, বাজারে যেতে পারে না, খেতে পায় না। একদিন এক ঠেলাওয়ালা সব্জি নিয়ে এল তার উঠোনের পাশে। তবু, তার কেনা হল না সে সব্জি। তার আপনজনেরা বলে উঠল, ওর কোনও জিনিস কেনা যাবে না, ও যে মুসলমান।  লোকটা বলেছিল, আমি চাষি,  তোমরাও যদি ফেরাও তো বেচব কুথায়?  লোকটা যাবার সময় বলে গেছে আমাদের ওখানে সব চাষিই তো মুসলমান। ফসল যদি না বিক্রি হয় তো  আমরা আর চাষ করব না। কেন করব?

এ-ও কী ষড়যন্ত্র?  কে জানে? যারা এই সব গরিব খেটে খাওয়া মানুষ আর চাষির খাওয়া, আয়ের পথ বন্ধ করেছে তারা হয়তো জানে, আমি জানি না। আমি কেবল এটুকু জানি যে ট্রাম্প ও মোদিভাই মানবতার শত্রু, এরা যত দ্রুত ষড়যন্ত্র থামায় তত দ্রুত শান্তি ফেরে পৃথিবীতে। খেটে খাওয়া মানুষ কাজ পায়, খেতে পায়, তাতেই তো তাদের শান্তি, পৃথিবীর শান্তি।

Sunday, 26 April 2020

অনলাইন শিক্ষা নিয়ে আরও কিছু কথা

ভবিষ্যতের মানবসম্পদ
বিনয় কৃষ্ণ পাল

করোনা পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বেই আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় এক ব্যাপক পরিবর্তনের আভাস মিলছে। শিক্ষাক্ষেত্রও এর ব্যতিক্রম নয়। একদিকে দীর্ঘদিন যাবৎ স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে ঘরবন্দী থেকে করোনার প্রসার রোধ করা, অন্যদিকে সিলেবাস ও পড়াশোনার চাপে নতুন উপায় বের করার চেষ্টার ফল স্বরূপই অনলাইন ও ভিডিও কলের মাধ্যমে ক্লাস এই ক্ষেত্রে কিছুটা সুরাহা করেছে।

বর্তমানে অনলাইন ক্লাসের বিভিন্ন পদ্ধতি দেখা যাচ্ছে:
১) অডিও বা ভিডিও করে ইউটিউব অথবা হোয়াটসআপ'এর মাধ্যমে তা সবাইকে পাঠানো বা শেয়ার করা। এই পদ্ধতিটি ডেমন্স্ট্রেটিং বলে আলোচনা ও অংশগ্রহণের অভাব থেকে যায়;
২) অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ভিডিও কনফারেন্সিং (জুম বা গো টু মিটিংয়ের অথবা অন্য কোনও এপ্লিকেশনের মাধ্যমে);
৩) অডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে ক্লাস;
৪) লেখা শেয়ারিংয়ের  মাধ্যমে ক্লাস।

করোনা সমসাময়িক পরিস্থিতিতে অনলাইন ক্লাসই আপাতত পড়াশুনার উপায়। অসংখ্য ছাত্রছাত্রী যেমন এতে মানসিক ভাবে অংশগ্রহণ করছে, একইভাবে শিক্ষক-শিক্ষিকারাও কাজের মধ্যে সময়কে অতিবাহিত করছেন ও কাজে লাগাচ্ছেন। ক্লাসরুম শিক্ষার সুবিধা হল, এখানে শিক্ষক ও ছাত্রের সরাসরি সাক্ষাৎ হওয়ার ফলে ছাত্র-শিক্ষকের ক্লাসরুম আচরণ, শরীরী ভাষা, বাক্যালাপ, তর্ক-বিতর্ক প্রভৃতির মাধ্যমে শিক্ষক ও ছাত্রের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্র তৈরি থাকে। শিক্ষাদানকে শুধু দেওয়া নয়, শিক্ষা ও জ্ঞান লেনদেনের প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা হয়। অর্থাৎ, শিক্ষা অর্জন শুধু ছাত্রছাত্রীদের নয়, শিক্ষকদেরও। মোবাইল বা কম্পিউটারের মনিটরে দেখতে পাওয়া ছোট ছোট মুখ একজন শিক্ষককে তার ছাত্র-ছাত্রীদের মন, আগ্রহ, অনাগ্রহ বুঝতে সাহায্য করবে না।

শিক্ষকতার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ছেলেমেয়েরা অনেক জটিল ও কষ্টকর পরিস্থিতিতে আমাদের সামনে তাদের সমস্যা নিয়ে আসে। তাদের সামনে বা পাশে বসে কিছুক্ষণ গল্প করা, মন দিয়ে তাদের কথা শুনে পরামর্শ দেওয়া অনেক সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যের কথা বলতে গিয়ে বিবেকানন্দ বলেছেন, শিক্ষা হল মানুষের আচরণগত পরিবর্তন। এই অনলাইন ক্লাস আর্থিক ভাবে সাশ্রয়ী হলেও তা যে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যকে পূরণ করবে তা বোধহয় আমরা হলফ করে বলতে পারি না। অনলাইন ক্লাসের ক্ষেত্রে প্রথমেই ধরে নিতে হয়, ছেলেমেয়েরা সংসদীয় আচরণে যথেষ্ট পটু, প্রত্যেকেই যে ক্লাসে পড়ছে সেই ক্লাসের সিলেবাস, বই, বিষয়বস্তু গ্রহণের জন্য প্রস্তুত,  অন্যের প্রশ্ন বা সমস্যা শোনার পর নিজের সমস্যাও সহজেই বলবে, আলোচনায় অংশগ্রহণ করবে ও নিজের প্রয়োজন বুঝে নেবে। কিন্তু তা কতটা সম্ভব?

শিশু ও ছাত্রছাত্রীদের সামাজিকীকরণে  প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তাই একক ভাবে বাড়িতে অনলাইন ক্লাস করার মাধ্যমে সমাজের বিস্তৃত মানুষের সাথে মেশার যে সুযোগ তা কোনও ছাত্রছাত্রীকে বৈষয়িক জ্ঞান লাভে সাহায্য করলেও চারপাশের পরিবেশ, মানুষজন ও সমাজের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে। এ প্রসঙ্গে লেখকের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র জীবনের কথা মনে করা যেতে পারে- কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকা সব সময় উৎসাহ দিতেন প্রশ্ন করতে, সমালোচনা করতে, ওনার ক্লাসে যে বিষয় নিয়ে পড়াতেন সেই বিষয় নিয়ে আমাদের কথা বলতে ও আলোচনা করতে। কোনও কোনও শিক্ষক কঠিন তত্ত্বগত বিষয় পড়াতে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারতেন, কে বুঝতে পারছে না, কারও মনে প্রশ্ন আছে কিনা। এ পাওয়া একটু শান্ত, লাজুক, পিছিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীদের কাছে পরম সৌভাগ্যের। অনলাইন ক্লাসের ভয়েস নোট বা বহু সংখ্যক ছোট ছোট মুখ একজন শিক্ষকের কাছে তার ছাত্রছাত্রীদের সমস্যা প্রকৃতভাবে তুলে ধরতে পারবে কি?

খবরের কাগজ খুললেই দেখা যাচ্ছে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য সহজেই চুরি হচ্ছে ও তা অন্য কোনও কোম্পানি বা প্ল্যাটফর্মে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ তো শিক্ষক-ছাত্রছাত্রীদের মতো সাধারণ মানুষের কাছে এক অতল গহ্বর, এর হাত থেকে নিস্তার কোথায় ও কিভাবে তা আমাদের জানা আছে কি? বেঙ্গালুরুতে নার্সিং কলেজে পাঠরত এক ভাইয়ের থেকে একটি ঘটনা শুনে প্রায় তাজ্জব বনে যাওয়ার কথা। সেখানে পাঠরত অধিকাংশই বাঙালি, অন্যদিকে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অধিকাংশই কন্নড়। তাই, ভাষাগত পার্থক্যের জন্য ইংরেজিকেই শিক্ষণ মাধ্যম হিসেবে নেওয়া হয়েছে। লকডাউনকালীন সময়কে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে কলেজ কর্তৃপক্ষ ঠিক করলেন অনলাইনে ক্লাস করানো হবে, সেইমতো জুমে সব ব্যবস্থাও করা হল। ক্লাসের সময়ে শিক্ষিকাকে উদ্দেশ্য করে বাঙালি কিছু ছাত্র বাংলা ভাষায় কিছু অকথ্য গালাগাল ওই প্ল্যাটফর্মে দিয়ে মজা নিতে থাকল। শিক্ষিকা ও কলেজ কর্তৃপক্ষ ওই ক্লাসের রেকর্ডিং দেখে ও বাংলা ভাষী ছাত্রীর মাধ্যমে বিষয়টি জানার পর ওই ক্লাস নেওয়া বন্ধ করে দিলেন। ছাত্র শিক্ষক ক্লাসরুম ব্যবস্থায় প্রায়শই এক অদৃশ্য উচ্চতার ক্রম দেখা যায়, যেখানে শিক্ষক তুলনায় ক্ষমতার উচ্চতর স্থানে থাকেন ও ছাত্রছাত্রীদের স্থান তার নিচে। শিক্ষাক্ষেত্রে এই ক্রম যতই প্রকট হবে, অনলাইনে প্রযুক্তির অপ-ব্যবহারও ততই বেশি হওয়ার সম্ভবনা।

বিগত কয়েক বছর ধরেই কেন্দ্রীয় সরকার শিক্ষাকে অনলাইনমুখি করার উদ্দেশ্য নিয়েই বেশ কিছু প্রকল্প নিয়েছে। করোনা পরিস্থিতি সেই উদ্যোগকে বাস্তবায়িত করতে কয়েক ধাপ এগিয়ে দিচ্ছে। হয়তো এর গভীর উদ্দেশ্য শিক্ষাক্ষেত্রে কর্মসংস্থান কমিয়ে সরকারি ব্যয় সংকোচন ও শিক্ষার মর্মবস্তুর পরিবর্তন ঘটিয়ে তাকে বাজার ও চাকরিমুখি করে তোলা। দেশের এক বিশাল সংখ্যক মানুষের হাতে স্মার্টফোন পৌঁছলেও, টেলিভিশন ও ইন্টারনেট সংযোগ সহ কম্পিউটার এসে পৌঁছয়নি। তাছাড়া প্রযুক্তিগত সমস্যা, বিভাজন ও বৈষ্যমের কথাও ভুলে গেলে চলবে না। প্রান্তিক স্তরের মানুষ তথা ছাত্রছাত্রীদের কাছে এই প্রযুক্তি না থাকার ফলে এক বিশাল সংখ্যক ছাত্রছাত্রী এ ক্ষেত্রে যে বঞ্চিত হচ্ছে ও হতে চলেছে তা সহজেই অনুমেয়। করোনা পরিস্থিতি বর্তমান শিক্ষাক্ষেত্রকে অনলাইনমুখি করলেও তা যদি শিক্ষাদানের ভবিষ্যৎ হয়ে দাঁড়ায় সে ক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীদের কিছু বিষয় বলে-বুঝিয়ে-আলোচনার মাধ্যমে হয়তো কিছু কাজের জন্য উপযুক্ত করে তোলা যাবে, কিন্তু তাদের ভবিষ্যতের দায়িত্বশীল নাগরিক ও প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

Saturday, 25 April 2020

লকডাউন ও ডুবসাঁতার

অজস্র স্থবির বিন্দু
অমৃতা ঘোষাল

লকডাউনে আপাতত কলকাতার গঙ্গায় দূষণ নেই, দিল্লির যমুনায় বিষাক্ত ফোম নেই, মুম্বইয়ের বাতাসে ধুলোর আস্তরণ নেই। শুধু আপনার মনে নির্জনতা আছে। একবিংশ শতাব্দীর ষড়যন্ত্র, নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখার পরিকল্পনা কিংবা নিয়তির শিকার, যা-ই হোক না কেন, মোদ্দা কথা হল আপনি একা। 

প্রথমত, আপনি সিঙ্গল মাদার। তিন বছর আগে আপনার প্রেমিক যখন দুর্দান্ত সেক্স করেই অন্য একটা রিলেশনে জড়িয়ে পড়েন, তখন আপনি ঠিক কী অবস্থায়? প্রাইমারি টিচারের চাকরিতে জয়েন করলেন আর অবিবাহিত অবস্থায় মা হলেন। মা, বাবা, প্রেমিক, বন্ধু- কেউই আর যোগাযোগ রাখেনি। অসহায় 'সিঙ্গল' ভেবে একজন মধ্যবয়স্ক বিবাহিত লাইন লাগিয়েছিল। তার বুকে অনেক চুল আর দেহে অনেক ছদ্ম-দয়া থাকলেও চরিত্রে মনুষ্যত্ব ছিল না। তাই আপনার আর এগোতেও সাহস হল না। এখন দুপুরে সাদামাটা খিচুড়ি বসিয়ে একটাই চিন্তা আপনার মাথায় এল- যদি এক্ষুনি হাসপাতালে ভর্তি হন তাহলে বাচ্চাটা কোথায় থাকবে! আর যদি মরেই যান তখন! সরকারি অনাথ আশ্রমেই শেষ অবধি বাচ্চাটার গতি!

দ্বিতীয়ত, পেতলের ননীচোরা গোপালই আপনার সবচেয়ে বড় সম্পদ। পাড়ার ভোলা সপ্তাহে দুদিন চাল তেল দুধ আরও কী কী সব বারান্দার সামনে দিয়ে যায়। টাকাও নেয়নি এখনও। ও এখন কোনও কথা বলে না আপনার সঙ্গে। শুধু সমাজের কাজ করে। তাই আপনি সারাদিন একা একাই প্রলাপ বকেন। আজ  গোপালকে চান করাতে করাতে সত্তর বছরে এসেও আপনার হঠাৎ মনে পড়ে গেল, আপনি বাঁজা মহিলা। এটা আপনার পাপ। মানুষের সব পাপ কিভাবে ধোয়া যায়! দুধ নাকি গঙ্গাজলে! আপনি তো সেই চেষ্টা অনেকবারই করে দেখেছেন। এমনকি সকালে নিয়ম করে গোমূত্র খাওয়াও শুরু করেছিলেন। এবার আপনি ভাবলেন লকডাউনে এত লোকে মরে, আপনি মরেন না কেন! আচ্ছা, আপনি মরলে ঠাকুর-গোপালের নিত্যসেবা করবে কে!

তৃতীয়ত, লকডাউনে আপনার লিভ-ইন পার্টনার ভেগে গেছে। আপনার স্টুডিও ফ্ল্যাটটায় আপনি একা। সোনা গার্লফ্রেন্ড নিজের পুরো মাল-কড়ি নিয়েই পালিয়েছে যখন, আর ফিরবে বলে বোধ হয় না। ফলে, যাবতীয় খরচা অনির্দিষ্ট সময়ের জন্যে আপনার একার ওপর। নো নাইটক্লাব, নো এক্সট্রিম প্লেজার। নীল ছবি, পানু গল্প খুব বোরিং। উপায় একটা করা আছে। আলমারির এক কোণে গার্লফ্রেন্ডের চোখ বাঁচিয়ে ব্যাগপ্যাকে রেখেছেন বেবি ডল, সঙ্গে একটা ছোট রবারের আর্টিফিশিয়াল ভ্যাজাইনা। কিন্তু লকডাউন না উঠলে এই মালে আর আপনার কত দিন চলবে !

চতুর্থত, লকডাউনে আপনার বাচ্চার আয়া বীণা বা বিনিমা আসছে না। আপনার অফিস ছুটি। সকালে বর বাচ্চার মন জয় করতে পিৎজা বানিয়েছেন। বর নেটফ্লিক্স দেখতে দেখতে দিব্যি খেয়ে নিল। কিন্তু কী অসভ্য হয়ে গেছে বাচ্চাট! বিনিমার হাতের মাখা মুড়ি, গরম দুধ, বাতাসা, কলা খাওয়ার জন্যে আপনার বাচ্চা কাঁদছে। কী ডিসগাস্টিং! কলকাতার টপ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করা বাচ্চার  কিনা এসব খাওয়ার রুচি! কান্না থামাতে অনলাইনে আনানো সসেজ ফ্রাই করে দেন। বাচ্চা তা-ও খায় না, বলে বিনিমার মতো চিড়ে ভাজা করে দাও। আপনার ইংরেজি সেন্টেন্স বলতে শুরু করা বাচ্চাকে বিনিমা লো-মিডল ক্লাস বানিয়ে ফেলেছে! সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, লকডাউনে বাচ্চাকে একটু স্মার্ট বানিয়ে ফেলবেনই। তবু বাচ্চা সসেজ, পিৎজা, নুডুলস, পাস্তা, পেস্ট্রিকেক ইত্যাদি ভুলে কার্পেটের ওপর দু' পা ছড়িয়ে কাঁদতে লাগল। আপনি চুপ করাবার জন্যে মোবাইলে কার্টুন চালিয়ে বাচ্চার হাতে ধরিয়ে দিলেন! সসেজে এক কামড় বসিয়ে এবার ভাবতে লাগলেন, ওই গাঁইয়া আয়া কত দিনে আসবে, আপনি ওর লুকিয়ে মুড়ি-চিড়ে-খই-বাতাসা আনা চিরতরে বন্ধ করে দেবেন।

প্রত্যেকের গল্প আলাদা। মিল শুধু একাকিত্বের সুতোয়। এই আমরা যারা একা অথচ কোনও না কোনও ভাবে মধ্যবিত্ত সমাজের একটা ছোট অংশ, প্রত্যেকে নিজের ভবিষ্যৎ চিন্তায় মগ্ন। যারা সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেকে অবিরাম পরিবারের মধ্যেই প্রকাশ করে চলেছি, তারাও কিন্তু একাকিত্বে ভুগছি। কারণ, পূর্ণতাকে যে প্রতিক্ষণে প্রমাণ করার প্রয়োজন হয় না। দেশে কত মানুষ পরিযায়ী শ্রমিক, কত মানুষ ছাদ খুঁজতে গিয়ে ওভারব্রিজের তলায় পুলিশের খেদানি খেয়েও টিকে আছে- সে সব ভাবতে আমাদের বয়ে গেছে। তার চেয়ে অনলাইনে মশালা ওটস থেকে দামি নাইট ক্রিম কিংবা চিজ স্প্রেড থেকে ডটেড কন্ডোম সার্চ করা অনেক সুখপ্রদ। 

মধ্যবিত্ত আসলে ইকোনমিক্স কিংবা ইকোক্রিটিসিজম কোনওটারই ধার ধারে না। শুধু জানে আত্মরতিকে কিভাবে জিইয়ে রাখতে হয়! প্রথম উদাহরণে যেমন মধ্যবিত্ত সমাজই দু'টো প্রাণীকে একেবারে একা করে দিয়েছে! আর লকডাউন পিরিয়ডে এই 'একা করা' আর 'একা হওয়া'র প্রবণতাগুলো সমাজে এক ভয়ঙ্কর ক্যান্সারের জন্ম দিয়ে চলেছে। এক একটি স্থবিরতার কোষ বিভাজিত হয়ে জন্ম দিচ্ছে অজস্ৰ স্থবির বিন্দু। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের 'সমুদ্রের কাছে এসে' কবিতার শেষ লাইনটার মতো তাই লকডাউনেও একাকিত্বে তলিয়ে যাওয়া প্রতিটি মানুষকে মনে করিয়ে দেওয়া যায়- 'তুমি না মানুষ! বেশ কিছুদিন সাঁতার শিখেছো!' আর সাঁতার না জানলে অন্তত ভেসে থাকো।
 

Thursday, 23 April 2020

অনলাইনে লেখাপড়া

কিছু অস্বস্তিকর প্রশ্ন
অশোকেন্দু সেনগুপ্ত
শিক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. সমীর ব্রহ্মচারী আমাদের কাজের একেবারে গোড়ায় রাজ্য সরকারের কাছে কিছু তথ্য চেয়েছিলেন। কিছু পেয়েছিলেন, কিছু পাননি। তিনি চেয়েছিলেন রাজ্যের মোবাইল টাওয়ারগুলির একটি মানচিত্র। তার পাশে রাখতে চেয়েছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থান সম্বলিত তথ্য। দুয়ের তথ্য মিলিয়ে দেখলে বোঝা সম্ভব হবে যে রাজ্যের কোথায়, কেন এবং কত প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র তথা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রয়োজন রয়েছে। তখন তো আমাদের অনেকেরই মনে হয়েছিল যে প্রস্তাবটি অভিনব এবং অনেকটাই অবাস্তব।

এমন আর একটি অভিনব প্রস্তাব তিনি দিয়েছিলেন; বলেছিলেন, এই রাজ্যের সরকারি কলেজগুলি নিয়ে গড়া হোক একটি Meta University (অনেকটা CSIR ধাঁচে)। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ আর গবেষণাগারগুলি জুড়ে দেওয়া হোক ইন্টারনেটের মাধ্যমে যাতে তার সুফল পেতে পারে রাজ্যের সব শিক্ষার্থী। রাজ্য শিক্ষা কমিশন চায়, এভাবে যেন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুযোগ নিয়ে এই রাজ্য দ্রুত দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে  প্রথম সারিতে আসতে পারে। অনুমান  করি যে, রাজ্য সরকার কমিশনের প্রস্তাবের কিছ মেনেছেন, কিছু মানেননি। কোনটা কতখানি মানলেন সরকারও জানায়নি, বিরোধীরাও জানতে চায়নি। লকডাউন সত্যকে চেনার ও বোঝার কিছু সুযোগ দিয়েছে আমাদের। এখন দেখছি, স্কুল-কলেজে অনলাইন লেখাপড়ায়  তথা প্রযুক্তি ব্যবহারে জোর পড়েছে। যেদিন মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করলেন স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকবে ‘করোনা তাণ্ডব’ এড়াতে, সেদিন থেকে পড়াশোনা পুরোপুরি বন্ধ হতে পারত যদি না শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা লেখাপড়াটা হোক চাইতেন। তাদের চাওয়াতেই মূলত লেখাপড়া শুরু হল তবে তা হল টেলিভিশন সেট আর ইন্টারনে্টের মাধ্যমে, নতুন গড়ে ওঠা ডিজিটাল মঞ্চ থেকে। 

অন্তত শিক্ষাক্ষেত্রে এই মঞ্চের ব্যবহার নতুন। অধ্যাপকরা ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমের সাহায্য নিয়ে পড়াতে শুরু করলেন। তার ভালোমন্দ বিচার-বিবেচনা শেষ হবার আগেই শিক্ষা দফতরের কর্তাদের মনে হল বুঝি, সব ঘোষণাই মুখ্যমন্ত্রী করবেন কেন? মুখ্যমন্ত্রী এর মধ্যে শিক্ষকদের শিক্ষাব্যবস্থা সচল রাখার আবেদন জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি সিদ্ধান্ত নেবার আগেই তিনি এই রাজ্যের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা স্থগিত করেছেন। শিক্ষা দফতরই বা পিছিয়ে থাকে কেন, শুরু হল যেন রেষারেষি। তাঁরাও শিক্ষকদের নির্দেশ দিলেন, ‘আগে বড়ো’। সেই সঙ্গে একটি টিভি চ্যানেলের সঙ্গে কথা সেরে  ফেললেন মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাদানের জন্য। শিক্ষা দফতরের নিজস্ব প্ল্যাটফর্ম বন্ধ হল কার্যত।  শিক্ষকরা তৈরিই ছিলেন, নেমে পড়লেন অনলাইন শিক্ষাদানে। এরপর শিক্ষা দফতর আরও একটি চ্যানেলের সঙ্গে আরও একটি ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রাথমিক ও উচ্চপ্রাথমিক স্তরের শিক্ষার আয়োজন করল।

আর যেন এড়িয়ে থাকা গেল না। কিছু প্রশ্ন, অন্তত এরপর, স্পষ্ট হয়ে সামনে এল। যেমন, অনেকেই মনে করলেন যে, এতে গ্রাম তথা দুর্গম অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের অসুবিধাই হল। প্রশ্ন উঠল, গ্রাম প্রধান এই দেশে কতজন শিক্ষার্থী এই ব্যবস্থার সুযোগ নিতে পারে? সবার কাছে স্মার্টফোন বা সর্বত্র তো ইন্টারনেট পরিষেবা নেই! তারা বঞ্চিত হবে কেন? মফস্বলের শিক্ষকরাই বা শিক্ষাদানের এমন সুযোগ পাবেন না কেন? আরও বড় যে প্রশ্ন সামনে এল তা হল এই যে, এতে কী শ্রেণিকক্ষ গুরুত্ব হারাল? এভাবে কী হাজার হাজার শূন্য শিক্ষকপদ আর পূরণ করার প্রয়োজন থাকবে না? অন্যদিকে প্রাক-প্রাথমিক তথা শিশুশিক্ষার কী হবে, তাও ভাবাল।

সব স্তরের সবার শিক্ষার দায় নিশ্চয় শিক্ষা দফতরের। তবু, শিশু আয়োগেরও কিছু দায় থাকে। দেখাশোনা তথা তদারকির দায়। তারা কী দেখবে না ? এতে সমাজের কল্যাণ হবে তো?

প্রশ্নগুলি যতই অস্বস্তিকর হোক, উত্তরগুলো কিন্তু একেবারে অজানা নয়। লকডাউন যেমন চিরদিনের জন্য নয়, তেমনই সমাজ জানে– সব দেশে ও সব কালে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম কখনই শিক্ষক ও শ্রণিকক্ষের বিকল্প হতে পারে না। তাই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার একটা আপৎকালীন ব্যবস্থা হতে পারে, চিরকালীন ব্যবস্থা হতে পারে না। যা অজানা তা হল, এই দুয়ের সমন্বয়-সাধন কোন পথে? এই সমন্বয় একান্ত জরুরি, তাই তার পথ সন্ধানও জরুরি।  শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে কিছু সংকেত আছে, তবে তা যথেষ্ট নয়। এখন সময় এসেছে যাবতীয় সংকেতের মর্ম উদ্ধার করার।

Tuesday, 21 April 2020

সার্ধ শতবর্ষে

'ক্লীবতার কাছে নেই ঋণ...'
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
(২২ এপ্রিল ১৮৭০ - ২১ জানুয়ারি ১৯২৪)
এমন একটা গল্প (হয়তো সত্যি) চালু ছিল অনেকদিন। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের গোড়ার বছরগুলির কথা। ফিনল্যান্ড তখন জার সাম্রাজ্যের অধীন। সেখানে একটি জনবহুল রেস্তোরাঁয় এক তরুণ একা একা বহুক্ষণ বসে থাকেন। কারও সঙ্গে তাঁর তেমন কথা নেই। এক বয়স্ক খদ্দের তা লক্ষ করে সেই তরুণের সঙ্গে ভাব জমান। সুযোগ মতো একদিন জিজ্ঞেস করেন, 'তোমায় তো কখনও এ তল্লাটে আগে দেখিনি। তা তুমি এখানে এসে চুপচাপ প্রায় সারাদিন বসে থাকো। কেন বলো তো?' সে যুবক মৃদু হেসে প্রশ্নটি এড়িয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে যান।

যেদিন থেকে সে যুবককে ওই রেস্তোরাঁয় আর কোনওদিনও দেখা যাবে না, ঠিক তার আগের দিন সন্ধ্যেবেলা সেই বয়স্ক লোকের প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি- 'আসলে আমি এখানে মন দিয়ে শুনি সকলে কী আলোচনা করেন, ভাবেন।' বিস্মিত চোখে প্রশ্নকর্তা জিজ্ঞেস করেন, 'কেন?'

- 'রাশিয়ায় আমি এক আগুয়ান বিপ্লবের স্বপ্ন দেখছি। এখানে বসে মানুষের কথা শুনে বোঝার চেষ্টা করছি বিপ্লবের সম্ভাব্যতাকে।'

পরদিন থেকে সে যুবককে আর সেই চত্বরে দেখা যায়নি।

এই যুবক ভ্লাদিমির ইলিচ উইলিয়ানভ। ফিরে এসেছিলেন রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডে। আত্মগোপন কালে ফিনল্যান্ড থেকে প্রাথমিক প্রস্তুতি নিয়েছিলেন বিপ্লবের। ১৯১৭'র নভেম্বর বিপ্লব হয়েছিল তাঁর নেতৃত্বে। তখন তিনি লেনিন নামে বিশ্বখ্যাত। সে এক যুগান্তকারী ঘটনা ও সময়।

কিন্তু প্রশ্ন হল, আজ তাঁর জন্মের সার্ধশতবর্ষে ও সোভিয়েত বিপ্লবের শতবর্ষ পরে তাঁকে আমরা কীভাবে স্মরণ করব? তাঁর প্রাসঙ্গিকতাই বা কোথায়?

অল্প কথায় বললে- তাঁর জীবনকালে সোভিয়েত বিপ্লবের প্রস্তুতিতে ও সোভিয়েত সমাজ গঠনে তাঁর উদ্ভাবিত চিন্তাবীজের মধ্যেই তাঁর প্রাসঙ্গিকতা লুকিয়ে আছে। যার মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হল কমিউনিস্ট পার্টির প্রসঙ্গ। আর সে বিষয়ে তাঁর অনুশীলন ও ভাবনাকে অন্ধভাবে অনুসরণ কর‍তে গিয়েই আজ সোভিয়েত পতন ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের চূড়ান্ত পশ্চাদপসরণ। এই স্বল্প পরিসরে বরং সেটুকুকেই বুঝে নেওয়া যাক।

'গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা' নামক যে শব্দযুগল আমরা কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালনা প্রসঙ্গে শুনি তার উদ্ভাবক লেনিন। কিন্তু সকলে ভুলে যান, জারের স্বৈরাচারী শাসনের অধীনে গোপনে বিপ্লবী কাজকর্ম পরিচালনার জন্য কেন্দ্রিকতাই ছিল সে সময়ে ফলপ্রসূ ও কার্যকরী একটি উপায়; যার গড়ে ওঠার ভিত্তিটি বরং হতে পারে গণতান্ত্রিক। তা কেমন? বলা হল, পার্টি সম্মেলন বা কংগ্রেসে নানা তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে যা উপলব্ধ বা গৃহীত হল, পরবর্তী পর্যায়ে তার ওপর পার্টি নেতৃত্বের পূর্ণ কমান্ড থাকবে। অর্থাৎ, পার্টির কেন্দ্র এরপর যা বলবে, তাই আপাত শিরোধার্য করতে হবে, যতক্ষণ না আবার পরবর্তী কংগ্রেস বা সম্মেলনে নতুন কোনও সিদ্ধান্ত বা নীতি গৃহীত হচ্ছে। কিন্তু, এই নিদান ছিল স্বৈরাচারী জারের শাসনে বিপ্লবকালীন পরিস্থিতির জন্যই। অথচ পরে, সর্বতোভাবে এই 'গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা'কেই সাধারণ নিয়ম হিসেবে এক মৌলবাদী উদ্দীপনায় মান্য করে নেওয়ার ফলে সমাজতান্ত্রিক দেশে ও অন্যত্র কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে ধীরে ধীরে গণতন্ত্রের মৌলিক শর্তগুলিই ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার অর্থ হয়ে দাঁড়াল, উচ্চ নেতৃত্ব তথা কেন্দ্রীয় কমিটি তথা পলিটব্যুরো তথা সাধারণ সম্পাদক- যার কথাই প্রথম ও শেষাবধি শিরোধার্য শুধু। আর এরই পরিণতিতে আমরা পেলাম অতীতে কাম্পুচিয়ায় পল পট বা আজকের উত্তর কোরিয়ায় কিম-জন-উঙ'কে। সর্বোচ্চ নেতৃত্বে থেকে মাওসেতুঙ'কেও তাই আওয়াজ তুলতে হয়েছিল- সদর দফতরে কামান দাগো।

অথচ সোভিয়েত বিপ্লবের পর পুঁজিবাদী দেশগুলো কিন্তু এই বিপদ বুঝে নিজেদের গণতন্ত্রের বনিয়াদকে আরও প্রসারিত করে। ১৯১৭-২০ সালে যেখানে সোভিয়েত ইউনিয়নকে অন্যান্য সব দেশের তুলনায় অনেক বেশি গণতান্ত্রিক ও কাঙ্ক্ষিত বলে বোধ হচ্ছিল, সেই দেশই কিন্তু ১৯৭০-৮০'র দশক থেকে প্রত্যক্ষত বদ্ধ, রুদ্ধ এক দমবন্ধ দেশে পরিণতি পেল। এর সঙ্গে সঙ্গে সে হারালো অর্থনীতির নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার তাৎপর্যকেও। লেনিনের জীবিতকালে 'ওয়ার কমিউনিজম' ও 'নিউ ইকনমিক পলিসি'- সময়ের পরতে এই দুই বিপরীতধর্মী অনুশীলনের মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন কিন্তু তখন নানান অর্থনৈতিক উদ্ভাবনের পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। পরে অর্থনীতির এই বৈচিত্র্যময় ধারার অনুশীলনটিও লুপ্ত হয়।

অর্থাৎ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক- এই দুই পরিসরেই লেনিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন যে যুগান্তকারী পট পরিবর্তন ও নতুন যুগের সূচনা করেছিল তা পরবর্তীকালে আর সজীব রাখা যায়নি। এর অন্যতম কারণ, যা ইতিহাসে বহুবার পরিলক্ষিত হয়েছে, তা এক কথায়: অমোঘ, মেধাবী ও প্রখর ব্যক্তিত্বের যান্ত্রিক ছায়া ও উচ্চারণ থেকে সময়ের অবগাহনে পরবর্তীকালে অনুরাগীদের বিযুক্ত হওয়ার সমস্যা। যে কারণে নিজের অনুরাগীদের দেখে এমনকি মার্কসকেও বলতে হয়েছিল: Thank God, I am not a Marxist.।

লেনিনকে যান্ত্রিকভাবে বোঝার মধ্যেই লেনিনবাদীদের সমস্যা লুকিয়ে। যদি তাঁরা বুঝতেন, লেনিনের 'গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা' কোনও আক্ষরিক বাধ্যবাধকতা নয়, বরং গণতন্ত্র অনুশীলনের একটা উত্তরণশীল পর্যায় মাত্র, তাহলে গণতন্ত্রের পরীক্ষায় কমিউনিস্ট আন্দোলনকে হয়তো এত ল্যাজেগোবরে হতে হত না।

মাত্র ৫৪ বছরের জীবনে, যার মধ্যে একটা বড় পর্যায় গেছে আত্মগোপন করে থাকা ও সাংগঠনিক কাজের খুঁটিনাটিতে, বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর মধ্যে সব থেকে বেশি লিখেছেন যা তৎকালীন সোভিয়েত প্রকাশনায় ৫৫টি সংকলনে বিধৃত হয়ে আছে। তিনি উল্টোপথে হাঁটা এক প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ, এক অত্যাশ্চর্য মানসচক্ষু দিয়ে বিশ্বকে শোষণমুক্ত করার দৃষ্টি অর্জন করে তাকে হাতেকলমে বাস্তবায়িত করে সদর্থক প্রয়াস রেখেছিলেন- একাধারে চিন্তক, দার্শনিক, জননেতা ও কর্মী, এ হেন যুগপুরুষ বিশ্ব ইতিহাসে বিরলতম। যতদিন পুঁজিবাদ আছে ততদিন তিনি প্রাসঙ্গিক- নানা অর্থে, নানা অনুশীলনে; তাঁকে বোঝার মধ্যে, তাঁর সঙ্গে তর্কে-বিতর্কেও।

লেনিন সম্পর্কে গান্ধী বলেছিলেন, 'বলশেভিক আদর্শের পেছনে যে অগণিত নরনারীর পবিত্রতম আত্মত্যাগ ছিল তা নিঃসন্দেহে সংশয়াতীত। এই আদর্শ পবিত্র হয়েছে লেনিনের মতো মহান মানুষদের আত্মত্যাগে যা কখনও বিফলে যাবে না।' (ইয়ং ইন্ডিয়া, ১৫ নভেম্বর ১৯২৮)।

Monday, 20 April 2020

নজরবন্দী জীবন

একনায়কের তথ্য ভাণ্ডার
সোমনাথ গুহ

এটা ভাবতে আশ্চর্য লাগে যে আমেরিকায় লকডাউন বিরোধী একটা ছোট বিক্ষোভ ছাড়া বিশ্বের প্রায় দুশোটি দেশের মানুষ আজ রাষ্ট্রের যে কোনও নির্দেশ নির্দ্বিধায় মেনে নিচ্ছে। এটাই যেন স্বাভাবিক, দ্য নিউ নরম্যাল। যুগ যুগ ধরে কষ্টার্জিত স্বাভাবিক অধিকারগুলির ওপর সাময়িক স্থগিতাদেশ আমরা মেনে নিয়েছি; বাকস্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা সব আমরা বিনা প্রতিবাদে, নীরবে রাষ্ট্রের এক কথায় স্বেচ্ছায় ত্যাগ করেছি। আমরা ঘরবন্দিত্ব মেনে নিয়েছি, আমাদের চলাফেরার ওপর যে বেড়ি লাগানো হয়েছে মেনে নিয়েছি, স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে আমাদের শিক্ষার অধিকার যে হরণ হচ্ছে তা মেনে নিয়েছি, কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে আমাদের রুটিরুজি যে বিপন্ন হচ্ছে তাও মেনে নিয়েছি, শান্তিপূর্ণ জমায়েতের ওপর নিষেধাজ্ঞা সেও আমরা মেনে নিয়েছি। আমরা কখন কোথায় যেতে পারব, কোথায় যেতে পারব না, কোন কাজটা করতে পারব, কোনটা পারব না, সব কিছুই হবে রাষ্ট্রের অঙ্গুলি হেলনে। 

এটা অভুতপূর্ব। আমাদের যাপনের ওপর রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আমরা মুখ বুজে মেনে নিয়েছি। আমরা কোনও প্রতিবাদ তো করিইনি বরং আমরা নিজেদের বোঝাচ্ছি, অন্যদেরও বোঝাচ্ছি যে যা করা হচ্ছে তা ঠিকই হচ্ছে, আমাদের স্বার্থেই হচ্ছে, আমাদের জীবনরক্ষার জন্য করা হচ্ছে। উদারনৈতিক গণতন্ত্রের পীঠস্থান পশ্চিম ইউরোপ, আমেরিকা, এমনকি আদর্শ কল্যাণমূলক রাষ্ট্র ডেনমার্ক থেকে কম্যুনিস্ট চিন, স্বৈরতান্ত্রিক রাশিয়া, মৌলবাদী ইরান, ফ্যাসিবাদ-প্রবণ গণতান্ত্রিক ভারত  এবং পূর্ব এশিয়ার রক্ষণশীল এবং কর্তৃত্ববাদী গণতান্ত্রিক দেশ- ছবিটা সর্বত্র এক। মানুষের এই স্বাভাবিক অধিকারগুলো যে হরণ করা হয়েছে এর জন্য কোথাও কোন উল্লেখযোগ্য বিক্ষোভ হয়েছে এমনটা শোনা যায়নি। ভারতে পরিযায়ী শ্রমিকরা ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য, ভালো আশ্রয়, খাদ্য, পরিবারের কাছে টাকা পাঠানোর জন্য ক্ষোভে ফেটে পড়েছে, কিন্তু লকডাউন তুলে নিতে হবে এই দাবি কিন্তু কোথাও করেনি। শুরুতে কিছু ধর্মীয় সম্প্রদায় নিষেধাজ্ঞা না মেনে জমায়েত করেছে কিন্তু ধীরে ধীরে মানতে বাধ্য হয়েছে যে তাদের ভালোর জন্যই এত কড়াকড়ি করা হচ্ছে।

করোনা ভাইরাসের বিষাক্ত ছায়া যদি সারা পৃথিবী জুড়ে বিস্তৃত না হত তাহলে কি মানুষ এত সহজে রাষ্ট্রের নিদান মেনে নিত? এই তো মাত্র তিন মাস আগে নাগরিকত্ব বিল নিয়ে বিভিন্ন শহরে, কলেজে পুলিশের সাথে প্রতিবাদীদের খন্ডযুদ্ধ হয়েছে। প্যারিসে প্রতি শনিবার ‘ইয়েলো ভেস্ট’ আন্দোলনকারীদের নিয়ম করে জমায়েত হয়েছে, চিলির রাস্তায় নারীরা নিরাপত্তার দাবিতে মুখর হয়েছে, হংকংয়ে চিনের খবরদারির বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে। সব নিস্তব্ধ, সবাই ঘরে ঢুকে গেছে। মৃত্যুভয়! সে বড় সাংঘাতিক ভয়। এর অর্থ তো এই যে শুধুমাত্র জীবনের ভয় দেখিয়ে রাষ্ট্র লাখো জনতাকে তার কর্মসূচিতে শামিল করতে পারে। আর যদি মারির ভয় প্রলম্বিত হতে থাকে তাহলে এই সব নিষেধাজ্ঞাও অন্তহীন ভাবে বলবৎ থাকতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) কিন্তু বারবার চেতাবনি দিচ্ছে যে প্রকৃতিকে মনুষ্য প্রজাতি গত কয়েক শতক ধরে এত নির্মম নিপীড়ন করেছে যে এইরকম অতিমারি বারবার আসতে পারে। আর এখনই তো নতুন কোনও মহামারি বা নতুন ভাইরাসের প্রয়োজন নেই কারণ কোভিড-১৯ যেখানে নিয়ন্ত্রণে আসছে সেখানেও সতর্ক করা হচ্ছে এর কিন্তু দ্বিতীয়, তৃতীয় ঢেউ আসতে পারে এবং সেগুলো আরও মারণঘাতি হতে পারে। প্রচলিত মিডিয়া এবং ডিজিটাল ও অ-ডিজিটাল সব সংবাদ মাধ্যমে যদি অষ্টপ্রহর এই মারি কত বিপজ্জনক ইত্যাদি ফাটা রেকর্ডের মতো বাজতে থাকে তাহলে সম্মতি নির্মাণ কী করে হয় সেটা জানার জন্য আর চোমস্কি পড়তে হয় না। মাপ করবেন, আমি কিন্তু কোনও চক্রান্তের কথা বলছি না। কোনও ঘটনা বোধগম্য না হলেই আমাদের সেটার মধ্যে একটা ষড়যন্ত্র খুঁজে পাওয়ার বাতিক আছে। আমি শুধু বলতে চাইছি, ক্ষমতাশালী মহল কোভিড-১৯ জনিত উদ্ভুত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে নিজেদের গুপ্ত অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়িত করতে চাইছে।

এই অ্যাজেন্ডার অন্যতম হচ্ছে ব্যক্তির সমস্ত কার্যকলাপের ওপর রাষ্ট্রের নজরদারি কায়েম করা। এটা লক্ষণীয় যে রাষ্ট্র যত কর্তৃত্ববাদী তারা তত ভালো করে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। এর সোজাসাপটা অর্থ হল, কোনও বিপর্যয়ের সময় মানুষ দাপুটে শাসকের ওপর বেশি আস্থা রাখে। মারির রাশ টেনে ধরার ক্ষেত্রে দক্ষিণ কোরিয়ার সফলতা উল্লেখ করা হচ্ছে। কোরিয়ার সফলতার অন্যতম কারণ হচ্ছে প্রত্যেক ব্যক্তি যাদের কোয়ারিন্টিনে পাঠানো হয়েছে তাদের বাধ্যতামূলক ভাবে একটা নজরদারি অ্যাপ ডাউনলোড করতে হয়েছে। এর মাধ্যমে কেউ নিভৃতবাস অমান্য করছে কিনা, নিজের পরিবারের সাথেও মেলামেশা করছে কিনা সেটার ওপর নজর রাখা হচ্ছে। মানুষ এটা স্বেচ্ছায় মেনে নিয়েছে, তারা মনে করেছে এটা রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন। তাদের কাছে প্রাইভেসির চেয়ে সামাজিক সুরক্ষা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই ধরনের সংস্পর্শ-সন্ধান (Contact-tracing) অ্যাপ বিভিন্ন দেশে নানা রূপে এসেছে, কিন্তু প্রত্যাশিত ভাবে পশ্চিমে সরকারের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এটা এখনও অত গ্রহণীয় হয়নি। ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করার ক্ষেত্রে চিন অনেক এগিয়ে। সেখানে প্রত্যেকের কাছে একটি কার্ড থাকে যেটা তার ব্যক্তিগত তথ্যের একটি ভাণ্ডার: যেমন সে বিদ্যুৎ, ফোন ইত্যাদির বিল সময় মতো মেটায় কিনা, সে ট্রাফিক আইন মানে কিনা, তার স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত যাবতীয় খুঁটিনাঁটি, তার সফর-ইতিহাস ইত্যাদি। এই কার্ডের তথ্যের ওপরেই নির্ভর করে সে রাষ্ট্রের কাছ থেকে কোনও পরিষেবা পাওয়ার যোগ্য কিনা, এমনকি সে ট্রেন বা উড়ানে কোথাও যেতে পারবে কিনা। ভারতে আধার, ব্যাংক একাউন্ট, মোবাইল সংযুক্তিকরণের মাধ্যমে আমাদের অনেক তথ্যই সরকারের কাছে বাক্সবন্দী হয়ে গেছে। ‘আরোগ্য সেতু’তে আমাদের কী কী রোগ আছে তা আমরা জানিয়ে দিচ্ছি, বাকিটা উন্নত হওয়া খালি সময়ের অপেক্ষা। একালের জনপ্রিয় চিন্তাবিদ য়ুভাল নোয়া হারারি বলছেন, এতদিন তো ব্যক্তির বাইরের কার্যকলাপের ওপর নজর রাখা হচ্ছিল, এখন তার শরীরের অভ্যন্তরে নজরদারি শুরু হয়ে গেল। আমার রক্তচাপ, সুগার, হার্টবিট, শরীরের তাপমাত্রা কত তা সরকার বাহাদুরের খাতায় লিপিবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। এই সব তথ্যের ভিত্তিতে ও অ্যালগরিদমের সাহায্যে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের সময় আমার ভ্রু কুঞ্চিত হচ্ছে না আমি আহ্লাদে গদগদ হচ্ছি তা আইটি সেলে বসে কেউ গোঁফে তা দিতে দিতে ঠিক নজর করছে।  বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবিষ্যতের মহামারিকে ঠেকানোর জন্য এই সব ডিভাইস নাকি এখন থেকেই প্রস্তুত করা প্রয়োজন।
বিল গেটস তো এক কাঠি ওপরে। ‘ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম’এ তিনি প্রস্তাব দিয়েছেন যে প্রত্যেকের কাছে একটা ডিজিটাল সার্টিফিকেট থাকা প্রয়োজন। এই সার্টিফিকেট হবে মাদার অফ অল সার্টিফিকেটস, যাতে ব্যক্তির সব তথ্য থাকবে। ‘সন্দেহজনক’ যদি কিছু থাকে তাহলে সে পরিষেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে। এর সাথে কোভিড-১৯'এ সে সংক্রামিত হয়েছিল কিনা, কিংবা তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠেছে কিনা, সেই তথ্যও থাকবে। যদি সে সংক্রামিত না হয়ে থাকে এবং তার মধ্যে ইমিউনিটি না গড়ে ওঠে তবে, দুঃখিত, সে উড়ানে উঠতে পারবে না, তার বিদেশ ভ্রমণ বাতিল। আফটার অল গরিব দেশ, যাদের এই রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা নেই, তাদের তো আমরা বিপদে ফেলতে পারি না- গেটস সাহেবের হিতোপদেশ। এইভাবে বিশ্বব্যাপী একটা তথ্যভাণ্ডার গড়ে উঠবে যাতে ২০ শতাংশ মানুষের ঠিকুজি-কোষ্ঠী নথিবদ্ধ থাকবে। আর কী চাই! এরাই তো এই ভোগবাদী সমাজের চালিকা শক্তি। বাকী ৮০ শতাংশ তো চিরকালই খরচের খাতায়। আমরা কি অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বব্যাপী এক সর্বগ্রাসী একনায়কত্বের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি?

Sunday, 19 April 2020

লকডাউনে পরিবার

অমৃতের পুত্র নই!
অমৃতা ঘোষাল

ছুটি, অনলাইনে সামান্য কাজ, মাইনে আপাতত পুরোই পাচ্ছেন, বাজারও সকালে ভালোই মিলছে। দিব্যি আছেন। চোখের দূষণ শুধু হয়ে উঠছে একজন। আপনার থপথপে ম্যাড়ম্যাড়ে ধর্মপত্নী। কেমন যেন নোংরা মতো নাইটি পরেই কিচেনে ঢুকছে! চান করে এলেও বেশ নোংরা লাগে। নাইটিগুলোয় হলুদ ছোপ। 'কাজের মাসি'-মার্কা স্ত্রী নিয়ে আপনার মন খুব খারাপ। কিছুক্ষণ ফেসবুক। অফিসে তিন মাস আগে জয়েন করা তরুণীর ঝকঝকে ডিপি। ছবিতে বুকের ভাঁজে নীল পাথরের লকেট। মুগ্ধ হয়ে দেখছেন, অমনি ঘরের ওই মহিলা এসে আপনার চেয়ারের নিচে সিগারেটের ছাই মুছে দিচ্ছে। ঘামের বিকট গন্ধে আপনার গা গুলিয়ে উঠল। আপনি সহ্য করতে না পেরে ঘর মুছতে থাকা প্রাণীটির কাঁধে বেশ কষিয়ে লাথি মারলেন। গৃহকর্তা হিসেবে খুব অন্যায় করলেন নাকি!

ছেলে স্কুলে অনলাইনে দেওয়া হোমটাস্ক করছে। বর 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম' করে চলেছে। শাশুড়ি শয্যাশায়ী। আয়া সবেতন ছুটিতে। সকালে শাশুড়ির বেডপ্যান নিতে গিয়ে খুব বমি পেল আপনার। তারপর আপনি শাশুড়ির ব্রেকফাস্টে স্যুপ বানিয়ে তাতে মাত্রাতিরিক্ত নুন দিয়ে দিলেন। দুপুরে তাকে গলা-ভাতের সঙ্গে দিলেন একটাই উচ্ছের তরকারি। শাশুড়িকে পরিষ্কার করার সময় ডেটল জলে না মিশিয়ে এমনিই তার লোলচর্মে ঢেলে দিলেন। তারপর একটা রুক্ষ তোয়ালে দিয়ে ঘষে ঘষে শাশুড়িকে পরিচ্ছন্ন করলেন। আপনি তো লক্ষ্মী সোনা বৌমা নাকি!

আপনার কিছুই ভালো লাগছে না। ঘরে মদ নেই। মাইনে ঢুকেছে অর্ধেক। ছেলে ছয় মাসের। ওইটুকু বাচ্চা কি আরামে থাকে! খালি খায়, ঘুমায় আর কাঁদে! ভাবছেন ছেলের মাকে বলবেন, বাপের বাড়ির থেকে কিছু টাকা আদায় করতে। চাকরি রেখে আর লাভ নেই। বৌকে আদর করে বোঝাতে যাবেন। অমনি ছেলে উঠল কঁকিয়ে। হাত নিশপিশ করে উঠল। এক হাতে ছেলের ঠোঁট দুটো চেপে যদি অন্য হাতে গলাটা টিপে ধরা যায়। আপনার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল--- 'যাহঃ শালা'! বৌ উঠে গিয়ে আপনার বাচ্চাকে কোলে তুলে নিল! আপনি কিছুই করলেন না আর। আপনি তো একজন দায়িত্ববান পিতা নাকি!

আপনি মোবাইল এখন প্রায়ই বন্ধ রাখেন। বরকে সময় দেন। লোকটা ভালোই ঘর সামলায়। রান্নার দায়িত্বও বরের। হেয়ার রিমুভাল ক্রিম অনলাইনে আনিয়েছেন। আপাতত সেগুলো প্রয়োগ করে মসৃণ হওয়ার অপেক্ষা। বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে অনেকদিন দেখা হবে না। দুপুরে তাই বরের সঙ্গেই চাইছেন বিডিএসএম-খেলা। নখ আপনার এমনিতেই বেশ বড়। তার ওপর ডিপ অরেঞ্জ নেলপলিশ। পুরুষের লোমশ বুকে তীক্ষ্ণ নখাগ্র ফুটিয়ে আনন্দ নেবেন। হঠাৎ ধরিয়ে নেবেন সিগারেট। নিজের মুখের ধোঁয়া অন্যের মুখে চালান করতে করতে উত্তেজিত হবেন। বয়ফ্রেন্ডের মুখ মনে করে সিগারেটের একটা আলগা ছ্যাঁকাও দিয়ে দিন ভেজা পাউরুটির মতো 'সুইট হাবি'র গলায়। আপনি বিছানায় চূড়ান্ত আবেদনময়ী তো নাকি!

ঘটনাগুলো আপাতভাবে বানানো মনে হলেও একেবারে মিথ্যে নয়! লকডাউন প্রত্যেক মুহূর্তে বুঝিয়ে দিচ্ছে, আমরা বন্দী, আর নিজের মতো করেই বাঁচবার উপায় খুঁজে নিতে হবে। বাঁচার চেয়েও আরও বেশি করে খুঁজছি কিভাবে নিজের শখ-আহ্লাদকে অব্যাহত রাখব সেই পন্থা! জৈবিকতাকে মেটানোর বিবিধ উপায় খুঁজে চলেছে মানুষ। অবদমিত ব্যাপারগুলো কিন্তু অনেক সময়েই অতিরিক্ত গুরুত্ব পাচ্ছে। শুধু পূর্ণতাসাধনের পদ্ধতি খুঁজতে গিয়েই যত হয়রানি! এক স্বামী-সোহাগিনী সুন্দরী যেমন সেদিন ফোন করে জানতে চাইলেন, 'তোরাও কি রাত্রে মাস্ক পরেই...!'

বিস্ময়ের পরতে পরতে 'Phobos', 'Thanatos', 'Deimos' প্রমুখ এসে উঁকি মারেন। আমরা যে সত্যিই এবার বিমূঢ় সময়ে পৌঁছে গিয়েছি, বেঁচে থাকতে হলে বিভ্রান্ত হতে হবে। মানসিকভাবে একটু পিছিয়ে পড়া শিশু হঠাৎই মায়ের হাতে তুমুল মার খেয়ে বারান্দায় বসে নিজের মনে দুলতে আরম্ভ করে। মাটির দিকে তাকিয়ে দোলে, আকাশ দেখতে সে ভয় পায়। সব মিলিয়ে একটা ক্যালেইডোস্কোপিক পটভূমি গড়ে উঠেছে, নতুন নতুন গঠন যেন একবার গড়ে উঠেই অতল কৃষ্ণগহ্বরে ডুবে যাচ্ছে। করোনার অ-প্রত্যাশিত অভিঘাত স্পষ্টভাবেই প্রমাণ করে দিয়েছে যে আমরা কোনও অংশেই অমৃতের পুত্র অন্তত নই। বাইরের চকচকে পৃথিবীর বিলাস-উপাদানের ওপর বড্ড বেশি নির্ভরশীল আমরা।

লকডাউন পরিস্থিতিতে যখন কৃত্রিম নির্ভরতার সূত্রগুলো ক্রমশ হারাতে শুরু করেছি, তখন আর আত্ম-সংশোধনের চেষ্টাই আমরা করি না, কারণ আমরা অনেকেই হৃদয়হীন হয়ে সুখ পাই। এখন ধর্ষকাম-মর্ষকামের নিষ্ঠুরতা দেখাবার সবচেয়ে বিশ্বস্ত ক্ষেত্র তাই হয়ে উঠল পরিবার। অবশ্য উল্টোটাও দেখা যাচ্ছে। পরিবারকে গভীরভাবে আঁকড়ে সুরক্ষিত থাকার দৃষ্টান্তও অজস্র মিলছে। তবে এটাও স্বীকার করতে হবে যে, পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে পারিবারিক হিংসার এক একটি নির্লজ্জ ঘটনা। সবাই দেখছি, জানছি, শুনছি আর সহ্য করছি। এখনও সময় ফুরোয়নি। একটু অভিনয় ছেড়ে এই বন্দীদশায় আরেকবার চেষ্টা করি মানসিকভাবে মুক্ত হতে। বাড়ির সবাইকে সুস্থভাবে কাছে টেনে বলি,  'আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি'। তবে রিপুর থেকে মুক্তি পাওয়া এখন এত সহজ কি? উত্তর মেলে না।

Saturday, 18 April 2020

করোনার তেতো কথা

সরকারি পদক্ষেপের সমালোচনাও একপ্রকারের সহযোগিতা
অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
,
শিল্পী: ক্ষীরোদ বিহারী ঘোষ

মালোচনা সদর্থক হোক বা নিরর্থক- এ কথা মেনে নিতেই হবে যে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় চিন্তাভাবনা সংক্রান্ত-সমালোচকও শাসকের সহকর্মী। দুনিয়াতে এমন মানুষ নেই যিনি ভাবছেন করোনা থেকে যাক, এ সভ্যতা শেষ হয়ে যাক। আমি নিহিলিস্টদের এ তালিকায় রাখছি না, কেননা সংখ্যাটা বিচারের সাপেক্ষে নগণ্য। এ কথা সত্য যে, করোনা ভাইরাসের উৎস-সন্ধান এখনও চলছে, সে সম্বন্ধে যুক্তির পরাকাষ্ঠায় নতজানু হয়ে বলার মতো সত্য আমাদের কাছে নেই। ফলে, কী কারণে ও কীভাবে এর উদ্ভব সে সব বিশ্লেষণের প্রশ্নই নেই। কী আছে তবে? আছে দুটো নিহিত মর্মবস্তু: এক, যতদিন না চিকিৎসা (ওষুধ, ভ্যাকসিন ইত্যাদি) আবিষ্কার হচ্ছে ততদিন অবধি যতটা সম্ভব মানুষজনকে আক্রান্ত হতে না দেওয়া– উপায় লকডাউন, সামাজিক দূরত্বের বিধিনিষেধ আরোপ ও সর্বোপরি র‍্যাপিড টেস্টের মাধ্যমে শনাক্তকরণ; দুই, প্রথমটির কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতির মোকাবিলা।

যে সব তথ্য আমাদের সামনে আসছে তার মধ্যে অন্যতম হল- ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে সব থেকে কম পরিমাণে টেস্টের সংখ্যা। তাহলে লকডাউনের মানে কী? শুধুমাত্র রেশন বিলি করে মানুষজনকে ঘরে আটকে রাখা? সেখানেও তো উঠছে হাজারও অভিযোগ। সাংসদ জন বার্লা প্রধানমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করেছেন যে আমাদের রাজ্যে এই দুর্দিনেও নাকি রেশন বন্টন নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতি চলছে। অন্যদিকে টেস্ট বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য হল, ভারতে প্রতি মিলিয়ন জনসংখ্যায় ২৪৩টি (সূত্র: ওয়ার্ল্ডোমিটার )। ভারতবর্ষের ওপরে-নিচে যে দেশগুলি আছে তাদের একটিরও টেস্ট সংখ্যা প্রতি মিলিয়নে ১৮০০০-এর কমে নয়, এমনকি জনস্বার্থে প্রচারিত সর্বাধিক শত্রুদেশ পাকিস্তানে অবধি ৪১৯। আর পশ্চিমবঙ্গে দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম- ৩৩.৭টি প্রতি মিলিয়নে (সূত্র: দ্য ওয়্যার ও নিউ-ইয়র্ক টাইমস)। এর মধ্যে, ১৯,০০০ ডাক্তারদের প্রতিনিধিত্বকারী পশ্চিমবঙ্গ ডাক্তার ফোরাব'এর ডাঃ অর্জুন দাশগুপ্ত বলেছেন, 'যদি আপনি কোভিড বলে কাওকে সন্দেহ করেন এবং নমুনাগুলি প্রেরণ করেন তবে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে, অথবা তিন থেকে চার দিন পরে রিপোর্টটি আসছে।' (সূত্র: নিউ-ইয়র্ক টাইমস)। তদুপরি তথ্য গোপনের অভিযোগ পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে আরেকটা অশনি সংকেত।

কলকাতার একজন নেফ্রোলজিস্ট ডাঃ প্রতীম সেনগুপ্ত ফেসবুকে লিখেছেন যে, করোনাভাইরাস রোগীরা যখন শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যর্থতার লক্ষণ নিয়ে মারা যাচ্ছিল, তখনও কমিটি কোভিড১৯-কে মৃত্যুর কারণ হিসাবে উল্লেখ করেনি। সেনগুপ্ত আরও লিখেছিলেন, 'এটি সত্যের সাথে নির্লজ্জভাবে মিথ্যা খেলা'– এ বিষয়ে ফুসফুসের এক্স-রে এবং করোনা ভাইরাস রোগীর একটি সিটি স্ক্যান করে রেনাল ব্যর্থ হয়ে মারা গেছে বলে ঘোষণা করার একটি তথ্য উনি শেয়ার করেছিলেন (সূত্র: নিউ-ইয়র্ক টাইমস ১৪ এপ্রিল ২০২০)।  এসব বিষয় কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে বৈকি!

লকডাউনের অর্থই হচ্ছে পুরো দেশকে একটা বাক্সের মধ্যে পুরে, কতকগুলো ছোট-ছোট বাক্সে ভাগ করে স্ট্যাটিস্টিক্যালি সিগ্নিফিক্যান্ট লেভেলে স্যাম্পেলিং-এর ভিত্তিতে র‍্যাপিড টেস্টিং চালিয়ে দেশের মধ্যে করোনা পরিস্থিতির প্রকৃত বিস্তার ও তার আদল জেনে ফেলা। তবেই আসবে মোকাবিলার স্ট্র্যাটেজির প্রশ্ন। অথচ এইখানেই প্রশ্ন উঠে আসে সামর্থ্যের। কিট নেই, ভেন্টিলেটর কম, হাসপাতাল নেই, ডাক্তার নেই, ল্যাব নেই ইত্যাদি নাকেকান্না। তাহলে সে প্রসঙ্গে আসবেই- দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অর্থনৈতিক অব্যবস্থার কথা, লাগামছাড়া বঞ্চনার কথা, স্বাস্থ্য-শিক্ষা-পরিকাঠামো উন্নয়নে ছিটেফোঁটা বরাদ্দের কথা, লকডাউনের মধ্যে আটকে যাওয়া অসংখ্য ভুখা মানুষের মধ্যে সচেতনতার সাড়া না পাওয়ার কারণ ইত্যাদির কথা। সুতরাং, সমালোচনা তো হবেই । আর তা না হলে এই পরিস্থিতি থেকে ভবিষ্যতের জন্য আমরা কী শিক্ষা নেব!

শিক্ষা নেবার বালাই তো নেইই, বরং সেই কেঁচে-গন্ডুষ করে একই ভুলের পুনরাবৃত্তির পরিকল্পনা। লকডাউনের ফলে দুনিয়া জুড়ে যে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে তা আর কিছুই নয়, মোদ্দা কথায়, পুঁজিবাদের টিকে থাকার সংকট। আইএমএফ বলেছে, গ্রেট ডিপ্রেশন নয়, গ্রেট লকডাউন। তাতে কী! আরে তাতেই তো পুঁজিবাদের ঢাল জিডিপির ভিত্তিতে শুরু হয়ে গেছে হেলিকপ্টার ইকোনমির প্রস্তাব, বেইল-আউটের সিদ্ধান্ত ইত্যাদি; যাতে কোনওভাবে বেনিয়াতন্ত্রের বিপদ না ঘটে। বিখ্যাত কিছু অর্থনীতিবিদ মৃদুস্বরে যে ভবিষ্যতের দিকে ইঙ্গিত করছেন তার নাম ঠারেঠোরে বললে কমিউনিজম। সুতরাং, করোনা পরিস্থিতি সামলে গেলে যেন আবার বিদ্রোহ-আন্দোলনের উপক্রম না হয় সে জন্য এখন থেকেই ঘুঁটি  সাজিয়ে রাখছে শীর্ষমহল। সুতরাং, করোনা পরিস্থিতি যা জনমানসের চোখ কিছুটা হলেও খুলে দিয়েছে- যারা বুঝতে  শুরু করেছে ধর্ম-জাত-বর্ণ নয়, সংসদীয় গণতন্ত্রের মধ্যে থাকতে হলেও নির্বাচনের ভিত্তি হবে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-স্বাস্থ্য-শিক্ষা-সমতা। ফলে, সাধারণ্যে এই সমালোচনার ঢেউ একপক্ষের কাছে যথেষ্ট উদ্বেগের, অন্যপক্ষের কাছে আশার। কেননা জোড়াতাপ্পি দিয়ে আর কদিন মানুষ বাঁচবে, চুপ করে থাকবে, সেইটাই দেখার।

অন্তিমে, যে বিষয়টা করোনার সঙ্গে জড়িত হয়েও আলোচিত নয় তা হল পরিবেশ। করোনা মিটলেই কি দুনিয়া সুরক্ষিত? এই যে খনিজদ্রব্যের সন্ধানে পৃথিবীর ফুসফুসের (পড়ুন অরণ্যের) বিনষ্টিকরণ চলছে তা কি আমাদের আরও বড় বিপদের দিকে ঠেলছে না। শুধু তাই নয়, বিশ্ব উষ্ণায়ন, অরণ্যনাশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত যে জুনোটিক রোগের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছে, যা চলবে, সেও কি মানবসমাজের চিন্তার বিষয় নয়? নাকি আমরা আমল দেব না তাতে। সর্বনাশের সম্ভাবনাকে পাত্তা না দিলেই সর্বনাশ আটকে যাবে, এমনও তো নয়। সুতরাং, এ নিয়েও কি আমরা আলোচনা-সমালোচনা করব না !

অবশ্যই করব। আমরা আলোচনা যেমন করব, বেগতিক দেখলে কঠোর সমালোচনাও করব। দুনিয়াতে সবাই সব কিছু জানে না, যতটুকু জানে তাও অনেকাংশে সম্পূর্ণ নয়। তাই বোঝার ধরন, ভাবনার প্রকৃতি ও বলার ভাষা সবসময় যে সঠিক ও খাঁটি হবে তাও নয়। তথ্য ও তত্ত্বের মাপকাঠিতে শাসককে ঠিক করে নিতে হবে কোনটা গ্রহণ করা হবে কোনটা হবে না। তবেই সে প্রকৃত শাসক, দণ্ডমুণ্ডের কর্তার গদিতে আসীন। কিন্তু তা না করে কাওকে চুপ করিয়ে দেওয়া যাবে না। আইন প্রয়োগ করে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া যাবে না। ভয় দেখিয়ে পরোয়ানা শানিয়ে মগজে কার্ফিউ জারি করা যাবে না।  তাহলে সাধারণ সমালোচনা থেকে ঝড় উঠবেই– দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান।

তখন আবার ব্যাপারটা রাজনৈতিক হয়ে যাবে ।

Thursday, 16 April 2020

কোভিড১৯'এর ধাক্কা


ভার্চুয়াল অর্থনীতির তিন লাফ
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
বিশ্ব জুড়ে কোভিড১৯-এর প্রকোপে, বিশেষত ইউরোপ ও আমেরিকায়, মানুষের মৃত্যু মিছিল যে ত্রাসের সঞ্চার করেছে তা অভাবনীয়। সেই সঙ্গে এই দুর্যোগের অবসান কবে, তা নিয়েও সকলের শঙ্কা ও উদ্বেগের সীমা-পরিসীমা নেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভবিষ্যৎ যাপনের অনিশ্চয়তার কালো মেঘ। বিশেষ করে, অর্থনীতির ভবিষ্যৎ কী হতে চলেছে আর তাতে সাধারণ মানুষের অবস্থান ও তার জীবন-জীবিকার কী দশা হবে তা নিয়ে উৎকণ্ঠা ও ভীতির পারদ যথেষ্ট উর্ধ্বমুখি। ইতিমধ্যেই এ দেশে ও বিদেশে বহু মানুষ কাজ হারিয়েছেন, কারখানার চিমনিগুলো অনেকদিন হল খাঁ খাঁ করছে, পরিষেবা শিল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার হিসেবে, সারা বিশ্বে প্রায় ২০ কোটি মানুষ কাজ হারাবেন- সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাসস্থান ও খাদ্য পরিষেবা ক্ষেত্র, ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প, ক্ষুদ্র ও বাণিজ্য ক্ষেত্র এবং প্রশাসনিক কাজকর্ম। সবচেয়ে বড় কথা, অর্থনীতির রথ যেমন চলছিল তেমন কবে আবার চলতে শুরু করবে তা নিয়ে কেউ কিছু বলতে অক্ষম। কারও কারও মতে, ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় বেকারত্ব মহামন্দার সময়ের থেকেও বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে।

কিন্তু ইতিমধ্যে গঙ্গা বা টেমস নদী দিয়ে বহু জল গড়িয়েছে। তাই এইসব ঘনঘোর দুঃসহতার মাঝে আরও একটি ভিন্ন চিত্রও উদীয়মান। দেখা যাচ্ছে, এতদসত্ত্বেও বেশ কিছু কোম্পানি তাদের কর্মী নিয়োজনের ধারাকে অব্যাহত রেখেছে। যেমন এ দেশে টিসিএস ও উইপ্রো এই বার্ষিক বছরে যথাক্রমে ৩০,০০০ ও ১২,০০০ কর্মী নিয়োজনের পরিকল্পনা নিয়েছে। কগনিজেন্ট’ও জানিয়েছে, তারা এই বছরে ২০,০০০ কর্মী নিয়োগ করবে। লকডাউন তাদের ক্ষেত্রে তেমন কোনও বাধা নয়। এই জায়গাটি চিত্তাকর্ষক। অনুরূপ আরও কিছু তথ্য হাজির করলে বিষয়টা আরও স্পষ্ট হবে। যেমন, এই লকডাউন সময়ে অর্থনীতির কোন ক্ষেত্রটি প্রসারিত ও বাণিজ্য-সমৃদ্ধ হয়েছে? আসলে কাদের ব্যবসা বাড়ল? বোঝাই যাচ্ছে, উত্তরটি হল, ভার্চুয়াল দুনিয়ার কারবারীদের। এখন আপনারা সকলেই ‘জুম’ ভিডিও-কলিং অ্যাপ্লিকেশনটি সম্পর্কে অবহিত হয়ে গেছেন। কারণ, লকডাউনের কারণে স্কুল-কলেজে অনলাইনে ক্লাস নিতে এর ব্যবহার এখন তুঙ্গে। তথ্য বলছে, ফেব্রুয়ারি মাসে বিশ্বে যেখানে ‘জুম’এর মাসিক ডাউনলোড ছিল ৫ লক্ষের মতো, মার্চে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯০ লক্ষের কাছাকাছি (প্রায় ১৭ গুণ বৃদ্ধি)। এমত ভার্চুয়াল দুনিয়ার প্রায় সমস্ত অ্যাপ ও উপযোগিতা টুলস’এর এখন রমরমা বাণিজ্য। যেমন, টিকটক, ইউটিউব, অ্যামাজন, গুগল পে, টিন্ডার ইত্যাদিদের বৃদ্ধির হার ও ব্যবহার অকল্পনীয় স্তরে পৌঁছেছে। অ্যামাজন ইন্ডিয়ার কীওয়ার্ড সার্চ অনুসন্ধান করে দেখা যাচ্ছে, গত ৪ থেকে ১১ এপ্রিলের সপ্তাহে ক্রেতারা ম্যাগির থেকে মোবাইলের খোঁজ বেশি করেছেন। কারণ, স্মার্ট ফোনই এখন যোগাযোগ, বাণিজ্য, কাজ, বিনোদন ও রোজগারের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। শুধু কি তাই! খেয়াল করুন, এই লকডাউনের সুযোগে আমাদের দেশে ক্রিপটোকারেন্সি’র দৈনিক বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ প্রসঙ্গে বস্টন কনসাল্টিং গ্রুপের ম্যানেজিং ডিরেক্টর নিমিশা জৈনের বক্তব্য হল, লকডাউন ব্যবসা-বাণিজ্যের রীতিনীতিকেই বদলে দিচ্ছে ও আগামী ৩ থেকে ৫ বছরের মধ্যে এক সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আমরা যাব।

তা তো বটেই! ইতিমধ্যে দেখাই যাচ্ছে, ওয়ার্ক ফ্রম হোম যা এতদিন সীমিত পরিসরে অনুশীলিত হত, তা কোভিড১৯’এর কারণে এখন সর্বজনীন হয়ে উঠছে। থ্রি-ডি প্রিন্টিং যা আধুনিক উৎপাদনশীলতায় এক নতুন আঙ্গিকের সূচনা করেছিল তাও হয়ে উঠছে দস্তুর। অনলাইন শপিং, ভার্চুয়াল ক্লাস, টেলি-ঔষধি, নেট-বিনোদন, মায় আলপিন থেকে এলিফ্যান্ট যা কিছু, সবই এখন ভার্চুয়ালি চাগিয়ে উঠেছে ঘরবন্দী মানুষের তাড়নায়। যে রূপান্তর হয়তো হত আরও ধীরে, আরও কয়েক বছর পর, তা এখন কোভিড১৯-ব্যতিব্যস্ততায় কোনও উপায়ন্তর না পেয়ে তড়িৎ গতিতে আয়ত্তাধীন-প্রায়। ভার্চুয়াল ও ডিজিটাল দুনিয়া দখল নিয়ে নিচ্ছে অর্থনীতির সিংহভাগ ও জীবনযাপনের প্রায় সমস্ত দায়।      

পরিবর্তনের এই বাস্তব অভিঘাতকে বোঝার চেষ্টা না করলে বর্তমানের এই মহাসংকটময় পরিস্থিতিকে আন্দাজ করা যাবে না। আজ নিঃসন্দেহে অনুধাবন করা উচিত, গত পাঁচ থেকে দশ বছরে বিশ্ব জুড়ে অর্থনীতির আঙ্গিকটাই দ্রুত বদলে গেছে। এবং তা কতকটা নিঃশব্দে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবটিক্স’এর অভিঘাতে মনুষ্য শ্রমকে প্রতিস্থাপিত করে আমরা এমন এক স্বকীয় যন্ত্র-চালিত উৎপাদন ব্যবস্থার দিকে শনৈ শনৈ এগোচ্ছিলাম যে অচিরেই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল, অধিক সংখ্যক লোকের হাতে আর সংগঠিত চাকরি থাকবে না; প্রযুক্তির বিকাশের অনুষঙ্গে অস্থায়ী নানাবিধ কাজের পরিসর তৈরি হবে ও আবার তা মিলিয়ে যাবে নতুনতর প্রযুক্তি-আঙ্গিকের অভিষেকে। এই অস্থায়ী কাজের প্রাঙ্গণে যথাযথ কিছু মানুষের কাজ মিলবে বটে কিন্তু তা স্বল্প সময়ের জন্য বা চুক্তির ভিত্তিতে। অর্থনীতিতে কাজের এই নতুন আঙ্গিককে অনেকেই ‘গিগ অর্থনীতি’ বলে অভিহিত করেন যার মোদ্দা কথাটি হল- কাজের চরিত্র হবে অস্থায়ী ও উত্তরণ সাপেক্ষ। অর্থাৎ, প্রযুক্তির নবতর দ্রুত উল্লম্ফন পুরনো কাজ ও কর্মীকে অসার করে দিয়ে নতুনের সন্ধান করবে যা আবার কিছু সময় পর পরিত্যক্ত-যোগ্য হবে। এইভাবে কাজের এমন এক ধারা প্রবহমান হবে যেখানে মনুষ্য শ্রমের পরিমাণগত প্রয়োজনীয়তা ক্রমেই কমে আসতে থাকবে। কোভিড১৯-এর আচম্বিত সর্বগ্রাসী আক্রমণ প্রযুক্তি চালিত এই চলমান প্রক্রিয়াটিকেই ত্বরান্বিত করল বলে মালুম হচ্ছে। এটা এই অর্থে যে, বিশ্ব অর্থনীতিতে যদি ২০ কোটি মানুষের কাজ চলে যাওয়া সাব্যস্ত হয় তাহলে তা হওয়ারই ছিল, হয়তো আরও কিছু সময় পরে, কোভিড১৯ তার পরোয়ানা আগেই ধরিয়ে দিল।

অন্যদিকে, কোভিড১৯-এর তাণ্ডবে যারা ধনতন্ত্রের অন্ত সুনিশ্চিত দেখছেন অথবা কিছুটা আপস করে ধনতন্ত্রের প্রকট বৈষম্য নীতির অবসানের প্রত্যাশা করছেন তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত সমসময়ের অর্থনীতির অন্তর্হিত ক্রমবিকাশমান বার্তাটিকে পড়তেই পারেননি। গত তিন-চারশো বছর ধরে ধনতন্ত্রের যে বিকাশ, তার মূল চালিকাশক্তিই ছিল উৎপাদনের পরিসরে মুনাফার হারকে ক্রমাগত বাড়িয়ে চলা এবং কোনও কর্মক্ষেত্রে তা স্থিতাবস্থায় পৌঁছলে নতুন উর্বর ক্ষেত্রে পুঁজিকে স্থানান্তরিত করা। এই কারণেই পুরনো শিল্প বাতিল হয়ে বন্ধ হয় ও নতুন শিল্পের উদয় ঘটে। আর এই কাণ্ডটিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে প্রযুক্তি, যার উদ্দেশ্যই হল আরও বেশি আধুনিক ও উৎপাদনশীল হয়ে উঠে মুনাফার হারকে বাড়িয়ে চলা। স্বতঃসিদ্ধ এই যে, শ্রমিকের তুলনায় যন্ত্রের ব্যবহার যত আনুপাতিক হারে বাড়বে ততই উৎপাদনশীলতা তথা মুনাফার হারের বৃদ্ধি হবে ও তজ্জনিত কারণে মনুষ্য শ্রমের প্রয়োজনীয়তা কমে আসবে। এইভাবেই ধনতন্ত্র তার যাত্রাপথকে অব্যাহত রেখেছে ও আজ এসে বাধ্যত প্রযুক্তির এমন এক গুণগত পরিবর্তনের স্মারক হয়েছে যেখানে প্রযুক্তি নিজেই অর্জন করেছে প্রায় মনুষ্যতুল্য স্বাধীন এক কর্মসত্তা: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। সাধারণ ভাবে মনুষ্য শ্রমের প্রয়োজনীয়তা তাই আপেক্ষিক অর্থে আরও হ্রাস পেয়েছে ও পাবে

শ্রমের নিরিখে এর ফলে যে পরিস্থিতির উদয় হবে তা কতকটা এইরকম: (১) কৃষি, পরিষেবা (শিক্ষা, স্বাস্থ্যকে ধরে) ধরনের কিছু মৌলিক ক্ষেত্র ছাড়া মনুষ্য শ্রমের প্রয়োজনীয়তা চূড়ান্ত ভাবে হ্রাস পাবে; (২) যারা কাজ করবেন তাদের মধ্যে মূলত তিন ধরনের আয়ের ভিত্তিতে শ্রম বিভাজন হবে- নিম্ন, মধ্য ও উচ্চ আয়। বলাই বাহুল্য, নিম্ন আয়ের শ্রমই হবে মোট ব্যয়িত শ্রমের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ; (৩) তদুপরি, সমাজের কর্মক্ষম মানুষের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশের হাতে কোনও কাজ থাকবে না (তা স্বল্প বা দীর্ঘ সময় উভয়তই)। আর এই শেষোক্ত কারণটির জন্যই ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম (বা ইউবিআই) প্রদানের চর্চা রাজনৈতিক ও অর্থনীতির মহলে ক্রমেই জোরদার হয়েছে। এখন কোভিড১৯’এর আক্রমণ সরকারগুলিকে বাধ্য করছে সমস্ত কাজহারা মানুষের কাছে অর্থ ও খাদ্য পৌঁছে দিতে। নির্দ্বিধায় এই বাধ্যতাকে বলা যেতে পারে ইউবিআই’এর মহড়া, কোভিড১৯-এর কারণেই যার সূত্রপাত।

মড়ক, মহামারি বিশ্বে নতুন কিছু নয়। দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধ ও বহু আঞ্চলিক যুদ্ধের নিত্য সাক্ষী এ ধরিত্রী জননী। ফলত লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু আগেও প্রত্যক্ষ করা গেছে। আর স্বভাবতই এইসব দুর্যোগের সময় মানুষের হৃদয় উদ্বেলিত হয়, তার কুসুম মন চারপাশে তাকানোর চেষ্টা করে, তাকে মৃত্যুভয় গ্রাস করে। তখন মানুষ স্বপ্ন দেখে, আশা করে এক নির্মল মনের স্বত্বাধারী হয়ে উঠতে, যাতে ভবিষ্যতে এমন দুঃসময় আর না আসে। কিন্তু সব ঝড় থেমে গেলে আবারও চারপাশ পঙ্কিল হয়ে ওঠেএ ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। যদি আধুনিক সময় ধনতন্ত্রকেই সাব্যস্ত করে থাকে, তবে তার কন্দরেই রয়েছে লোভ, জিঘাংসা ও বৈষম্যের প্রগাঢ় বিষ। তাকে নিকেশ না করে তার বৈষম্যের ক্ষুধাকে নির্বিষ করা যায় না। আর ধনতন্ত্র অবসানের স্বপ্ন যারা দেখেন তারা যদি বোঝেন যে ধনতন্ত্র আসলে লালিত হয় প্রতিটি ব্যক্তি মানুষের চৈতন্যে ধনে-মানে-ক্ষমতায় অন্য সকলকে ছাপিয়ে যাওয়ার চরম উচ্চাশা থেকেই, তাহলে তার অবসানকল্পে যে কাজের ভার ও প্রজ্ঞাকে উপলব্ধ করতে হয় তা বড় গভীর ও ব্যাপ্ত।

কোভিড১৯ আমাদের নাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের ধ্বস্ত করেছে। লক্ষাধিক মানুষের শবকে পিছনে ফেলে যারা বেঁচেবর্তে এগিয়ে যাবেন তাঁরা আবারও শুরু করবেন তাঁদের দৈনন্দিন কর্মধারা। স্বভাবতই মানুষের প্রাপ্য তালিকায় জীবনের নবতর জয়গান তেমন কিছুই থাকবে না, বরং চলমান পরিবর্তিত অর্থনীতিকে কোভিড১৯ যে দ্রুত এক ধাক্কায় অনেকটা ডিজিটাল-বন্দী করে ফেলল, থাকবে সে জানানটুকুই। আর থাকবে এ বার্তাও যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত অর্থনীতির যে আপন গতিপথ নির্মিত হয়েছে, সেখানে আজকের রাষ্ট্রপ্রধানদের আর তেমন কোনও কীর্তি প্রকৃত প্রস্তাবে অসার। তারা বড়জোর নিজেদের প্রাসঙ্গিক ও ক্ষমতাবান রাখতে ধর্ম-বর্ণ-জাতি-জাতপাতের নামে অসার বজ্জাতিটুকুই করতে পারবে। সবটা মিলিয়ে এই নতুনতর হঠাৎ-পাওয়া পরিস্থিতিকে মানুষ কীভাবে মোকাবিলা করেন সেটাই এখন দেখার।                          

Wednesday, 15 April 2020

করোনা চিত্র


পরিযায়ী শ্রমিক: সমস‍্যার একপিঠ মাত্র
সঞ্জয় মজুমদার

COVID-19 ঘিরে আমাদের দেশে যা কিছু ঘটছে তার দায় কারও একার উপর চাপানো ঠিক নয়। এটা পারস্পরিক দোষারোপ করার সময় নয়, রাজনীতির তো নয়ই। তবু দুর্ভাগ্যজনকভাবে দোষারোপ এবং রাজনীতি দুটোই চলছে এবং বেশ ভালো ভাবেই চলছে। সরকার বহু ক্ষেত্রেই তথ্য গোপন করছে, এইরকম সন্দেহ সাধারণের মধ্যে দানা বাঁধতে শুরু করেছে। খোদ মার্কিন মুলুক, যা করোনা সংক্রমণের ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছে,  সেখানেও চূড়ান্ত কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি চলছে।

আমাদের দেশে পরিযায়ী শ্রমিকদের যাতায়াত এবং জমায়েতের যা কিছু খবর সামনে আসছে তার কিছুটা হয়তো প্ররোচনামূলক বা গুজবের ফলশ্রুতিতে, তবে বেশির ভাগটাই মানুষ তাঁদের পুঞ্জীভূত উদ্বেগ ও আশঙ্কা থেকে আতঙ্কিত হয়ে করছেন। এর একটা কারণ বোধহয় পরিযায়ী শ্রমিকরা দলবদ্ধভাবেই থাকা বা ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। দশজনের মধ্যে তিনজনের বাড়ি ফেরার ইচ্ছে না থাকলেও, দলে ভিড়ে সেটা করতেই হয়। দিল্লি, বান্দ্রা এবং সুরাটের যা ছবি আমরা পাচ্ছি তা জনস্বাস্থ্যের নিরিখে নিঃসন্দেহে উদ্বেগের এবং চূড়ান্ত ক্ষতিকর। রোজগারের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, পকেটে টাকা-পয়সার অভাব, সংক্রমিত হওয়ার ভয়, ছোট অপরিচ্ছন্ন বাসস্থান, অভুক্ত দিনযাপন, কিংবা নিছকই বাড়ির টান- যে কোন‌ও কারণেই হোক এঁরা ফিরতে চাইছেন। সে ক্ষেত্রে প্রশাসনের একটা নিশ্চিত দায়িত্ব থেকেই যায়। হয় তাদেরকে বুঝিয়ে আশ্বস্ত করে আর‌ও কয়েকদিন সেখানেই আটকে রাখা, অথবা ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া। কার্যকরী সিদ্ধান্ত একটা নিতেই হবে।

বাড়ি ফিরতে চাওয়া শ্রমিকদের যেমন একটা বিরাট অংশ আছেন, তেমনি উল্টো দিকে, বেশ কিছু সংখ্যক শ্রমিক আছেন যাঁরা কিন্তু দলবদ্ধভাবেই ফেরার সিদ্ধান্ত নেননি। কারণটা অবশ্যই সেই রাজ্যের সরকারি ব্যবস্থাপনা, স্বেচ্ছাসেবক সংস্থা, এনজিও, স্থানীয় মানুষজন এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনেকটাই তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আপাতত সম্ভব হয়েছে। দীর্ঘ বছর ধরে আমার বাড়িতে কাজ করতে আসেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার সংগ্রামপুরের বাসিন্দা আজিজুল (মূলত খবরের কাগজ শিশি-বোতল লোহালক্কড় কিনে বিক্রি করেন)। আজিজুলের ছেলে মুম্বাইতে সোনার গয়নার কারখানায় কাজ করেন। ফোন করে জানতে পারলাম, কারখানার মালিক ব্যক্তিগত উদ্যোগে চল্লিশ জন কর্মীকেই মুম্বাইয়ের বিভিন্ন ফ্ল্যাটে এবং কারখানার একাংশ ইত্যাদিতে ভালো মতো থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। নিজেই গাড়ি চালিয়ে চাল ডাল তেল নুন পৌঁছে দিয়ে আসছেন। এরপরেও এঁদের একটা বড় অংশ, আগামীকাল বা কয়েক ঘণ্টা পরেই, কোথাও জমায়েত হয়ে বাড়ি ফিরতে চাইবেন না এমন নিশ্চয়তা দেওয়া যাচ্ছে না।

আরেকটা বিষয়, আটকে থাকা মানুষজনের মধ্যে শুধুমাত্র পরিযায়ী শ্রমিকরা আছেন, এটাই বা কেমন কথা! অজস্র মানুষজন অবস্থার ফেরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আটকে রয়েছেন। গন্তব্যে ফিরতে পারছেন না। কেউ পরিবার পরিজন সহ বেড়াতে গিয়ে আটকে রয়েছেন। কেউ মুমূর্ষু রুগী নিয়ে দক্ষিণ ভারতে গিয়ে আটকে রয়েছেন। প্রচুর ছাত্রছাত্রী তাদের হোস্টেল বা মেসবাড়িতে আটকে রয়েছেন। তাদের কথাটাও সামনে আনা প্রয়োজন। কিন্তু, সব মিলিয়ে এত কিছু ভাবতে গেলে লকডাউন তুলে দিতে হয়, ফলে সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং'ও মানার প্রয়োজন নেই, যা এই পরিস্থিতিতে অসম্ভব।  বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, ভারতে লকডাউনের সময়সীমা অনেক আগে থেকেই শুরু করা উচিত ছিল। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বারবার বলছেন, টেস্ট-এর (ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত) সংখ্যা যত বাড়ানো যাবে ততই করোনার বিরুদ্ধে লড়াই আমরা জোরদার করতে পারব। সরকারকেও এ ক্ষেত্রে প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করতেই হবে। তা না হলে কতজনের টেস্ট হয়েছে, কতজন সংক্রামিত হয়েছেন, চিকিৎসায় সাড়া দিয়েছেন কজন এবং শেষমেশ মারা গিয়েছেন বা সুস্থ হয়ে ফিরেছেন কতজন- এইসব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যত গোপন করা হবে ততই বিপদ বাড়বে। ফলে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করলেও কিছুতেই সচেতনতা আনা যাবে না এবং লকডাউনের প্রকৃত উদ্দেশ্য সার্থক হবে না। দিনের শেষে জনস্বাস্থ্য এবং অর্থনীতি, দুটোই মুখ থুবড়ে পড়বে। দৈনিক রোজগারের উপর ভিত্তি করে থাকা প্রান্তিক মানুষেরা যত বেশি কর্মদিবস হারাতে শুরু করবেন ততই হতাশা এবং হিংস্রতা তাঁদের মধ্যে জন্ম নেবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও লুটপাট করে খাওয়ার প্রবণতা বাড়বে।

এর সঙ্গে আর‌ও কিছু ছবি অস্বীকার করলে চলবে না। ধর্মীয় জমায়েত এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের জমায়েত ছাড়াও আমরা সাধারণ মানুষও দোকান বাজার রাস্তাঘাটে কারণে অকারণে অজস্র জমায়েত করেই চলেছি। বিভিন্ন মিডিয়াতে ক্রমাগত তার ছবি তুলে ধরা হচ্ছে। তবু হুঁশ ফিরছে না। পুলিশ প্রশাসনের শত চেষ্টা সত্ত্বেও মানুষজন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছেন। সম্প্রতি টেলিভিশন রিপোর্টে দেখা গিয়েছে, ক্যানিংয়ের বিডিও অফিসের সামনে কোনওরকম সরকারি ঘোষণা ছাড়াই, সম্ভবত গুজবের উপর ভিত্তি করে, কয়েক হাজার মানুষ সস্তায় চাল পাওয়ার আশায় লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।‌ ফলে জমায়েতের দায় কোন‌ও ব্যক্তি, রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে হাত ধুয়ে ফেলা যাবে না।

দাড়িপাল্লার একদিকে এখন করোনা নামক অতিমারিকেন্দ্রিক জনস্বাস্থ্য,  অন্যদিকে মানুষের রুজি-রোজগার ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অর্থনীতি। এই দুই পাল্লার ভারসাম্য রক্ষার দায় কার? অবশ্যই সিংহভাগটুকু সরকারকেই নিতে হবে, কোন‌ও সন্দেহ নেই। কিন্তু আমাদেরও রীতিমতো দায়িত্ব আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের পরামর্শে সরকার যা নির্দেশাবলী জারি করছে সেগুলো যতটা সম্ভব মেনে চলাটাই এই সময়ের দাবি। অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের জোগান আজকের তারিখ পর্যন্ত গোটা দেশে ঠিকই আছে। কেবল মানুষের কাছে সে সব পৌঁছনো সুনিশ্চিত করতে হবে।

চিকিৎসাকর্মী, পুলিশ বা প্রশাসনের কর্মী, ব্যাঙ্ক এবং পৌরকর্মী, প্রত্যেকেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছেন, যাঁরা নিজেরাও করোনা সংক্রমনের ভয়ে আতঙ্কিত। ইতিমধ্যেই আমাদের দেশ সহ গোটা পৃথিবীতে বেশ কয়েকশো চিকিৎসা ও পুলিশকর্মী করোনার প্রকোপে মারা গেছেন। আমরা না হয় ঝগড়াঝাঁটি ভুলে, ইগোর অত্যাচার পাশে সরিয়ে রেখে, এঁদের পাশে দাঁড়াই। আমাদের সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া করোনা মোকাবিলা কার্যত অসম্ভব এবং অবাস্তব।

Tuesday, 14 April 2020

নববর্ষের কথা

হন্তারক দৈত্যকে বোতলবন্দি 
করার রক্ষাকবচ প্রকৃতির হাতেই
অনিরুদ্ধ মুখোপাধ্যায়
 
ভাবি, আজ অন্তত আমরা একসাথে ভাবি।
 
যে নির্জন দ্বীপে আজ আমরা সবাই বসে আছি- কেন এখানে এলাম? কী এমন হল যার জন্য আমাদের এই বাধ্যতা? বরং চোখে দূরবীন লাগাই। দুর থেকে, হ্যাঁ, আমাদের রেখে আসা অতীতকে দেখি। আর চারপাশের আমাদের ক্রিয়াকলাপে চোখ রাখি। 

আমরা সুন্দর সুন্দর কথা বলি বিস্তর। মুখে লেগে থাকে হিসেবি হাসি। উন্নয়নের জোয়ারে আমরা গা ভাসাই। বাড়িতে আমি পাখির ছবি টাঙাই। নদীর পাড়ের হোটেলে আমি দিনযাপন করি। সমুদ্রতীরে গাড়ি ছোটাই। জলাভূমিকে মুহূর্তে উধাও করি। আমাদের রচিত শিল্পে বাতাসে জলে অন্ধকার নেমে আসে। প্রিয় সুর কখন উৎকট চীৎকার হয়ে যায়। স্বাভাবিক খাদ্য অস্বাভাবিক হয়ে যায় রাসায়নিক সখ্যের চক্রান্তে। বলি বটে জঙ্গলের রূপে আমরা মুগ্ধ- সে আমাদের কথার কথা। বরং যুগ যুগ ধরে যা কিছু স্বাভাবিক নিয়মে বাঁধা- এই আমরা আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে- তার ওপর আগ্রাসন চালিয়েছি। নিন্দুকরা তো হন্তারকও বলেন। ঐ নিন্দুকরা আসলে না-মানুষের দল। আমরা আমাদেরই তৈরি করা  শব্দবন্ধে উত্তর-আধুনিক সভ্যতার সীমা বাড়িয়ে চলেছি। ম্যাজিক দেখিয়ে গিয়েছি অন্যদের। হাতিয়ার করেছি অর্থ ও প্রযুক্তিকে। অবাক হয়ে সহনাগরিকেরা বুঝে না বুঝে যত হাততালি দিয়েছে, আমরা উচ্চকিত হয়েছি। আরও ম্যাজিক আরও। আমরা ভাব দেখিয়েছি আমরা আরোপিত ঈশ্বর- সব পারি, সব জানি, গতিবিধি আমার সর্বত্র। এভাবেই চলেছে যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী। আমাদের মতো করে আমরা আমাদের মনের ভূগোল ইতিহাস তৈরি করেছি। আমরাই স্থির করেছি প্রথম বিশ্ব-দ্বিতীয় বিশ্ব, সাদা-কালো, উন্নত-অনুন্নত কত না বিভাজন।

অতঃপর এই নির্জন দ্বীপে আজ
আমরা সবাই। সব পাওয়া আর সবহারারা এখন একই শৃঙখলে। একে অপরের প্রাণরক্ষার খাতিরে দ্বীপান্তরে। হানা দিয়েছে দৈত্য। অজানা দৈত্য প্রাণ নিতে এসেছে। অপ্রস্তুত পৃথিবী জুড়ে ত্রাস। আত্মকেন্দ্রিক ভোগক্লান্ত বৃহত্তর সমাজ তৈরি ছিল না এসবের তরে। আর তৈরি থাকবেই বা কীভাবে? আমরাই তো অনেকে বলে আসছিলাম, জলবায়ু পরিবর্তন- ওসব আবার কী? অ্যামাজন পুড়েছে? পুড়ুক না! অস্ট্রেলিয়ার আগুন লাগা অরণ্য থেকে বেরিয়ে পড়েছে মা কোয়ালা? কী এমন হয়েছে যদি মেষভালুক বা বাঘেরা হেঁটে বেড়ায় জাতীয় সড়কে? শত শত বছরের গাছেদের প্রকাশ্য নিধনও যেন তাদের প্রাপ্য- অনেকদিন তো বেঁচেছ। তোমরা মনুষ্যেতর- অনেক হয়েছে। আমরা বাড়তে বাড়তে দেখ প্রায় সাড়ে সাতশো কোটি গোটা বিশ্বে। আমাদের জায়গা দাও। পথ ছাড়ো তোমরা। আমরা চাঁদে গিয়েছি, গ্রহান্তরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি। আমরা বাজার জানি। বাজারও তার সেরা বিনোদনের বস্তুটিকে চিহ্নিত করে ফেলেছে। হঠাৎ কী যে হল! বলছিলাম না, অচেনা দৈত্য এসে পড়েছে। নিজেকে সে পরিবর্তন করে দ্রুত। সে শ্বাসঘাতী অত্যাচার করে। মৃত্যুর আগে ডুবে মরার অনুভূতি জোগায়। সেও হন্তারক। সেও অদৃশ্য। সেও ম্যাজিক জানে। সেও লড়াইয়ের কৌশল শিখে ফেলেছে। পালিয়ে বেড়াচ্ছি আমরা দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে। কী পরিহাস এই বসন্তের। আপনি নির্বাক। বরং সবাক হয়েছে না-মানুষেরা।

যদি আমাদের আর্তি, আমাদের বোধ প্রকৃতির মায়াজালকে টলাতে পারে সেটাই হবে শেষ সুযোগ। সেই সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য এখনও পড়ে আছে সামান্য কিছু প্রকৃতি ও তার সন্তানেরা। আসুন, আমরা সবাই এই অন্যরকম নতুন বছরের শুরুতে তাদের দিকে স্নেহ ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিই। আজ আমাদের দুর্দিনের এই দ্বীপান্তরে প্রকৃতিরও যে মনখারাপ। প্রকৃতির সন্তানেরা তো আমাদের ভালবাসতেই চেয়েছিল। ভুললে চলবে না, এই হন্তারক দৈত্যকে বোতলবন্দি করার রক্ষাকবচও কিন্তু প্রকৃতির হাতেই।
 নব আনন্দে জেগে ওঠার সুযোগ বিশ্বপ্রকৃতি মানবসভ্যতাকে নিশ্চয়ই আরেকবার দেবে।

Friday, 10 April 2020

বিশ্ব প্রকৃতি


উন্নত দেশগুলির বেহাল অবস্থা কেন!
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

কোভিড১৯-এর দাপটে এখন বিশ্ব জুড়ে নাভিশ্বাস। এ আর বলার মতো কী কথা! সে তো দেখাই যাচ্ছে। কিন্তু যা দেখা যাচ্ছে তার ভেতরে অন্য এক ছবিও যেন প্রতীয়মান।

কেউ কেউ এই দ্রুত পালটে যাওয়া চারপাশকে ‘এন্ড অফ ক্যাপিটালিজম’ বলছেন, কেউ বলছেন নতুন মানবসত্তার উত্থানের কথা। আকাশ আবার নীল রঙ ফিরে পাচ্ছে, বাতাস অনেক শ্বাসযোগ্য হচ্ছে, নদী-নালা স্বচ্ছ হয়ে উঠছে, কাশির দমকের সঙ্গে কালো কফ’ও তেমন দেখা দিচ্ছে না- এইসব ছবিও অনেককে স্বস্তি দিচ্ছে। তাহলে সব কিছু ছাপিয়ে এই ধরা কি আবার নির্মল, স্বচ্ছ, প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে? বহু মানুষ এমনটাই ভাবতে চাইছেন। দুর্যোগ-দুর্বিপাকে মৃত্যুভয়ে জর্জরিত, বিপন্ন, বিপর্যস্ত মানুষ আশার আলো বোনে, বহু গুণে মানবিক ও দার্শনিক হয়ে ওঠাই তার কাছে তখন ব্রত। এই স্বপ্নের বুনন তাকে কলুষমুক্ত করে। এ শুধু আজকের প্রবণতা নয়, বহুবার, বারবার মানুষ এমনতর স্বপ্নের ছাপ রেখে গেছে। কিন্তু আবারও, সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে এলে, সে তার জিঘাংসার দান ফেলতে কসুর করেনি।

একদিন কোভিড১৯’কে মনুষ্য প্রজাতি হয়তো জয় করবে, তার ঔষধি ও ভ্যাকসিনও আবিষ্কৃত হবে, মৃত্যু মিছিল স্তব্ধ হবে কিন্তু আবারও সে সুসময়ে নতুন করে মানুষের দুঃসহ যাপন যে পৃথিবীর আলোবাতাসকে গ্রাস করবে না, তার তো কোনও নিশ্চয়তা নেই! আমরা জানি, প্রতিটি কর্মের ফল সে কর্মের ছাপ বহন করে। আজ মানুষের ঐকান্তিক ও মরীয়া প্রচেষ্টায় হয়তো নিকট ভবিষ্যতে রুদ্ধ হবে কোভিড১৯-এর আগ্রাসন কিন্তু এর এই তীব্র প্রকোপে কি অতীত কর্মের কোনও ছাপ ছিল না? সে প্রশ্নটি আমাদের সাধারণজনকে বড় ভাবাচ্ছে। কিছু বেয়াড়া প্রশ্ন হয়তো অনেকেরই মাথায় ছিটকে উঠছে।

যেমন, বলা হয়েছে, কোভিড১৯ অত্যন্ত সংক্রামক হলেও এর মারণক্ষমতা মোট আক্রান্তের ২ থেকে ৩ শতাংশের বেশি নয়। এই ধারণাটি অনেক দিন ধরেই ঘুরছে এবং এ দেশের পরিসংখ্যানেও তেমন ইঙ্গিত আছে। কিন্তু চোখটা টেরিয়ে গেল ইউরোপিয় দেশগুলির তথ্য দেখে। জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয় তথ্যে (সূত্র: টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ১০ এপ্রিল ২০২০) দেখা যাচ্ছে,
দেশ                    আক্রান্ত            মৃত্যু          শতাংশ
স্পেন                   ১৫২৪৪৬         ১৫২৩৮         ৯.৯
ইতালি                 ১৪৩৬২৬         ১৮২৭৯         ১২.৭২
ফ্রান্স                    ৮৩০৮০         ১০৮৮৭         ১৩.১
ইংল্যান্ড                 ৬১৫১৬           ৭৯৭৮         ১২.৯৬
বেলজিয়াম              ২৪৯৮৩         ২৫২৩          ১০.০৯

অর্থাৎ, ইউরোপের অতি আক্রান্ত দেশগুলিতে মৃত্যুর হার ১০ শতাংশ বা তার অধিক। এই হার যে বাড়বে না সে কথা জোর করে এখনই কেউ বলতে পারছে না। সবচেয়ে বড় কথা, এ রোগের প্রকোপ কবে প্রায়-নির্মূল হবে সে কথাও অনিশ্চিত। তথাকথিত অনুন্নত দেশগুলি থেকে এইসব উন্নত দেশে মৃত্যুর হার কেন বেশি তা নিয়ে রয়েছে নানা মুনির নানা মত। যেমন, কেউ কেউ বলছেন, ইউরোপের দেশে বরিষ্ঠ মানুষজনের সংখ্যা বেশি এবং যেহেতু বয়সোজনিত কারণে তারাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন এবং তারা নানা পূর্ব-ব্যাধি দ্বারাও ন্যুব্জ অতএব তাদের মৃত্যুহারও বেশি। এই তথ্যটি আমি জানি না যথেষ্ট সাবলীল কিনা। এ নিয়ে তেমন কিছু সংকলনও হয়নি। তবে আরেকটি উল্লেখযোগ্য তথ্য ইতালি সম্পর্কে পাচ্ছি (সূত্র: www.worldometers.info)- ১০ এপ্রিল ২০২০-তে সংকলিত মোট সমাধা হয়ে যাওয়া ৪৬৭৪৯ কেসগুলির (closed cases) মধ্যে আরোগ্য লাভ করেছেন ২৮৪৭০ জন বা ৬১ শতাংশ এবং মৃত্যু হয়েছে ১৮২৭৯ জনের বা ৩৯ শতাংশের। এই আরোগ্য লাভ ও মৃত্যুর মধ্যে দূরত্ব কিন্তু খুব বেশি লম্বা নয়। ছবিটি অত্যন্ত নিরাশাজনক।

প্রশ্ন হল, ইউরোপে মৃত্যুহারে এই উর্ধ্বগতি কেন?  যেমন ধরা যাক ইতালি। গত ২৫ মার্চ ‘দ্য ল্যানসেট’এ ইতালির মৃত্যুর কারণ নিয়ে ‘The Italian Health System and the Covid19 Challenge’ শীর্ষক একটি নিবন্ধ বেরিয়েছে। সেখানে ইতালির এই দুর্যোগের কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়েছে তাদের ন্যাশনাল হেলথকেয়ার সার্ভিস ব্যবস্থার ভেঙ্গে পড়াকে এবং তা ঘটেছে মূলত দীর্ঘদিন ধরে স্বাস্থ্যের বেসরকারিকরণ ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সরকারের তরফে অর্থ সংস্থানের জোগান কমিয়ে আনার ফলে। ২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ইতালিতে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ৩৭ বিলিয়ন ইউরো কাটছাঁট করা হয়েছে। এই বেপরোয়া বেসরকারিকরণ ও স্বাস্থ্যের ব্যবসা শুধু ইতালি কেন, প্রায় সমগ্র ইউরোপ ও আমেরিকায় সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্য বীমার দাসে পরিণত করেছে এবং অতি মাত্রায় ওষুধ, হাসপাতাল, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অস্ত্রোপচারের ওপর নির্ভরশীল করিয়েছে। যে কোনও মামুলি অসুখবিসুখেই ডাক্তার ও ওষুধের ওপর মানুষকে অতি মাত্রায় নির্ভর করিয়ে দেওয়ার ফলে অতি চিকিৎসা, ভুল চিকিৎসা ও অপ্রয়োজনীয় চিকিৎসার বলি হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। এই প্রাণঘাতী চিকিৎসা জনিত মহামারীতে মৃত্যু এক স্বাভাবিক জীবনপ্রণালীতে রূপ পেয়েছে, যাকে তারা আবার নামকরণ করেছে iatrogenic disease নামে। আমেরিকায় প্রতি বছরে সব থেকে বেশি মৃত্যুর প্রথম দুটি কারণ যদি হার্ট অ্যাটাক ও ক্যানসার হয় তো তৃতীয় কারণ হচ্ছে এই iatrogenic disease। ওষুধ ও হাসপাতালের ওপর এই অতি নির্ভরতা মানুষকে প্রকৃতি থেকে সম্পূর্ণত বিযুক্ত করেছে এবং জল কাদা মাটিতে বেঁচে থাকার যে স্বাভাবিক যাপন তার থেকে দূরে সরিয়ে তাকে ভূ-বিরোধী এক যান্ত্রিক সত্তায় পরিণত করেছে, যেখানে অজানা কোনও রোগ বা ভাইরাসকে মোকাবিলা করার জৈবিক ক্ষমতাকে সে হারিয়ে ফেলেছে। আর এই বিপর্যয় উন্নত দেশের প্রায় সব পরিসরেই নির্মম ভাবে থাবা বসিয়েছে।

গত ১৮ মার্চ ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় জর্জ মনবিয়ট একটি নিবন্ধে বলছেন, ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়াকে শাসন করছে প্রধানত তামাক ও তেল কোম্পানিগুলো। তাদের নির্দেশিত বিবিধ নীতির কারণে ভেঙ্গে পড়েছে জলবায়ুর ভারসাম্য, ধস নেমেছে জৈব জগতে, দূষিত হয়েছে জল ও বাতাস, অস্বাভাবিক ভাবে বেড়েছে শারীরিক স্থূলতা ও ক্রেতা ঋণ এবং সর্বশেষ প্রকোপ হল এই করোনা ভাইরাস। এই সার্বিক বিপর্যয়ের আধারেই আজকের কোভিড১৯-এর মারণক্ষমতাকে বিচার করা উচিত। সে তুলনায় ভারত সহ অন্যান্য এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলির অবস্থা অনেক ভাল। দারিদ্র্য ও পরম্পরাগত ঐতিহ্যের নানাবিধ কারণে প্রকৃতি-বিযুক্ত বদ্ধ জীবনের ওষুধ-সর্বস্বতা এখানে এখনও তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। যে কারণে মানুষের সাধারণ প্রতিরোধ ক্ষমতা এখানে অনেক বেশি ও প্রকৃতির নিয়মে নানা ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াকে সঙ্গী করে ও শরীরে তার স্বভাবজাত অ্যান্টিবডি তৈরি করেই বাঁচার কৌশলে তারা অনেক বেশি পারদর্শী। তা বলে, চিহ্নিত রোগী ও রোগের সংক্রমণকে উপেক্ষা করা বাঞ্ছনীয় নয়। কিন্তু উন্নত দেশের ‘অতি উন্নতি’র কাছে বিকিয়ে যাওয়া মানবিক সত্তা ‘অনুন্নত’ দেশের সাধারণজনের তুলনায় যে প্রকৃতিগত ভাবে দুর্বল ও অসহায় তা আজ এই বাতায়নে এসে স্বীকার করে নেওয়াই ভাল।

দেশের সুবিখ্যাত কার্ডিওলজিস্ট ডাঃ বি এম হেগড়ে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, অসুস্থ মানুষজনের মাত্র ১ শতাংশের চিকিৎসা দরকার। অসুখ ও রোগভোগকে শরীর ও মন অনেকাংশেই প্রতিরোধ করতে পারে। কথায় বলে, জ্বর হয়েছে? ওষুধ খেলে সাতদিনে সারবে, না খেলে এক সপ্তাহ। স্বাস্থ্য সচেতনতা, শরীরকে বুঝে চলা, ধুলো মাটি জল হাওয়া নিয়ে বাঁচা– এই হতে পারে আমাদের বিশ্ব প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতার সুর। আর সেখানেই আছে নীরোগ হওয়ার মোক্ষম দাওয়াই। তবু যদি শরীর না দেয় তখন তো ডাক্তারবাবুরা আছেনই। কিন্তু কথায় কথায় ওষুধ, হাসপাতাল, অস্ত্রোপচার? নৈব নৈব চ। কোভিড১৯ নিয়ে যে বিশ্বত্রাস ও উন্নত দেশগুলির মুখ থুবড়ে পড়া অবস্থা তার থেকে শিক্ষা নিয়েই আমাদের আরও আরও প্রকৃতির কোলকে আশ্রয় করতে হবে। ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া, পশু-পাখি, গাছপালা নিয়েই তো আমাদের সার্বিক জীবন।

তবে আমাদের অন্য এক দুশ্চিন্তা গ্রাস করছে। দেশে যে লকডাউন চলেছে তার অর্থনৈতিক অভিঘাত কী হতে পারে এ নিয়ে অবশ্যই শঙ্কার কারণ আছে। ক্ষুধা বনাম কোভিড– কোন পথে চলেছে দেশ? অর্থনীতির আঙ্গিনায় কি সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন আগতপ্রায়? সমস্ত কিছু কি উলটে যেতে বসেছে নাকি মহামারীর এ এক ক্ষণিকের ঝাপটা মাত্র! যার পর আবার আগের মতোই পৃথিবীকে দিকনির্দেশ করবে চরম লোভ ও জিঘাংসা! অত রোমান্টিকতার আদৌ কি কিছু আছে? উন্নত দেশগুলি সজোরে ধাক্কা খেল বলে কী এ অনুন্নত দেশগুলোর তির্যক তিরস্কার: দ্যাখ, কেমন লাগে!