Thursday, 27 March 2025

হিন্দি এক নির্মিত ভাষা

ভাষা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাক্ষিণাত্যের বিদ্রোহ

দীপঙ্কর দে



সারা দেশে, বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে, হিন্দি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নতুন করে জোরদার প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে উঠছে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্তালিন ও তাঁর দল ডিএমকে'র নেতৃত্বে। দ্রাবিড় জাতিসত্তার শক্ত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে তামিলরা ভারত রাষ্ট্রের ত্রিভাষা নীতি, নতুন শিক্ষা নীতি সহ ইউনিয়ন সরকারের ব্রাহ্মণ্যবাদী কেন্দ্রিকতার বিরুদ্ধে হুঙ্কার ছেড়েছেন। ভারত সরকারের শিক্ষা মন্ত্রীর 'টাকা আটকে' দেওয়ার অসাংবিধানিক হুমকির বিরুদ্ধে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রীর পাল্টা হুমকি 'কর দেওয়া বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিতে আমাদের এক মিনিট সময় লাগবে' স্রেফ রাজনৈতিক তরজা ভাবলে ভুল হবে।

হিন্দি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তামিলদের লড়াই আজকের নয়। ১৯৩৭ সালে তৎকালীন ভারত সরকার এক অধ্যাদেশ জারি করে আদেশ দেয়, তামিলনাড়ুর প্রতিটি সরকারি বিদ্যালয়ে হিন্দি ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক। সেই আদেশের বিরুদ্ধে ই ভি পেরিয়ারের নেতৃত্বে তামিলনাড়ুর বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। আন্দোলন চলে লাগাতার তিন বছর। ভাষা শহীদ হন দু' জন। অবশেষে ১৯৪০ সালে সেই আদেশ প্রত্যাহার করে বলা হয় দেবনাগরী লিপিতে লেখা হিন্দির সঙ্গে ইংরেজি ভাষাও সরকারি কাজকর্মে ব্যবহার করা যাবে। এই মীমাংসা সূত্রটি কার্যকর করার ক্ষেত্রে খুব সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু। 

তামিলনাড়ুর হিন্দি বিরোধী আন্দোলনকে বুঝতে হলে তৎকালীন রাজনীতির চর্চা অবশ্যই আবশ্যক। গত শতকের গোড়ার দিকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস উদ্যোগ নেয়, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন সংগঠিত করতে একটি সর্বজন সম্মত ভারতীয় ভাষাকে ব্যবহার করা হবে। সেই মতো ঠিক হয় হিন্দি বা হিন্দুস্থানী হবে সেই ভারতীয় ভাষা। ১৯১৮ সালে মহাত্মা গান্ধীর উদ্যোগে 'দক্ষিণ ভারত হিন্দি প্রচার সভা' প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২৫ সালে জাতীয় কংগ্রেস ইংরেজির পরিবর্তে হিন্দুস্থানী ভাষাকে দলীয় যোগাযোগের মাধ্যম বলে স্বীকৃতি দেয়।

১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে ক্ষমতায় আসে জাতীয় কংগ্রেস। প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী হন কংগ্রেসের রাজাগোপালাচারী। ১৯৩৭ সালের অগস্ট মাসে, ক্ষমতায় আসার এক মাসের মধ্যেই, রাজাগোপালাচারী প্রতিটি বিদ্যালয়ে হিন্দি ভাষা শিক্ষাকে আবশ্যিক ঘোষণা করেন। তখন তামিলনাড়ু কংগ্রেসে ব্রাহ্মণ নেতাদের প্রাধান্য ছিল। তাছাড়া রাজাগোপালাচারী নিজেও ছিলেন কট্টর ব্রাহ্মণ। তিনি একটি পদার্থবিদ্যার পুস্তক অনুবাদকালীন প্রচুর সংস্কৃত শব্দের ব্যবহার করায় এমনিতেই সমালোচিত ছিলেন। ক্ষমতায় এসেই তাঁর হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত স্বাভাবিক ভাবেই তামিল রাজনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। পেরিয়ারের 'আত্মসম্মান আন্দোলন' (সেলফ রেসপেক্ট মুভমেন্ট) ও জাস্টিস পার্টি একযোগে হিন্দি আগ্রাসনের প্রতিবাদে গণ আন্দোলনের ডাক দেয়। রাজাজীর ঘোষণার প্রতিবাদে ৪ অক্টোবর ১৯৩৭ এক হিন্দি বিরোধী জনসভার আয়োজন হয়। আন্দোলন উপেক্ষা করে রাজাগোপালাচারী ২১ এপ্রিল ১৯৩৮ সালে এক আদেশনামায় তামিলনাড়ুর সব কটি সরকারি বিদ্যালয়ে (১২৫) হিন্দি বাধ্যতামূলক বলে বিজ্ঞপ্তি জারি করেন। 

হিন্দি বিরোধী আন্দোলন আরও গতি পায়। এমনকি শৈব ধর্মাবলম্বীরাও ভেলোরে অনুষ্ঠিত তাঁদের মহাজন সভায় হিন্দির বিরোধিতা করেন। তামিলনাড়ুর মুসলিম লীগ উর্দুর পরিবর্তে তামিল ভাষার দাবিতে সামিল হন। অনেক আর্য ব্রাহ্মণও একই সিদ্ধান্ত নেন। তাই তামিল ভাষার আন্দোলন স্রেফ দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমিত ছিল না। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে তামিলবাসী তাঁদের মাতৃভাষা রক্ষার তাগিদে তীব্র হিন্দি বিরোধিতায় সামিল হয়েছিলেন। ১৯৩৯ সালে ভারতের বিশ্বযুদ্ধে যোগদানের বিরোধিতায় মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির কংগ্রেস সরকার ইস্তফা দেয়। শাসনভার গ্রহণ করেন গভর্নর জেনারেল। গভর্নরের আশ্বাসে ৩১ অক্টোবর পেরিয়ার আন্দোলনে বিরতি টানেন। অবশেষে  ১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মাদ্রাজ সরকার বাধ্যতামূলক হিন্দি শিক্ষার আদেশ প্রত্যাহার করে।

সাময়িক পিছু হটলেও জাতীয় কংগ্রেস সারা দেশে হিন্দি চাপানোয় অনড় ছিল। ১৯৬৪ সালে নেহেরুর মৃত্যুর পর নতুন করে উদ্যোগ নেওয়া হয় শুধুমাত্র হিন্দিকেই রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার। দিল্লী ঘোষণা করে ১৯৬৫ সালের ২৬ জানুয়ারি থেকে দেশে বলবৎ হবে সরকারি ভাষা আইন (অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাক্ট) এবং হিন্দি হবে সরকারি ভাষা। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে গোটা তামিলনাড়ু। ত্রিচিতে চিন্নাস্বামী নামে এক যুবক প্রতিবাদে আত্মাহুতি দেয়। কলেজ ছাত্রদের উদ্যোগে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। প্রতিবাদে আরও কয়েক জন আত্মাহুতি দেন। তামিল নেতা আন্নাদুরাই ২৬ জানুয়ারি শোক দিবস পালনের ডাক দেন। পরবর্তী দু' সপ্তাহে ভাষা দাঙ্গায় প্রাণ হারান অন্তত ৭০ জন নাগরিক। তামিল প্রতিরোধে পিছু হটতে বাধ্য হয় দিল্লী। অবশেষে ১৯৬৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী এক রেডিও ভাষণে তামিল নাগরিকদের আস্বস্ত করেন, নেহেরুর প্রস্তাবিত হিন্দি ও ইংরেজি দুটি ভাষাই সরকারি ভাষা বলে ব্যবহৃত হবে। প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে আন্দোলন তুলে নেওয়া হয়। কিন্তু তারপরে আর কোনওদিন জাতীয় কংগ্রেস বা অন্য কোনও সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল তামিলনাড়ুর মসনদে বসতে পারেনি। তাদের কোনও না কোনও তামিল ভাষী আঞ্চলিক দলের লেজুড় হয়ে রাজনীতি করতে হয়েছে। সেই থেকে তামিলনাড়ুর রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে কোনও আঞ্চলিক দল। তামিল রাজনীতি আবর্তিত হয় তাদের মাতৃভাষা ও দ্রাবিড় জাতিসত্তাকে আঁকড়ে ধরেই। ষাটের দশকে তামিল জাতিসত্তার আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয় ডিএমকে নেতা করুণানিধি (বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্টালিনের পিতা)।

গত ষাটের দশকে তামিলনাড়ুতে ভারত সরকারের ত্রিভাষা নীতির প্রতিবাদের পর ইউনিয়ন সরকার ত্রিভাষা বাধ্যতামূলক না করলেও দিল্লী লাগাতার হিন্দি ভাষার আগ্রাসন চালিয়ে গেছে অ-হিন্দিভাষী রাজ্যগুলোর উপর। বিগত এক দশকে সব সরকারি ক্ষেত্রে হিন্দির আধিপত্য পরিকল্পিত ভাবে বাড়িয়েছে ভারত সরকার। সারা দেশে এমন এক বাতাবরণ সৃষ্টি করা হয়েছে যাতে মনে হবে হিন্দি ভারতের জাতীয় ভাষা। সাধারণ নাগরিক থেকে উচ্চ আদালতের এক মাননীয় বিচারক পর্যন্ত তাঁর রায়ে হিন্দিকে ভারতের জাতীয় ভাষা বলে ভুল করে বসেন। আমরা যেন ভুলে যেতে বসেছি, ভারতে কোনও একটি জাতীয় ভাষা নেই। দেশের অন্তত বাইশটি প্রাচীন ভাষাকে সংবিধান স্বীকৃত ভাষা বলে গণ্য করা হয়। 

২০২০ সালে নতুন শিক্ষা নীতি ঘোষণার পর ভাষা সমস্যা আবার মাথা চাড়া দিয়েছে। খানিকটা পরিবর্তন করে আবার ত্রিভাষা নীতির কথা বলা হয়েছে। আগের ত্রিভাষা নীতিতে বলা ছিল, সব কটি অ-হিন্দি ভাষী রাজ্যে ইংরেজি ও স্থানীয় ভাষা শিক্ষার সঙ্গে হিন্দি অবশ্যই শিখতে হবে (স্মরণ থাকতে পারে, স্বাধীনতার পর ভাষার ভিত্তিতে রাজ্যগুলির পুনঃগঠন হয়েছিল)। নতুন শিক্ষা নীতিতে বলা হল, অ-হিন্দি ভাষী রাজ্যগুলিতে তিনটে ভাষা শিখতে হবে তবে কোনও বিশেষ ভাষার কথা উল্লেখ করা হল না। শুধু বলা হল, তিনটে ভাষার অন্তত দুটি ভাষা হতে হবে স্থানীয় ভাষা। সরাসরি হিন্দির উল্লেখ না থাকলেও ত্রিভাষা নীতিতে হিন্দি চাপিয়েই দেওয়া হল; কারণ, ইংরেজির সঙ্গে  হিন্দি হচ্ছে ভারতের সরকারি ভাষা। তাই কোনও বাঙালি বা তামিল ছাত্রকে, বিদ্যালয়ে তিনটি ভাষা শিক্ষা আবশ্যিক হলে, স্বভাবতই তাদের নিজেদের মাতৃভাষার সঙ্গে হিন্দি শিখতে হবে যেহেতু তিনটির অন্তত দুটি ভাষা হতে হবে ভারতীয় ভাষা। ঠিক এখানেই তামিলরা আপত্তি তোলেন। তাঁদের যুক্তি খুব পরিষ্কার। ছাত্রদের  তিনটি ভাষা শেখার চাপ অযৌক্তিক। তাছাড়া হিন্দি ভাষী রাজ্যগুলিতে ছাত্ররা যখন বড় জোর দুটি ভাষা শিখছে তখন অ-হিন্দি ভাষী রাজ্যের ছাত্রদের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক ভাবে তিনটি ভাষা শেখার নীতি বিভেদমূলক।

প্রশ্ন হচ্ছে, ভারত রাষ্ট্র কেন বার বার অ-হিন্দি ভাষী রাজ্যগুলিতে হিন্দি চাপাতে চাইছে? আরও আশ্চর্যের বিষয় হল, হিন্দি ভাষার বয়স মেরেকেটে মাত্র দুশো বছরও হবে না। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে এই ভাষাটি নির্মাণ করা হয়েছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উদ্যোগে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ভাষাবিদ জন গিলক্রিস্টের তত্ত্বাবধানে। মনে রাখতে হবে, তখন সরকারি দফতরে ফার্সি ও উর্দু ভাষার চল ছিল; আর ছিল হিন্দুস্থানী ভাষা, যা মূলত উত্তর ভারতের কথ্য ভাষা। মীরার ভজন গীত হত হিন্দুস্থানী ভাষায়। দফতরের কাজের সুবিধার্থে গিলক্রিস্ট সাহেবের উদ্যোগে হিন্দুস্থানী ভাষার পরিমার্জন করে নির্মিত হল হিন্দি। ফার্সি ও উর্দু শব্দের পরিবর্তে ব্যবহার করা হল সংস্কৃত শব্দ আর লিপি হল দেবনাগরী। এভাবেই তৈরি হল আর্যাবর্তের ভাষা হিন্দি। সিপাহী বিদ্রোহের পর সরকারি মদতে খুব দ্রুত ফার্সি, উর্দু ও হিন্দুস্থানী ভাষার স্থান দখল করল হিন্দি। সেই থেকে হিন্দু জনগোষ্ঠীর ভাষা হয়ে উঠল হিন্দি আর মুসলমানের ভাষা উর্দু। ধর্মের ভিত্তিতে দুই ভাষা ভাষীরাও বিভক্ত হয়ে গেলেন। 

গত দুশো বছরে হিন্দির আগ্রাসনে বর্তমান আর্যাবর্তের বহু প্রাচীন ভাষা ও আদিবাসী কৃষ্টি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। স্বাধীন ভারতে হিন্দুত্বের আগ্রাসন যত বেড়েছে সঙ্গে বেড়েছে হিন্দির আগ্রাসন। ভারতে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান হয়ে উঠেছে আর্যাবর্তের এক রাজনৈতিক হাতিয়ার। অনার্য দক্ষিণ ভারত এই আগ্রাসন মেনে নিতে পারেনি। দ্রাবিড় জাতিসত্তা বার বার রুখে দাঁড়িয়েছে ব্রাহ্মণ্যবাদী আর্য আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। হালে অনার্য ও আর্য বিভাজন দক্ষিণ ও উত্তর ভারতের বিভাজন বলে প্রচারিত হচ্ছে। এই বিভাজন মূলত সভ্যতার দ্বন্দ্বের প্রকাশ। অনার্য ও আর্যদের ঐতিহাসিক লড়াই আজও চলছে।


No comments:

Post a Comment