Monday, 24 March 2025

কবর খুঁড়ে ঔরঙ্গজেব কেন?

মেরুকরণ ও বিদ্বেষই বিজেপির অস্ত্র

সোমা চ্যাটার্জি



গত দু' দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতীয় রাজনীতির সবচেয়ে সংবেদনশীল বিষয় হল, পুরনো মসজিদ্গুলিকে পুরনো হিন্দু মন্দিরের নতুন সংস্করণ দিয়ে প্রতিস্থাপন করার প্রচেষ্টা; সাম্প্রতিককালে যার ছায়া পড়েছে মহারাষ্ট্রে। নাগপুর থেকে প্রায় ৫০০ কিলোমিটার দূরে ছত্রপতি সম্ভাজিনগর জেলায় (যা আগে ঔরঙ্গাবাদ নামে পরিচিত ছিল) ৩০০ বছরেরও বেশি পুরনো ঔরঙ্গজেবের একটি সাধারণ স্মৃতিস্তম্ভ কট্টর হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলি দ্বারা অপসারণের দাবিতে বিতর্কের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে ও দাঙ্গার রাজনীতিকে উসকে দিয়েছে।

এই হিংসার সূত্রপাত শিবাজি পুত্র সম্ভাজির উপর নির্মিত 'ছাভা' নামে একটি বলিউড চলচ্চিত্র যেখানে ওই মারাঠা শাসককে ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে দেখা যায় এবং হেরে যাওয়ার পর তাকে শারীরিক ভাবে নিগৃহীত করা হয়। এর আগে সমাজবাদী পার্টির নেতা আবু আজমি মহারাষ্ট্র বিধানসভায় বলেন যে 'ছাভা'তে ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। এই মন্তব্যের ফলে তাকে বিধানসভা থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং তিনি তাঁর মন্তব্য প্রত্যাহার করে নেন। এরপর বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরং দল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের কুশপুতুল পুড়িয়ে তাঁর সমাধি অপসারণের দাবিতে স্লোগান দেওয়ার পর গত সোমবার (১৭ মার্চ) থেকে সেখানে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, ৩০০ বছর আগে অনাড়ম্বর ও খোলা কবরস্থানে সমাহিত ঔরঙ্গজেব আজ এতদিন পরে হঠাৎ এত আলোচিত ও বিতর্কিত হয়ে উঠলেন কেন?

তার কারণ সম্ভবত এই যে, মুঘল সাম্রাজ্যের ষষ্ঠ শাসক ঔরঙ্গজেব তাঁর ৩৯ বছরের রাজত্বকালে  ভারতীয় উপমহাদেশের বেশির ভাগ অংশকে তাঁর একক শক্তির অধীনে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে মুঘল সাম্রাজ্যের জনসংখ্যা সমগ্র ইউরোপকে ছাপিয়ে যায় এবং তাদের সম্পদ বিশ্বে অতুলনীয় হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদরা সুপরিকল্পিত ভাবে ওই সময় ঔরঙ্গজেবকে ধর্মান্ধ ও নিষ্ঠুর শাসক হিসেবে চিহ্নিত করেন। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক জেমস মিল'এর 'দ্য হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া' বা ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সচিব হেনরি মায়ারস এলিয়ট'এর 'দ্য হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া অ্যাজ  টোলড বাই ইটস ওন হিস্টোরিয়ান' পড়লে বোঝা যায়, এদের উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের তুলনায় তথাকথিত হিন্দু যুগ ও বৃটিশ ঔপনিবেশিকতার মহত্ব প্রচার এবং ঔপনিবেশিক স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ঔরঙ্গজেবকে খলনায়কে পরিণত করা। ব্রিটিশ বর্ণিত এই ইতিহাস ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিদ্দ্বজ্জনেদের কাছে ঔরঙ্গজেবকে ধর্মান্ধ, নিষ্ঠুর শাসক হিসেবে পরিচিত করে তোলে। ১৯২৪ সালে শীর্ষস্থানীয় ইতিহাসবিদ  যদুনাথ সরকারের 'হিস্ট্রি অফ ঔরঙ্গজব' বইটিতেও তিনি ঔরঙ্গজেবের রাজনৈতিক দর্শনকে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও অসহিষ্ণু বলে ব্যক্ত করেছেন। ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত 'ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া' গ্রন্থে নেহেরুও ঔরঙ্গজেবের শাসনকালের ত্রুটিগুলি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন এবং তাঁকে 'একজন ধর্মান্ধ ও কঠোর শুদ্ধবাদী' বলে তিরস্কার করেন। সম্ভবত এই ধরনের বিবৃতিই ভারতের হিন্দু ও মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে উগ্র জাতীয়তাবাদের সূচনা করে এবং সমগ্র ভারতীয় বিদ্বান সমাজে ঔরঙ্গজেব একজন ক্রূর, হিংস্র ও হিন্দু বিদ্বেষী মুসলমান শাসক হিসেবে চিহ্নিত হন।

আধুনিক ভারতের অনুষঙ্গ থেকে ঔরঙ্গজেবকে মুছে ফেলার রাজনৈতিক প্রচেষ্টা শুরু হয় ২০১৫ সালে যখন দিল্লির ঔরঙ্গজেব রোড'এর নাম পরিবর্তন করে এপিজে আব্দুল কালামের নামে করা হয় এবং বিজেপি ও সমমনস্ক হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ঔরঙ্গজেবকে একজন নিষ্ঠুর ইসলামপন্থী নিপীড়ক হিসাবে বর্ণনা করতে থাকে। ২০২২ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী  বারাণসীতে কাশী বিশ্বনাথ মন্দির সংলগ্ন 'জ্ঞানব্যাপী মসজিদ' ধ্বংস করার সপক্ষে বলতে গিয়েও 'ঔরঙ্গজেবের নৃশংসতা ও সন্ত্রাস' সম্পর্কে বলেন, যদিও জ্ঞানব্যাপী মসজিদটি আদৌ কোনও হিন্দু মন্দিরের উপর নির্মিত কিনা তার কোনও ইতিহাস ভিত্তিক প্রমাণ আজও মেলেনি এবং আদালতে এটি বিচারাধীন।

বিজেপি এবং আরএসএস'এর যৌথ উদ্যোগে মুসলমান বিরোধী অ্যাজেন্ডার অংশ হিসেবে বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়া ও কিছু পত্রিকায় ঔরঙ্গজেব সম্পর্কে বহু মিথ্যা ধারণা প্রচার করা হচ্ছে। যেমন, তিনি নাকি অনেক হিন্দু মন্দির ধ্বংস এবং লক্ষ লক্ষ হিন্দুদের হত্যা করেছিলেন। অথচ, ঔরঙ্গজেব তাঁর ন্যায়বিচারের জন্য সমস্ত ধর্মীয় ধারার মানুষের কাছে আলোচিত ছিলেন। শুধু তাই নয়, ঔরঙ্গজেব বহু হিন্দু মন্দির সংস্কার করে ব্রাহ্মণদের জমি, বৃত্তি চালু করেছিলেন এবং সম্ভবত তিনিই তাঁর প্রশাসনে সবচেয়ে বেশি হিন্দুদের নিয়োগ করেছিলেন। ঔরঙ্গজেব হিন্দু উৎসবের উপর চালু কর বাতিল করে এই ধরনের উদযাপনকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। অসংখ্য ইউরোপীয় ভ্রমণকারী এবং হিন্দু লেখক ১৬৯০'এর দশকের শেষের দিকে হোলি উদযাপনের কথা উল্লেখ করেছেন যেখানে ঔরঙ্গজেবের নিজের সন্তানরাও অংশ নিতেন।

গত এক দশক ধরে ভারতের ইতিহাসকে বিকৃত করে ভারতের ইসলামি অতীত সম্পর্কে মানুষকে বিভ্রান্ত করার যে নির্লজ্জ প্রচেষ্টা বিজেপি তথা প্রধানমন্ত্রীর মদতপুষ্ট হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলো চালাচ্ছে তাতে ভারতীয় রাজনীতির সহিংসতার দিকটিই প্রতিভাত হয়ে উঠছে। সুপরিকল্পিত ভাবে গোদি মিডিয়া এবং বলিউডকে ব্যবহার করা হচ্ছে একের পর এক জাতীয়তাবাদী বিতর্ক উসকে দিয়ে ভুল তথ্য-নির্ভর ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র বানাতে, যেমন, 'পদ্মাবত', 'পৃথ্বীরাজ', 'তানাজি', যেখানে সব মুসলমান শাসকই বর্বর, নিষ্ঠুর এবং হিন্দু বিরোধী। অথচ যে সময়ের পটভূমিতে চলচ্চিত্রগুলি তৈরি হয়েছে, সেই সময় জাতীয়তাবাদের কোনও ধারণাই ভারতীয়দের মধ্যে ছিল না।

এখনও অনেক ভারতীয় বিশ্বাস করেন যে মুসলমান শাসকেরা প্রায়শই ইচ্ছাকৃতভাবে হিন্দু মন্দিরগুলি লুটপাট ও ধ্বংস করে মসজিদ নির্মাণ করতেন। স্বাধীনতার পর প্রথম চার দশকে এই সমস্যাটি এত প্রকট ছিল না। কিন্তু ১৯৮০-র দশকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বিজেপি অযোধ্যায় ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত 'বাবরি মসজিদ'এর স্থানে একটি রাম মন্দির নির্মাণের জন্য প্রচার শুরু করে এবং ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা ওই মসজিদ ভেঙে ফেলে। এর ফলে ভারতের হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কমপক্ষে ২০০০ মানুষের মৃত্যু হয়। এই  আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল আরএসএস এবং অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি যা 'সংঘ পরিবার' নামে পরিচিত; যাদের মূল উদ্দেশ্যই হল ভারতে হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণ এবং মুসলমান নিধন।

২০১৪ সালে মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুসলমান বিরোধী ঘৃণার মনোভাব এবং হিংসাকে বৈধতা দানের মাধ্যমে ধর্মীয় মেরুকরণের সপক্ষে একের পর এক আইন প্রণয়ন করে চলেছে। তারা ২০১৭ সালে গো-মাংস নিষিদ্ধ করা থেকে ২০১৯'এর নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের মাধ্যমে ক্রমাগত মুসলমানদের কোণঠাসা করে ফেলার পদক্ষেপ নিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর চাপ সৃষ্টি করে  চলেছে। উত্তরাখণ্ডে ইতিমধ্যেই আইনে পরিণত হওয়া ইউনিফর্ম সিভিল কোড দুই প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির আন্তঃধর্মীয় ও আন্তঃবর্ণ বিবাহ বা তাদের নিজস্ব পছন্দের লিভ-ইন সম্পর্কে প্রবেশের সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষিত স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে। সংসদে পাসের অপেক্ষায় থাকা হাল আমলের ওয়াকফ সংশোধনী বিল প্রণয়নেরও আসল উদ্দেশ্য সমস্ত মুসলিম দাতব্য সম্পত্তি, মসজিদ এবং সমাধিসৌধকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা।

'ইউএপিএ অ্যামেন্ডমেন্ড অ্যাক্ট'এর ভয়াবহ বাতাবরণে বিনা বিচারে মানুষকে গ্রেফতার করে জেলে বন্দি করে রাখা হচ্ছে। উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশে সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত জীবনও আজ রাষ্ট্রের নজরদারি ও হস্তক্ষেপে বিপর্যস্ত। উত্তরপ্রদেশের সম্ভলে এ বছর জুমার নামাজের বিরুদ্ধে 'হোলি' উদযাপন ছিল পরিকল্পিতভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রচারের অংশ। এমনকি 'হোলির' দিন সম্ভলের  মসজিদ্গুলিকে ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় এবং প্রশাসন ওইদিন মুসলমানদের বাড়ির ভিতর থাকতে আদেশ দেয়। দলিতরাও এই হোলির হিংসার বলি হয়েছে। বিহারের ঔরঙ্গাবাদ জেলায় এক দলিত নাবালিকা কোমল পাসওয়ানকে রঙ নিতে অস্বীকার করার জন্য পিষে মেরে হত্যা করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

ভারতের ক্রমাগত নিম্নগামী অর্থনৈতিক অবস্থা, মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারত্বের দিক থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘোরানোর লক্ষ্যে আজ পাঠ্যপুস্তক ও গণমাধ্যমের মাধ্যমে মুসলমান বিরোধী ঘৃণার মনোভাব ও ধর্মান্ধতার ধারণাগুলি সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং শিক্ষা, সংস্কৃতি ও কর্মক্ষেত্রেও এই গৈরিকিকরণ চলেছে। মুসলমান বিরোধী নিপীড়নের নতুন নতুন অজুহাত আবিষ্কৃত হচ্ছে এবং সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় অনুভূতির বিরুদ্ধেও নতুন সব হাতিয়ার তৈরি হচ্ছে। নিত্য নতুন আইন ও বিল মুসলমানদের প্রতিদিন আরও ভীত, সন্ত্রস্ত ও দুর্বল করে তুলছে এবং নিরাপত্তাহীনতার দিকে  ঠেলে দিচ্ছে।  

বিকৃত ইতিহাস, ধর্মীয় মেরুকরণ ও রাজনীতির এই ত্রিভুজ সংকটে সাধারণ মানুষের আবেগ বিধ্বস্ত ও দোদুল্যমান। তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করার দায়িত্ব বর্তমান প্রজন্ম ও সচেতন নেতৃত্বের হাতে।


10 comments:

  1. Well written

    ReplyDelete
  2. Mallika Sinharoy25 March 2025 at 13:02

    অসাধারণ প্রতিবেদন

    ReplyDelete
  3. Ashombhab bhaalo lekha. Ei dharoner lekha aaro prokaashito hok, shompaadoker kaacchey Aarti.

    ReplyDelete
  4. Khub sundor lekha hoeche, besh kichu alada drishtibhongi phute utheche.

    ReplyDelete
  5. সুভাষ দাস
    বাংলায় হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক (মধ্যযুগ)--
    শ্রীজগদীশনারায়ন সরকার / প্রকাশক:
    বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ
    বইটি পড়ে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক অনেকটা বুঝতে পেরেছি।

    ReplyDelete
  6. অসাধারণ সত্যি খুব ভালো লাগলো পড়ে , হিন্দু ও মুসলিম কিছু বুঝি না বুঝি আমরা মানুষ ।

    ReplyDelete
  7. Contemporary topic. Do we wait for new history book? Many countries are getting into the grips of fundamentalism. See the situation in our neighbouring contry. But I am sure, ultimately humanity will win and prevail. Common peace and development loving people will say the final words. We can always be prouder hindu and prouder human being as well. No need to hate others.

    ReplyDelete
  8. নিরপেক্ষ এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি কে ইঙ্গিত করে লেখাটি। ধর্ম আগে না মানুষ আগে? এটা যদি আজ ও না বুঝি -- এগিয়ে না কি পিছিয়ে চলেছি আগামী ভয়াবহ দিনগুলিতে ..?

    ReplyDelete
  9. ভালো লেখা

    ReplyDelete
  10. খুব সুন্দর গোছানো লেখা, বেশ ভালো লাগলো। এসময়ের প্রাসঙ্গিক লেখা। কলম চলুক। আরো নুতন লেখার প্রতিখ্যায় রইলাম।

    ReplyDelete