চারিপাশ নীল হয়ে যাক ঈর্ষায়
শ্রেয়া ঘোষ
১৯ ফেব্রুয়ারি ট্যাংরা, ২৮ ফেব্রুয়ারি মধ্যমগ্রাম, পর দিনই ১ মার্চ বেহালা, ৩ মার্চ আলিপুরদুয়ার; টেলিভিশনে খবর শুনতে ভয় করছে, সকালের খবরের কাগজ খুলতে ভয় করছে। 'অদ্ভূত আঁধার এক এসেছে...'। যেন করোনার চেয়েও মারাত্মক সংক্রমণ। সপরিবারে আত্মহননের ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত। সিদ্ধান্ত কিন্তু যৌথ নয়, একক। তারপর আর সকলকে রাজি করানো। অথবা, কোনও ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গোপন রেখে এই ভয়াবহ হত্যালীলা। একটি ঘটনা প্ররোচনা দিচ্ছে আর একটি সদৃশ ঘটনা ঘটাতে। নিউক্লিয়ার চেইন রিয়্যাকশনের মতো বিধ্বংসী একটা পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।
আমরা বলব এঁরা দুর্বল, ভীতু। সংকটের সঙ্গে লড়াই করার পরিবর্তে একটা তাৎক্ষণিক সমাধান, যেটা কদাপি কোনও সমাধান হতে পারে না, সেটাকেই বেছে নিচ্ছেন। আচমকা সব শেষ করে দিচ্ছেন অথচ এই অন্ধকার সুড়ঙ্গ কখনই একমাত্র পথ নয়, হতেই পারে না। অন্য পথের সন্ধান করার মতো মানসিক ধৈর্যটুকু না রেখে এমত এক নির্মমতাকে শেষ আশ্রয় বলে মনে করছেন। অজস্র উদাহরণ ছড়িয়ে আছে যেখানে অবর্ণনীয় প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে মৃত্যুকে 'সূচ্যগ্র মেদিনী' ছাড়ছে না মানুষ। তাঁদের দৃষ্টান্ত থেকে প্রেরণা না নিয়ে হঠকারিতার পথের আশ্রয় নিচ্ছে কেন মানুষ? দৃঢ়তার অভাব? আলস্য? আত্মহনন করার কোনও অধিকার কিন্তু সমাজ দেয় না। এটা সামাজিক অপরাধ। কারণ, এই প্রবণতা একটা সাঙ্ঘাতিক কুদৃষ্টান্ত তৈরি করছে, আমরা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।
'Suicide' শব্দটির মধ্যে থাকা cide প্রত্যয়টির অর্থই হল killing। আর এই পরিবার সহ হননে লিপ্ত হওয়া এক সীমাহীন অপরাধ। একবার ভাবুন, ট্যাংরার পরিবারটির বালক-বালিকা দুটি স্কুলে যেতে ভালোবাসত। প্রতিবেশীদের সঙ্গে এই পরিবারের কোনও সম্পর্ক ছিল না, স্কুলের বন্ধুদের সাহচর্য ছিল এই নবীন দুটি প্রাণের অতি কাঙ্ক্ষিত। সংবাদে প্রকাশ, পরিবারের অভিভাবকেরা এমনকি এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি কয়েকদিন স্থগিত রেখেছিলেন স্কুলের পরীক্ষার কারণে। কিন্তু শেষ অবধি সেই সহজ আনন্দে বেঁচে থাকার সুযোগ পেল না ঐ দুর্ভাগা শিশু-কিশোর সন্তানেরা। কেন নিকটতম আপনজনেদেরও একবারও মনে হল না দুটি সম্ভাবনাময় কচি প্রাণকে নিকেশ করার এই একতরফা সিদ্ধান্ত তাঁরা কিছুতেই নিতে পারেন না।
ব্যবসায়ী এই পরিবারটি অগাধ সম্পত্তির মালিক ছিল। তথাপি তাঁদের বিপুল ঋণের বোঝা। অর্থাৎ, বেহিসেবি জীবনযাপন বা বিচক্ষণতার একান্ত অভাব বা এরকমই কোনও কারণে এই পরিণতি। বয়স্কদের ভুলের মাশুল কেন দেবে পরিবারের বাকি সদস্যরা। একজনের চরম দায়িত্বহীন কাজের দায়ভাগ নিতে বাধ্য হল পরিবারের নিরপরাধ সদস্যরা। আর এই ঘটনাকে চটজলদি প্যানাশিয়া ভেবে বসলেন আরও কত জন।
আর্থিক অনটনের থেকে মুক্তির কোনও উপায় না খুঁজে পেয়ে জীবনের ইতি টেনে দেওয়ার দুঃসহ দুঃখের এক ঘটনা আমার নিকট প্রতিবেশেই ঘটেছিল। একদম চোখের ওপর। তখন আমাদের বয়স তিরিশের আশেপাশে। আমাদের দুটি পরিবারের ভাড়া বাড়ির ঠিকানা ছিল অভিন্ন। প্রথম দর্শনেই ঐ ভদ্রলোক আমাকে দিদিভাই ডেকে আপন করেছিলেন। নিজেকে অক্লেশে আমাদের দুই প্রজন্ম এগিয়ে রেখে অভিভাবকসুলভ দায়িত্ব নিয়েছিলেন। অমায়িক এই ব্যক্তি যে এমন অঘটন ঘটাবেন কারও পক্ষে ভাবা সম্ভব ছিল না। সামান্য একটা কারখানা চালাতেন তিনি বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেই। প্রায় 'দিন আনি দিন খাই' অবস্থা। এক 'বিশ্বস্ত' কর্মচারীর অসততায় সর্বস্বান্ত হয়ে এই সিদ্ধান্তকেই একমাত্র পালানোর রাস্তা ভেবেছিলেন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তি তিনি শুধুমাত্র নিজের কথাই ভেবেছিলেন। ভাবেননি তাঁর প্রৌঢ়া স্ত্রীর কথা, অসুস্থ, নিঃসন্তান, চিরদিন শুধু অভাবী সংসারের জোয়াল টেনে যাওয়া তাঁর দুরবস্থার কথা; এতটুকুও না ভেবে তিনি নিজেকে শেষ করে সব দায়িত্ব থেকে পালিয়ে গেছেন ভোর রাতে, চুপিচুপি। স্ত্রী'র মৃত্যুর জন্য তিনি দায়ী ছিলেন পরোক্ষ ভাবে।
আবার আজ তিরিশ বছর পরে বিপুল অর্থ উপার্জন করেও মানুষ নিজের সৃষ্টি করা অনটনের গভীর খাদে ডুবে যাচ্ছে। চাহিদার এক অনন্ত জ্বালামুখ-- সবই, সব পেতে হবে, আজই, এই মুহূর্তে। জাগতিক সব সম্পদের মালিকানা পেতেই হবে। কারও থেকে যেন এক কণাও কম না পড়ে। সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া ট্র্যাজেডিগুলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ব্যাপ্তি বিশাল। কপর্দকশূন্য হতে প্রভূত সম্পদের অধিকারী ব্যক্তি রয়েছেন দুই সীমায়। কিন্তু মূল কারণ কাছাকাছি: অর্থ। অভাব বা প্রাচুর্য। অভাব সঞ্জাত অবসাদ বা প্রাচুর্য সঞ্জাত লোভ। কেউ লোভের হাতছানিতে পতঙ্গের মতো ঝাঁপ দিচ্ছে আগুনে। সর্বনাশ জেনেও পা দিচ্ছে চোরাবালিতে। অপরদিকে কারও ক্ষেত্রে দিনগত অতিবাহন এতটাই ক্লেশ বা ক্লান্তির যে, রূপ, রস, গন্ধ, মায়া, মমতা দিয়ে সাজিয়ে তোলা নিজের একান্ত আপন, নিজের সর্বস্ব পৃথিবীটা ছেড়ে বরাবরের মতো চলে যাচ্ছে।
"জলের কলরোলের পাশে এই নগরীর অন্ধকারে আজ
আঁধার আরো গভীরতর ক'রে ফেলে সভ্যতার এই অপার আত্মরতি"।
বিষাক্ত মাকড়সার মতো ঘাতক ভোগবাদ বাসা করছে আমাদের মস্তিষ্কে। গুটি পাকাচ্ছে, অসংখ্য ডিম্বাণু জমে জমে স্ফীত হচ্ছে তার পেট। একদিন সেই স্ফীতোদর ফেটে লক্ষ লক্ষ অষ্টাপদ জন্মের খিদে নিয়ে কিলবিল করে বেরিয়ে এসে ছড়িয়ে পড়ছে দিগ্বিদিকে। গিলে খাচ্ছে যা কিছু দৃশ্যমান তার কুটিল অক্ষিগোলকে। অন্তহীন সেই খিদের আগুনে জ্বলে যাচ্ছে মানুষ আজ। মুহূর্তকালের আয়ু নিয়ে যেন জন্মেছে সে। এই মুহূর্তেই সব চাই তার।
নৈতিকতা?
আমার ভাল থাকাই নীতি একমাত্র।
ভালো থাকা মানে?
আরও আরও বিলাস, ব্যসন, সব চাই। সব পেয়ে গেলে আরও চাই। চারিপাশ নীল হয়ে যাক ঈর্ষায়।
“চারিদিকে নীল নরকে প্রবেশ করার চাবি" - চারিপাশ, আত্মীয়, স্বজন, প্রতিবেশী? না, চারিপাশ মানে অসীম শূন্যতা। কেউ নেই, কেউ না। সামনে, পেছনে, পাশে একজনও নেই। না বন্ধু, না স্বজন, শুধু প্রতিপক্ষ। ছক সাজিয়ে বসে দান দিচ্ছে সকলে। ছাপিয়ে যেতে হবে, পিছনে ফেলে রেখে যেতে হবে তাকে, যে ছুঁতে চাইবে। পাশ থেকে সরে যাক প্রতিদ্বন্দ্বী যত অন্তহীন ঘোড়দৌড়ের বাজিতে।
সকলকে হারিয়ে কে জিতছে?
বিষ মেশানো পায়েস, মুঠো মুঠো ঘুমের ওষুধ, সিলিং'এর হুক থেকে ঝোলানো দড়ি।
"কোথাও সান্ত্বনা নেই পৃথিবীতে আজ;
বহুদিন থেকে শান্তি নেই।
নীড় নেই"
... এই ধরনের হনন প্রক্রিয়ার দায় সমাজের ওপরেও বর্তায়। ১৮৯৭ সালে, প্রায় সোয়াশো বছর আগে, ফরাসি সমাজতত্ত্ববিদ এমিল ডারখিম এরকম আত্মহত্যাকে 'এনোমিক সুইসাইড' নামে অভিহিত করেছেন যেখানে ব্যক্তি নয়, দায়ী করা হচ্ছে সমাজকে। যে সমাজ নাকি আমাদের ধারণ করে, সেখানেই যখন নীতি আর মূল্যবোধের চূড়ান্ত অবক্ষয় ঘটে, তখন মানুষও বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য হারিয়ে দিশাহীন হয়ে পড়ে। ডারখিমের এই ভাবনা ও পরবর্তী বিশ্লেষণ আত্মহননের মতো ঘটনার দায় কেবলমাত্র ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত বা স্বভাবের ওপর ন্যস্ত করে না।
জীবনের সার্থকতা, সাফল্যের সমাজ নির্ধারিত সংজ্ঞাকেই কেন আমরা মেনে নেব? আর সেই অনুসারে ব্যক্তিকে বিচার করব? সমাজ যদি মানুষকে নিরাপত্তা দিতে পারে, মর্যাদা দিয়ে গ্রহণ করতে পারে, তবে এইসব অপঘাত বন্ধ করা যাবে। টাকা, শিক্ষাগত ডিগ্রি, উঁচু পদ এরকম প্রথাগত কিছু মাপকাঠি দিয়ে মানুষকে বিচার করার মতো একটা হীন চিন্তা কেন অনাদিকাল আমরা বয়ে চলব আর পদে পদে মানুষকে অপমানে আর আঘাতে জর্জরিত করব? আমাদের কেন লজ্জা হয় না যখন শুনি শুধুমাত্র অর্থের অভাবে আমাদের মতো কেউ জীবনকে মাঝপথে থামিয়ে দিচ্ছে পরিবার সহ, শিশু সহ। আমরা তার পাশে দাঁড়াতে পারিনি বলে ধিক্কার দিই কি নিজেকে? টাকা আর মহার্ঘ পণ্য দিয়ে মানুষকে বিচার করা যদি বন্ধ হত, তবে তো এমন মরীয়া হয়ে অর্থের বিনিময়ে মানসম্মান লাভের বিপজ্জনক জুয়া খেলায় মানুষ অন্ধকূপে ঝাঁপ দিত না।
লক্ষ-লক্ষ, কোটি-কোটি টাকার চোখ-ধাঁধাঁনো অপচয়ের পাশে সন্তানের চিকিৎসার খরচটুকু সংগ্রহ করতে না পেরে, পুরো পরিবার জীবনকে শেষ করে দিচ্ছে যখন, আমরা কোনও প্রতিকারের সন্ধান করছি না। সংবাদপত্রের একটি পাতায় যখন আত্মহত্যার খবর আর সে পাতা উল্টোলেই অপরিমেয় বিত্ত প্রদর্শনের বিবরণ, আমরা কেউ সে অভব্য অশ্লীলতার বিরুদ্ধে চেঁচিয়ে উঠি না।
মেট্রো রেলের লাইনে ঝাঁপ দেবার সংবাদ অবধারিতভাবে শেষ হয়, কতক্ষণ ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল আর অফিস টাইমের ব্যস্ততায় যাত্রীদের কত ভোগান্তি তার উল্লেখে।
উদ্ধৃতি ঋণ: জীবনানন্দ দাশ।
একদম সত্য কথা। তবে এই কি পরিণতি নয় যখন চারিপাশে এই পরিলক্ষিত হয়:
ReplyDelete- সামাজিক স্থিতি ও প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা সুরক্ষার, ভালোবাসার স্নেহ ও মায়া মমতায় সিক্ত বন্ধন গুলির ভেঙে যাওয়া?
- নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে ধন ও অর্থ সমাগমের পেছনে নিরন্তর ছুটে চলা?
- অত্যন্ত সহজলভ্য খ্যাতি অর্জনের জন্য নিজের দৈহিক ও মানসিক লজ্জাকে ত্যাগ করা?
- কেবলমাত্র কিছু টাকার লোভে প্রিয়জনদের ধোঁকা দেওয়া? তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ আনা?
- নিরন্তরভাবে অর্থ প্রদর্শনের জন্য বেহিসেবীভাবে খরচ করে চলা এবং বিন্দুমাত্র পরিণতি কি হবে তার কথা চিন্তা না করা?
- ভ্রান্ত মিডিয়া এবং সমাজ প্রদর্শিত স্ট্যাটাস রাখার জন্য সকল মূল্যবোধের এবং বিবেক ও বুদ্ধির বলি দেওয়া?
- প্রিয়জনদের মধ্যে সমস্ত সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া এবং দিনে দিনে ভ্রান্ত, ভ্রমসম্পন্ন জীবনের পেছনে ছোটার জন্য একা হয়ে যাওয়া - ক্রমশ এবং অবধারিতভাবে?
ভালোবাসাই প্রধান।
ReplyDeleteসদগুরু বলছেন : ভালোবাসাযউ ভক্তি।
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন : জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।
Dr B.M. Hegde( Professor Cardiology) Padma Bhushan বলেছেন ব্যক্তিগত স্তরে ক্রোধ, শোক, ঘৃনা দুঃখ ক্যান্সার ডায়াবেটিসের মত প্রায় অনিরাময়যোগ্য রোগের সৃষ্টি করে। তিনি মানুষকে নিঃশর্ত ভালোবাসার কথা বলেছেন। তখনই শরীরের কোষগুলো যথাযথভাবে ক্রিয়া করে শরীরের কোষগুলি সবসময় আনন্দে থাকতে চায়।
যদিও সামাজিক- রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্রোধ এবং ঘৃণা সদর্থক।
বাইবেল বলছে : At the heart of true love, there is self destruction --- যিশু তাঁর নিজের জীবন দিয়ে তা প্রমাণ করেছেন। এইভাবে সমাজের স্বার্থে নিজের জীবন বিসর্জন দেওয়া শ্রদ্ধার বিষয়।
সম্পদ আর প্রতিপত্তির নিরিখে সফলতার বিচার করা সামাজিকতার অন্ত না হলে এমন আত্মহননের মহামারী মিছিল থামবে না। সংযত জীবনযাপনের পুরনো মূল্যবোধ ফেরত না এলে এই আত্মরতির পথই বাকি পড়ে থাকবে।
ReplyDelete