আগামী নির্বাচনের দিনগুলি!
কল্যাণ সেনগুপ্ত
আশ্চর্যজনক ভাবে হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র এবং সর্বশেষ দিল্লির নির্বাচনে বিজেপির জয়লাভ ওইসব রাজ্যের বিজেপি বিরোধী পক্ষকে হতবাক ও সচকিত করেছে। অন্য নানা কারণ থাকা সত্ত্বেও ভোটার লিস্টের গড়বড় অবশ্যই পরাজয়ের একটি বড় বিষয়। এ কথা অনস্বীকার্য যে, বিরোধী সংঘবদ্ধতার অভাব, নানাবিধ সাংগঠনিক ত্রুটি ইত্যাদি অবশ্যই ছিল। কিন্তু, প্রতিটি রাজ্যেই ভোটের ফল প্রকাশের পর সবার নজরে এসেছে যে লোকসভার নির্বাচন সাঙ্গ হবার মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানেই এক অসম্ভব ঘটনা ঘটেছে; বেশ কয়েক লক্ষ ভোটারের অবাস্তব সংখ্যা বৃদ্ধি। যেমন মহারাষ্ট্রে লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনের মধ্যবর্তী মাত্র সাত মাস সময়ে ভোটার লিস্টে ৩৯ লক্ষ ভোটারের নাম যুক্ত হয়েছে। এই নতুন নাম তালিকাভুক্তির অধিকাংশই হচ্ছে অনলাইনে, যেখানে কোনও ভেরিফিকেশন ছাড়াই এন্তারসে বিজেপি শাসিত কিছু রাজ্য থেকে নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। এবার নেপোয় এসে দই মেরে দিয়ে চলে যাচ্ছে! কথিত তিন রাজ্যের বিজেপি বিরোধী নেতৃত্ব অন্যান্য বিষয় নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিল যে ভোটার লিস্টের এই অসম্ভব সংখ্যা বৃদ্ধির দিকে তাদের সময়মতো নজরই পড়েনি। এ ব্যাপারে প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সাংবাদিক রাজদীপ সারদেশাই, এরপর তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ সাগরিকা ঘোষ তথ্য সহকারে তাঁর নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জানালে তিনি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে ইস্যুটিকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে সোরগোল তোলেন যে এখন আর তাকে কোনওভাবেই পাস কাটিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
এর ফলে অবশ্য শুধু এ রাজ্যেই নয়, এ বছরের শেষের দিকে আসন্ন বিহার নির্বাচনেও এইদিকে সব দলেরই নজর থাকবে। যদিও বিহারের নির্বাচনে মূল বিষয় হচ্ছে বিরোধী দল সমূহকে বিরোধী জোট গড়ে নিজেদের মধ্যে সুষ্ঠু রূপে আসন বণ্টনের সমস্যাটি সহমতের ভিত্তিতে সমাধান করা। তৃণমূল স্তরে জোটের সাংগঠনিক ঐক্যবদ্ধ রূপ গড়ে তুলতে সফল হলে সর্বত্র প্রচারে ঝড় তোলা সম্ভব। আমরা লক্ষ করেছি, অতীতের ভোটে কংগ্রেস তার জাতীয় রাজনীতির ওজন দেখিয়ে বাস্তব সাংগঠনিক ক্ষমতার থেকে অনেক বেশি আসন আদায় করে অথচ যোগ্য লড়াই দিতে ব্যর্থ হয়ে বিজেপিকেই জিততে পরোক্ষে সাহায্য করে। এর অবসান জরুরি। বিহারে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন দলের কিছু এলাকায় যথেষ্ট শক্তি আছে, কিন্তু তাদের কম আসনে লড়তে বাধ্য করা হয়। এরও প্রতিকার হওয়া উচিত। বিহারে বিজেপি নীতিশকেই মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করায় লড়াই বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়াল নিঃসন্দেহে। ফলে, বিরোধী ঐক্যে সামান্য ত্রুটিও ভবিষ্যতে হতাশার কারণ হতে পারে।
এ রাজ্যের ক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে লড়াই তৃণমূল বনাম বিজেপি। বাস্তবে সিপিএম ও কংগ্রেসের ভূমিকা এখানে স্রেফ বিজেপিকে পরোক্ষে মদত দেওয়া। বিশেষত সিপিএমের ভোটই যে বিজেপির ভাণ্ডারকে পুষ্ট করেছে সে তো দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট। উল্লেখ্য, কিছুদিন আগেই অনুষ্ঠিত দিল্লির ভোটে বিজেপি জেতায় এবং আপ হারায় কংগ্রেস নেতৃত্বের কি নির্লজ্জ উল্লাস! দেশের প্রধান বিরোধী দলের নেতৃত্ব যদি এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করে তবে তার লাভ যায় শাসক বিজেপির পক্ষেই। আজ অনেকের মনেই এই প্রশ্ন উঠছে যে, প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের এমন অদ্ভুত আচরণের কারণ কী? দেশের একটি শিশুও সম্ভবত জানে, সর্বাত্মক বিরোধী ঐক্য বিনা বিজেপিকে হারানো অসম্ভব। তবুও কোনও এক রহস্যজনক কারণে বিরোধী ঐক্যের ইন্ডিয়া জোটকে কোমায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বাংলার ভোট আগামী বছর। তবে অনেকে এমনটাও ভাবছেন, কোনও কারণে এ রাজ্যের ভোট কয়েক মাস এগিয়ে এনে বিহারের সঙ্গেই সাঙ্গ হবে না তো? সেটা সম্ভব একমাত্র রাজ্য সরকার চাইলেই। রাজ্যের সরকার চূড়ান্ত গরমে ভোট গ্রহণের অসুবিধার কথা অতীতে বহুবার প্রকাশ্যে বলেছে। বাংলার চেয়েও বিহারের ভোট বিজেপির কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ফলে, একসঙ্গে ভোট হলে বিজেপি বাংলার ভোটে সর্বোচ্চ নেতৃত্ব অর্থাৎ মোদী-শাহ'দের এনে প্রচারে বেশি সময় দিতে পারবে না, এতে লাভ টিএমসি'র। সে কারণেই বিজেপি এতে রাজি হবে না, কিন্তু আটকাতে পারবে কি? কারণ, এ বিষয়ে রাজ্যের প্রস্তাব গ্রহণ না করা কঠিন এবং যুক্তির দিক দিয়েও একসঙ্গে ভোট করার পক্ষেই বিজেপি বলে থাকে, সবাই জানে। সুতরাং রাজ্য চাইলে একসঙ্গে হবার সম্ভাবনাই বেশি।
ভোট বাংলায় যবেই হোক নিশ্চিত ভাবেই লড়াই দ্বিমুখি হবে। একটা সামান্য পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে-- উচ্চতর কংগ্রেস নেতৃত্বের অনুরোধে কিছু আসন ছেড়ে দিলে গড়ে উঠতে পারে এক অনিচ্ছুক কর্তব্যের জোট। কারণ এ রাজ্যে কংগ্রেস কর্মীদের কাছে বিজেপির চেয়েও তৃণমূল অনেক বড় শত্রু। আর জোট হলেও বাকি সব আসনে কংগ্রেস কর্মীরা তৃণমূলকে আদৌ ভোট দেবে কিনা সন্দেহ। এর জন্য অবশ্য ভোটের ফলে বিশেষ হেরফের হবে না। আমরা জানি, লোকসভার ভোটে বিজেপি কিঞ্চিৎ বেশি ভোট পায় বিধানসভার ভোটের তুলনায়। তবে এবার ভোটে সব দায়িত্ব নিজেদের কাঁধেই তুলে নিয়েছে সংঘ নেতৃত্ব, এমনটাই জানিয়েছেন সংঘকর্তা মোহন ভগবৎ স্বয়ং। অস্বীকার করার উপায় নেই, শেষ তিনটি রাজ্যের ভোটে তৃণমূল স্তরের প্রচারে সংঘের ভূমিকা ছিল যথেষ্ট প্রভাবশালী। সুতরাং, এ রাজ্যেও অধিক সাবধানতার প্রয়োজন নিশ্চিত। মাথায় রাখতে হবে, এরই সাথে যুক্ত হবে বিজেপির বিশাল অর্থ ভাণ্ডারের সুচতুর ব্যবহার। ফলে লড়াই এবার বেশ কঠিন।
উপরোক্ত বিভিন্ন বিষয় ছাড়াও শাসক দলের প্রধান কাজ আসন্ন ভোটে প্রতিটি বুথে ভুয়ো ভোটারের সন্ধান ও তা লিপিবদ্ধ করে প্রথমে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের কাছে সে তালিকা সহ অভিযোগ দায়ের করা ও কড়া নজর রাখা। তৎসহ সমস্ত বিরোধী পক্ষের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের উপর প্রয়োজনীয় চাপ সৃষ্টি করা। আমরা জানি, নতুন মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিটি হচ্ছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহের এক খাস ও নির্ভরযোগ্য আধিকারিক। সুতরাং এদের চালাকি ও অন্যায় কর্মের ব্যাপ্তি সীমাহীন। এরা জানে, আদালতকে কীভাবে নিজেদের সপক্ষে ব্যবহার করতে হয়। ফলে আশঙ্কা হয় যে, বিরোধী পক্ষকে আগাগোড়া 'গুড হিউমারে' রেখে শেষ মুহূর্তে চূড়ান্ত ভোটার লিস্টে বিজেপি কৃত যথেষ্ট গড়বড় সহ তা প্রকাশিত হয়ে যেতে পারে। স্ক্রুটিনি, নাম সংযোজন বা বাতিলের সমস্ত প্রক্রিয়ার অন্তে শেষ কথা তো বলবেন মুখ্য কমিশনারই এবং তার আজ্ঞাই শিরোধার্য করতে হবে সব পক্ষকে। কিন্তু তাতে অসন্তুষ্ট হলেও শেষ মুহূর্তে কিছু করার আদৌ কোনও সুযোগ থাকবে কি? সামনে থাকবে মাত্র দুটো অপশন, হয় নির্বাচন বয়কট করো নয়তো আদালতে যাও এবং সেখানেও শেষ সময়ে আদালত কোনওরকম সুবিচার দেবে, এমন আশা প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে, কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত চাপ সৃষ্টি করতে হবে এবং তার জন্য কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপি বিরোধী শক্তির সুসম্পর্ক ও বোঝাপড়া বিশেষ জরুরি। প্রধান বিরোধীরা এ বিষয়গুলো বুঝলেও কতখানি সফল হন, তার উপরেও এবারের ভোটের ফল অনেকখানিই নির্ভরশীল।
ফন্ট সাইজ বাড়ানো দরকার। Space between the lines বাড়াতে পারলে পাঠযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে।
ReplyDeleteযুক্তিপূর্ণ নিপুণ বিশ্লেষণ।
ReplyDelete