Monday, 31 March 2025

‘রাম’গরুড়ের ছানা…

হাস্যরসও যখন অপরাধ

সোমা চ্যাটার্জি



ভারতীয় সংস্কৃতিতে রাজনৈতিক হাস্যরস বা ব্যঙ্গ, যাকে ইংরেজিতে 'পলিটিকাল স্যাটায়ার' বলে, তার গ্রহণযোগ্যতা এখন বড় প্রশ্নের মুখে।

গত  কয়েক দিন ধরে  স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ান কুণাল কামরার একটি কমেডি ভিডিও 'নয়া ভারত' ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে রাজনৈতিক অসন্তোষ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তাঁকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া শুরু হয়েছে এবং বিরূপ সহিংস প্রতিক্রিয়া দেখা যাছে। কমেডিটি'তে কুণাল বর্তমান  সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকটিই কৌতুকের সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন এবং ‘গদ্দার' বলে  একটি প্যারডি পরিবেশন করেছেন যার অর্থ বিশ্বাসঘাতক। কিন্তু এই ঘটনার পর মহারাষ্ট্রের উপমুখ্যমন্ত্রী একনাথ শিন্ডে ও শিবসেনা দল আক্রমণাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, এমনকি মুম্বাই'এর হ্যাবিটাট সেন্টার যেখানে কুণাল এই অনুষ্ঠান করেছিলেন, সেখানে গিয়ে ভাঙচুর করে তাঁর কুশপুতুল পুড়িয়েছে। 

কুণাল কামরা তাঁর বিতর্কের জন্য, বিশেষ করে তাঁর তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক ব্যঙ্গের জন্য যথেষ্ট পরিচিত। ২০২০ সালে এক বিমানে সাংবাদিক অর্ণব গোস্বামীর মুখোমুখি হওয়ার পর একাধিক বিমান সংস্থা তাঁকে নিষিদ্ধ করে। বিচার বিভাগ সম্পর্কে তাঁর রসিকতার জন্য তিনি আইনি সমস্যায় জর্জরিত হয়েছেন, এমনকি সুপ্রিম কোর্ট তাঁর ট্যুইট'এর জন্য তাঁর বিরুদ্ধে অবমাননার মামলা জারি করেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও, কামরা ভারতের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতার একজন সমালোচক হিসাবেই বরাবর সোচ্চার থেকেছেন।

অবশ্য এই ঘটনা নতুন নয়। ২০১৭ সালে কুণাল তাঁর প্রথম ইউটিউব ভিডিও আপলোড করেন যার শিরোনাম ছিল 'দেশপ্রেম ও সরকার'। আট মিনিটের ক্লিপটিতে তিনি বিমুদ্রাকরণ, ছাত্রদের কণ্ঠরোধ করা এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অপ্রয়োজনীয় নিন্দা সম্পর্কে রসিকতা করেছিলেন। বেশ কয়েকটি সহিংস হুমকি পাওয়া সত্ত্বেও কুণাল ভিডিওটি সরিয়ে নেননি। এটি ১.৮ কোটিরও বেশি বার দেখা হয়েছে। গত বছর অক্টোবরের শুরুতেও কুণাল মুম্বাইয়ের বিলাসবহুল কমেডি ক্লাব 'দ্য হ্যাবিট্যাট'এ পাঁচটি শো করেন কিন্তু তাঁর বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান বাতিল হয়ে যায় এবং তাঁকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়। তাঁর মুম্বাইয়ের বাড়িওয়ালা পর্যন্ত তাঁকে উচ্ছেদ করেন। কিন্তু কামরা তখনও বলেছিলেন, তিনি যে  জিনিসগুলি স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছেন সেগুলি নিয়েই রসিকতা করতে চান, কারণ, তাঁর মতে 'কমেডি আক্রমণাত্মক কোনও শিল্প নয়, এক বাস্তবতা'। 

'দ্য হ্যাবিট্যাট'এর মালিক বলরাজ ঘাই' এর কথায়, ২০১৬ সালে 'দ্য হ্যাবিট্যাট' খোলার পর থেকে তাঁর সেন্টারটি রাজনৈতিক উৎপীড়ন ও ক্ষোভের নিশানা হয়ে উঠেছে এবং প্রতি বছর তিন থেকে চারটি এরকম ঘটনা ঘটে চলেছে। তাঁর মতে, কিছু দর্শকের কাছে কামরা একজন নায়ক, 'এমন একজন যিনি কর্তৃত্বের কণ্ঠস্বরের বিরুদ্ধে কথা বলেন'। কামরার এজেন্ডা বিনা কারণে 'প্রতিষ্ঠান বিরোধী' হওয়া নয়, তাঁর এজেন্ডা 'উন্নত ব্যবস্থা, উন্নত শাসন, উন্নত সমাজ'। ঘাই বলেন, যারা কামরার শোয়ের টিকিট কেনেন তাঁরা জেনেই আসেন যে এখানে কী ধরনের রাজনৈতিক উপাদান উপস্থাপিত হবে, সে জন্য যদি শ্রোতারা সম্পূর্ণরূপে কামরার সঙ্গে একমত থাকেন, তিনি যে কোনও রসিকতা করতে পারেন এবং কোনও অপরাধ না করে চাতুরীর সঙ্গে সত্যি কথা বলতে পারাটাও একটা পরিছন্ন শিল্পবোধকেই ব্যক্ত করে।

কিন্তু গত কয়েক বছর ধরেই বিশেষ করে বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার অধীনে ভারতে স্ট্যান্ড-আপের ভবিষ্যৎ ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়েছে এবং কৌতুকাভিনেতাদের স্বাধীন মন নিয়ে নিজের শিল্পকে প্রকাশ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্ট্যান্ড-আপ কমেডি ভারতে তুলনামূলকভাবে নতুন। ২০১০-এর দশক থেকে অনেকেই এটিকে ক্যারিয়ার হিসাবে ভাবতে শুরু করে, তবে এর পূর্বসূরীরা অনেক পুরনো।  প্রাচীন ইতিহাসেও রাজদরবারে বিদূষকরা ছিলেন যারা উপহাস ও বিদ্রুপের মাধ্যমে রাজা ও পারিষদদের  মনোরঞ্জন করতেন কিন্তু তাদেরও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ছিল। কয়েক শতাব্দী ধরে কমেডি মানব জীবনের একটি অঙ্গাঙ্গী শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিককালে ভারতে কৌতুকাভিনেতাদের নির্মমভাবে হয়রানি ও ট্রোলের শিকার হওয়ার জন্য ভারতের স্ট্যান্ড-আপ কমেডির ভবিষ্যৎ এখন  অজানা।

২০১৯ সালে কৌতুকাভিনেত্রী আগ্রিমা জোশুয়া মহারাষ্ট্র রাজ্য সরকারের একটি মূর্তি প্রকল্প সম্পর্কে রসিকতা করার পর ২০২০ সালের ৭ জুলাই মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনার (এমএনএস) সমর্থকরা 'দ্য হ্যাবিট্যাট' ভাঙচুর করে ও আগ্রিমা জোশুয়ার কাছে রসিকতার জন্য ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানায়। তাঁর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ এবং তাঁকে ধর্ষণের হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়। জোশুয়াকে বাধ্য করা হয়  জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস পার্টি, শিবসেনা, এমএনএস এবং কংগ্রেসের কাছে ক্ষমা চাইতে। জোশুয়া বলেন, ক্ষমা চাওয়ার পর আরও ঘৃণা ও আপত্তিকর মন্তব্য শুনতে হয়েছিল এবং তাঁকে কোনওরকম নিরাপত্তাও  দেওয়া হয়নি। 

একই ভাবে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে কট্টর ডানপন্থী হিন্দু রক্ষক সংগঠনের সদস্য ও ইন্দোরের প্রাক্তন বিজেপি মেয়রের ছেলে একলব্য লক্ষ্মণ সিং গৌরের দায়ের করা অভিযোগের ভিত্তিতে মুনাওয়ার ফারুকি নামে এক কৌতুকাভিনেতাকে গ্রেফতার করা হয় এবং প্রায় এক মাস ধরে তাঁকে আটক রাখা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে তিনি হিন্দু দেবদেবীদের সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। অথচ, অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগেই ফারুকিকে আটক করা হয় এবং পুলিশ পরে স্বীকার করে যে তিনি হিন্দু দেবতাদের অপমান করেছেন এমন কোনও প্রমাণ নেই। তবুও, ডানপন্থী হিন্দু গোষ্ঠীগুলি তখন থেকে বারবার তাঁকে হেনস্থা করেছে এবং তাঁর অনুষ্ঠান বাতিল করতে বাধ্য করেছে। গোয়ায় সাম্প্রতিক একটি অনুষ্ঠানে তাঁকে মঞ্চে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হলে ৫০০ লোক নিজেদের আগুনে পুড়িয়ে ফেলার হুমকি দেয়।

২০২১ সালের নভেম্বরে ওয়াশিংটন ডিসির কেনেডি সেন্টারে ভারতের শীর্ষস্থানীয় স্ট্যান্ড-আপ কৌতুকাভিনেতা বীর দাস 'টু ইন্ডিয়াস' নামে একটি কৌতুক কবিতা পাঠ করে শোনানোর পর তাঁকে নিদারুণ হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। এই অনুষ্ঠানে দাস ভারতকে বৈপরীত্যের দেশ হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন যেখানে লোকেরা 'দিনের বেলায় মহিলাদের পূজা করে কিন্তু রাতে তাদের ধর্ষণ করে'। অনুষ্ঠানটি তীব্র ভাবে সমালোচিত হয় এবং তাঁর বিরুদ্ধে আইনি মামলাও দায়ের হয়। সমালোচকরা তাঁর বিরুদ্ধে ভারতকে বদনাম করার অভিযোগ আনেন। দাস'এর বক্তব্য তিনি ওই কবিতাটিতে দক্ষিণ এশীয় দেশের সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে তাঁর চিন্তাভাবনাই তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন বিজেপি'র মুখপাত্র আদিত্য ঝা দাসের বিরুদ্ধে 'দেশকে অপমান' করার জন্য পুলিশে অভিযোগ দায়ের করেন এবং অবিলম্বে তাঁকে গ্রেফতারের দাবি জানান। ঝা'এর অভিযোগ, 'নারী ও ভারতের বিরুদ্ধে' এই অবমাননাকর বক্তব্য উস্কানিমূলক এবং এটি আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। 

শাসকগোষ্ঠীরা যে ব্যঙ্গের প্রতি খুব একটা সহনশীল নয় সে ব্যাপারে কলকাতাও পিছিয়ে নেই। তার প্রমাণ দ্য হ্যাবিট্যাটের 'অল-স্টার' লাইন-আপের অংশ, অভিনেতা অনির্বাণ দাশগুপ্ত। ২০১৭ সালে অনির্বাণ কলকাতায় তাঁর বড় হয়ে ওঠা এবং সুভাষ চন্দ্র বসুর অন্তর্ধান সম্পর্কে সেখানকার শিশুরা কী ভাবেন তা নিয়ে একটি ভিডিও প্রকাশ করে রসিকতা করেছিলেন। সেই ভিডিও অপসারণের দাবিতে তিনি কলকাতার রাজনৈতিক কর্মীদের কাছ থেকে হুমকি পেয়েছিলেন। তাঁর মতে, ‘বামপন্থী’ বা  ‘ডানপন্থীদের’ হেনস্থার আক্রমণাত্মক ভঙ্গী একই ধরনের। যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, সবসময় কমেডিকে দমন করে।

এই প্রসঙ্গে কমেডি শিল্পের কিংবদন্তি চার্লি চ্যাপলিন'এর কথা অবশ্যম্ভাবী ভাবে এসে পড়ে। চ্যাপলিন নিজেও একনায়কতন্ত্রের বিরোধিতা করেছিলেন এবং ধর্মকে অস্বীকার করতেন। ১৯৪০ সালে নির্মিত তাঁর 'দ্য গ্রেট ডিক্টেটর' ছবিটিতে তিনি অ্যাডলফ হিটলার ও বেনিতো মুসোলিনির তীব্র নিন্দা করেছিলেন এবং ফাসিবাদ, নাৎসিবাদ ও ইহুদী বিদ্বেষেরও সমালোচনা করেন। তার ফলে জার্মানি ও অন্যান্য দেশে এটির প্রদর্শন বন্ধ করে দেওয়া হয়। চ্যাপলিন তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, 'কমেডি তৈরিতে, ট্র্যাজেডি উপহাসের চেতনাকে উদ্দীপিত করে।' তাঁর মতে, কমেডি এমনই শিল্প যা রাষ্ট্রীয় সহিংসতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, অনুকরণ করে এবং উপহাস করে। এটি সরকারকে তাদের কর্মের জন্য দায়বদ্ধ করে তোলে। হাস্যরস হল ভিন্ন মতের একটি বুদ্ধিমান অভিব্যক্তি।

১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধের পর জওহরলাল নেহরুকে কার্টুনিস্ট আর কে লক্ষ্মণ ব্যঙ্গ করেছিলেন। ট্রোল বা ভাড়া করা গুণ্ডাদের দিয়ে আক্রমণ করার পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রী তাঁকে বলেন যে কার্টুনটি তাঁর খুব ভালো লেগেছে এবং তিনি ফ্রেমবন্দী স্বাক্ষরিত একটি বড় কপিও চেয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের রাজনৈতিক ভাবে আরোপিত সমসাময়িক ভারতে বিদ্রূপ বা হাস্যরস হারিয়ে গেছে বলে মনে হয়। গোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রাহুল ত্রিপাঠি বিশ্বাস করেন যে, বর্তমান শাসক দল এবং তার পদাতিক সৈন্যদের সমস্যা হল যে তাদের জাতীয়তাবাদ, হিন্দুধর্ম ও বহুত্ববাদের এত সংকীর্ণ ব্যাখ্যা রয়েছে তা যে কোনও বিরোধী চিন্তাভাবনার সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে তাদের অস্থির করে তোলে। তাই তারা প্রতিশোধ স্পৃহায় জড়িত থাকে, কারণ, তারা ধর্মীয় এবং জাতীয় গর্বের অনুভূতির নিজস্ব মাপকাঠিতে এগুলিকে বিচার করে।

ভারতে কুণাল কামরা ও মুনাওয়ার ফারুকি'র মতো কৌতুকাভিনেতারা এবং রচিতা তানেজার মতো কার্টুনিস্টরা যে কাজ করেন তার জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও না কোনও ধরনের ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়। সুপ্রিম কোর্ট রনবীর এলাহাবাদীকে ইউটিউবে কোনও বিষয়ে কিছু আপলোড করতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। ফারুকি এবং আরও তিন সহযোগীর সঙ্গে গ্রেফতার হওয়া কৌতুকাভিনেতা নলীন যাদবের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির অন্যান্য ধারাগুলির মধ্যে ২৯৫এ (ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা) ২৯৮ (ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার ইচ্ছাকৃত অভিপ্রায়) এবং ১৮৮ (অবাধ্যতা)'এর অধীনেও মামলা চলছে। যাদবের  নিজের ভাষায়, 'ইন্দোরের মানুষের কাছে এখন তিনি একজন সন্ত্রাসবাদী এবং তার আর কোনও পরিচয় নেই।' স্ট্যান্ড-আপ কৌতুকাভিনেতা প্রশাস্তি সিং-এর মতে, 'দশ বছর আগে যে  রসিকতা নিছক বিরক্তিকর ছিল, আজ তার মাত্র ১ শতাংশই আপনাকে সমস্যায় ফেলে দিতে পারে।' 

হাস্যরস আমাদের সবচেয়ে গুরুতর ট্র্যাজেডির অর্থ বুঝতে সাহায্য করে। কিন্তু উপরোক্ত ঘটনাগুলি বারবার মনে করিয়ে দেয় যে ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশেও আজ রাজনৈতিক বিদ্রুপ ও মতবিরোধের কোনও স্থান নেই। সাম্প্রতিক সময়ে মোদী সরকার আইন প্রণয়নের মাধ্যমে ভিন্নমতাবলম্বীদের দমন করার চেষ্টা করে চলেছে। কামরার মতে, সংশোধিত তথ্য প্রযুক্তি বিধি তাঁর 'রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক কাজে জড়িত থাকার ক্ষমতা' হ্রাসের একটি হাতিয়ার। সরকার তাঁর ফ্যাক্ট-চেক ইউনিটকে 'জাল, মিথ্যা এবং বিভ্রান্তিকর' বলে 'এমনতর বিষয়বস্তু'কে অপসারণের ক্ষমতা দিয়ে কমিক্সকে 'স্বেচ্ছাচার ও বিষয়গত' হস্তক্ষেপের আওতায় আনতে চাইছে। কামরা বলেন, 'সরকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সম্পূর্ণ একচেটিয়া অধিকার চায় এবং এটি আমাদের এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে এনে ফেলেছে।' তিনি ইতিমধ্যে বম্বে হাইকোর্টে আবেদন করেছেন। ইতিমধ্যেই বিদেশি অনুদান নীতি (এফসিআরএ অ্যাক্ট) লঙ্ঘনের জন্য শিবসেনা নেতা সঞ্জয় নিরুপম অভিযোগ করেছেন যে কামরা বিদেশ থেকে এই ধরনের শো করার জন্য ৪ কোটি টাকা পেয়েছেন, যা কামরা ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁকে ক্ষমা চাওয়ার কথা বললে তিনি বলেন, একমাত্র মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী বললেই তিনি ক্ষমা চাইবেন।

হাসি আজও আমাদের অন্ধকার সময়ে বেঁচে থাকার ওষুধ। কিন্তু মঞ্চের রসিকতার বিতর্ক রুখতে যদি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয় তাহলে আগামী দিনে প্রস্তাবিত নতুন সংবিধানে হাস্যরসকে অপরাধ হিসেবে দেখানো এবং অপরাধের সংজ্ঞা পরিবর্তনের দিন আসন্ন বলেই মনে হয়।


Thursday, 27 March 2025

হিন্দি এক নির্মিত ভাষা

ভাষা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাক্ষিণাত্যের বিদ্রোহ

দীপঙ্কর দে



সারা দেশে, বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে, হিন্দি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নতুন করে জোরদার প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে উঠছে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্তালিন ও তাঁর দল ডিএমকে'র নেতৃত্বে। দ্রাবিড় জাতিসত্তার শক্ত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে তামিলরা ভারত রাষ্ট্রের ত্রিভাষা নীতি, নতুন শিক্ষা নীতি সহ ইউনিয়ন সরকারের ব্রাহ্মণ্যবাদী কেন্দ্রিকতার বিরুদ্ধে হুঙ্কার ছেড়েছেন। ভারত সরকারের শিক্ষা মন্ত্রীর 'টাকা আটকে' দেওয়ার অসাংবিধানিক হুমকির বিরুদ্ধে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রীর পাল্টা হুমকি 'কর দেওয়া বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিতে আমাদের এক মিনিট সময় লাগবে' স্রেফ রাজনৈতিক তরজা ভাবলে ভুল হবে।

হিন্দি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তামিলদের লড়াই আজকের নয়। ১৯৩৭ সালে তৎকালীন ভারত সরকার এক অধ্যাদেশ জারি করে আদেশ দেয়, তামিলনাড়ুর প্রতিটি সরকারি বিদ্যালয়ে হিন্দি ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক। সেই আদেশের বিরুদ্ধে ই ভি পেরিয়ারের নেতৃত্বে তামিলনাড়ুর বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। আন্দোলন চলে লাগাতার তিন বছর। ভাষা শহীদ হন দু' জন। অবশেষে ১৯৪০ সালে সেই আদেশ প্রত্যাহার করে বলা হয় দেবনাগরী লিপিতে লেখা হিন্দির সঙ্গে ইংরেজি ভাষাও সরকারি কাজকর্মে ব্যবহার করা যাবে। এই মীমাংসা সূত্রটি কার্যকর করার ক্ষেত্রে খুব সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু। 

তামিলনাড়ুর হিন্দি বিরোধী আন্দোলনকে বুঝতে হলে তৎকালীন রাজনীতির চর্চা অবশ্যই আবশ্যক। গত শতকের গোড়ার দিকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস উদ্যোগ নেয়, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন সংগঠিত করতে একটি সর্বজন সম্মত ভারতীয় ভাষাকে ব্যবহার করা হবে। সেই মতো ঠিক হয় হিন্দি বা হিন্দুস্থানী হবে সেই ভারতীয় ভাষা। ১৯১৮ সালে মহাত্মা গান্ধীর উদ্যোগে 'দক্ষিণ ভারত হিন্দি প্রচার সভা' প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২৫ সালে জাতীয় কংগ্রেস ইংরেজির পরিবর্তে হিন্দুস্থানী ভাষাকে দলীয় যোগাযোগের মাধ্যম বলে স্বীকৃতি দেয়।

১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে ক্ষমতায় আসে জাতীয় কংগ্রেস। প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী হন কংগ্রেসের রাজাগোপালাচারী। ১৯৩৭ সালের অগস্ট মাসে, ক্ষমতায় আসার এক মাসের মধ্যেই, রাজাগোপালাচারী প্রতিটি বিদ্যালয়ে হিন্দি ভাষা শিক্ষাকে আবশ্যিক ঘোষণা করেন। তখন তামিলনাড়ু কংগ্রেসে ব্রাহ্মণ নেতাদের প্রাধান্য ছিল। তাছাড়া রাজাগোপালাচারী নিজেও ছিলেন কট্টর ব্রাহ্মণ। তিনি একটি পদার্থবিদ্যার পুস্তক অনুবাদকালীন প্রচুর সংস্কৃত শব্দের ব্যবহার করায় এমনিতেই সমালোচিত ছিলেন। ক্ষমতায় এসেই তাঁর হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত স্বাভাবিক ভাবেই তামিল রাজনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। পেরিয়ারের 'আত্মসম্মান আন্দোলন' (সেলফ রেসপেক্ট মুভমেন্ট) ও জাস্টিস পার্টি একযোগে হিন্দি আগ্রাসনের প্রতিবাদে গণ আন্দোলনের ডাক দেয়। রাজাজীর ঘোষণার প্রতিবাদে ৪ অক্টোবর ১৯৩৭ এক হিন্দি বিরোধী জনসভার আয়োজন হয়। আন্দোলন উপেক্ষা করে রাজাগোপালাচারী ২১ এপ্রিল ১৯৩৮ সালে এক আদেশনামায় তামিলনাড়ুর সব কটি সরকারি বিদ্যালয়ে (১২৫) হিন্দি বাধ্যতামূলক বলে বিজ্ঞপ্তি জারি করেন। 

হিন্দি বিরোধী আন্দোলন আরও গতি পায়। এমনকি শৈব ধর্মাবলম্বীরাও ভেলোরে অনুষ্ঠিত তাঁদের মহাজন সভায় হিন্দির বিরোধিতা করেন। তামিলনাড়ুর মুসলিম লীগ উর্দুর পরিবর্তে তামিল ভাষার দাবিতে সামিল হন। অনেক আর্য ব্রাহ্মণও একই সিদ্ধান্ত নেন। তাই তামিল ভাষার আন্দোলন স্রেফ দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমিত ছিল না। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে তামিলবাসী তাঁদের মাতৃভাষা রক্ষার তাগিদে তীব্র হিন্দি বিরোধিতায় সামিল হয়েছিলেন। ১৯৩৯ সালে ভারতের বিশ্বযুদ্ধে যোগদানের বিরোধিতায় মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির কংগ্রেস সরকার ইস্তফা দেয়। শাসনভার গ্রহণ করেন গভর্নর জেনারেল। গভর্নরের আশ্বাসে ৩১ অক্টোবর পেরিয়ার আন্দোলনে বিরতি টানেন। অবশেষে  ১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মাদ্রাজ সরকার বাধ্যতামূলক হিন্দি শিক্ষার আদেশ প্রত্যাহার করে।

সাময়িক পিছু হটলেও জাতীয় কংগ্রেস সারা দেশে হিন্দি চাপানোয় অনড় ছিল। ১৯৬৪ সালে নেহেরুর মৃত্যুর পর নতুন করে উদ্যোগ নেওয়া হয় শুধুমাত্র হিন্দিকেই রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার। দিল্লী ঘোষণা করে ১৯৬৫ সালের ২৬ জানুয়ারি থেকে দেশে বলবৎ হবে সরকারি ভাষা আইন (অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাক্ট) এবং হিন্দি হবে সরকারি ভাষা। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে গোটা তামিলনাড়ু। ত্রিচিতে চিন্নাস্বামী নামে এক যুবক প্রতিবাদে আত্মাহুতি দেয়। কলেজ ছাত্রদের উদ্যোগে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। প্রতিবাদে আরও কয়েক জন আত্মাহুতি দেন। তামিল নেতা আন্নাদুরাই ২৬ জানুয়ারি শোক দিবস পালনের ডাক দেন। পরবর্তী দু' সপ্তাহে ভাষা দাঙ্গায় প্রাণ হারান অন্তত ৭০ জন নাগরিক। তামিল প্রতিরোধে পিছু হটতে বাধ্য হয় দিল্লী। অবশেষে ১৯৬৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী এক রেডিও ভাষণে তামিল নাগরিকদের আস্বস্ত করেন, নেহেরুর প্রস্তাবিত হিন্দি ও ইংরেজি দুটি ভাষাই সরকারি ভাষা বলে ব্যবহৃত হবে। প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে আন্দোলন তুলে নেওয়া হয়। কিন্তু তারপরে আর কোনওদিন জাতীয় কংগ্রেস বা অন্য কোনও সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল তামিলনাড়ুর মসনদে বসতে পারেনি। তাদের কোনও না কোনও তামিল ভাষী আঞ্চলিক দলের লেজুড় হয়ে রাজনীতি করতে হয়েছে। সেই থেকে তামিলনাড়ুর রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে কোনও আঞ্চলিক দল। তামিল রাজনীতি আবর্তিত হয় তাদের মাতৃভাষা ও দ্রাবিড় জাতিসত্তাকে আঁকড়ে ধরেই। ষাটের দশকে তামিল জাতিসত্তার আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয় ডিএমকে নেতা করুণানিধি (বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্টালিনের পিতা)।

গত ষাটের দশকে তামিলনাড়ুতে ভারত সরকারের ত্রিভাষা নীতির প্রতিবাদের পর ইউনিয়ন সরকার ত্রিভাষা বাধ্যতামূলক না করলেও দিল্লী লাগাতার হিন্দি ভাষার আগ্রাসন চালিয়ে গেছে অ-হিন্দিভাষী রাজ্যগুলোর উপর। বিগত এক দশকে সব সরকারি ক্ষেত্রে হিন্দির আধিপত্য পরিকল্পিত ভাবে বাড়িয়েছে ভারত সরকার। সারা দেশে এমন এক বাতাবরণ সৃষ্টি করা হয়েছে যাতে মনে হবে হিন্দি ভারতের জাতীয় ভাষা। সাধারণ নাগরিক থেকে উচ্চ আদালতের এক মাননীয় বিচারক পর্যন্ত তাঁর রায়ে হিন্দিকে ভারতের জাতীয় ভাষা বলে ভুল করে বসেন। আমরা যেন ভুলে যেতে বসেছি, ভারতে কোনও একটি জাতীয় ভাষা নেই। দেশের অন্তত বাইশটি প্রাচীন ভাষাকে সংবিধান স্বীকৃত ভাষা বলে গণ্য করা হয়। 

২০২০ সালে নতুন শিক্ষা নীতি ঘোষণার পর ভাষা সমস্যা আবার মাথা চাড়া দিয়েছে। খানিকটা পরিবর্তন করে আবার ত্রিভাষা নীতির কথা বলা হয়েছে। আগের ত্রিভাষা নীতিতে বলা ছিল, সব কটি অ-হিন্দি ভাষী রাজ্যে ইংরেজি ও স্থানীয় ভাষা শিক্ষার সঙ্গে হিন্দি অবশ্যই শিখতে হবে (স্মরণ থাকতে পারে, স্বাধীনতার পর ভাষার ভিত্তিতে রাজ্যগুলির পুনঃগঠন হয়েছিল)। নতুন শিক্ষা নীতিতে বলা হল, অ-হিন্দি ভাষী রাজ্যগুলিতে তিনটে ভাষা শিখতে হবে তবে কোনও বিশেষ ভাষার কথা উল্লেখ করা হল না। শুধু বলা হল, তিনটে ভাষার অন্তত দুটি ভাষা হতে হবে স্থানীয় ভাষা। সরাসরি হিন্দির উল্লেখ না থাকলেও ত্রিভাষা নীতিতে হিন্দি চাপিয়েই দেওয়া হল; কারণ, ইংরেজির সঙ্গে  হিন্দি হচ্ছে ভারতের সরকারি ভাষা। তাই কোনও বাঙালি বা তামিল ছাত্রকে, বিদ্যালয়ে তিনটি ভাষা শিক্ষা আবশ্যিক হলে, স্বভাবতই তাদের নিজেদের মাতৃভাষার সঙ্গে হিন্দি শিখতে হবে যেহেতু তিনটির অন্তত দুটি ভাষা হতে হবে ভারতীয় ভাষা। ঠিক এখানেই তামিলরা আপত্তি তোলেন। তাঁদের যুক্তি খুব পরিষ্কার। ছাত্রদের  তিনটি ভাষা শেখার চাপ অযৌক্তিক। তাছাড়া হিন্দি ভাষী রাজ্যগুলিতে ছাত্ররা যখন বড় জোর দুটি ভাষা শিখছে তখন অ-হিন্দি ভাষী রাজ্যের ছাত্রদের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক ভাবে তিনটি ভাষা শেখার নীতি বিভেদমূলক।

প্রশ্ন হচ্ছে, ভারত রাষ্ট্র কেন বার বার অ-হিন্দি ভাষী রাজ্যগুলিতে হিন্দি চাপাতে চাইছে? আরও আশ্চর্যের বিষয় হল, হিন্দি ভাষার বয়স মেরেকেটে মাত্র দুশো বছরও হবে না। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে এই ভাষাটি নির্মাণ করা হয়েছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উদ্যোগে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ভাষাবিদ জন গিলক্রিস্টের তত্ত্বাবধানে। মনে রাখতে হবে, তখন সরকারি দফতরে ফার্সি ও উর্দু ভাষার চল ছিল; আর ছিল হিন্দুস্থানী ভাষা, যা মূলত উত্তর ভারতের কথ্য ভাষা। মীরার ভজন গীত হত হিন্দুস্থানী ভাষায়। দফতরের কাজের সুবিধার্থে গিলক্রিস্ট সাহেবের উদ্যোগে হিন্দুস্থানী ভাষার পরিমার্জন করে নির্মিত হল হিন্দি। ফার্সি ও উর্দু শব্দের পরিবর্তে ব্যবহার করা হল সংস্কৃত শব্দ আর লিপি হল দেবনাগরী। এভাবেই তৈরি হল আর্যাবর্তের ভাষা হিন্দি। সিপাহী বিদ্রোহের পর সরকারি মদতে খুব দ্রুত ফার্সি, উর্দু ও হিন্দুস্থানী ভাষার স্থান দখল করল হিন্দি। সেই থেকে হিন্দু জনগোষ্ঠীর ভাষা হয়ে উঠল হিন্দি আর মুসলমানের ভাষা উর্দু। ধর্মের ভিত্তিতে দুই ভাষা ভাষীরাও বিভক্ত হয়ে গেলেন। 

গত দুশো বছরে হিন্দির আগ্রাসনে বর্তমান আর্যাবর্তের বহু প্রাচীন ভাষা ও আদিবাসী কৃষ্টি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। স্বাধীন ভারতে হিন্দুত্বের আগ্রাসন যত বেড়েছে সঙ্গে বেড়েছে হিন্দির আগ্রাসন। ভারতে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান হয়ে উঠেছে আর্যাবর্তের এক রাজনৈতিক হাতিয়ার। অনার্য দক্ষিণ ভারত এই আগ্রাসন মেনে নিতে পারেনি। দ্রাবিড় জাতিসত্তা বার বার রুখে দাঁড়িয়েছে ব্রাহ্মণ্যবাদী আর্য আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। হালে অনার্য ও আর্য বিভাজন দক্ষিণ ও উত্তর ভারতের বিভাজন বলে প্রচারিত হচ্ছে। এই বিভাজন মূলত সভ্যতার দ্বন্দ্বের প্রকাশ। অনার্য ও আর্যদের ঐতিহাসিক লড়াই আজও চলছে।


Monday, 24 March 2025

কবর খুঁড়ে ঔরঙ্গজেব কেন?

মেরুকরণ ও বিদ্বেষই বিজেপির অস্ত্র

সোমা চ্যাটার্জি



গত দু' দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতীয় রাজনীতির সবচেয়ে সংবেদনশীল বিষয় হল, পুরনো মসজিদ্গুলিকে পুরনো হিন্দু মন্দিরের নতুন সংস্করণ দিয়ে প্রতিস্থাপন করার প্রচেষ্টা; সাম্প্রতিককালে যার ছায়া পড়েছে মহারাষ্ট্রে। নাগপুর থেকে প্রায় ৫০০ কিলোমিটার দূরে ছত্রপতি সম্ভাজিনগর জেলায় (যা আগে ঔরঙ্গাবাদ নামে পরিচিত ছিল) ৩০০ বছরেরও বেশি পুরনো ঔরঙ্গজেবের একটি সাধারণ স্মৃতিস্তম্ভ কট্টর হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলি দ্বারা অপসারণের দাবিতে বিতর্কের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে ও দাঙ্গার রাজনীতিকে উসকে দিয়েছে।

এই হিংসার সূত্রপাত শিবাজি পুত্র সম্ভাজির উপর নির্মিত 'ছাভা' নামে একটি বলিউড চলচ্চিত্র যেখানে ওই মারাঠা শাসককে ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে দেখা যায় এবং হেরে যাওয়ার পর তাকে শারীরিক ভাবে নিগৃহীত করা হয়। এর আগে সমাজবাদী পার্টির নেতা আবু আজমি মহারাষ্ট্র বিধানসভায় বলেন যে 'ছাভা'তে ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। এই মন্তব্যের ফলে তাকে বিধানসভা থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং তিনি তাঁর মন্তব্য প্রত্যাহার করে নেন। এরপর বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরং দল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের কুশপুতুল পুড়িয়ে তাঁর সমাধি অপসারণের দাবিতে স্লোগান দেওয়ার পর গত সোমবার (১৭ মার্চ) থেকে সেখানে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, ৩০০ বছর আগে অনাড়ম্বর ও খোলা কবরস্থানে সমাহিত ঔরঙ্গজেব আজ এতদিন পরে হঠাৎ এত আলোচিত ও বিতর্কিত হয়ে উঠলেন কেন?

তার কারণ সম্ভবত এই যে, মুঘল সাম্রাজ্যের ষষ্ঠ শাসক ঔরঙ্গজেব তাঁর ৩৯ বছরের রাজত্বকালে  ভারতীয় উপমহাদেশের বেশির ভাগ অংশকে তাঁর একক শক্তির অধীনে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে মুঘল সাম্রাজ্যের জনসংখ্যা সমগ্র ইউরোপকে ছাপিয়ে যায় এবং তাদের সম্পদ বিশ্বে অতুলনীয় হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদরা সুপরিকল্পিত ভাবে ওই সময় ঔরঙ্গজেবকে ধর্মান্ধ ও নিষ্ঠুর শাসক হিসেবে চিহ্নিত করেন। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক জেমস মিল'এর 'দ্য হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া' বা ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সচিব হেনরি মায়ারস এলিয়ট'এর 'দ্য হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া অ্যাজ  টোলড বাই ইটস ওন হিস্টোরিয়ান' পড়লে বোঝা যায়, এদের উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের তুলনায় তথাকথিত হিন্দু যুগ ও বৃটিশ ঔপনিবেশিকতার মহত্ব প্রচার এবং ঔপনিবেশিক স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ঔরঙ্গজেবকে খলনায়কে পরিণত করা। ব্রিটিশ বর্ণিত এই ইতিহাস ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিদ্দ্বজ্জনেদের কাছে ঔরঙ্গজেবকে ধর্মান্ধ, নিষ্ঠুর শাসক হিসেবে পরিচিত করে তোলে। ১৯২৪ সালে শীর্ষস্থানীয় ইতিহাসবিদ  যদুনাথ সরকারের 'হিস্ট্রি অফ ঔরঙ্গজব' বইটিতেও তিনি ঔরঙ্গজেবের রাজনৈতিক দর্শনকে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও অসহিষ্ণু বলে ব্যক্ত করেছেন। ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত 'ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া' গ্রন্থে নেহেরুও ঔরঙ্গজেবের শাসনকালের ত্রুটিগুলি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন এবং তাঁকে 'একজন ধর্মান্ধ ও কঠোর শুদ্ধবাদী' বলে তিরস্কার করেন। সম্ভবত এই ধরনের বিবৃতিই ভারতের হিন্দু ও মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে উগ্র জাতীয়তাবাদের সূচনা করে এবং সমগ্র ভারতীয় বিদ্বান সমাজে ঔরঙ্গজেব একজন ক্রূর, হিংস্র ও হিন্দু বিদ্বেষী মুসলমান শাসক হিসেবে চিহ্নিত হন।

আধুনিক ভারতের অনুষঙ্গ থেকে ঔরঙ্গজেবকে মুছে ফেলার রাজনৈতিক প্রচেষ্টা শুরু হয় ২০১৫ সালে যখন দিল্লির ঔরঙ্গজেব রোড'এর নাম পরিবর্তন করে এপিজে আব্দুল কালামের নামে করা হয় এবং বিজেপি ও সমমনস্ক হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ঔরঙ্গজেবকে একজন নিষ্ঠুর ইসলামপন্থী নিপীড়ক হিসাবে বর্ণনা করতে থাকে। ২০২২ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী  বারাণসীতে কাশী বিশ্বনাথ মন্দির সংলগ্ন 'জ্ঞানব্যাপী মসজিদ' ধ্বংস করার সপক্ষে বলতে গিয়েও 'ঔরঙ্গজেবের নৃশংসতা ও সন্ত্রাস' সম্পর্কে বলেন, যদিও জ্ঞানব্যাপী মসজিদটি আদৌ কোনও হিন্দু মন্দিরের উপর নির্মিত কিনা তার কোনও ইতিহাস ভিত্তিক প্রমাণ আজও মেলেনি এবং আদালতে এটি বিচারাধীন।

বিজেপি এবং আরএসএস'এর যৌথ উদ্যোগে মুসলমান বিরোধী অ্যাজেন্ডার অংশ হিসেবে বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়া ও কিছু পত্রিকায় ঔরঙ্গজেব সম্পর্কে বহু মিথ্যা ধারণা প্রচার করা হচ্ছে। যেমন, তিনি নাকি অনেক হিন্দু মন্দির ধ্বংস এবং লক্ষ লক্ষ হিন্দুদের হত্যা করেছিলেন। অথচ, ঔরঙ্গজেব তাঁর ন্যায়বিচারের জন্য সমস্ত ধর্মীয় ধারার মানুষের কাছে আলোচিত ছিলেন। শুধু তাই নয়, ঔরঙ্গজেব বহু হিন্দু মন্দির সংস্কার করে ব্রাহ্মণদের জমি, বৃত্তি চালু করেছিলেন এবং সম্ভবত তিনিই তাঁর প্রশাসনে সবচেয়ে বেশি হিন্দুদের নিয়োগ করেছিলেন। ঔরঙ্গজেব হিন্দু উৎসবের উপর চালু কর বাতিল করে এই ধরনের উদযাপনকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। অসংখ্য ইউরোপীয় ভ্রমণকারী এবং হিন্দু লেখক ১৬৯০'এর দশকের শেষের দিকে হোলি উদযাপনের কথা উল্লেখ করেছেন যেখানে ঔরঙ্গজেবের নিজের সন্তানরাও অংশ নিতেন।

গত এক দশক ধরে ভারতের ইতিহাসকে বিকৃত করে ভারতের ইসলামি অতীত সম্পর্কে মানুষকে বিভ্রান্ত করার যে নির্লজ্জ প্রচেষ্টা বিজেপি তথা প্রধানমন্ত্রীর মদতপুষ্ট হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলো চালাচ্ছে তাতে ভারতীয় রাজনীতির সহিংসতার দিকটিই প্রতিভাত হয়ে উঠছে। সুপরিকল্পিত ভাবে গোদি মিডিয়া এবং বলিউডকে ব্যবহার করা হচ্ছে একের পর এক জাতীয়তাবাদী বিতর্ক উসকে দিয়ে ভুল তথ্য-নির্ভর ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র বানাতে, যেমন, 'পদ্মাবত', 'পৃথ্বীরাজ', 'তানাজি', যেখানে সব মুসলমান শাসকই বর্বর, নিষ্ঠুর এবং হিন্দু বিরোধী। অথচ যে সময়ের পটভূমিতে চলচ্চিত্রগুলি তৈরি হয়েছে, সেই সময় জাতীয়তাবাদের কোনও ধারণাই ভারতীয়দের মধ্যে ছিল না।

এখনও অনেক ভারতীয় বিশ্বাস করেন যে মুসলমান শাসকেরা প্রায়শই ইচ্ছাকৃতভাবে হিন্দু মন্দিরগুলি লুটপাট ও ধ্বংস করে মসজিদ নির্মাণ করতেন। স্বাধীনতার পর প্রথম চার দশকে এই সমস্যাটি এত প্রকট ছিল না। কিন্তু ১৯৮০-র দশকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বিজেপি অযোধ্যায় ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত 'বাবরি মসজিদ'এর স্থানে একটি রাম মন্দির নির্মাণের জন্য প্রচার শুরু করে এবং ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা ওই মসজিদ ভেঙে ফেলে। এর ফলে ভারতের হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কমপক্ষে ২০০০ মানুষের মৃত্যু হয়। এই  আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল আরএসএস এবং অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি যা 'সংঘ পরিবার' নামে পরিচিত; যাদের মূল উদ্দেশ্যই হল ভারতে হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণ এবং মুসলমান নিধন।

২০১৪ সালে মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুসলমান বিরোধী ঘৃণার মনোভাব এবং হিংসাকে বৈধতা দানের মাধ্যমে ধর্মীয় মেরুকরণের সপক্ষে একের পর এক আইন প্রণয়ন করে চলেছে। তারা ২০১৭ সালে গো-মাংস নিষিদ্ধ করা থেকে ২০১৯'এর নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের মাধ্যমে ক্রমাগত মুসলমানদের কোণঠাসা করে ফেলার পদক্ষেপ নিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর চাপ সৃষ্টি করে  চলেছে। উত্তরাখণ্ডে ইতিমধ্যেই আইনে পরিণত হওয়া ইউনিফর্ম সিভিল কোড দুই প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির আন্তঃধর্মীয় ও আন্তঃবর্ণ বিবাহ বা তাদের নিজস্ব পছন্দের লিভ-ইন সম্পর্কে প্রবেশের সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষিত স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে। সংসদে পাসের অপেক্ষায় থাকা হাল আমলের ওয়াকফ সংশোধনী বিল প্রণয়নেরও আসল উদ্দেশ্য সমস্ত মুসলিম দাতব্য সম্পত্তি, মসজিদ এবং সমাধিসৌধকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা।

'ইউএপিএ অ্যামেন্ডমেন্ড অ্যাক্ট'এর ভয়াবহ বাতাবরণে বিনা বিচারে মানুষকে গ্রেফতার করে জেলে বন্দি করে রাখা হচ্ছে। উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশে সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত জীবনও আজ রাষ্ট্রের নজরদারি ও হস্তক্ষেপে বিপর্যস্ত। উত্তরপ্রদেশের সম্ভলে এ বছর জুমার নামাজের বিরুদ্ধে 'হোলি' উদযাপন ছিল পরিকল্পিতভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রচারের অংশ। এমনকি 'হোলির' দিন সম্ভলের  মসজিদ্গুলিকে ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় এবং প্রশাসন ওইদিন মুসলমানদের বাড়ির ভিতর থাকতে আদেশ দেয়। দলিতরাও এই হোলির হিংসার বলি হয়েছে। বিহারের ঔরঙ্গাবাদ জেলায় এক দলিত নাবালিকা কোমল পাসওয়ানকে রঙ নিতে অস্বীকার করার জন্য পিষে মেরে হত্যা করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

ভারতের ক্রমাগত নিম্নগামী অর্থনৈতিক অবস্থা, মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারত্বের দিক থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘোরানোর লক্ষ্যে আজ পাঠ্যপুস্তক ও গণমাধ্যমের মাধ্যমে মুসলমান বিরোধী ঘৃণার মনোভাব ও ধর্মান্ধতার ধারণাগুলি সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং শিক্ষা, সংস্কৃতি ও কর্মক্ষেত্রেও এই গৈরিকিকরণ চলেছে। মুসলমান বিরোধী নিপীড়নের নতুন নতুন অজুহাত আবিষ্কৃত হচ্ছে এবং সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় অনুভূতির বিরুদ্ধেও নতুন সব হাতিয়ার তৈরি হচ্ছে। নিত্য নতুন আইন ও বিল মুসলমানদের প্রতিদিন আরও ভীত, সন্ত্রস্ত ও দুর্বল করে তুলছে এবং নিরাপত্তাহীনতার দিকে  ঠেলে দিচ্ছে।  

বিকৃত ইতিহাস, ধর্মীয় মেরুকরণ ও রাজনীতির এই ত্রিভুজ সংকটে সাধারণ মানুষের আবেগ বিধ্বস্ত ও দোদুল্যমান। তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করার দায়িত্ব বর্তমান প্রজন্ম ও সচেতন নেতৃত্বের হাতে।


Sunday, 23 March 2025

আশা-আশঙ্কার দোলাচলে

বাংলাদেশ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে

শাহেদ শুভো



এই লেখাটি যখন লিখছি সেই মুহুর্তে আমার নিউজ স্ক্রলে দেখছি ইজরায়েল ফিলিস্তিনিতে হামলা চালিয়ে নির্বিচারে হত্যা করছে! নেতানাহু যুদ্ধ বিরতিকে অস্বীকার করেছেন! দুর্নীতিবাজ নেতানেহু তাঁর দেশে চরম অজনপ্রিয়, তাঁকে ক্ষমতায় থাকতে হলে ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে অন্যায্য হামলা চালিয়ে যেতে হবে, যেমন ভারতে স্রেফ একটা চলচ্চিত্রকে কেন্দ্র করে ভারতীয় উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দলগুলি মোঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের কবর ধংস করতে চায়! কী অদ্ভুত মিল-- আমাদের এখানে পীর-ওলিদের মাজার ভাঙছে ইস্লামিস্ট চরমপন্থীরা! গত সাত মাসে ৮০'র অধিক মাজার ভেঙ্গে ফেলেছে তারা! পবিত্র রমজান মাসে ফিলিস্তিনের সাধারণ নাগরিকদের উপর যখন একদল নির্বিচারে গণহত্যা চালাচ্ছে, তখন অন্য কেউ ৩০০ থেকে ৪০০ বছর আগের কোনও মোঘল শাসকের কবর উপড়ে ফেলে ইতিহাস মুছে ফেলতে চায়; আবার আমার দেশেই তৌহিদী জনতার বেশে মাজারে অ-ইসলামিক কর্মকাণ্ডের ধুয়ো তুলে সেগুলিকে ধংস করা হচ্ছে। 

আছিয়া নামে এক শিশুকে নারকীয় ভাবে ধর্ষণ করে হত্যা করেছে তারই স্বজনেরা! কী অমানবিক এই সমাজ! এর প্রতিবাদে যখন সারা দেশের মানুষ, রাজনৈতিক দল, সাংস্কৃতিক-সামাজিক সংগঠন  রাজপথে, গণজাগরণ মঞ্চের সাবেক ও বর্তমান সিপিবি নেতা লাকি আক্তার তাঁর অবস্থান থেকে এই আন্দোলনে যুক্ত হন, সেইদিন পুলিশ বামেদের উপর হামলা চালায়। ইউটিউবার পিনাকী ভট্টাচার্য সহ ইসলামপন্থী একটা অংশ প্রচার করে যে, বামেদের এই আন্দোলন থেকে মূলত আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের আয়োজন করা হয়েছে। পিনাকীবাবু ভিডিও বানায় এবং সিপিবি অফিস দখল নিতে বলে। শাপলা-শাহবাগ'এর বাইনারি হাজির করে তারা! ন্যারেটিভ, পালটা ন্যারেটিভ, বাইনারি, কালচারাল ওয়ার, মব লিঞ্চিং, মব জাস্টিস, তৌহিদী জনতা, সংস্কার, কবর দেওয়ার হুমকি (যা কিছু আমার পছন্দ নয়), ফার রাইট, নয়া বন্দোবস্ত এগুলো এখন আমাদের অ্যালগরিদম স্ক্রল ফিড আর নিউজ ফিডের স্ক্রিনিং। যা ঘটছে অথবা দৃশ্যমান, সেগুলোই কি সত্য? সাধারণ মানুষের কি এতে কোনও যোগ আছে? নাকি প্রপাগান্ডা চালানো একটা অংশ এমন ভাবে দেখাচ্ছে যেন বাংলাদেশের রাস্তায় জঙ্গিরা প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে! বাংলাদেশ কি পরবর্তী আফগানিস্তান? আমরা ভয় পাচ্ছি, সাম্রাজ্যবাদী চক্র কি 'ওয়ার অন টেরর'এর ক্ষেত্র বানাচ্ছে বাংলাদেশকে? 

বাংলাদেশের এই মুহুর্তে বৃহত্তম দল বিএনপি দ্রুত নির্বাচন চাইছে। বেশ কিছু জরিপ থেকেও তেমন একটা ছবি ধরা পড়েছে। তাদের সঙ্গে সংযুক্ত প্রায় সমমনা দলগুলিও দ্রুত নির্বাচন চাইছে। অবশ্য, জনমনে এবং ফেসবুকের ষড়যন্ত্র তত্ত্বে অনেক খবর ঘুরে বেড়ায় যার সত্য-মিথ্যা সাধারণজনেরা জানে না। প্রশ্ন হল, অন্তর্বর্তী সরকার কি নির্বাচনের ব্যাপারে আন্তরিক? শেখ হাসিনাও নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার হাত বদল চায়নি এবং বাংলাদেশের সংকটের শুরু এই 'পাওয়ার ট্রান্সফার'এর অনীহা থেকেই! অভ্যুত্থান পরবর্তী লেখায় আমি বেশ কিছু সংশয়ের কথা বলেছিলাম। হাসিনা পতনের অন্যতম কারণ ১৫ বছর জোর করে অসৎ পদ্ধতিতে তাঁর ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং এক অলিগার্ক বাহিনী গড়ে সমস্তরকম অন্যায় করে যাওয়া। ২০২৪'এর জুলাই ছিল হাসিনা বাহিনীর চরম নৃশংসতার বহিঃপ্রকাশ। ফলে, সাধারণ মানুষ, ছাত্র আর রাজনৈতিক দলগুলো এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছিল সকল বিভেদ ভুলে; দেশের অধিকাংশ মানুষের একটাই লক্ষ্য ছিল: হাসিনার পতন! 

হাসিনা উচ্ছেদের পর প্রশ্ন উঠেছে, তাঁকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা ছাড়া বাংলাদেশের মানুষের সামনে কি কোনও বিকল্প রাজনীতির উপস্থিতি ছিল? বাস্তব এটাই যে, কোনও রাজনৈতিক দল একক ভাবে হাসিনা পতনে ভূমিকা রাখেনি, অনেক অনুঘটকও ছিল, হয়তো কিছু ষড়যন্ত্রও ছিল। কিন্তু কোনওটাই প্রাসাদ ষড়যন্ত্র নয়; তা ছিল বাংলাদেশের অধিংকাংশ মানুষের চরম ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণি যারা ২০২৪'এর আগে অবধি বিএনপি'র গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছে, এমনকি বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনেও অনেককেই সেই সময় সক্রিয় দেখা যায়নি। তাই সেই গণতন্ত্র বা ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন স্রেফ বিএনপি'র দলগত আন্দোলনে পরিণতি পায়। যখন হাসিনার দুর্বৃত্ত পেটোয়া বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত নগরবাসী দেখে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে তখনই তারা প্রবলভাবে হাসিনার বিরুদ্ধাচারণ করে, ফলত হাসিনার পতন হয়। হাসিনা'র পতনের পর প্রায় তিনদিন যখন দেশে কোনও কার্যকর সরকার ছিল না তখন কিন্তু ছাত্রজনতা ও সেনাবাহিনী একসঙ্গে বাংলাদেশের সেই সময়ের সার্বিক পরিস্থিতি সামলে ছিল, হাসিনা পরবর্তী বড় ধরনের গণহত্যা হওয়া থেকে বাংলাদেশ রক্ষা পেয়েছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, নানা জনে এখন অভ্যুত্থানের ক্রেডিট সংগ্রহে ব্যস্ত। অথচ জনগণের অভিপ্রায় না থাকলে এই সামগ্রিক লড়াই হত কিনা তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। 

রাজনৈতিক সংস্কার বা নয়া বন্দোবস্তের প্রশ্ন সবই এখন আলাপে আসছে যদিও হাসিনার পতনের আগে তা সেভাবে কেউ ভেবে দেখেনি। একজন ভাইরাল কবি লিখেছেন, 'জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে কেন সংস্কার করতে হবে, জনগণ শুধু ভোটের মালিক!' আবার একজন সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সার বলেছেন ভোটকে ব্যান করে দিতে! কী অদ্ভুত! এরাই আমাদের জেন-জি সম্প্রদায়ের আইডল! এদের কারও অঙ্গুলি হেলন ও উত্তেজনায় ৩২ নম্বর গুড়িয়ে দেওয়া হয়! ১৯৭১ না ২০২৪-- এখন অ্যালগরিদমের স্ক্রলের আলাপ, আপনি ২৪'এর নির্বিচার হত্যাকে স্বীকার করে নিবেন! আবার ৭১'এ বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পূর্বে যে গণহত্যা চালানো হয়েছিল সেই বিষয় প্রশ্ন তৈরি করবেন মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে! এইসব কিছু দেখে অনেকে ধারণা করছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় মূলত মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী সক্রিয় রাজনৈতিক অংশই কি ২৪'এর হাসিনা পতনের আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিচ্ছে? 

রাজনৈতিক দলগুলি, বিশেষ করে বিএনপি'র মতো জনমুখি শক্তিশালী সংগঠনগুলো, যাদের মূল অংশ এক ধরনের উদার গণতান্ত্রিক চরিত্রের এবং অনেকগুলো উদারপন্থী বাম দল এই সরকার এবং এদের সঙ্গে থাকা ছাত্র নেতৃত্বকে নিয়ে সন্দিহান, কারণ, এই ছাত্ররা প্রথম থেকেই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র রাজনীতির নামে 'অরাজনৈতিক' পরিচয়ের কথা বললেও এদের অধিকাংশই জামাতের ছাত্র সংগঠন 'শিবির'এর বর্তমান এবং প্রাক্তন কর্মী! আবার যে 'জাতীয় নাগরিক কমিটি' করা হয়েছিল সেখানে অনেক সংগঠকের পরিচয় ছিল প্রাক্তন 'শিবির'। শিবির বা জামায়াত হওয়াটা অবশ্যই দোষের নয় কিন্তু জনমানসের বৃহৎ অংশের মধ্যে এখনও তাদের মুক্তিযুদ্ধে অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, যদিও তাদের অনেকেই বলছে তারা স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে। কিন্তু তাদের বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধিকাংশের মধ্যে আমরা কি আদৌ দেখতে পেয়েছি বাংলাদেশ এবং মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে পরিষ্কার কোনও অবস্থান? এই নেতৃত্বদানকারী অংশ এই মুহূর্তে নির্বাচনে আগ্রহী নয়! তারা হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিচার, দ্বিতীয় রিপাবলিকের গণপরিষদ নির্বাচন, ৭২'এর  সংবিধান ছুড়ে ফেলে দেওয়া, এই আলাপেই ব্যস্ত। কাকতালীয় ভাবে, জামাত সহ তাদের আরেক মিত্র শক্তি এবি পার্টিও ছাত্রদের এই সুরেই অনেকটা কথা বলছে। মানুষের মধ্যে প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে, নির্বাচন কি আদৌ হবে? এর মধ্যে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্টে আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনা সরকারকে জুলাই গণহত্যার জন্য দায়ী করা হয়েছে। তৎসত্ত্বেও আওয়ামী লীগের সমর্থকরা কি বিশ্বাস করে যে তারা কী ভয়াবহ নৃশংসতা চালিয়েছে এই দেশের জনগণের উপর? বিন্দুমাত্র অনুশোচনা অনুভব না করা এই দলের সমর্থকরা তো শেখ হাসিনা ও তাঁর দলবলের মতো পালিয়ে যেতে পারেনি। তাদের কী অবস্থা হবে? 

এসবের মধ্যেই তরুণদের রাজনৈতিক দলের অভিষেক হল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি' নামে। ব্যাপক আয়োজনে এই দলের অভিষেকে বর্তমান সরকারে তাদের সংযুক্ত থাকার খবর গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই তাদের 'কিংস পার্টি' বলছে। এই দল শুরু থেকেই বিতর্ক জারি রেখেছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি'র নেতা যিনি বর্তমান সরকারে তথ্য উপদেষ্টা ছিলেন, তিনি দেশের আইনশৃঙ্খলা এখন সুখকর না তাই নির্বাচন পেছনোর পক্ষে মত দিয়েছিলেন, যদিও পরে তাঁর ওই বক্তব্য প্রত্যাহার করেছেন; আবার সংগঠনের অর্থ বিষয় প্রশ্ন করা হলে দলের অর্থদাতাদের বিষয়ে তথ্য দিতে অপারগতা দেখিয়েছেন। এই দলের অর্থ সহ নানা প্রসঙ্গে অনেক প্রশ্ন জনপরিসরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, এই দলের মতাদর্শ কী? শুধু বিগত রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধবাদিতার রাজনীতি কি দীর্ঘমেয়াদে কার্যকরী থাকবে?

আরও প্রশ্ন উঠছে-- দেশের তৃণমূল স্তরে শক্তিশালী দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি'র দ্বিদলীয় রাজনীতির যুগ কি শেষ হবে? কারণ, আওয়ামী লীগের মতো বিএনপি'র তৃণমূল স্তরে নেতাকর্মীরাও চাঁদাবাজি ও দখলের কর্মকাণ্ড শুরু করে দিয়েছে। আবার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি কি এই সরকারের সঙ্গে যুক্ত নতুন রাজনৈতিক দল অস্বীকার করতে পারে? গত শনিবার (২২ মার্চ) মহম্মদ ইউনুসের প্রেস সচিব সফিকুল আলম জানিয়েছেন যে দেশের সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আইনশৃঙ্খলার সমস্যা।

গোটা বাংলাদেশটা ঢাকা অথবা ঢাবির ক্যাম্পাস নয়। এখনও গ্রামে সামন্ত চিন্তার সমাজ সক্রিয়! জাতীয় পুঁজির নামে হাসিনা লুটেরা পুঁজি নির্মাণ করেছে, আবার গার্মেন্টস'এ গত সাত মাসে কয়েক হাজার শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে, আন্দোলনরত শ্রমিকের রক্তে লাল হয়েছে এই সরকারের হাত। এই প্রশ্নও আছে, প্রবাসে যে মানুষগুলো সস্তা শ্রম বেচে তাদের নাগরিক সত্তা কী? এমন অনেক প্রশ্নই ঘুরে ফিরে আসছে। মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা তরুণরা নতুন রাজনীতি নির্মাণ করবে নাকি বিগত দিনের মতোই বৃহত্তম দল হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় আরেকটা এলিটোক্রেসির কাঠামো তৈরি করবে?  চারপাশের পরিস্থিতি আমাদেরও ভাবিয়ে তোলে-- বাংলাদেশ কি ভবিষ্যতের গাজা হয়ে উঠছে? সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্ত আর আমাদের বিভ্রান্ত রাজনীতি এই ব-দ্বীপকে কোন প্রশ্নের সামনে দাঁড় করাবে?


Tuesday, 18 March 2025

ভুয়ো ভোটারের মেগা কারচুপি

আগামী নির্বাচনের দিনগুলি!

কল্যাণ সেনগুপ্ত



আশ্চর্যজনক ভাবে হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র এবং সর্বশেষ দিল্লির নির্বাচনে বিজেপির জয়লাভ ওইসব রাজ্যের বিজেপি বিরোধী পক্ষকে হতবাক ও সচকিত করেছে। অন্য নানা কারণ থাকা সত্ত্বেও ভোটার লিস্টের গড়বড় অবশ্যই পরাজয়ের একটি বড় বিষয়। এ কথা অনস্বীকার্য যে, বিরোধী সংঘবদ্ধতার অভাব, নানাবিধ সাংগঠনিক ত্রুটি ইত্যাদি অবশ্যই ছিল। কিন্তু, প্রতিটি রাজ্যেই ভোটের ফল প্রকাশের পর সবার নজরে এসেছে যে লোকসভার নির্বাচন সাঙ্গ হবার মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানেই এক অসম্ভব ঘটনা ঘটেছে; বেশ কয়েক লক্ষ ভোটারের অবাস্তব সংখ্যা বৃদ্ধি। যেমন মহারাষ্ট্রে লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনের মধ্যবর্তী মাত্র সাত মাস সময়ে ভোটার লিস্টে ৩৯ লক্ষ ভোটারের নাম যুক্ত হয়েছে। এই নতুন নাম তালিকাভুক্তির অধিকাংশই হচ্ছে অনলাইনে, যেখানে কোনও ভেরিফিকেশন ছাড়াই এন্তারসে বিজেপি শাসিত কিছু রাজ্য থেকে নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। এবার নেপোয় এসে দই মেরে দিয়ে চলে যাচ্ছে! কথিত তিন রাজ্যের বিজেপি বিরোধী নেতৃত্ব অন্যান্য বিষয় নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিল যে ভোটার লিস্টের এই অসম্ভব সংখ্যা বৃদ্ধির দিকে তাদের সময়মতো নজরই পড়েনি। এ ব্যাপারে প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সাংবাদিক রাজদীপ সারদেশাই, এরপর তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ সাগরিকা ঘোষ তথ্য সহকারে তাঁর নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জানালে তিনি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে ইস্যুটিকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে সোরগোল তোলেন যে এখন আর তাকে কোনওভাবেই পাস কাটিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

এর ফলে অবশ্য শুধু এ রাজ্যেই নয়, এ বছরের শেষের দিকে আসন্ন বিহার নির্বাচনেও এইদিকে সব দলেরই নজর থাকবে। যদিও বিহারের নির্বাচনে মূল বিষয় হচ্ছে বিরোধী দল সমূহকে বিরোধী জোট গড়ে  নিজেদের মধ্যে সুষ্ঠু রূপে আসন বণ্টনের সমস্যাটি সহমতের ভিত্তিতে সমাধান করা। তৃণমূল স্তরে জোটের সাংগঠনিক ঐক্যবদ্ধ রূপ গড়ে তুলতে সফল হলে সর্বত্র প্রচারে ঝড় তোলা সম্ভব। আমরা লক্ষ করেছি, অতীতের ভোটে কংগ্রেস তার জাতীয় রাজনীতির ওজন দেখিয়ে বাস্তব সাংগঠনিক ক্ষমতার থেকে অনেক বেশি আসন আদায় করে অথচ যোগ্য লড়াই দিতে ব্যর্থ হয়ে বিজেপিকেই জিততে পরোক্ষে সাহায্য করে। এর অবসান জরুরি। বিহারে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন দলের কিছু এলাকায় যথেষ্ট শক্তি আছে, কিন্তু তাদের কম আসনে লড়তে বাধ্য করা হয়। এরও প্রতিকার হওয়া উচিত। বিহারে বিজেপি নীতিশকেই মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করায় লড়াই বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়াল নিঃসন্দেহে। ফলে, বিরোধী ঐক্যে সামান্য ত্রুটিও ভবিষ্যতে হতাশার কারণ হতে পারে।

এ রাজ্যের ক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে লড়াই তৃণমূল বনাম বিজেপি। বাস্তবে সিপিএম ও কংগ্রেসের ভূমিকা এখানে স্রেফ বিজেপিকে পরোক্ষে মদত দেওয়া। বিশেষত সিপিএমের ভোটই যে বিজেপির ভাণ্ডারকে পুষ্ট করেছে সে তো দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট। উল্লেখ্য, কিছুদিন আগেই অনুষ্ঠিত দিল্লির ভোটে বিজেপি জেতায় এবং আপ হারায় কংগ্রেস নেতৃত্বের কি নির্লজ্জ উল্লাস! দেশের প্রধান বিরোধী দলের নেতৃত্ব যদি এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করে তবে তার লাভ যায় শাসক বিজেপির পক্ষেই। আজ অনেকের মনেই এই প্রশ্ন উঠছে যে, প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের এমন অদ্ভুত আচরণের কারণ কী? দেশের একটি শিশুও সম্ভবত জানে, সর্বাত্মক বিরোধী ঐক্য বিনা বিজেপিকে হারানো অসম্ভব। তবুও কোনও এক রহস্যজনক কারণে বিরোধী ঐক্যের ইন্ডিয়া জোটকে কোমায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বাংলার ভোট আগামী বছর। তবে অনেকে এমনটাও  ভাবছেন, কোনও কারণে এ রাজ্যের ভোট কয়েক মাস এগিয়ে এনে বিহারের সঙ্গেই সাঙ্গ হবে না তো? সেটা সম্ভব একমাত্র রাজ্য সরকার চাইলেই। রাজ্যের সরকার চূড়ান্ত গরমে ভোট গ্রহণের অসুবিধার কথা অতীতে বহুবার প্রকাশ্যে বলেছে। বাংলার চেয়েও বিহারের ভোট বিজেপির কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ফলে, একসঙ্গে ভোট হলে বিজেপি বাংলার ভোটে সর্বোচ্চ নেতৃত্ব অর্থাৎ মোদী-শাহ'দের এনে প্রচারে বেশি সময় দিতে পারবে না, এতে লাভ টিএমসি'র। সে কারণেই বিজেপি এতে রাজি হবে না, কিন্তু আটকাতে পারবে কি? কারণ, এ বিষয়ে রাজ্যের প্রস্তাব গ্রহণ না করা কঠিন এবং যুক্তির দিক দিয়েও একসঙ্গে ভোট করার পক্ষেই বিজেপি বলে থাকে, সবাই জানে। সুতরাং রাজ্য চাইলে একসঙ্গে হবার সম্ভাবনাই বেশি।

ভোট বাংলায় যবেই হোক নিশ্চিত ভাবেই লড়াই দ্বিমুখি হবে। একটা সামান্য পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে-- উচ্চতর কংগ্রেস নেতৃত্বের অনুরোধে কিছু আসন ছেড়ে দিলে গড়ে উঠতে পারে এক অনিচ্ছুক কর্তব্যের জোট। কারণ এ রাজ্যে কংগ্রেস কর্মীদের কাছে বিজেপির চেয়েও তৃণমূল অনেক বড় শত্রু। আর জোট হলেও বাকি সব আসনে কংগ্রেস কর্মীরা তৃণমূলকে আদৌ ভোট দেবে কিনা সন্দেহ। এর জন্য অবশ্য ভোটের ফলে বিশেষ হেরফের হবে না। আমরা জানি, লোকসভার ভোটে বিজেপি কিঞ্চিৎ বেশি ভোট পায় বিধানসভার ভোটের তুলনায়। তবে এবার  ভোটে সব দায়িত্ব নিজেদের কাঁধেই তুলে নিয়েছে সংঘ নেতৃত্ব, এমনটাই জানিয়েছেন সংঘকর্তা মোহন ভগবৎ স্বয়ং। অস্বীকার করার উপায় নেই, শেষ তিনটি রাজ্যের ভোটে তৃণমূল স্তরের প্রচারে সংঘের ভূমিকা ছিল যথেষ্ট প্রভাবশালী। সুতরাং, এ রাজ্যেও অধিক সাবধানতার প্রয়োজন নিশ্চিত। মাথায় রাখতে হবে, এরই সাথে যুক্ত হবে বিজেপির বিশাল অর্থ ভাণ্ডারের সুচতুর ব্যবহার। ফলে লড়াই এবার বেশ কঠিন।

উপরোক্ত বিভিন্ন বিষয় ছাড়াও শাসক দলের প্রধান কাজ আসন্ন ভোটে প্রতিটি বুথে ভুয়ো ভোটারের সন্ধান ও তা লিপিবদ্ধ করে প্রথমে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের কাছে সে তালিকা সহ অভিযোগ দায়ের করা ও কড়া নজর রাখা। তৎসহ সমস্ত বিরোধী পক্ষের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের উপর প্রয়োজনীয় চাপ সৃষ্টি করা। আমরা জানি, নতুন মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিটি হচ্ছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহের এক খাস ও নির্ভরযোগ্য আধিকারিক। সুতরাং এদের চালাকি ও অন্যায় কর্মের ব্যাপ্তি সীমাহীন। এরা জানে, আদালতকে কীভাবে নিজেদের সপক্ষে ব্যবহার করতে হয়। ফলে আশঙ্কা হয় যে, বিরোধী পক্ষকে আগাগোড়া 'গুড হিউমারে' রেখে শেষ মুহূর্তে চূড়ান্ত ভোটার লিস্টে বিজেপি কৃত যথেষ্ট গড়বড় সহ তা প্রকাশিত হয়ে যেতে পারে। স্ক্রুটিনি, নাম সংযোজন বা বাতিলের সমস্ত প্রক্রিয়ার অন্তে শেষ কথা তো বলবেন মুখ্য কমিশনারই এবং তার আজ্ঞাই শিরোধার্য করতে হবে সব পক্ষকে। কিন্তু তাতে  অসন্তুষ্ট হলেও শেষ মুহূর্তে কিছু করার আদৌ কোনও সুযোগ থাকবে কি? সামনে থাকবে মাত্র দুটো অপশন, হয় নির্বাচন বয়কট করো নয়তো আদালতে যাও এবং সেখানেও শেষ সময়ে আদালত কোনওরকম সুবিচার দেবে, এমন আশা প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে, কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত চাপ সৃষ্টি করতে হবে এবং তার জন্য কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপি বিরোধী শক্তির সুসম্পর্ক ও বোঝাপড়া বিশেষ জরুরি। প্রধান বিরোধীরা এ বিষয়গুলো বুঝলেও কতখানি সফল হন, তার উপরেও এবারের ভোটের ফল অনেকখানিই নির্ভরশীল।


Sunday, 16 March 2025

ভবিষ্যৎ কি ছোট উদ্যোগের হাতে?

পাকিয়ে উঠছে নতুন এক চরাচর

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

সম্প্রতি OpenAI সংস্থার সিইও স্যাম অল্টম্যান বলেছেন, আগামী দিনে এক-ব্যক্তিক কোম্পানিও ১ বিলিয়ন ডলার মূল্যের যোগ্য হয়ে উঠতে পারে। অর্থাৎ, কোম্পানির যিনি মালিক তিনিই কর্মচারী এবং আর কেউ কর্মে নিয়োজিত নেই, সে কোম্পানির পক্ষেও বাজারে ১ বিলিয়ন ডলার মূল্য অর্জন কোনও অভাবনীয় বিষয় নয় আর। কথাটি শুনলে তাক লেগে যেতে পারে, কিন্তু তা আজকের সময়ে তেমন অসম্ভব কিছু নয় মোটেই। তাহলে কি আগত ভবিষ্যতে সত্যি সত্যিই কাজকম্মে লোকজনের তেমন আর প্রয়োজন নেই? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অগ্রগমন তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে বৈকি!

দেখেছি, এই ধরনের প্রসঙ্গ পাড়লেই কিছু উত্তেজিত কিন্তু ‘নৈতিক’ মানুষজন বেশ তেড়েফুঁড়ে এসে জিজ্ঞেস করেন, তাহলে কি আপনি বলতে চাইছেন সকলে বেকার হয়ে ঘুরে বেড়াবে আর রাষ্ট্রীয় কোষাগারের ‘ভিক্ষা’ নিয়ে বেঁচে থাকবে? আজকাল ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকামের যে প্রস্তাব নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনা উঠেছে, আংশিক ভাবে কোথাও কোথাও তার প্রচলনও হয়েছে (আমাদের দেশের বিভিন্ন রাজ্যে তো বটেই), তাকে তাঁরা ‘ভিক্ষাবৃত্তি’ বলে থাকেন। কী মুশকিল! আমি এনাদের কিছুতেই বোঝাতে পারি না যে আমি এক পর্যবেক্ষক মাত্র, এ আমার ভাবনা-প্রসূত কোনও প্রকল্প নয়, পুঁজিবাদী রাজনৈতিক অর্থনীতির এক স্বাভাবিক পরিণতি যেখানে জগৎ-সংসারের প্রায়-সমস্ত কাজের ভার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে নিচ্ছে এবং ক্রমেই বহু সংখ্যক কর্মকুশলী মানুষজনকে অবাঞ্ছিত করে দিচ্ছে। এর পিছনে মৌলিক তাড়নাটা ব্যবসায় মুনাফার হারে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি ঘটানো। মুনাফার হারে উর্ধ্বগতি না এলে মুনাফা অর্জনে স্থিতাবস্থা থাকে না— এই হল পুঁজিবাদী অর্থনীতির সচলবচল থাকার চাবিকাঠি। শিল্প বিপ্লবের পরে এ তাবৎ প্রযুক্তির যে কোনও অগ্রগতি ও প্রয়োগের পিছনে এই তাগিদ ও আকাঙ্ক্ষাই কাজ করেছে। আজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অলৌকিক সম্ভাবনা সেই তাগিদ ও আকাঙ্ক্ষাকে শত গুনে বর্ধিত করেছে মাত্র! তাই, স্যাম অল্টম্যান যখন বলতে চান যে ভবিষ্যতের কোম্পানিগুলোতে প্রায় কোনও লোকই থাকবে না, সে জায়গায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত মনুষ্যরূপী রোবট সমূহ অথবা একগুচ্ছ অ্যালগরিদমকে দেখা যাবে উৎপাদন বা পরিষেবার কাজে অংশ নিতে যারা মুনাফার হারে উর্ধ্বগতি এনে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চলাচলকে নিশ্চিত করবে, কারণ তাদের কর্মক্ষমতা নানা অর্থে যে কোনও স্বাভাবিক মানুষের থেকে বহু গুনে অধিক, তিনি ভুল কিছু বলেন না।

ফলে, আজকের স্টার্টআপগুলি বিনিয়োগ ও অর্থের জন্য আর হত্যে দিয়ে বসে থাকে না। অনেক সময় ‘ভেঞ্চার পুঁজি’ওয়ালারা অর্থের থলি নিয়ে এদের পিছনে ঘুরঘুর করলেও এরা তাদের দিকে ফিরেও তাকায় না। কারণ, অযথা অর্থ বা পুঁজির ভার থেকে এদের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারুকৌশল, যা দিয়ে তারা স্ব স্ব সংস্থার কর্মক্ষমতা ও উৎপাদনশীলতাকে বাড়াতে পারে। এক সময় সিলিকন ভ্যালি’র ধারণা ছিল, নতুন কোম্পানিকে এগোতে হলে ভেঞ্চার পুঁজির বিনিয়োগকারীদের থেকে মোটা অর্থ সংগ্রহ ও প্রচুর কর্মী নিয়োগ করে নিজেদের বেশ বড়সড় করে দেখাতে হবে; মুনাফা না হয় আসবে পরে। এই বাগাড়ম্বরটা দেখাতে পারলেই বাজারে তাদের দর বেড়ে যেত, কারণ, কতজন কর্মী নিয়োগ হল এবং কত পরিমাণ অর্থ জোগাড় করা গেল, এইটাই ছিল সে কোম্পানির মর্যাদা, ঠাটবাট ও বাজার মূল্যের মাপকাঠি। পরে দেখা গেছে, এমনতর বহু কোম্পানি অচিরেই মুখ থুবড়ে পড়েছে ও তেমন উদ্যোগপতিরা হয় দেউলিয়া হয়ে অন্যত্র পালিয়েছে, নচেৎ কোনওমতে সে সব বেচেবুচে নিজেদের মুখরক্ষা করেছে। কিন্তু এখন রণকৌশলটা ভিন্ন: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মারফত সর্বোচ্চ স্তরের নিপুণ কার্যক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা, যেখানে কর্মী সংখ্যাকে যথাসম্ভব কম রাখা এবং অযথা বিনিয়োগের রোয়াব না দেখানো। বর্তমানের এই প্রবণতাকে খেয়ালে রেখেই স্যাম অল্টম্যানের অমন মন্তব্য। সামান্য তথ্য ঘাঁটলেই দেখা যাবে, আজকের বেশ কিছু স্টার্টআপ এই রীতিতে এগিয়ে উল্লেখযোগ্য সফলতা পেয়েছে; যেমন, Eleven Labs, Gamma, Anysphere, Trata, Diligent, Truewind ও আরও অনেক। এ ক্ষেত্রে অভাবনীয় ভূমিকা রেখেছে Deepseek, যারা গণনার খরচকে অনেক সস্তা করে, নিজেদের কোডকে open source’এ রেখে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারকে আরও বেশি সর্বজনীন করতে সফল হয়েছে।

ইতিমধ্যেই লক্ষণীয়, একদিকে যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যাপক প্রয়োগের ফলে চাকরির জগতে লোকজনের চাহিদা বহু ক্ষেত্রে নিম্নগামী, অন্যদিকে আবার সেই বুদ্ধিমত্তার সহজলভ্যতা ও সর্বজনীনতার জন্য যে কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তাকে কাজে লাগিয়ে নতুন কর্মের জগৎ তৈরি করতে উদগ্রীব। কতরকমের যে কাজের বাহার, কতরকমের পরিষেবা, কত বিচিত্র বাজার অভিসার— সব মিলিয়ে নব-নির্মিত অভিনব কাজের দুনিয়া। অর্থনীতির ভাষায় যাকে বলে ‘utility’ (উপযোগিতা) সৃষ্টি। সমস্ত কাজই জীবিকার কাজ যখন সে কাজের অন্তে নির্মিত স্পর্শযোগ্য অথবা অস্পর্শযোগ্য পণ্যটির বাজার মূল্য নিশ্চিত। এই মূল্য-স্বীকৃতি তার উপযোগিতার স্মারক। আমি যদি বিকেলে বাড়িতে গরম তেলেভাজা ভেজে প্রতি ১০ মিনিট অন্তর ৫ কিলোমিটার ব্যাসার্ধে চাহিদা অনুযায়ী একটি অ্যাপের মাধ্যমে ক্রেতাদের (ব্যক্তি, পরিবার বা অন্য দোকান) সরবরাহ করি, বুঝতে হবে, তার বাজার মূল্য আছে, কিছু কর্মীকে মজুরির বিনিময়ে কয়েক ঘন্টা কাজে লাগানো গেছে এবং সর্বোপরি, অ্যাপের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে ক্রেতাদের চাহিদার বিন্যাসকে যথাযথ ভাবে রপ্ত করে তাদের আকাঙ্ক্ষাকে পূরণ করাও সম্ভব হয়েছে। ক্রেতাদের চাহিদাকে ধরা ও সামলানো এবং কর্মীরা কতটা কম সময়ে ক্রেতাদের কাছে পৌঁছতে পারল— কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কিন্তু এই সমস্ত বিষয়াদিকে নজরে রেখে তার উপলব্ধ অ্যালগরিদম দিয়ে প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন করল; সঙ্গে পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাবপত্রও সেরে রাখল। এইভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে ও সামান্য উদ্যোগে যে কোনও পছন্দের কাজকে আয়ত্ত্বাধীনে এনে আয়ের পথকে প্রশস্ত করে ফেলা তেমন কষ্টসাধ্য নয় মোটে। তবে সে কাজের আয়ু কতদিনের তা বলা মুশকিল। এও বলা শক্ত, সকলে এ কাজে পটু হবে কিনা। কিন্তু তথ্য বলছে, আমাদের দেশের মোবাইল ঘনত্ব ৮২.৫৪ শতাংশ (২০২৩), অর্থাৎ, প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৮২ জন মোবাইল ব্যবহার করেন; আর একই সময়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন ১২০ কোটি মানুষ (statista.com)। বলাই বাহুল্য, নৈতিক চিন্তাবিদদের আমাদের দেশের আমজনতাকে অতি-অসহায় ভাবার কোনও কারণ নেই! 

অবশ্য, এইভাবে কত শত মানুষ তাদের নিজেদের সক্ষমতাকে উজ্জীবিত করে নানারকম ব্যবসা-বাণিজ্যে মেতে উঠেছে তার যথাযথ তথ্য এখনও সংকলিত নয়। সে ভাবে কোনও সমীক্ষাও হয়নি। কিন্তু চারপাশে নজর করলেই ব্যাপারটা বেশ প্রকট। তাই যখন বলা হয়, আজ কাজের এক বহুমুখি বিচিত্র জগৎ তৈরি হয়েছে যেখানে কাজ অঢেল যদিও স্থায়িত্ব অনিশ্চিত, তা বহমান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত এক নতুন রাজনৈতিক অর্থনীতির দিকেই আমাদের দিকনির্দেশ করে। ফলে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সক্ষমতা সম্পর্কে আজ প্রায় সকল মানুষকেই কমবেশি জানতে হয়, না হলে তারা দিকদিশা হারায়। কিন্তু তৎসত্ত্বেও কাজকর্মের অস্থায়িত্বের কারণে (আজ যে কাজ আছে কাল সে কাজ নাও থাকতে পারে, কাল যে কাজের সৃষ্টি হবে আজ সে কাজের অস্তিত্ব নেই) এক নিবিড় অনিশ্চয়তার ঘেরাটোপে মানুষের জীবন যে নিমজ্জিত, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। আর সেইজন্যই ‘ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম’এর অবশ্যম্ভাবিতাকে অস্বীকার করারও কোনও উপায় নেই। অতএব, ‘ভিক্ষাবৃত্তি’র তত্ত্ব এনে যারা এই ন্যায্য নাগরিক হকের নৈতিক বিরোধিতা করছেন তারা আসলে স্বীকারই করতে চাইছেন না সমাজে সাধারণ ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষের অতি-নিম্ন মজুরি প্রাপ্তির বাস্তবতাকে। ফলে, সে ক্ষতিপূরণের দায়ও তাঁরা নিতে চান না, কারণ, আদপে তাঁরা মনে করেন, পুঁজিবাদী বৈষম্য নীতিগত ভাবে ন্যায্য। আর এই কথাগুলি যখন তথাকথিত বামপন্থার ধারক-বাহকেরা বলেন, তখন সে ‘বামপন্থা’ যে মৃত তা তাদের জনবিচ্ছিন্নতা দেখলেই মালুম হয়।

অথচ, সারা বিশ্ব জুড়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আচম্বিত ও দ্রুত অভিঘাতে ভেঙে পড়ছে সাবেক পুঁজিবাদের ইমারত। আমেরিকা ও ইউরোপ আজ ‘অভিবাসীদের ভয়ে’ আতঙ্কিত। ট্রাম্প অচিরেই ঘোষণা করতে চলেছেন, কতিপয় বিদেশের নাগরিক বাদে আমেরিকায় কেউ আর প্রবেশই করতে পারবে না। রাজনৈতিক মঞ্চে দ্রুত উত্থান ঘটছে চরম দক্ষিণপন্থী শক্তির। দোর্দণ্ডপ্রতাপ এলন মাস্ক’এর টেসলা’র বিক্রি পড়ে গেছে ৪৬ শতাংশেরও বেশি; চীনের BYD’র কাছে সে নাজেহাল। মঙ্গল গ্রহের উদ্দেশ্যে পাঠানো এলন মাস্ক’এর SpaceX স্টারশিপও আকাশে ওড়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আবারও স্ব-বিস্ফোরণে উড়ে গেল। এবার ‘স্টারলিঙ্ক’কে ধরে ট্রাম্প ও মোদির ঘাড়ে চেপে এলন মাস্ক ভারতের বিশাল বাজারে ঢুকে রাজ করতে চাইছে। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দুরন্ত দৌড়ে তারা ছোট ছোট কোম্পানিগুলির সঙ্গে কতটা এঁটে উঠতে পারবে তা নিয়েই দেখা দিয়েছে ঘোরতর সন্দেহ। আমাদের দেশেও এইসব ছোটরা খেল দেখাচ্ছে-- Observe AI, InVideo, Avaamo, Spyne ইত্যাদি বহু ভারতীয় স্টার্টআপ ও ছোট ছোট সংস্থাগুলি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে বড় বড় সংস্থাকে আজ চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। এ নিয়ে পরে বিশদে কোথাও বলা যাবে। তথ্য বলছে, DPIIT (Department for Promotion of Industry and Internal Trade) স্বীকৃত ভারতীয় স্টার্টআপের সংখ্যা ২০১৬ সালে যেখানে ছিল মাত্র ৫০২, তা ২০২৪’এর ৩১ ডিসেম্বর দাঁড়িয়েছে ১,৫৭,৭০৬’এ; অনুমান ২০৩০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা দ্বিগুনেরও বেশি হয়ে যাবে।

রাজনৈতিক অর্থনীতির নতুন এই অভিযোজনকে না বুঝলে দেওয়ালে মাথা ঠুকে ভেজাল নৈতিকতার বাতাস উড়িয়ে যেতে হবে!

                          

Thursday, 13 March 2025

'সভ্যতার এই অপার আত্মরতি'

চারিপাশ নীল হয়ে যাক ঈর্ষায়

শ্রেয়া ঘোষ



১৯ ফেব্রুয়ারি ট্যাংরা, ২৮ ফেব্রুয়ারি মধ্যমগ্রাম, পর দিনই ১ মার্চ বেহালা, ৩ মার্চ আলিপুরদুয়ার; টেলিভিশনে খবর শুনতে ভয় করছে, সকালের খবরের কাগজ খুলতে ভয় করছে। 'অদ্ভূত আঁধার এক এসেছে...'। যেন করোনার চেয়েও মারাত্মক সংক্রমণ। সপরিবারে আত্মহননের ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত। সিদ্ধান্ত কিন্তু যৌথ নয়, একক। তারপর আর সকলকে রাজি করানো। অথবা, কোনও ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গোপন রেখে এই ভয়াবহ হত্যালীলা। একটি ঘটনা প্ররোচনা দিচ্ছে আর একটি সদৃশ ঘটনা ঘটাতে। নিউক্লিয়ার চেইন রিয়্যাকশনের মতো বিধ্বংসী একটা পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।

আমরা বলব এঁরা দুর্বল, ভীতু। সংকটের সঙ্গে লড়াই করার পরিবর্তে একটা তাৎক্ষণিক সমাধান, যেটা কদাপি কোনও সমাধান হতে পারে না, সেটাকেই বেছে নিচ্ছেন। আচমকা সব শেষ করে দিচ্ছেন অথচ এই অন্ধকার সুড়ঙ্গ কখনই একমাত্র পথ নয়, হতেই পারে না। অন্য পথের সন্ধান করার মতো মানসিক  ধৈর্যটুকু না রেখে এমত এক নির্মমতাকে শেষ আশ্রয় বলে মনে করছেন। অজস্র উদাহরণ ছড়িয়ে আছে যেখানে অবর্ণনীয় প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে মৃত্যুকে 'সূচ্যগ্র মেদিনী' ছাড়ছে না মানুষ। তাঁদের দৃষ্টান্ত থেকে প্রেরণা না নিয়ে হঠকারিতার পথের আশ্রয় নিচ্ছে কেন মানুষ? দৃঢ়তার অভাব? আলস্য? আত্মহনন করার কোনও অধিকার কিন্তু সমাজ দেয় না। এটা সামাজিক অপরাধ। কারণ, এই প্রবণতা একটা সাঙ্ঘাতিক কুদৃষ্টান্ত তৈরি করছে, আমরা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।

'Suicide' শব্দটির মধ্যে থাকা cide প্রত্যয়টির অর্থই হল killing। আর এই পরিবার সহ হননে লিপ্ত হওয়া  এক সীমাহীন অপরাধ। একবার ভাবুন, ট্যাংরার পরিবারটির বালক-বালিকা দুটি স্কুলে যেতে ভালোবাসত। প্রতিবেশীদের সঙ্গে এই পরিবারের কোনও সম্পর্ক ছিল না, স্কুলের বন্ধুদের সাহচর্য ছিল এই নবীন দুটি প্রাণের অতি কাঙ্ক্ষিত। সংবাদে প্রকাশ, পরিবারের অভিভাবকেরা এমনকি এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি কয়েকদিন স্থগিত রেখেছিলেন স্কুলের পরীক্ষার কারণে। কিন্তু শেষ অবধি সেই সহজ আনন্দে বেঁচে থাকার সুযোগ পেল না ঐ দুর্ভাগা শিশু-কিশোর সন্তানেরা। কেন নিকটতম আপনজনেদেরও একবারও মনে হল না দুটি সম্ভাবনাময় কচি প্রাণকে নিকেশ করার এই একতরফা সিদ্ধান্ত তাঁরা কিছুতেই নিতে পারেন না।

ব্যবসায়ী এই পরিবারটি অগাধ সম্পত্তির মালিক ছিল। তথাপি তাঁদের বিপুল ঋণের বোঝা। অর্থাৎ, বেহিসেবি জীবনযাপন বা বিচক্ষণতার একান্ত অভাব বা এরকমই কোনও কারণে এই পরিণতি। বয়স্কদের ভুলের মাশুল কেন দেবে পরিবারের বাকি সদস্যরা। একজনের  চরম দায়িত্বহীন কাজের দায়ভাগ নিতে বাধ্য হল পরিবারের নিরপরাধ সদস্যরা। আর এই ঘটনাকে চটজলদি প্যানাশিয়া ভেবে বসলেন আরও কত জন।

আর্থিক অনটনের থেকে মুক্তির কোনও উপায় না খুঁজে পেয়ে জীবনের ইতি টেনে দেওয়ার দুঃসহ  দুঃখের এক ঘটনা আমার নিকট প্রতিবেশেই ঘটেছিল। একদম চোখের ওপর। তখন আমাদের বয়স তিরিশের আশেপাশে। আমাদের দুটি পরিবারের ভাড়া বাড়ির ঠিকানা ছিল অভিন্ন। প্রথম দর্শনেই ঐ ভদ্রলোক আমাকে দিদিভাই ডেকে আপন করেছিলেন। নিজেকে অক্লেশে আমাদের দুই প্রজন্ম এগিয়ে রেখে অভিভাবকসুলভ দায়িত্ব নিয়েছিলেন। অমায়িক এই ব্যক্তি যে এমন অঘটন ঘটাবেন কারও পক্ষে ভাবা সম্ভব ছিল না। সামান্য একটা কারখানা চালাতেন তিনি বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেই। প্রায় 'দিন আনি দিন খাই' অবস্থা। এক 'বিশ্বস্ত' কর্মচারীর অসততায় সর্বস্বান্ত হয়ে এই সিদ্ধান্তকেই একমাত্র পালানোর রাস্তা ভেবেছিলেন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তি তিনি শুধুমাত্র নিজের কথাই ভেবেছিলেন। ভাবেননি তাঁর প্রৌঢ়া স্ত্রীর কথা, অসুস্থ, নিঃসন্তান, চিরদিন শুধু অভাবী সংসারের জোয়াল টেনে যাওয়া তাঁর দুরবস্থার কথা; এতটুকুও না ভেবে  তিনি নিজেকে শেষ করে সব দায়িত্ব থেকে পালিয়ে গেছেন ভোর রাতে, চুপিচুপি। স্ত্রী'র মৃত্যুর জন্য তিনি দায়ী ছিলেন পরোক্ষ ভাবে।

আবার আজ তিরিশ বছর পরে বিপুল অর্থ উপার্জন করেও মানুষ নিজের সৃষ্টি করা অনটনের গভীর খাদে ডুবে যাচ্ছে। চাহিদার এক অনন্ত জ্বালামুখ-- সবই, সব পেতে হবে, আজই, এই মুহূর্তে। জাগতিক সব সম্পদের মালিকানা পেতেই হবে। কারও থেকে যেন এক কণাও কম না পড়ে। সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া ট্র‌্যাজেডিগুলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ব্যাপ্তি বিশাল। কপর্দকশূন্য হতে প্রভূত সম্পদের অধিকারী ব্যক্তি রয়েছেন দুই সীমায়। কিন্তু মূল কারণ কাছাকাছি: অর্থ। অভাব বা প্রাচুর্য। অভাব সঞ্জাত অবসাদ বা প্রাচুর্য সঞ্জাত লোভ। কেউ লোভের হাতছানিতে পতঙ্গের মতো ঝাঁপ দিচ্ছে আগুনে। সর্বনাশ জেনেও পা দিচ্ছে চোরাবালিতে। অপরদিকে কারও ক্ষেত্রে দিনগত অতিবাহন এতটাই ক্লেশ বা ক্লান্তির যে, রূপ, রস, গন্ধ, মায়া, মমতা দিয়ে সাজিয়ে তোলা নিজের একান্ত আপন, নিজের সর্বস্ব পৃথিবীটা ছেড়ে বরাবরের মতো চলে যাচ্ছে।

"জলের কলরোলের পাশে এই নগরীর অন্ধকারে আজ

আঁধার আরো গভীরতর ক'রে ফেলে সভ্যতার এই অপার আত্মরতি"।

বিষাক্ত মাকড়সার মতো ঘাতক  ভোগবাদ বাসা করছে আমাদের মস্তিষ্কে। গুটি পাকাচ্ছে, অসংখ্য  ডিম্বাণু জমে জমে স্ফীত হচ্ছে তার পেট। একদিন সেই স্ফীতোদর ফেটে লক্ষ লক্ষ অষ্টাপদ জন্মের খিদে নিয়ে কিলবিল করে বেরিয়ে এসে ছড়িয়ে পড়ছে দিগ্বিদিকে। গিলে খাচ্ছে যা কিছু দৃশ্যমান তার কুটিল  অক্ষিগোলকে। অন্তহীন সেই খিদের আগুনে জ্বলে যাচ্ছে মানুষ আজ। মুহূর্তকালের আয়ু নিয়ে যেন জন্মেছে সে। এই মুহূর্তেই সব চাই তার। 

নৈতিকতা? 

আমার ভাল থাকাই নীতি একমাত্র। 

ভালো থাকা মানে? 

আরও আরও বিলাস, ব্যসন, সব চাই। সব পেয়ে গেলে আরও চাই। চারিপাশ নীল হয়ে যাক ঈর্ষায়।

“চারিদিকে নীল নরকে প্রবেশ করার চাবি" - চারিপাশ, আত্মীয়, স্বজন, প্রতিবেশী? না, চারিপাশ মানে অসীম শূন্যতা। কেউ নেই, কেউ না। সামনে, পেছনে, পাশে একজনও নেই। না বন্ধু, না স্বজন, শুধু প্রতিপক্ষ। ছক সাজিয়ে বসে দান দিচ্ছে সকলে। ছাপিয়ে যেতে হবে, পিছনে ফেলে রেখে যেতে হবে তাকে, যে ছুঁতে চাইবে। পাশ থেকে সরে যাক প্রতিদ্বন্দ্বী যত অন্তহীন ঘোড়দৌড়ের বাজিতে। 

সকলকে হারিয়ে কে জিতছে? 

বিষ মেশানো পায়েস, মুঠো মুঠো ঘুমের ওষুধ, সিলিং'এর হুক থেকে ঝোলানো দড়ি।

"কোথাও সান্ত্বনা নেই পৃথিবীতে আজ;

বহুদিন থেকে শান্তি নেই।

নীড় নেই"

... এই ধরনের হনন প্রক্রিয়ার দায় সমাজের ওপরেও বর্তায়। ১৮৯৭ সালে, প্রায় সোয়াশো বছর আগে, ফরাসি সমাজতত্ত্ববিদ এমিল ডারখিম এরকম আত্মহত্যাকে 'এনোমিক সুইসাইড' নামে অভিহিত করেছেন যেখানে ব্যক্তি নয়, দায়ী করা হচ্ছে সমাজকে। যে সমাজ নাকি আমাদের ধারণ করে, সেখানেই যখন নীতি আর মূল্যবোধের চূড়ান্ত অবক্ষয় ঘটে, তখন মানুষও বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য হারিয়ে দিশাহীন হয়ে পড়ে। ডারখিমের এই ভাবনা ও পরবর্তী বিশ্লেষণ আত্মহননের মতো ঘটনার দায় কেবলমাত্র ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত বা স্বভাবের ওপর ন্যস্ত করে না।

জীবনের সার্থকতা, সাফল্যের সমাজ নির্ধারিত সংজ্ঞাকেই কেন আমরা মেনে নেব? আর সেই অনুসারে ব্যক্তিকে বিচার করব? সমাজ যদি মানুষকে নিরাপত্তা দিতে পারে, মর্যাদা দিয়ে গ্রহণ করতে পারে, তবে এইসব অপঘাত বন্ধ করা যাবে। টাকা, শিক্ষাগত ডিগ্রি, উঁচু পদ এরকম প্রথাগত কিছু মাপকাঠি দিয়ে মানুষকে বিচার করার মতো একটা হীন চিন্তা কেন অনাদিকাল আমরা বয়ে চলব আর পদে পদে মানুষকে অপমানে আর আঘাতে জর্জরিত করব? আমাদের কেন লজ্জা হয় না যখন শুনি শুধুমাত্র অর্থের অভাবে আমাদের মতো কেউ জীবনকে মাঝপথে থামিয়ে দিচ্ছে পরিবার সহ, শিশু সহ। আমরা তার পাশে দাঁড়াতে পারিনি বলে ধিক্কার দিই কি নিজেকে? টাকা আর মহার্ঘ পণ্য দিয়ে মানুষকে বিচার করা যদি বন্ধ হত, তবে তো এমন মরীয়া হয়ে অর্থের বিনিময়ে মানসম্মান লাভের বিপজ্জনক জুয়া খেলায় মানুষ অন্ধকূপে ঝাঁপ দিত না।

লক্ষ-লক্ষ, কোটি-কোটি টাকার চোখ-ধাঁধাঁনো অপচয়ের পাশে সন্তানের চিকিৎসার খরচটুকু সংগ্রহ করতে না পেরে, পুরো পরিবার জীবনকে শেষ করে দিচ্ছে যখন, আমরা কোনও প্রতিকারের সন্ধান করছি না। সংবাদপত্রের একটি পাতায় যখন আত্মহত্যার খবর আর সে পাতা উল্টোলেই অপরিমেয় বিত্ত প্রদর্শনের বিবরণ, আমরা কেউ সে অভব্য অশ্লীলতার বিরুদ্ধে চেঁচিয়ে উঠি না।

মেট্রো রেলের লাইনে ঝাঁপ দেবার সংবাদ অবধারিতভাবে শেষ হয়, কতক্ষণ ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল আর অফিস টাইমের ব্যস্ততায় যাত্রীদের কত ভোগান্তি তার উল্লেখে।

উদ্ধৃতি ঋণ: জীবনানন্দ দাশ।


Monday, 3 March 2025

'প্রগতিশীল' শ্বেতাঙ্গ বিশ্ব!

মুখে সাম্যের বুলি অবচেতনে বৈষম্য

শ্রীপর্ণা চক্রবর্তী



৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, এক তুষার ঢাকা শীতের সকাল। সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমের অদূরেই ওরেব্রো শহর, আর সেখানেই অবস্থিত ক্যাম্পাস রিসবার্গস্কা; সরকারি ভাষ্যে 'প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র'। আচমকা সেদিন ভাষার শব্দ, লেখার খসখসানি, নিশ্চিত জীবনের স্বপ্ন ছাপিয়ে গর্জে উঠল গুলির শব্দ, আর তারপরই নিস্তব্ধতায় রয়ে গেল রক্তমাখা মেঝে, কিছু স্তব্ধ দৃষ্টি। ১১টি প্রাণ নিভল নিমেষে। আরও ছয়জন আহত। আধুনিক সুইডেনের ইতিহাসে উন্মোচিত হ'ল অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যা মঞ্চ। নিহতদের পরিচয়-- অভিবাসী-বৈধ অভিবাসী এবং স্থানীয় ভাষা পাঠ্যের ছাত্রছাত্রী। নিহতদের মধ্যে ছিলেন কুর্দ, সিরিয়ান, ফিলিস্তিনি ও অন্যান্য দক্ষিণ গোলার্ধের দেশ থেকে আসা মানুষ, যাঁরা আশ্রয় খুঁজতে এসে বিদ্বেষের নিশানা হয়ে শেষে এ দুনিয়া থেকেই আশ্রয়চ্যুত হলেন। বরফের পাতলা চাদর ছিঁড়ে নিচে লুকিয়ে থাকা আপাত নিস্তব্ধ জল হঠাৎই যেমন উন্মুক্ত হয়ে পড়ে গলনাঙ্ক ছুঁলে, তেমনই স্বপ্নের দেশটির নির্মিত মুখোশেও আচমকা ফাটল ধরাল কোনও এক অজানা প্রবর্ধক। 

যে মানুষটি সেদিন ট্রিগারে হাত রেখেছিল— সেই  রিকার্ড অ্যান্ডারসন, ৩৫ বছরের এক খাঁটি সুইডিশ যুবক। কোনও ঘৃণাপত্র নয়, কোনও প্রকাশ্য ইশতেহার নয়, তবুও তার বুলেট যে উদ্দেশ্যে ছুটে গিয়েছিল তা হয়তো কোনও শূন্যতা থেকেও ধাবিত নয়। প্রতিটি সহিংস গর্জনের মতোই এ ঘটনার শেকড়টিও নিসংশয়ে গভীর। সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হল, এই হত্যাকাণ্ডের পর রাষ্ট্রীয় বিবৃতি কিংবা সংবাদমাধ্যমে একবারও উল্লেখ করা হল না ঘটনার প্রাক-মুহূর্তে আততায়ীর সেই চিৎকার— 'নি স্কা বোর্ত ফ্রান ইউরোপা' (Ni ska bort från Europa -- 'তোমরা ইউরোপ থেকে বেরিয়ে যাও')। উল্লিখিত হল না, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির যে বিশেষ চত্বরে আততায়ী গুলি চালায়, তা নির্দিষ্ট ভাবেই শুধুমাত্র অভিবাসী এবং উদ্বাস্তুদের সুইডিশ শেখার জন্য নির্ধারিত কেন্দ্র (Swedish for Immigrants (SFI))। বরং হামলার পর দিন পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জানাল, ঘটনার পেছনে 'আদর্শগত উদ্দেশ্য' থাকার কোনওই ইঙ্গিত নেই। এই শিউরে ওঠা, ইউরোপের বুকে গভীরভাবে প্রোথিত বর্ণ ও জাতি বিদ্বেষের নির্মম প্রতিফলনের বার্তাটি বহু মূলধারার সংবাদমাধ্যমই  সুনিপুণভাবে উপেক্ষা করে গেল।

'Sweden searches for answers after country’s deadliest shooting' -- পরদিন এই শিরোনামে বিবিসি একটি সংবাদ করল। শিরোনামের নিচে বাদামি চামড়া, কালো চাপ দাড়ির এক কিশোরের মুখচ্ছবি। কে এই কিশোর? ১৬ বছর বয়সী কুর্দি বালক ইসমাইল মোরাদি, লাল ফুলের তোড়া হাতে নিহতদের শ্রদ্ধা জানাতে ঘটনাস্থলে গিয়েছিল সে। ফুল হাতে তার সেই ছবি বেশ কিছু অনাম্নী সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিতও হয়। সাংবাদিকদের সে জানিয়েছিল, এই স্কুলটি যেহেতু অভিবাসীদের জন্য, তাই এই হামলাও পরিকল্পিতভাবেই তাদের লক্ষ্যে ঘটানো হয়েছে। অথচ বিশ্বের সর্ববৃহৎ ও প্রাচীনতম সম্প্রচার সংস্থাটি তার সেই একই ছবি সুচারু উপায়ে কাটছাঁট করে হাতের ফুলগুলি কাঠামোর বাইরে রেখে প্রকাশ করল। মুখ্য চরিত্রের ছবি পরিবর্তন করে কিংবা মুখ্য চরিত্রকেই রূপান্তরিত করে মূল উপাখ্যানটিকে পুনর্গঠন করা বা সম্পূর্ণ নতুন উপাখ্যান নির্মাণে গণমাধ্যমের এই ভূমিকা ভীষণ কার্যকরী। স্পষ্টতই এভাবে এক ছবি গড়ে দিতে চাইল আরেকটি প্রতিচ্ছবি: এক শ্যামবর্ণ মুসলিম কিশোর ‘অন্য’— শোকাতুর নয়, বরং সন্দেহভাজন।

ঘটনার পর রবিবার জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী উলফ ক্রিস্টারসন। তিনি স্বীকার করেন যে বিদেশি বংশোদ্ভূতদের মধ্যে বিশেষভাবে নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি কাজ করছে। অন্যান্য সহিংস ঘটনার পর দেওয়া পূর্বপরিকল্পিত বক্তব্যের মতো তিনিও বিবৃতি দেন, 'আমরা এমন এক সময়ে রয়েছি, যখন সমাজে সহিংসতা ক্রমশ বাড়ছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি।' ১২ ফেব্রুয়ারি সুইডেনে এক মিনিটের নীরবতা পালন করা হয়। রাজা কার্ল ষোড়শ গুস্তাফ স্মৃতিফলকে ফুল অর্পণ করেন। হামলার পরদিনই সুইডেনের রাজনৈতিক নেতারা ও রাজপরিবারের সদস্যরা ওরেব্রো সফর করেন। বিরোধী দলীয় নেতা মাগদালেনা অ্যান্ডারসন, যার সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট পার্টিও অভিবাসন হ্রাসের পক্ষে, শহরে গেলে এক নারী তাঁর উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলেন, 'আমাদের কথা বলুন, অভিবাসীদের নিয়ে ইতিবাচক কিছু বলুন!'

সুইডেনে বহু বছর ধরে বর্ণবাদ বিরোধী কর্মকাণ্ডে যুক্ত সমাজকর্মী অ্যানি বোরোইয়ান জানান, হামলার পর থেকে অভিবাসীদের মধ্যে উদ্বেগ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। তাঁর মতে, 'সুইডেনের ডানপন্থী সরকার, যা চরম ডানপন্থী সুইডেন ডেমোক্র্যাটস পার্টির সমর্থনে চলছে, প্রায়ই অপরাধ বৃদ্ধির জন্য অভিবাসীদের দায়ী করে থাকে।' মানবাধিকার ও শরণার্থী নীতির জন্য উত্তর ইউরোপের এই দেশটি দীর্ঘদিন যাবৎই বিশ্বমঞ্চে বন্দিত; কিন্তু ঠিক এই নীতিগুলিই বর্তমানকালে এক অংশের জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার ঘটাচ্ছে। উপরন্তু, কিছু বিশেষ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এই ক্ষোভকে প্রায়শই আরও উস্কে অভিবাসীদের সামাজিক সমস্যার মূল কারণ হিসেবে তুলে ধরে। এই ধারণা ক্রমশ এমনভাবে সামাজিক চেতনায় গেঁথে যাচ্ছে, যেখানে অভিবাসীরাও কোনও কোনও ক্ষেত্রে ইউরোপের সংকটের জন্য নিজেদের দোষী ভাবতে শুরু করেছেন। ফলস্বরূপ, সমাজে 'আমরা' বনাম 'ওরা'র বিভক্তি রেখাটি ক্রমে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে ।

সমাজের গহীনে লুকিয়ে রাখা এই বর্ণ বৈষম্যের প্রবাহ ক্রমশ সহিংসতায় রূপান্তরিত হচ্ছে। এই গণহত্যা যেন সমাজের এক অনুচ্চারিত অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে আপামরের সামনে এনে দিয়েছে— একদিকে প্রগতিশীল আদর্শ, অপরদিকে বর্ণবাদ, ঘৃণা ও ক্ষমতায়নের শক্তিশালী গাঁথুনি। তাই প্রশ্নটা স্রেফ অভিবাসীর অধিকার নয়, তাঁদের প্রতি শ্বেতাঙ্গ সমাজের সমদৃষ্টিরও। এছাড়াও অধিকারের লড়াই সফল মাত্রেই যে কাঙ্ক্ষিত ন্যায়ের নিশ্চয়তা জোটে না, আমেরিকায় ষাটের দশকের নাগরিক অধিকার আন্দোলনের ইতিহাসও তা দেখিয়েছে। ফলত রাষ্ট্রীয় আইনে, খাতায় কলমে নাগরিকদের সমানাধিকার থাকলেও, সামাজিক ন্যায় বহুলাংশে অধরাই থেকে যায়। যেভাবে ভারতীয় সংবিধান সকল নাগরিকের সমানাধিকারের কথা বললেও বাস্তবে তা আজও অধরাই।

তবে এই ঔপনিবেশিক প্রভুত্বের মানসিকতা শুধু যে শ্বেতাঙ্গদের মধ্যেই প্রোথিত এমনটা বললে কিছুটা কম বলা হবে। উপজাতি, অভিবাসী, উদ্বাস্তু, শরণার্থী, দলিত, মুসলমান এক হিসেবে সমাজের সমগ্র অশ্বেতাঙ্গর মননেও তাঁরা যে খোদ স্ব কিংবা পরভূমে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক, একপ্রকার অজ্ঞাতসারেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই চেতনায় লালিত হচ্ছেন। এখানেও সহিংসতার চিত্রায়নে প্রচার মাধ্যমের এক দৃষ্টিকটু দ্বৈতনীতি চূড়ান্তভাবে তার উদ্দেশ্যে সফল। একই অপরাধে অপরাধী এই দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত হলে তা তৎক্ষণাৎ 'সন্ত্রাসবাদ' বা 'দেশদ্রোহিতা'; আর অপরাধী 'শ্বেতাঙ্গ' হলে সে ক্ষেত্রে তা একাকিত্বের পরিণতি থেকে সৃষ্ট মানসিক অসুস্থতার বহিঃপ্রকাশ, অথবা নেহাৎই কোনও ব্যক্তিগত বা কাকতালীয় অঘটন। অতএব, সামাজিক মূল্যায়নও ভিন্ন। অথচ প্রতিটি সহিংসতা অপরাধীর ধর্ম-গাত্রবর্ণ-নৃতাত্ত্বিক পরিচয় নির্বিশেষে মানসিক ও সামাজিক বিকারের প্রতিফলন।

মর্মান্তিক এই ঘটনা সমাজের বর্ণবাদ ও রাজনৈতিক সংকটের গণ্ডি পেরিয়ে এক বৃহত্তর প্রশ্ন উত্থাপিত করেছে— আগামী প্রজন্মকে কীভাবে গঠন করা যাবে? ১৯৭৯'তে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে শিশুদের শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ হয় সুইডেনে। উদার সমাজ চিত্রায়নে এ এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। স্কুল স্তরে পাঠ্যপুস্তকের পরিবর্তে প্রযুক্তি-নির্ভর শিক্ষা চালু করার ক্ষেত্রেও এই দেশটি ছিল পথপ্রদর্শক, যা আধুনিক দুনিয়ার অন্যতম ‘স্মার্ট’ সিদ্ধান্ত হিসেবেই বিবেচিত! কিন্তু দীর্ঘ ১৫ বছর পর তাঁরা অনুধাবন করেন, এই ব্যবস্থা শিক্ষা ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে অকৃতকার্য এবং পুনরায় পুরনো পঠন পদ্ধতিতে ফিরতে প্রায় €১০৪ মিলিয়ন ব্যয় করে সুইডেন সরকার। গবেষণায় যে সকল গুরুতর প্রবণতাকে ব্যক্ত করা হয় তা হল বোধশক্তির অবক্ষয়, মনোযোগ বিভ্রান্তি, মৌলিক দক্ষতার অবনতি এবং সামাজিক মেলামেশার ঘাটতি। গত কয়েক বছরে ক্রমবর্ধমান সহিংসতার ঘটনায় রাষ্ট্রের এ হেন অত্যাধুনিক সিদ্ধান্তও আলোচ্য হয়ে উঠছে। শিশুকাল থেকেই মাত্রাতিরিক্ত যন্ত্র-নির্ভরতা যেমন তাদের সহজাত বৌদ্ধিক বিকাশের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে, তেমনই মানুষের স্বাভাবিক সহযোগিতামূলক মনোভাবটিও বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। আন্তর্জাল তথা সামাজিক মাধ্যমের অ্যালগরিদমে ছড়িয়ে পড়া ঘৃণা, একপাক্ষিক ভ্রান্ত তথ্য বা ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক প্রচার সহজেই শিশুমনকে প্রভাবিত করে ভুল মতাদর্শের দিকে ধাবিত করে। উদারনীতি আউড়ে সোশ্যাল সার্ভিস নামের এক অতি কঠোর নিয়মতন্ত্রের ভীতি প্রদর্শন দ্বারা শিশুর প্রত্যক্ষ আপন-অভিভাবক বা শিক্ষকের অপরিহার্যতাকে দীর্ঘকাল ধরে উপেক্ষা করা হয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার্থে শিশুদের প্রতি রাষ্ট্রীয় উদারতার এই পন্থায় কোথাও গিয়ে বিকাশের ধাপে আবশ্যিক ন্যূনতম শৃঙ্খলতা, সহনশীলতার পাঠের প্রয়োজনটুকু ভুলতে বসেছে। এই নিখুঁত পরিকাঠামোগত সেবা যেন ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা, স্বতঃস্ফূর্ত সহমর্মিতাকে মুছে দিচ্ছে, যা শুধু সমাজের নয় বরং রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও শিক্ষাগত ব্যর্থতার প্রতিফলনও বটে। 

'ইতিহাস বিজয়ীরাই লেখে'— বাক্যটির সত্যতা প্রমাণে যেন নিরলস প্রয়াস চালিয়ে যায় শ্বেতাঙ্গ বিশ্ব। ঔপনিবেশিক লুণ্ঠন এবং বিজয়ের ইতিহাস রচনার পাশাপাশি তারাই আবার 'যুদ্ধ খারাপ' এই বার্তা ছড়িয়ে দিয়ে নব্য ইতিহাস তৈরিতে মগ্ন। তাই গড়ে ওঠে বার্লিনের হলোকাস্ট স্মারক, ফ্রান্সের Mémorial ACTe, বেলজিয়ামের আফ্রিকা মিউজিয়াম, হিরোশিমার ধ্বংসাবশেষে শান্তির স্মারক, লিভারপুলের আন্তর্জাতিক স্লেভারি জাদুঘর কিংবা নেদারল্যান্ডসের ট্রোপেন মিউজিয়াম— পশ্চিমা জগতের একেকটি আত্মপ্রবঞ্চনার স্মারক। অন্যদিকে, আমেরিকাতেও চলে একইরকম প্রহসন। শতাব্দী ধরে এক সমগ্র জাতিগোষ্ঠীর গণহত্যা ও তাদের সংস্কৃতির বিলুপ্তি ঘটানোর পর কিছু রাজ্যে 'কলম্বাস দিবস' বাতিল করে 'ইন্ডিজেনাস পিপলস ডে' চালু করা হয়। জার্মানিতে নাৎসি শাসনের শিকার যারা তাদের উত্তরাধিকারীদের নাগরিকত্ব, স্পেন ও পর্তুগালের সেফার্ডিক ইহুদিদের বিশেষ অধিকার, সাবেক ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোর বিশেষ ভিসা সুবিধা— সব কিছুই যেন কাগজে-কলমে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি সহানুভূতির প্রতীক। এমনকি যুদ্ধবিধ্বস্ত শরণার্থীদের স্বাগত জানিয়েও তারা এক প্রকার আত্মপ্রসাদ লাভ করে। কিন্তু তারপর? মানবাধিকার ও আদর্শিক চেতনার পাঠ বাকি বিশ্বকে দিতে সর্বদা আগ্রহী ফ্রান্সও ২০২১ সাল পর্যন্ত স্বীকার করেনি যে তারা আলজেরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামী আলি বুমেনদজেলকে হত্যা করেছিল। ব্রিটেনের শিক্ষাব্যবস্থায় উপনিবেশবাদের প্রসঙ্গ 'এক মিশ্র ঐতিহ্য' হিসেবে হাজির হয়, যেখানে সভ্যতা তাদের হাত ধরেই এসেছে বলে আত্মপক্ষ সমর্থন করা হয়। জার্মানি যখন হলোকাস্টের দায় স্বীকার করেছে, তখনও নামিবিয়ার হেরেরো ও নামা জনগোষ্ঠীর গণহত্যার প্রসঙ্গে নীরব থেকেছে।

ভারতেও এই প্রবণতা ভিন্ন নয়। শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও ইসলামি যুগের বিকৃত ধারণা ছাত্রদের মস্তিষ্কে প্রবেশ করানো হয়, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত চলচ্চিত্রে দেশের সর্ববৃহৎ সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে নির্দিষ্ট ছাঁচে প্রদর্শন করা হয়। ফলে, সাম্প্রদায়িকতার বিষ সমাজে গভীরভাবে প্রোথিত হয়। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যেও শিক্ষিত বাঙালির চেতনায় সংখ্যালঘু, আদিবাসী কিংবা তথাকথিত নিম্নবর্গের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি অস্পষ্ট ও সামন্ততান্ত্রিক।

এই বহুমাত্রিক বাস্তবতা ও গণমাধ্যমের ন্যাক্কারজনক ভূমিকা অনস্বীকার্যভাবে স্পষ্ট করে তুলেছে বিভেদের মুদ্রার দুই পিঠের সমান্তরাল প্রতিকৃতি– 

১) ভিন্ন তথা বঞ্চিত আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে উঠে আসা এক শ্রেণি, যারা হামেশাই ইউরোপে অবৈধ কর্মকাণ্ডে ও বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত ধর্মীয় সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়ে এবং 

২) তথাকথিত প্রগতিশীল শ্বেতাঙ্গ সমাজ, যারা সাম্যের বুলি আওড়েও অবচেতনে বৈষম্যকে ধারণ করে।

এরই পাশাপাশি রয়েছে সেইসব মহীরূহসম রাষ্ট্র, যারা অলক্ষ্যে সন্ত্রাসকে মদত দিয়ে চলেছে আপন স্বার্থে। সব মিলিয়ে ভবিষ্যৎ এক অনিশ্চিত টালমাটাল পরিস্থিতির দিকে ধাবমান। ওলোফ পালমের সুইডেন যে সাম্য-সমাজের স্বপ্ন দেখেছিল কিংবা সুইডিশ সংস্কৃতির প্রতীক ‘লাগোম’, যার দর্শন 'না কম, না বেশি, ঠিক যতটুকু প্রয়োজন' ভারসাম্যের প্রতিশ্রুতি দেয়, তা বাস্তবে কতটা ফলপ্রসূ সেই প্রশ্ন এখন আরও জরুরি হয়ে উঠছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যে বিভেদের প্রাচীর গড়ে উঠেছে, তাকে এক লহমায় ভেঙে ফেলা সহজ নয়। তবে এই বিশ্বায়নের যুগে দোষারোপের চক্রে আবদ্ধ হয়ে আমরা যেন ভুলে না যাই: পরিবর্তনের দায় কোনও একক পক্ষের নয়, বরং সমগ্র সমাজের।