Tuesday, 21 October 2025

Gen Z’র রাজনীতি

রাজনীতি যখন দৃশ্যমান কথোপকথন

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

সম্প্রতি নেপালের অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান ও প্রধানমন্ত্রী ওলি’র পদত্যাগের পরেই প্রায় সর্বত্রই রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে Gen Z শব্দটি। দেখা যায়, শুধু নেপালে নয়, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ এবং অতি সম্প্রতি মাদাগাস্কার, কেনিয়া, পেরু, মরক্কো, ইন্দোনেশিয়া সহ আমাদের দেশে লাদাখ, বিহার ও অসমের কিছু অঞ্চলে এর অনুরণন পৌঁছেছে। অর্থনীতির সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতির পরিসরেও যে অবশ্যম্ভাবী এক বিপুল পরিবর্তনের সামনে আমরা আজ এসে দাঁড়িয়েছি, এ তারই এক সুস্পষ্ট ও সুদূরপ্রসারী ইঙ্গিত।

Gen Z হল ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে যাদের জন্ম, সেইসব কিশোর (কিশোরী) ও তরুণী (তরুণ)’দের দল, এই ২০২৫ সালে যাদের বয়স ১৩ থেকে ২৮’এর মধ্যে। এদের ‘ডিজিটাল নেটিভস’ও বলা হয়, কারণ, এরা ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া ও স্মার্ট ফোনের যুগে বড় হয়েছে। একইসঙ্গে তারা তাদের আগের প্রজন্মের থেকে এক বড় break (চ্যুতি) ও continuity (ধারাবাহিকতা)। তাদের বাবা-মা, চাচা-চাচী, বিশেষত দাদু-দিদা’দের প্রজন্ম অবিরাম বকাঝকা করে চলেছে, নিত্য হা-হুতাশ করছে, এমনকী গালিগালাজও দিচ্ছে এই বলে যে, তারা সকলে নাকি সব উচ্ছন্নে গেছে, বই-টই কিছু পড়ে না, এমনকি খবরের কাগজও নয়, টিভি’ও দেখে না, স্কুল-কলেজে খুব যে মতিগতি আছে তাও নয়, সারাদিন স্মার্ট ফোন নিয়ে বসে থাকে, রিল বানায়, অন্যের রিল চাটে, চ্যাট করে, ইউটিউব অথবা ওটিটি দেখে, নিদেনপক্ষে কোথাও হ্যাং-আউট করে, কে মরল কে বাঁচল তা নিয়েও নাকি তাদের কোনও হুঁশ নেই। অথচ এতসব গালমন্দ ও অপবাদের পরেও, ‘গল্প হলেও সত্যি’র মতো তারাই আবার হাজারে হাজারে রাস্তায় নেমে নিজেদের জীবন বাজী রেখে অপশাসনের শীর্ষ স্তম্ভকে গুড়িয়ে দেয়। পুরনো প্রজন্মের বুড়ো ভামেরা নিজেদের অক্ষমতাকে আড়াল করতে এই Gen Z’কে যখন নীতি-নৈতিকতার তরজা শোনায়, নিজেদের ভরা যৌবনকালের পাণ্ডিত্যের কৌলিন্য ও বীরত্বের দোহাই দিয়ে ‘আজকালকার ছেলেপিলেরা সব ভোগে গেছে’ বলে মদের গেলাস ঠোকে, তখনই সোশ্যাল মিডিয়ার পাতাল থেকে Gen Z আচম্বিতে রাস্তায় নেমে দেখিয়ে দেয় যাকে বলে, ‘Where order is injustice, disorder is the beginning of justice.’ (রমাঁ রল্যাঁ)। পুরনো, পচাগলা সমাজ ও রাজনীতির শৃঙ্খলকে তারা নিমেষে ভেঙে ফেলে, কারণ, তাদের অগ্রগণ্য  ভূমিকায় প্রাণিত ও সাহসী হয়ে পথে নেমে আসে অগণিত শ্রমজীবী মানুষের দল যারা এক ঘৃণ্য অব্যবস্থায় দিনের পর দিন নিষ্পেষিত হয়েছে। তবে, সেই উদ্গত বিশৃঙ্খলা আদপে ন্যায়ের সূচনা করে কিনা, সে প্রশ্ন থেকে যায় বটে, কিন্তু অচলায়তনকে যে নিশ্চিত ভেঙে ফেলতে হয়, সে প্রত্যয়ী পাঠ Gen Z অর্জন করে। এটাই এখন বিশ্বের উদীয়মান new normal। Gen Z’র রাজনীতি।

কিন্তু সে নতুন রাজনীতির ভাষা কেমন? তার আদর্শ অথবা মতাদর্শই বা কী? এ এক জটিল প্রশ্ন। তা পুরনো প্রজন্মের কাছে আরও জটিল, কারণ, তাদের চোখে ছানি, কানে তুলো, মনে কালি আর মুখে ক্লিশে বাণী। ফলে, তাঁদের পক্ষে সে রাজনীতিকে উপলব্ধ করার বৃথা চেষ্টা বিনা আর উপায়ই বা কী? যারা কিছু বুঝলেন তো খুব ভালো, একটা আলাপের পরিসর গড়ে উঠতে পারে; যারা পারলেন না, তারা যদি আরও কষ্টকল্পিত মাথা ঠোকেন তবে হতাশাই প্রাপ্তি।

প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো, Gen Z’র ভাষা প্রথাগত বক্তৃতা বা সংবাদপত্রের নিবন্ধের মতো নয়; অল্প কথায়, তা অধি-দৃশ্যমান, সংক্ষিপ্ত ও প্রচ্ছন্নভাবে ব্যঙ্গাত্মক। যেমন,

১) মিম ও জিফ: জটিল রাজনৈতিক বা সামাজিক আলোচনাকে একটি ব্যঙ্গাত্মক ছবির মাধ্যমে প্রকাশ করা। দীর্ঘ প্রবন্ধের পরিবর্তে একটি মিমের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে দ্রুত বার্তা পৌঁছে দেওয়া। ফলে, রাজনৈতিক সক্রিয়তাকে মজাদার ও সহজে ভাগ করে নেওয়া যায়।

২) যথাযথ বক্তব্য: দীর্ঘ টেক্সট’এর পরিবর্তে ইনস্টাগ্রাম রিল, টিকটক ভিডিও ও হোয়াটসঅ্যাপ স্ট্যাটাসের মতো সংক্ষিপ্ত, যথাযথ ও দ্রুত ফরম্যাট ব্যবহার করা। তথ্যকে যথার্থ করে তোলা। Gen Z বিশ্বাস করে, কোনও ইস্যুতে মানুষের মনোযোগ ধরে রাখার জন্য ৩০ সেকেন্ডের রিল অনেক বেশি সক্ষম।

৩) ডিজিটাল ও ইনক্লুসিভ (অন্তর্ভুক্তিমূলক) ভাষা: ‘FOMO’, ‘Vibe’, ‘No Cap’, ‘Delulu’ জাতীয় স্ল্যাং (আমাদের দেশে ইংরেজি-মিশ্রিত Gen Z স্ল্যাং বা শব্দ) ও লিঙ্গ-নিরপেক্ষ শব্দ ব্যবহার করা। ফলে, একটি অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীগত পরিচয় তৈরি হয়, যা নিজেদের মধ্যে সংহতি ও বোঝাপড়ার সহায়ক। এইভাবে তারা নিজেদের মধ্যকার কথাবার্তাকে আরও আন্তরিক ও ঘরোয়া করে তোলে।

৪) প্রামাণ্যতাকে গুরুত্ব দেওয়া: অত্যধিক চাকচিক্য ভূষিত, আনুষ্ঠানিক ও কর্পোরেট ধরনের বার্তাকে তারা ফেক মনে করে। তারা এমন লেখক, কন্টেন্ট ক্রিয়েটর ও ইনফ্লুয়েন্সারদের বিশ্বাস করতে চায় যারা নিজেদের ব্যক্তিগত জীবন বা দুর্বলতাকে প্রকাশ করতে ভয় পান না।

৫) বয়ানের মধ্যে বয়ান: একটি বয়ানে একাধিক সাংস্কৃতিক রেফারেন্স (যেমন, পপ-সংস্কৃতি, অ্যানিমে, পুরনো ইন্টারনেট ট্রেন্ড) ব্যবহার করা এদের অভ্যাস। যারা এই কোড বোঝে, কেবল তারাই যোগ দিতে পারে। ফলে, তা হয়ে ওঠে গভীর বোঝাপড়ার এক কমিউনিটি যা বার্তাটিকে বাইরের লোকেদের কাছে দুর্বোধ্য করে তুলে নিজেদের সুরক্ষিত রাখে।

এবারে তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্নটি হল, Gen Z কি সর্বতোভাবেই এক নতুন মতাদর্শগত আধার গড়ে তুলেছে? তারা কি এক নতুন রাজনীতির ভিত্তির উপর দাঁড়াতে চাইছে? এইসব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে তর্কের অবকাশ আছে, তবে তারা যে পুরনো প্রজন্মের থেকে এক অর্থবহ দূরত্বে সমান্তরাল পথ খুঁজে পেয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। যেমন, তাদের রাজনৈতিক অবস্থান বিশেষ ভাবে প্রয়োজন ভিত্তিক ও নির্দিষ্ট ইস্যু-কেন্দ্রিক, যা আগের প্রজন্মের দল-ভিত্তিক ও আদর্শ-কেন্দ্রিকতা থেকে একেবারেই ভিন্ন। আমরা দেখেছি, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, নেপাল, মাদাগাস্কার’এ সরকারি দুর্নীতি একটি বড়সড় ইস্যু হিসাবে Gen Z’কে পথে নামতে প্ররোচিত করেছে। পাশাপাশি, রাজনৈতিক স্বৈরাচার, গণহত্যা, ইন্টারনেট শাটডাউন, মূল্যবৃদ্ধি এইগুলিও বড় কারণ। এইসব ক্ষেত্রে, ইনফ্লুয়েন্সার, কন্টেন্ট ক্রিয়েটার ও নিজ নিজ গোষ্ঠী থেকে পাওয়া তথ্যকেই তারা গ্রাহ্য করে, যদিও যথেষ্ট ভাবে যাচাই করে নিয়েই। নেপালের অভ্যুত্থানে ‘হামি নেপাল’এর প্রতিষ্ঠাতা সুদান গুরুং’এর বিপুল প্রভাব স্মর্তব্য। লাদাখের জনজাগরণে সোনম ওয়াংচুকের প্রভাব খুবই শক্তিশালী। প্রথাগত মিডিয়াকে (সংবাদপত্র, টিভি) তারা একেবারেই পরোয়া করে না। বিশেষ করে আজকের সময়ে ধর্ম-বর্ণ-জাতপাত-জাতি-লিঙ্গগত বিভাজন যখন রাজনীতির প্রায় মূল অক্ষরেখা হয়ে উঠেছে, তখন তারা ঐক্য ও অন্তর্ভুক্তিকরণের রাজনীতিকেই আঁকড়ে ধরে, যেখানে লিঙ্গ, জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে নানাবিধ বৈচিত্র্যকে স্বাভাবিক মনে করা হয়। সংক্ষেপে, পুরনো প্রজন্ম যেখানে রাজনীতিকে একটি পদ্ধতিগত ও আনুষ্ঠানিক আলোচনা হিসেবে দেখে, Gen Z সেখানে রাজনীতিকে গতিশীল, ব্যক্তিগত ও দৃশ্যমান কথোপকথন হিসেবে গণ্য করে। হয়তো তা আপাতদৃষ্টিতে স্মার্টফোন কেন্দ্রিক, কিন্তু তা বাস্তবোচিত ও বিবিধ কর্মসূচিরও অন্তর্গত। সবচেয়ে বড় কথা, তা চলমান পরিস্থিতিকে যথার্থ ও পক্ষপাতহীন ভাবে বোঝার চেষ্টা করা এবং তার মোকাবিলায় উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া, অহেতুক মিথ্যার বেসাতি করে অথবা গুজব ছড়িয়ে পক্ষপাতদুষ্ট কোনও দলীয় রাজনৈতিক অভিসন্ধিকে পূরণ করা নয়। কারণ, এই প্রজন্মের কাছে রাজনীতির অর্থ নিছক ভোট দেওয়া নয়, প্রতিদিনের জীবনে মিম তৈরি, হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ডিং, পথে নামা, বিদ্রোহ করা এবং ন্যায়বিচার চাওয়া।

কিন্তু শুধু এটুকু বললে গল্পের অর্ধেকটা বলা হয়। বুঝতে হবে, ইতিমধ্যে সমাজ ও অর্থনীতিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যে আমূল পরিবর্তন এনেছে ও কার্যত এক প্যারাডাইম শিফট সাধন করেছে, তা বহুলাংশে Gen Z’কে নবতর এক সামাজিক স্তর হিসেবে নির্মাণ করেছে।

প্রথমত, যুগপ্রজন্ম হওয়ার কারণে Gen Z যেহেতু AI-দক্ষ, ফলে, AI-প্রুফ দক্ষতাগুলিকে— সৃজনশীলতা, মৌলিক চিন্তাভাবনা ও ব্যক্তিক যোগাযোগের কারুকৌশল— তারা সহজেই অর্জন করতে পারে আর সেইহেতু বহুমুখি আয়ের উৎস তৈরি করে কর্মজীবনকে বহুমুখি করতে তারা পারদর্শী।

দ্বিতীয়ত, তারা AI’র চরিত্র-চিত্রণে সড়গড় হওয়ায় যেহেতু জানে যে কাজের নিরাপত্তা নিয়ে প্রভূত সংশয়ের কারণ আছে, তাই, উচ্চ বেতনের পিছনে অন্ধভাবে না দৌড়ে অর্থপূর্ণ কাজ, সামাজিক উদ্দেশ্য পূরণ, জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে নমনীয়তা অবলম্বন ও মানসিক স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দিয়ে এক স্বাস্থ্যকর জীবনপ্রবাহ গড়ে তুলতে আগ্রহী হয়। যেমন, কলেজের অনর্থক ডিগ্রি অর্জনের পিছনে সময় নষ্ট না করে অনেকেই নিজ গুণে সচ্ছল কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে নেয়। ফলে, তারা খুব স্বাভাবিক ভাবেই সামাজিক সচেতনতার উপাদানগুলিকে সযত্নে বহন করে। আর এই কারণেই তারা রাজনৈতিক স্বৈরাচার ও দুর্নীতির উপরে সাড়ে ষোলোআনা খড়্গহস্ত। প্রায় প্রতিটি দেশের Gen Z অভ্যুত্থানে এই আক্রোশটি বেশ নজর কেড়েছে। নেপালে ‘নেপো কিড’দের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভের প্রকাশ আমরা দেখেছি।

তৃতীয়ত, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নৈতিকতা ও তথ্য সুরক্ষার বিষয়েও তারা অতিসচেতন।

সব মিলিয়ে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে এমন এক রূপান্তরের শক্তি যা সামগ্রিক ভাবে Gen Z’র অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভূমিকা, কর্মজীবনের পথ ও মূল্যবোধকে মৌলিকভাবে সংজ্ঞায়িত করছে। আর এই উৎসভূমি থেকেই জারিত হচ্ছে সমাজ-বিপ্লবের এক অভিনব অগ্নুৎগীরণ, যা তুলনারহিত।

আমরা নতুন এক যুগ সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছি। যে কোনও রাজনৈতিক দল বা শাসন ক্ষমতা যে কোনও মুহূর্তে চকিতে ভূলুন্ঠিত হতে পারে। Gen Z আজ বিশ্বে সব থেকে শক্তিশালী সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তি। আমাদের দেশের শাসকেরাও যেন তা পদে পদে স্মরণে রাখে। 


Friday, 17 October 2025

চলচ্চিত্রে আপসহীন উগ্রতায় নিটোল

কুমার সাহানি আজও প্রাসঙ্গিক

উত্তান বন্দ্যোপাধ্যায়



আগত ৩১তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের সাজো সাজো রবে'র আবহে আরও একবার মনে পড়ছে কুমার সাহানি'র কথা। গতবারের (৩০তম) চলচ্চিত্র উৎসবে কুমার সাহানিকে নিয়ে একটি বিশেষ আলোচনা সভা হয়েছিল। তার কয়েক মাস আগেই তিনি প্রয়াত (২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪) হয়েছেন। এবারের উৎসবেও কি তাঁকে নিয়ে কোনও আয়োজন থাকবে? কারণ, তাঁর প্রাসঙ্গিকতা এক বিস্তৃত পরিধি জুড়ে।

বলাই বাহুল্য, তাঁর চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনা করতে গেলে বামপন্থার আলোচনা অনিবার্যভাবে চলে আসে। অতীতে সহজেই বিবিধ মতাদর্শগুলোর মধ্যকার সূক্ষ্ম পার্থক্যগুলো ব্যাখ্যা করা সম্ভব ছিল; কিন্তু রাজনীতির জটিলতাগুলো এমন যে এখন অনুধাবন করা যায়, এর মূলে 'ক্ষমতা' অর্জন ও প্রয়োগের ইচ্ছা কাজ করে। 'বাম' আর 'ডান'-- এই পরিভাষাগত পার্থক্যগুলো দার্শনিক মতপার্থক্যের সত্যিকারের প্রতিফলনের চেয়ে রাজনৈতিক সুযোগসন্ধানের ফসল বলেই মনে হয়। ক্ষমতা কেন্দ্রহীন, রাজহীন হয়েও বিচরণ করে। কর্তৃত্ব না থাকলেও ক্ষমতার গতিশীলতা রাজনৈতিক ভূদৃশ্য গড়ে তোলে। ঠিক এখানেই কুমার সাহানিরা সব সময়েই প্রাসঙ্গিক। কারণ, তিনি তাঁর ছবির মাধ্যমে ক্ষমতার কাঠামো, সামাজিক সম্পর্ক ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য নিয়ে গভীর প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর ছবিগুলি ইউরোপীয় আধুনিকতার প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ এবং ভারতীয় দর্শন, রীতিনীতি ও ঐতিহ্যকে নতুনভাবে উপস্থাপন করে।

তিনি মনে করতেন, শিল্পকে পণ্যায়ন থেকে মুক্ত রাখতে হবে এবং চলচ্চিত্রের মাধ্যমে গভীর সামাজিক ও রাজনৈতিক সত্য তুলে ধরতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, তাঁর 'মায়া দর্পণ' বা 'তরঙ্গ' ছবি দুটিতে দেখা যায় প্রতীকী এক চিত্রকল্প ও বিমূর্ত আখ্যান, যেখানে তিনি সামাজিক শোষণ ও ক্ষমতার বৈষম্যকে তুলে ধরেন। তাঁর কাজ ব্রেসঁ'র মতো কৃচ্ছ্রতার দ্বারা প্রভাবিত হলেও তিনি ভারতীয় প্রেক্ষাপটে সম্পূর্ণ এক নতুন আঙ্গিকে তা প্রয়োগ করেছিলেন। তাঁর ছবিতে তাই প্রতিটি ফ্রেম emptiness ও nothingness'এর তফাত বুঝতে চাইত; এ স্বাধীনতা এক বৌদ্ধিক সর্বজনীনতা।

আমরা জানি, মণি কাউল, জন আব্রাহাম, কে কে মহাজন, কুন্দন শাহ্, অজয় করক ও কুমার সাহানি, এনারা সকলেই ঋত্বিক ঘটকের ছাত্র। প্রথমে জন আব্রাহাম বিদায় নিয়েছিলেন এ ধরাভূমি থেকে আগেই, তারপরে ক্রমান্বয়ে কে কে মহাজন, মণি কাউল ও কুমার সাহানি। হয়তো পরিণত বয়সেই গেলেন, অথচ আশ্চর্য, বিদায়কালে বেছে নিলেন সেই শহরকেই যা তাঁর গুরুর সাধনাস্থল ছিল। ঋত্বিক ঘটকের ছাত্র কুমার সাহানিদের মতো চলচ্চিত্র নির্মাতারা আজও প্রাসঙ্গিক, কারণ, তাঁদের কাজ মানুষের জীবন, সমাজ ও রাজনীতির জটিলতাকে অন্বেষণ করে। বাস্তবতা ও কল্পনাকে মিশিয়ে তিনি এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেন। তিনি চলচ্চিত্রে এক অনন্য শৈলী উপহার দিয়েছেন, যদিও চলচ্চিত্র সমালোচকদের দ্বারা তিনি একইসঙ্গে প্রশংসিত ও সমালোচিতও।

নয়াদিল্লি'র ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা (এনএসডি) থেকে সদ্য বেরিয়ে মিতা বশিষ্ট কুমার সাহানি পরিচালিত একটি নাটকে মেক-আপ শিল্পী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। এর পরপরই মিতা ১৯৮৭ সালে সাহানি'র স্বল্প দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র 'ভার ভার ভারি'তে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করার জন্য নির্বাচিত হন। কুমার শাহানির অধীনে নিজের ক্যারিয়ার শুরু করা ছিল মিতা বশিষ্ঠ'এর কাছে সিরিয়াস ছবির পবিত্র প্রবেশদ্বারে প্রবেশের মতো।

'কুমারের সঙ্গে দেখা করার পর আমি তাৎক্ষণিক ও সহজাত ভাবে বুঝতে পেরেছিলাম যে তিনি একজন অসাধারণ চলচ্চিত্র নির্মাতা ও বুদ্ধিধারী ব্যক্তি এবং তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের অর্থ হল আপনি আপনার আত্মা, মন, শরীর ও ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে গভীরভাবে নিজেকে জড়িয়ে নিলেন।' 'ফ্রন্টলাইন'এর সাংবাদিক শেখ আয়াজ'কে মিতা এ কথা বলেন। এর আগে মিতা কুমার সাহানি সম্পর্কে বা তাঁর বহুল প্রশংসিত 'আর্টহাউস চলচ্চিত্র' সম্পর্কে কিছু শোনেননি। এই স্মৃতিগুলো প্রায় তিন দশক পুরনো, কিন্তু মিতা বশিষ্ঠ যিনি আজ ৫৭ বছর বয়সী, এগুলিকে এমনভাবে ধরে রেখেছেন যেন গতকালের কথা। মিতা বশিষ্ঠ 'খেয়াল গাথা' (১৯৮৯) ও 'কসবা' (১৯৯১) ছবিতে কুমার সাহানি'র সঙ্গে প্রথম অভিনেত্রী হিসেবে কাজ করেন এবং জীবনের শেষ অবধি তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। কুমার সাহানি, শ্যাম বেনেগাল ও সমান্তরাল ছবির পরিচালকদের থেকেও আলাদা ছিলেন। অদ্ভুতভাবে, তাঁর কাজ যতটা শ্রদ্ধার ততটাই দুর্বোধ্য ও অস্পষ্ট।

এফটিআইআই'এর সহকর্মী এবং কাল্ট ক্লাসিক ছবির চর্চা করা ব্যক্তি ও পরিচালক কমল স্বরূপ যিনি মণি কাউল ও সাহানি উভয়কেই জানতেন এবং তাঁদের সঙ্গে কাজ করেছেন, কুমার সাহানি সম্পর্কে বলেন, 'তিনি একজন সুপণ্ডিত ব্যক্তি ও অসাধারণ নন্দনতত্ত্ববিদ ছিলেন, যিনি ডিডি কোসাম্বি (বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ও গণিতবিদ), রবার্ট ব্রেসঁ এবং সের্গেই আইজেনস্টাইনের মতো উগ্র চিন্তাবিদদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।' ফ্রান্সে রোবের ব্রেসঁ-র অধীনে প্রশিক্ষণের শেষে ফিরে আসার পর সাহানি ১৯৬৮ সালের মে মাসে ফরাসি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের একজন প্রচারক হয়ে ওঠেন এবং প্রায়শই জঁ-পল সাঁর্ত্রের মতো অস্তিত্ববাদীদের সম্পর্কে আলোচনা করতেন।

যদিও সাহানি পাশ্চাত্য দর্শনে পারদর্শী ছিলেন, তবুও তিনি মনেপ্রাণে ভারতীয় নন্দনতত্ত্বের একজন গুণী সমর্থকও ছিলেন। ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীত ও নৃত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগ 'খেয়াল গাথা' (১৯৮৯) ও  'ভবন্তরণ' (১৯৯১) ছবিতে সুন্দরভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল, যা ছিল ওড়িশি নৃত্যশিল্পী গুরু কেলুচরণ মহাপাত্রের প্রতি এক শ্রদ্ধাঞ্জলী। একই সঙ্গে তিনি পাহাড়ি ক্ষুদ্রাকৃতি চিত্রকলার একজন ভক্ত ছিলেন, যা 'কসবা' (১৯৯১) ছবিতে তাঁর ফ্রেমগুলিকে প্রভাবিত করেছিল। তাঁর বেশিরভাগ চলচ্চিত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আন্তন চেখভ ও নির্মল ভার্মার সাহিত্যের মহান রচনার উপর ভিত্তি করে তৈরি।

কুমার সাহানি অন্যান্য বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের মতো ভারতীয় লেখালেখি এবং পুরাণে পাওয়া বস্তুবাদকে প্রত্যাখ্যান করেননি। ১৯৭২ সালে হিন্দি লেখক নির্মল ভার্মার গল্পের উপর ভিত্তি করে তাঁর প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র 'মায়া দর্পণ' পরিচালনা করেন, যা মণি কাউলের 'উস্কি রোটি' বানানোর তিন বছর পর মুক্তি পায়। এক সাক্ষাৎকারে পরিচালককে 'মায়া দর্পণ'এর মূল্যায়ন করতে বলা হলে উত্তরে তিনি কিছুটা রসিকতা করে বলেন, 'জানি, এটি এমন একটি চলচ্চিত্র যা প্রথমবার দেখার পর কেউ পছন্দ করেনি।' ১৯৭২ সালে সেরা পূর্ণ দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিজয়ী 'মায়া দর্পণ' ঠিক এমনই এক রহস্যময় ছবি। এটি একজন জমিদারের যুবতী কন্যার প্রতিকৃতি, যখন সে তার অভ্যন্তরীণ জগতের অনুসন্ধান করে এবং শূন্যতার দিকে মননশীলভাবে তাকিয়ে থাকে, মাঝে মাঝে তার দম বন্ধ আকাঙ্ক্ষার দিকে আমাদের ক্ষণিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করার সুযোগ দেয়। গল্প বলার মধ্যে একটি জাদুকরী চেতনার ধারা রয়েছে, যা 'তোমাকে ছাড়া কখনও দেখা যেত না তা দৃশ্যমান করে তোলে' - ব্রেসঁনিয়ান সত্যবাদকে জাগিয়ে তোলে।

যদিও সবাই সাহানির প্রতিভা ও সাহসিকতার প্রশংসা করেননি। সত্যজিৎ রায় ছিলেন তাঁর অন্যতম তীব্র সমালোচক। 'চলচ্চিত্রের ভাষা বিলুপ্তির হুমকি' দেওয়ার অভিযোগে তিনি সাহানি'কে অভিযুক্ত করেছিলেন। অবশ্য কমল স্বরূপ পাল্টা বলেন, 'রায় নাটকীয় আখ্যানের শিল্পে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। সম্ভবত, তিনি আশা করেছিলেন যে অন্যরাও একইরকম সাবলীল থাকবে। এবং আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে ১৯৭০-এর দশকে মণি ও কুমার সবে মাত্র শুরু করেছিলেন এবং তাদের বাগধারা সম্পূর্ণরূপে বিকশিত হতে তখনও কয়েক বছর দূরে ছিলেন।'

অভিনেতাদের উপর সাহানির মানসিক প্রভাব ব্রেসঁনিয়ানদের কঠোর পরিশ্রমের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, তিনি মিতা বশিষ্ঠকে 'কসবা'তে তেজো চরিত্রটি সম্পর্কে খুব বেশি কিছু বলেননি। তিনি কেবল বলেছিলেন (মিতা বশিষ্ঠ'এর ভাষায়), 'আমার তোমাকে তার জন্য হাঁটার জায়গা খুঁজে বের করতে হবে। তাই, আমি দক্ষিণ মুম্বাইয়ের ট্রেন ধরে প্রতিদিন সকাল ১০টায় ওনার ফ্ল্যাটে পৌঁছতাম যেখানে দু' ঘন্টা ধরে আমি তাঁর ড্রয়িংরুমে এদিক-ওদিক হেঁটে যেতাম এবং আমরা হাঁটার চেষ্টা করতাম। কুমার বলতেন, তুমি যদি 'কসবা দেখে থাক তাহলে দেখতে পাবে তেজোর একটি রহস্যময় হাঁটা আছে। এবং সে যত বেশি নিস্তেজ হয়ে ওঠে, তাকে তত বেশি বিপজ্জনক দেখায়।'

বম্বে ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশুনা করে সাহানি গিয়েছিলেন পুনা FTII-এ ঋত্বিক ঘটকের ছাত্র হিসেবে চলচ্চিত্র নির্মাণের শিক্ষাগ্রহণ করতে। স্নাতক স্তরে পড়েছিলেন ইতিহাস। চর্চা বজায় রেখেছিলেন আজীবন ইতিহাসবিদ ডি ডি কোসাম্বির সান্নিধ্যে। ফ্রান্সে শিক্ষাকেন্দ্রেরই ছাত্র ছিলেন আলাঁ রেণেঁ, ওলকার স্লোনড্রফ, থিও আঞ্জেলোপুলোস, কস্টা গাভ্রাস প্রমুখ। ঠিক এই সময়ে তিনি রোবের ব্রেসঁ-র সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন আঁ ফিউম্ ডশ্ (Un Femme Douce) ছবিতে।

জীবনের অনেকটা সময়ই কেটেছে কলকাতা শহরে। প্রয়াণও এই কলকাতাতেই। ভারতীয় চলচ্চিত্রের সবচেয়ে উগ্র এবং মৌলিক মনের মানুষদের মধ্যে একজন ছিলেন। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতেও সমান প্রাসঙ্গিক।


Wednesday, 15 October 2025

'সৃজনশীল বিনাশ'এর গল্প

প্রযুক্তির উদ্ভাবনেই অগ্রগতির পথ?

সুব্রত বোলার



এই বছর (২০২৫) অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী তিন অর্থনীতিবিদ জোয়েল মকিয়র (Joel Mokyr), ফিলিপ আগিয়োঁ (Philippe Aghion) ও পিটার হাউইট (Peter Howitt) এক অভিনব বিষয়ে বিচরণ করেছেন। প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনকে তাঁরা অর্থনৈতিক অগ্রগতির দ্যোতক হিসেবে পেশ করেছেন; ব্যাখ্যা করেছেন কীভাবে নবতর প্রযুক্তি ও বাণিজ্যের নতুনতর উদ্ভাবন আরও অগ্রগতির কারণ হয়ে ওঠে। দেখিয়েছেন, কীভাবে প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রসরতায় নতুন পণ্য ও উৎপাদন পদ্ধতিগুলি এক অন্তহীন চক্রে পুরনো যা কিছু, তার বিনাশ করে। আগিয়োঁ ও হাউইট'এর ধারণা, সৃজনশীল বিনাশের আছে এক রূপান্তরমূলক প্রক্রিয়া, যা পুরনো কোম্পানি বা বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানকে ক্রমাগত অকেজো করে দেয় এবং প্রতিস্থাপিত হয় নতুনতর প্রযুক্তি ভিত্তিক এক নবতর রীতি ও পদ্ধতি। এই নব উন্মেষ আমাদের টেঁকসই বৃদ্ধির দিকে ধাবিত করে।

১৯৪২ সালে জোসেফ শুম্পেটার প্রবর্তিত 'সৃজনশীল বিনাশ' (creative destruction) ধারণাটি এমন একটি প্রক্রিয়াকেই বোঝায় যেখানে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক কাঠামোকে ভেঙে নতুন কাঠামোর জন্য পথ তৈরি করে। এটি প্রতিযোগিতাকে উৎসাহিত করে এবং 'বিঘ্নকামী প্রযুক্তি' (disruptive technology) প্রবর্তনের মাধ্যমে পুঁজিবাদকে এগিয়ে নিয়ে যায়। 'সৃজনশীল বিনাশ' অর্থনীতির এমন একটি ধারণা হয়ে ওঠে যেখানে নতুন উদ্ভাবনগুলি পিছিয়ে পড়তে থাকা বা অচল উদ্ভাবনগুলিকে প্রতিস্থাপন করে। শুম্পেটার এই তত্ত্বটি মার্কস'এর ভাবনার মধ্যে খুঁজে পান ও তাকে নিজস্ব ব্যাখ্যায় জনপ্রিয় করেন। এই তত্ত্ব শুম্পেটার'এর 'সৃজনশীল ধ্বংসের ঝড়' (Schumpeter's Gale) হিসেবেও বিখ্যাত। সহজ কথায়, উক্ত প্রক্রিয়ায় নতুন শিল্প, সম্পদ ও কর্মসংস্থান তৈরি হয়, কিন্তু একইসঙ্গে পুরনো প্রতিষ্ঠান, পণ্য ও কাজ বিলুপ্ত হয়ে যায়। অনেকেই বলেন, আধুনিক অর্থনীতিতে 'সৃজনশীল বিনাশ' তত্ত্বটি বর্তমানে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচিত।

বৃটিশ অর্থনীতিবিদ জেমস এ রবিনসন'এর মতে, বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক স্থবিরতা ও নিম্নগামিতার মূল কারণ, 'সৃজনশীল বিনাশ'এর অমোঘ বাস্তবতার প্রতি প্রবল অনীহা ও তাকে আটকানোর প্রবল প্রচেষ্টা।প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন বাণিজ্যকে এক ধরনের প্রযুক্তি হিসেবে ভাবা হয়? কারণ, নতুন প্রযুক্তির মতো নতুন বাণিজ্য পদ্ধতিও আমাদের সস্তা উপায়ে পণ্য উৎপাদন করতে সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ, গোলাপের কথাই ধরুন। আরও দক্ষ গ্রিনহাউস পরিবেশে উন্নত পরিচর্যা বা বীজের মতো প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের ফলে গোলাপের দাম কমে আসে। এই প্রক্রিয়া প্রতিযোগিতাকে উৎসাহিত করে, যা খরচ কম করতে ও মান উচ্চ রাখতে সহায়ক। বলা হয়ে থাকে, এইভাবে একচেটিয়া প্রতিষ্ঠানগুলিকে ভেঙে ফেলে পুরনো শিল্প বা প্রযুক্তির উপর নির্ভরতা কমানো গেলে অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করা যেতে পারে।

ইতিহাসে 'সৃজনশীল বিনাশ'এর উদাহরণগুলির মধ্যে অন্যতম হেনরি ফোর্ডের অ্যাসেম্বলি লাইন। আমরা জানি, তা কীভাবে অটোমোবাইল উৎপাদন শিল্পে বিপ্লব এনেছিল; পাশাপাশি, পুরনো বাজারগুলিকে স্থানচ্যুত করে এবং বহু শ্রমিককে কাজ থেকে অপসারিত করে। অটোমোবাইলের নতুন উদ্ভাবকরা তখন দ্রুততর ও ব্যক্তিগতকৃত পরিবহনের প্রয়োজনীয়তাকে উপলব্ধি করেছিলেন। অটোমোবাইল বিপ্লব মানুষের ভ্রমণের ধরণকে চিরতরে বদলে দেয়। বলাই বাহুল্য, প্রথম অটোমোবাইলের উদ্ভাবন পরবর্তী উদ্ভাবনগুলিকে ইন্ধন জোগায়।

অবশ্য এই প্রশ্নও উঠতে পারে, এবারের নোবেল পুরস্কার ঘোষণায় সময়ের কি কোথাও গোলমাল হল? কারণ, আগিয়োঁ ও হাউইট'এর এ সংক্রান্ত মূল লেখাটি প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৯২ সালে এবং মকিয়র'এর ক্ষেত্রে তা ১৯৯৮ সালে। তাহলে এতদিন পরে তাঁদের সম্মানিত করা কেন? কারণ, এতদিন ধারণাটি বহমান থাকলেও তাকে যেন সম্যক ভাবে উপলব্ধির সমস্যা ছিল। তা এই অর্থে যে, নবতর প্রযুক্তির উন্মেষ কতকটা ছিল ধীরে এবং বিবর্তনমূলক পথে। ফলে, পরিবর্তনের অভিঘাতগুলি তেমন সজোর ছিল না; সবটাই যেন ধীরে ধীরে এক মানিয়ে নেওয়ার মধ্য দিয়ে অগ্রগতি। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আগমনে এই পরিবর্তনের ধারা গেল আমূল বদলে। তা এতটাই বৈপ্লবিক অভিঘাতে উপস্থিত হল যে, 'সৃজনশীল বিনাশ'এর মর্মকথা এবার হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া গেল। হয়তো তাই নোবেল কমিটিও নড়েচড়ে বসল। 

দেখাই যাচ্ছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে নিয়ে এক  হৈ হৈ ভাব, বা বলা ভালো, গেল গেল রব। অনেকে এর জন্য বিজ্ঞানী বা প্রযুক্তিবিদদের দোষারোপ করছেন, একে মানব সভ্যতার ধ্বংসের সোপান হিসাবে দেখছেন। শিক্ষিত কর্মীরা কর্মচ্যুত হওয়ার ভয় পাচ্ছেন। প্রকৃতপক্ষে, সৃজনশীল যে কোনও উদ্ভাবন বা সৃষ্টির ভালো ও খারাপ দুই দিকই থাকে। সুফলটা পেতে মানবসভ্যতার কল্যাণকল্পে সকলকে (রাষ্ট্র, জনগণ, বিজ্ঞানী/গবেষক/পেশাদার) একযোগে কাজ করতে হয়। যেমন শিক্ষা, প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য, কৃষিতে আমরা তার সুফল পাচ্ছি। পাশাপাশি মানবসম্পদের উন্নয়নে জোর দিতে হয়। আসলে, যন্ত্রের উদ্ভাবনে ভয় না পেয়ে তাকে চালনা করার শিক্ষা লাভ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা সর্বাগ্রে জনকল্যাণমুখি হওয়া প্রয়োজনীয়। না হলে আবার সেই জন হেনরি'র গান.... 'আমি মেশিনের হব প্রতিদ্বন্দ্বী....', তারপর অহেতুক শ্বাসরোধ হয়ে মৃত্যু।



Tuesday, 14 October 2025

উৎসবই নতুন মানসিকতার প্রতীক

নবরাত্রির রাত এবং ভবিষ্যতের সমাজমন

অয়ন মুখোপাধ্যায়



নবরাত্রির রাত মানেই আলো, ভক্তি, নাচ, ডান্ডিয়ার ছন্দ আর উৎসবের উত্তেজনায় ভেসে ওঠা মানুষের ভিড়। দেবীর শক্তির আরাধনা যেমন থাকে, তেমনই থাকে অদৃশ্য আবেগের তরঙ্গ। এ বছর সেই তরঙ্গে এক অদ্ভুত তথ্য উঠে এসেছে— নবরাত্রি চলাকালীন একটি নির্দিষ্ট কোম্পানির কনডোম বিক্রি বেড়েছে আঠারো গুন। প্রথম শোনায় এটি নিছক বাজারি পরিসংখ্যান মনে হতে পারে, কিন্তু এর ভেতরে লুকিয়ে আছে এক দীর্ঘ ইতিহাস ও বিবর্তনের ছাপ, যেখানে যৌনতা সমাজ মানসে বহুবার নতুন রূপ নিয়েছে। উসকে দিয়েছে অনেক প্রশ্ন।

ভারতীয় সভ্যতায় যৌনতাকে সব সময় অস্বীকার করা হয়নি। বহু বিশেষজ্ঞের মতে, প্রাচীন গ্রন্থ 'কামসূত্র' শুধু দেহের ভঙ্গি নয়, বরং সম্পর্ক, আবেগ এবং সামাজিক কাঠামোর পাঠ্য। কামকে তখন ধর্ম ও অর্থের মতোই জীবনের অপরিহার্য স্তম্ভ ধরা হত। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, প্রাচীন ভারতের তন্ত্র সাহিত্যও দেহ ও কামনার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক মুক্তির কথা বলেছে। এর মানে, যৌনতা কোনও নিষিদ্ধ বিষয় নয়, বরং জীবনের এক স্বাভাবিক পরিসর। এমনকি মন্দিরের গায়ে যৌনতার পাঠ ভারতীয় ইতিহাসের এক অনন্য দলিল। অনেক গবেষকের মতে, সমাজের মানসেও তখন লজ্জা বা অপরাধবোধ এতটা প্রভাবশালী ছিল না।

কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে থাকে। মধ্যযুগে ধর্মীয় শৃঙ্খলা কঠোর হয়। হিন্দু সমাজে শাস্ত্রের নিয়ম, মুসলিম শাসনে শরিয়তি বিধান— দুটোই মিলিয়ে যৌনতাকে আড়ালে ঠেলে দেয়। বহু বিশেষজ্ঞ বলেন, এই সময়ে যৌনতা ধীরে ধীরে 'পাপবোধ' ও 'লজ্জা'র সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। মনোবিশ্লেষণের ভাষায়, যৌনতার দমন তখন সামাজিক কাঠামোর অংশ হয়ে দাঁড়ায়। ফ্রয়েড যেমন বলেছিলেন, দমন মানুষের অবচেতনে চাপে, আর সেখান থেকে নানা দ্বন্দ্ব, ভয় ও বিকৃতি জন্ম নেয়। (Three Essays on the Theory of Sexuality, 1905)। ভারতীয় সমাজে এই সময় সেই মানসিক দ্বন্দ্ব স্পষ্ট।

ঔপনিবেশিক যুগে এসে এই দমন পেল আইনি কাঠামো। ১৮৬১ সালে প্রণীত ভারতীয় দণ্ডবিধির ber notorious সেকশন ৩৭৭ সমলিঙ্গ সম্পর্ক ও 'অপ্রাকৃতিক' যৌনতাকে 'অপরাধ' ঘোষণা করল। বহু গবেষক বলেন, ভিক্টোরিয়ান নৈতিকতা ও ঔপনিবেশিক সংস্কার ভারতীয় সমাজে যৌনতার ওপরে এক নতুন ধরনের নিয়ন্ত্রণ চাপিয়ে দিল। এই আইন শুধু যৌন আচরণ নয়, যৌন পরিচয়কেও অদৃশ্য করে দিল। ভারতীয় সাহিত্যে সমলিঙ্গ প্রেম বা যৌন বৈচিত্র্যের উপস্থিতি বহু পুরনো— লোকগাথা, কবিতা, এমনকি পুরাণেও এর ছায়া পাওয়া যায়। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনের আইন তাদের অপরাধে পরিণত করল। অর্থাৎ, যৌন বৈচিত্র্য যে ছিল, তার সামাজিক স্বীকৃতি ঔপনিবেশিক যুগে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

'The History of Sexuality' (1976) গ্রন্থে ফুকো বলেছিলেন, যৌনতার ইতিহাস আসলে ক্ষমতার ইতিহাস। দমন মানে নিছক নীরবতা নয়, বরং রাষ্ট্র ও সমাজ দেহ ও কামনার ওপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতীয় প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশ শাসনের আইন সেই নিয়ন্ত্রণের অন্যতম প্রতীক। তবে একই সঙ্গে গবেষকেরা সতর্ক করেন, ফুকোর তত্ত্ব সরাসরি সব সমাজে প্রযোজ্য নয়, ভারতীয় সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও জটিলতা আলাদা করে বোঝা জরুরি।

স্বাধীনতার পরে যৌনতার ইতিহাসে নতুন অধ্যায় শুরু হয়। প্রথম কয়েক দশক যৌনতা ছিল সামাজিক আড়ালের মধ্যে। পরিবার ও সমাজ যৌনতাকে আলোচনা-বহির্ভূত রেখেছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে শহুরে মধ্যবিত্ত সমাজে পরিবর্তন দেখা দেয়। জনস্বাস্থ্য আন্দোলন, গর্ভনিরোধ ক্যাম্পেন কনডোমকে স্বাভাবিক করে তোলে। স্বাধীনতার সত্তর বছর পর এসে ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্ট সেকশন ৩৭৭ বাতিল করে ঘোষণা করে, প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সম্মত যৌন সম্পর্ক ব্যক্তির মৌলিক অধিকার। এটি নিছক একটি আইনগত রায় নয়, বরং এক সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক মুক্তি। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এতকাল যে কামনাকে অপরাধ বলা হচ্ছিল, হঠাৎ তা স্বীকৃতি পেয়ে সমাজের মানসে বড় পরিবর্তন আনে। তবে অন্যদিকে অনেকে মনে করিয়ে দেন, আইন পাল্টালেও সমাজের মনোভাব একদিনে বদলায় না; গ্রামাঞ্চল ও রক্ষণশীল পরিবেশে যৌনতা এখনও লজ্জা ও অপরাধবোধে ঢাকা।

আজকের তথ্য প্রযুক্তির যুগ যৌনতার মানচিত্রকে আমূল পাল্টে দিয়েছে। সম্পর্ক আর কেবল সামাজিক সূত্রে বা পরিবারের উদ্যোগে গড়ে ওঠে না। টিন্ডার, বাম্বল, হিঞ্জ কিংবা গ্রাইন্ডারের মতো অ্যাপ মুহূর্তে নতুন পরিচয় এনে দেয়। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, এই প্রযুক্তি সম্পর্ককে করেছে দ্রুত, অভিজ্ঞতা-নির্ভর, মুহূর্তমুখি। প্রেম এখন অনেক বেশি অনুসন্ধান ও অভিজ্ঞতার খোঁজে, প্রতিশ্রুতির চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে অভিজ্ঞতার বৈচিত্র্য। ই-কমার্স কনডোম কেনাকে করেছে সহজ ও লজ্জাহীন। আগে দোকানে গিয়ে কিনতে সংকোচ থাকত, এখন অনলাইন-ক্লিকে প্যাকেট পৌঁছে যায় বাড়িতে। সোশ্যাল মিডিয়া যৌন স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা নিয়ে সচেতনতা ছড়িয়েছে। তবে গবেষকদের মতে, এই পরিবর্তন সর্বজনীন নয়, ডিজিটাল বিভাজনের কারণে অনেক মানুষ এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত, বিশেষত গ্রামীণ বা দরিদ্র সমাজে।

নবরাত্রির রাতের কনডোম বিক্রির রেকর্ড আসলে এই পরিবর্তনের প্রতীক। উৎসব সব সময় মানুষের আবেগকে উচ্ছ্বাসে ভাসায়। সমাজবিজ্ঞানী এমিল দুর্খেইম এই অভিজ্ঞতাকে বলেছিলেন, collective effervescence— সমষ্টিগত আবেগের বিস্ফোরণ। নাচ, গান, ভিড়, রাতভর উচ্ছ্বাস মানুষের ভেতরে অবদমিত কামনাকে মুক্তি দেয়। আগে এই কামনা লুকিয়ে থাকত, ঔপনিবেশিক আমলে তা অপরাধ হত, স্বাধীনতার পরে ধীরে ধীরে স্বীকৃতি পেল, আর আজকের দিনে তা সুরক্ষা ও দায়িত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হচ্ছে।

তবে প্রশ্ন রয়ে যায়, এই পরিবর্তন কি সত্যিই সর্বজনীন? শহরে কনডোম বিক্রি রেকর্ড গড়ছে, কিন্তু গ্রামে এখনও যৌন শিক্ষা নিয়ে অন্ধকার। সেখানে যৌনতা মানে ভয়, গুজব ও লজ্জা। বিশেষজ্ঞরা বলেন, যৌন সচেতনতার বৈষম্য সমাজকে বিভক্ত করে রেখেছে। আবার বাজার যৌনতাকে ভোগ্যপণ্য বানিয়েছে। বিজ্ঞাপন কনডোমকে করেছে আকর্ষণীয় ও 'কুল'— এটি একদিকে লজ্জা ভেঙেছে, কিন্তু অন্যদিকে যৌনতাকে কখনও কখনও শুধু ভোগবাদের সমার্থক করে তুলেছে।

তাহলে আগামীতে কী? অনেক সমাজতাত্ত্বিকের মতে, ভবিষ্যতের সম্পর্ক হবে আরও তরল, অস্থায়ী, অভিজ্ঞতামুখি, যাকে বলা হচ্ছে Liquid Modernity (Zygmunt Bauman, Liquid Love, 2003)। ডেটিং অ্যাপ ও প্রযুক্তি সম্পর্ককে আরও ব্যক্তি-স্বাধীন করবে, কিন্তু একই সঙ্গে নতুন বৈষম্যও তৈরি করবে। যৌন শিক্ষা ও সচেতনতা যদি সর্বস্তরে ছড়ানো না যায়, তাহলে সমাজে দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হবে। আবার আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি হল, যুব সমাজ ইতিমধ্যেই যৌনতাকে লজ্জার বিষয় নয়, দায়িত্বশীল আনন্দ হিসেবে দেখছে।

নবরাত্রির আলোয় দাঁড়িয়ে এই পরিবর্তনের প্রতীকী ছবি আমাদের চোখে ভেসে ওঠে। গরবার মঞ্চ থেকে আলো ছড়িয়ে পড়ছে দূর রাতের অন্ধকারে। ঢাকের তালে নাচ থেমে গেলে ভিড়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে এক তরুণ-তরুণী, তাদের হাতে মোবাইলের ক্ষুদ্র আলো, ব্যাগের ভেতরে রাখা একটি ছোট্ট প্যাকেট, যা তাদের আগামীকে সুরক্ষিত রাখবে। আকাশে পূর্ণচন্দ্র উঠছে, হাওয়ায় মিশে যাচ্ছে পারফিউম আর ভিড়ের ঘামের গন্ধ, যেন দেবীর প্রতিমার ঠোঁটে ক্ষণিকের এক রহস্যময় হাসি খেলে যায়। সেখানে ভক্তি আর কামনা, আনন্দ আর দায়িত্ব, অতীতের দীর্ঘ দমন আর ভবিষ্যতের উন্মুক্ত স্বপ্ন— সব মিলেমিশে যায় এক অদ্ভুত বাস্তবতায়, যেখানে উৎসবই হয়ে ওঠে সমাজের নতুন মানসিকতার প্রতীক।


Sunday, 12 October 2025

নীল নকশার অভিযান

আমাদের পক্ষ নেওয়ার পালা

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

এই প্রথম দেখা গেল, ভারতের বুকে এমন এক সাংবাদিক সম্মেলন যেখানে নারী সাংবাদিকরা ব্রাত্য। হ্যাঁ, গত ১০ অক্টোবর দিল্লিতে ভারতে সফররত আফগান বিদেশ মন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি’র সাংবাদিক সম্মেলনে তেমন ঘটনাই ঘটেছে। এ নিয়ে তীব্র প্রতিবাদের ঢেউ উঠলে ভারত সরকারের বিদেশ মন্ত্রকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আফগান দূতাবাসে বিদেশ মন্ত্রী মুত্তাকি নিজ দায়িত্বে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকেছেন, এর সঙ্গে ভারত সরকারের কোনও যোগ নেই। কিন্তু বাস্তবতা হল, দিল্লিতে আফগান দূতাবাস নামে যে বাড়িটি দৃশ্যমান তা কার্যত অচল এবং সেখানে যে দু-চারজন আফগান পদাধিকারী ও কর্মচারী আছেন, তাঁরা পূর্বতন আফগান সরকারের অনুসারী এবং সেই সরকারের পতাকাই সেখানে এখনও উড়ছে, কারণ, ভারত তালিবান সরকারকে স্বীকৃতি না দেওয়ায় এ দেশে এই সরকারের কোনও locus standi নেই। কিন্তু সে সবের তোয়াক্কা না করে ভারত সরকার আফগান বিদেশ মন্ত্রীকে উল্লিখিত দূতাবাসে সাংবাদিক সম্মেলন করার অনুমতি দেয় যা কার্যত অস্বীকৃত এক বিদেশি সরকারকে দেশের কিছু অংশ ব্যবহারের অনুমতি মোতাবেক এমন কাজ করার সুযোগ করে দেওয়া যা আমাদের সংবিধানের মূল আত্মাকে বিদ্ধ করে। দুনিয়া সুদ্ধ লোক জানে, তালিবানরা তাদের সাংবাদিক সম্মেলনে কোনও মহিলা সাংবাদিককে ঢুকতে দেয় না। এবং তা জেনেই এমন একটি কুনাট্য করার সুযোগ তাদের দেওয়া হল। কারণ, আমাদের শাসকেরাও যে সামান্য ভিন্ন আঙ্গিকে নারী বিরোধী, সম্ভবত তা তালিবানিদের কাছে প্রকট করার দায় ছিল।

এটি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দেশে পর পর এমনতর কয়েকটি ঘটনা ঘটেই চলেছে, যা খানিক আলটপকা মনে হলেও দেখা যাবে, প্রতিটি ঘটনার মধ্যেই একটি নির্দিষ্ট যোগসূত্র আছে। সর্বোপরি, আজ যে পরিস্থিতিতে আমরা এসে দাঁড়িয়েছি, সেখানে এই ধরনের ঘটনা উত্তরোত্তর বাড়বে বলেই অনুমান। কারণ, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতান্ত্রিক পরিসর ও খোলামেলা মতপ্রকাশের যে আবহে স্বাধীনতার পরে অন্তত ৬৫ বছর আমরা কাটিয়েছি (হাজারও সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ সহ), তা আজ এক লহমায় বিলীন-প্রায়। তাই, আরও ভয়াবহ সব ঘটনার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।

যেমন, এতদিন ব্যক্তি ডোনাল্ড ট্রাম্প’এর সঙ্গে আদিখ্যেতার কুরঙ্গ করার পর সেখানে লাথি-ঝাঁটা খেয়ে এখন আমাদের একচ্ছত্র শাসক ভাব জমাচ্ছেন একদিকে চীন (একদা যাদের পণ্য বয়কটের ডাক দিয়েছিলেন) এবং অন্যদিকে তালিবানিদের সঙ্গে যাদের ভয়ঙ্কর শাসনে আফগানিস্তানে এক ঘন অন্ধকার নেমে এসেছে। আফগানিস্তানে মেয়েরা ঘরের বাইরে পা রাখা তো দূরের কথা, কোনও বই পড়ারও অধিকারী নয়। সেখানে গানবাজনা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ফলে, এ দেশের স্বঘোষিত ‘সনাতনী’রা এতে খুশি হচ্ছে, কারণ, তারাও তো কতকটা এমনতর মনুবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থাই গড়ে তুলতে সোচ্চারে প্রয়াসী। অতএব, রাজনৈতিক কারণে পাকিস্তান বা বাংলাদেশের মৌলবাদ নিয়ে ‘শঙ্কা’ প্রকাশ করলেও আফগানিস্তান এখন আমাদের শাসকদের ‘ব্লু আইড বয়’।

তাই, অতি আয়াসে ও কতকটা নিশ্চিন্তে দেশের দলিত ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী প্রধান বিচারপতি বি আর গভাই’এর দিকে জুতো ছুঁড়ে মারতে উদ্যত হয় এক স্বঘোষিত সনাতনী। উপরন্তু, পেশাগত ভাবে এই অপরাধী একজন উকিল হওয়া সত্ত্বেও নিজ দোষ স্বীকারে রাজী তো নয়ই, বরং উচ্চনিনাদে জানান দেয়, এরকম কাজ সে আবারও করবে। বোঝাই যাচ্ছে, এই ঘটনাগুলি কোনও বিচ্ছিন্ন ভুল বা তাৎক্ষণিক উন্মাদনা নয়, নীল নকশা ধরে এক পরিকল্পিত অভিযান, যার অন্তিমে গিয়ে পৌঁছনোর কথা সেই কল্পিত রাষ্ট্রে যা তালিবানিদের থেকে তেমন আলাদা নয় কিছু, যেখানে নারী এবং দলিত ও ভিন্ন ধর্ম বা চিন্তার মানুষের কোনও স্থান তো নেইই, বরং কেউ গলা তুললে তাকে আদিম ও নৃশংসতম শিক্ষা দেওয়ার আয়োজন চারিধারে সাজানো। যদিচ, উক্ত আইনজীবীর আচরণের নিন্দা করেছেন মোদিজী কিন্তু সংবিধান পদদলিত করেও যে ব্যক্তি অনুশোচনাহীন থাকে, তার যে খুঁটির জোর অনেক গভীরে, তা বলাই বাহুল্য। মিথ্যা কেসে দেশদ্রোহী তকমা দিয়ে পাদ্রী ও সমাজকর্মী স্ট্যান স্বামীকে গ্রেফতার করে হত্যা করতে অথবা ছাত্রনেতা উমর খালিদকে ইউএপিএ আইনে বছরের পর বছর আটকে রাখতে শাসক যেখানে দ্বিধাহীন, সেখানে ওই অপরাধী আইনজীবী রাকেশ কিশোরকে যে মামুলি কিছু হাল্কা কেস দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না!

যত দিন যাচ্ছে তত সুকৌশলে সমাজটাকে এইভাবেই দু’ ভাগ করে ফেলার চেষ্টা চলছে। একদিকে মনুবাদী সমাজের পক্ষে ওকালতি, বিপরীতে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের (Inclusive Society) নির্মাণ— এই দ্বৈরথেই এখন দেশের পারদ ওঠানামা করছে। ইতিহাসকে বিকৃত করে, বিশেষত একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়কে জাতিগত নির্মূলিকরনের (ethnic cleansing) কর্মসূচির মধ্য দিয়ে যে বিশেষ পশ্চাদপদ সমাজ নির্মাণের অভিসার শুরু হয়েছে, তার প্রেক্ষিতেই নতুনতর সংঘাতেরও উদয়। যে কারণে হরিয়ানার এডিজিপি পদমর্যাদার আইপিএস অফিসার ওয়াই পূরণ কুমার’কে নিজের সার্ভিস রিভলবার দিয়ে আত্মহত্যা করতে হয়। কারণ, তিনি তফসিলি জাতি সম্প্রদায়ের হওয়ায় ১০ জন আইপিএস ও ৩ জন আইএএস অফিসার সহ মোট প্রায় ১৬ জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা গত পাঁচ বছর ধরে জাতপাতগত কারণে তাঁকে প্রকাশ্যে মানসিক হয়রানি ও অপমান সহ তাঁর প্রতি নৃশংসতা প্রদর্শন করে গেছে— নিজের স্যুইসাইড নোটে তিনি এই কথাগুলি লিখে গেছেন। যদি একজন  কর্মরত আইপিএস অফিসারেরই এই দুর্দশা হয়, তাহলে গরিব আমজনতার কী হাল তা সহজেই অনুমেয়। আমরা দেখছিও, বিভিন্ন বিজেপি শাসিত রাজ্যে বাংলাভাষী শ্রমজীবী গরিব বাঙালি হিন্দু নিম্নবর্ণ ও মুসলমানদের উপর কী অকথ্য অত্যাচার নামিয়ে আনা হয়েছে এবং তাদের অনেককেই বেআইনি ভাবে বাংলাদেশে পুশব্যাক করে আরও বিপন্নতায় ছুঁড়ে দিয়েছে। এইগুলি সবই সেই নীল নকশার অংশ, নিছক কোনও বিদ্বেষ তাড়িত ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমূহের সাময়িক ঘৃণার উদ্রেক নয়। গোদি মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া, Whatsapp University, প্রশাসন, বিবিধ কালাকানুন, নিবিড় গুজব, হিংস্র ধর্মীয় প্রদর্শন, আরএসএস’এর শাখা, ভীতি, উগ্র দেশপ্রেম ইত্যাদি নানাবিধ প্রচার ও কৌশলে এমনই এক বাতাবরণ তৈরি করা হয়েছে যেখানে মনুবাদী সমাজের সমস্ত আকারপ্রকারকে সিদ্ধ করে তোলা যায়। তাই, ধর্মীয়, জাতপাত ও জাতিগত-- এমনতর নৃশংস মনোভাব ও ঘটনাবলী আমাদের চারপাশে অনায়াসেই প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা স্পষ্টতই দৃশ্যমান।

এমনকি উড়িষ্যাতেও বিজেপি দল শাসনক্ষমতায় আসতেই সে রাজ্যেরও হালহকিকত কী দ্রুত বদলে যাচ্ছে! এবার দুর্গোৎসবে কটকে ঝাঞ্জিরিমাঙ্গলা ভাগবত পূজা কমিটির বিসর্জনের শোভাযাত্রা নিয়ে গত ৩ অক্টোবর দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ শুরু হলে তা ৩৬ ঘন্টা কারফিউ ও ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ পর্যন্ত গড়ায়। অথচ, পশ্চিমবঙ্গে মহাসমারোহে দুর্গোৎসবে কোথাও কোনও বিন্দুমাত্র উত্তেজনারও খবর পাওয়া যায় না। ফলে, বোঝাই যাচ্ছে,  গণ্ডগোল ও হিংসার রাজনীতি কোথা থেকে ও কী উদ্দেশ্যে আয়োজিত হয়।

তাই, এই কালবিষকে এখন বাংলায় প্রোথিত করার উদগ্র প্রচেষ্টা। বাংলার উচ্চবর্ণের কৌলিন্য গৌরব বহুকাল আগেই খর্বিত হলেও তার রেশ ও কিছু প্রথা চোরাপথে থেকে গিয়েছিল বেশ সবলেই। সারা দেশ জুড়ে মনুবাদী মতাদর্শের উদ্গীরণে তা বাংলাতেও এই সময়ে তাল পেয়েছে বৈকি! বেশ দেখা যাচ্ছে, সরবে বা নীরবে, নিম্নবর্ণ ও মুসলমান নিধনে বাঙালি উচ্চবর্ণের এক বড় অংশের কী পরম হর্ষধ্বনি! বাংলায় সোশ্যাল মিডিয়ার এক বড় মাঠ দখল করে এরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, যেখানে মার্কস ও মনু যেন এক পাতে বসে পড়েছেন। উচ্চবর্ণ-উচ্চবিত্ত বাম মনোভাবাপন্ন লোকজনের এক বড় অংশের এ ব্যাপারে উৎসাহেরও শেষ নেই! ভিন রাজ্যে বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর অসহনীয় নির্যাতন এদের স্পর্শ করে না; দিনরাত বিনা মজুরিতে পরিশ্রম করা বাড়ির মা-মেয়েদের প্রদত্ত সরকারি অনুদানকে এরা ‘অদেয় মজুরি’ হিসেবে দেখে না, ভাবে ভিক্ষা; শ্রমজীবী মানুষের মজুরি বা দর বেড়ে যাচ্ছে বলে এদের আপসোসের শেষ থাকে না-- ‘ছোটলোকদের সব মাথায় তোলা হচ্ছে’; বড় বড় শিল্প কেন আসছে না, তবেই নাকি কর্মসংস্থান হবে, অথচ সকলেই জানে, আধুনিক বৃহৎ ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে নিয়োজনের হার অত্যন্ত স্বল্প, তবুও; বাংলায় নাকি সব রসাতলে গেছে, কারণ, এখানে সব কিছুই নাকি মুসলমানেরা দখল করে ফেলেছে; আর যে কোনও অপরাধের নিদান হল, এক বিশেষ সম্প্রদায়ের লোকজনকে ধরে ধরে এনকাউন্টারে মেরে ফেলা অথবা বুলডোজার চালিয়ে তাদের ঘরবাড়ি ভেঙে দেওয়া। এই হল কালবিষের মোদ্দা ন্যারেটিভ।

এই সার্বিক পরিস্থিতিতেই তালিবানি সমাজ-সংস্কৃতি, ধর্মীয় মৌলবাদ, হিংস্র ব্রাহ্মণ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদ মিলে যাচ্ছে এক প্রবাহে, যা রক্তাক্ত, হিংস্র ও দানবিক। অতএব, এই সন্ধিক্ষণেই আমাদের অবস্থান ও পক্ষ নেওয়ার পালা। বেঁচে ওঠার নির্মল আকুতি। পিট সিগার’এর একটি গানের কলি ছিল: Which side are you on boys?/ Which side are you on…’


Friday, 10 October 2025

প্রলয়ের নন্দন: লাসলো ক্রাসনাহর্কাই

'তবু আমরা গল্প বলব'

শাহেদ শুভো



২০২৫ সালের নোবেল সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত লাসলো ক্রাসনাহর্কাই (László Krasznahorkai)-এর নাম উচ্চারণ করলেই মনে হয়, সময় যেন থেমে যায়। তাঁর লেখায় পৃথিবীটা যেন এক ধ্বংসপ্রায় সভ্যতার ধূসর মরুভূমি— যেখানে মানুষ, সময় ও ঈশ্বর, সব কিছুই অস্পষ্ট হয়ে মিশে যায়। এই লেখকের ভাষা যেমন ধীর, তেমনই গভীর; তাঁর বাক্য এক অনন্ত যাত্রা, যার শেষ নেই, শুধু প্রবাহ। আর সেই প্রবাহই পর্দায় জীবন্ত হয়ে ওঠে বেলা তার (Béla Tarr)-এর ক্যামেরায়।

বেলা তার ও লাসলো ক্রাসনাহর্কাই— এই দুই শিল্পী যেন একে অপরের আয়না। একজন শব্দ দিয়ে যে জগৎ সৃষ্টি করেন, অন্যজন ক্যামেরার নীরবতায় সেটিকে দৃশ্যরূপ দেন। তাঁদের কাজ শুধু শিল্প নয়, মানব সভ্যতার অস্তিত্ব নিয়ে এক গভীর দর্শনচর্চা। 

বেলা তার

নোবেল কমিটি ক্রাসনাহর্কাইকে পুরস্কার দেওয়ার সময় ঘোষণায় বলে: 'For his compelling and visionary oeuvre that, in the midst of apocalyptic terror, reaffirms the power of art.'। অর্থাৎ, প্রলয়ের ভেতর থেকেও তিনি শিল্পের শক্তিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। এই ‘apocalyptic terror’ (প্রলয়ের ভয়) ক্রাসনাহর্কাই'এর সাহিত্যের কেন্দ্রবিন্দু। তাঁর প্রতিটি উপন্যাসে, যেমন Sátántangó (The Melancholy of Resistance)'এ দেখা যায়, এক ভগ্ন সমাজ ও নিঃশেষ সময়, যেখানে মানুষ বাঁচে কিন্তু জানে না কেন!

তিনি লেখেন এমন এক পৃথিবীর কথা যেখানে বিশ্বাসের আলো নিভে গেছে, কিন্তু লেখক তবু জিজ্ঞাসা করেন, 'আর কিছুই যদি অবশিষ্ট না থাকে, তবে শিল্পের প্রয়োজন কি নেই?' এই প্রশ্নই তাঁকে আধুনিক সময়ের সবচেয়ে নৈরাজ্য-সচেতন অথচ গভীর এক মানবিক লেখকে পরিণত করেছে। তাঁর লেখার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য, তাঁর দীর্ঘ ও অবিরাম বাক্যপ্রবাহ। অনেক সময় একটি বাক্য কয়েক পৃষ্ঠা জুড়ে চলতে থাকে, যেন শ্বাসরোধকারী এক নদী, যেখানে পাঠককে সাঁতরে যেতে হয় ধীরে ধীরে। এ শুধু ভাষার অলংকার নয়, বরং এক ধরনের দর্শন। তাঁর লেখায় সময় ধীর, যেমন মানুষের মন ধীর হয় হতাশার মধ্যে; তাঁর গদ্যে বিরতি নেই, কারণ জীবনের প্রলয়ে বিরতির সুযোগও নেই।

এখানেই বেলা তার'এর ছবির সঙ্গে তাঁর মিল। বেলা তার'এর ক্যামেরাও ঠিক তেমনই ধীর, অনন্ত; একটি দৃশ্য কখনও দশ মিনিট ধরে চলে, কিন্তু তবুও তার ভেতরে এক অসীম তীব্রতা লুকিয়ে থাকে। হাঙ্গেরির এই দুই শিল্পীর সহযাত্রা ইউরোপীয় আধুনিক চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা।

ক্রাসনাহর্কাই'এর উপন্যাস Sátántangó (১৯৮৫) থেকেই শুরু হয় তাঁদের যৌথ যাত্রা। বেলা তার ১৯৯৪ সালে এই উপন্যাস অবলম্বনে সাত ঘণ্টার এক মহাকাব্যিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন: Sátántangó।


এই ছবিটি শুধু ধৈর্যের পরীক্ষা নয়; সময় ও স্থবিরতার দর্শন। গ্রামের মানুষের জীবনের অবক্ষয়, এক ভণ্ড ত্রাণকর্তার প্রতারণা এবং মানুষের অবিশ্বাস— সব মিলিয়ে ছবিটি এক ধর্মহীন পৃথিবীর প্রতিচ্ছবি। ক্যামেরা ধীরে হাঁটে, বৃষ্টি পড়ে, গরু হেঁটে যায়, সব কিছু এক প্রলয়োত্তর স্থবিরতায় ডুবে থাকে।

এরপর আমরা  পাই Werckmeister Harmonies (২০০০), যেখানে এক নৈরাজ্যময় শহর ও এক অজানা তিমির আগমন মানুষের মনোজগতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। বেলা তার ও ক্রাসনাহর্কাই এখানে একযোগে প্রশ্ন করেন, 'মানুষের সভ্যতা কি কখনও সুরে বাঁধা পড়েছিল?'

শেষে The Turin Horse (২০১১) হল তাঁদের দর্শনের পরিণতি— এক পিতা, এক কন্যা, একটি ঘোড়া ও এক শুষ্ক পৃথিবী। এ যেন ঈশ্বরের পরিত্যক্ত সময়ের গল্প, যেখানে জীবনের প্রতিটি নিঃশ্বাসই মৃত্যুর অনুশীলন। 

ক্রাসনাহর্কাই ও বেলা তার— উভয়ের কাজেই আছে এক অস্তিত্ববাদী সুর। তাঁদের পৃথিবী কালো-সাদা, কিন্তু তার ভেতর আলো আছে, সেই আলো মানুষ নয়, বরং অস্তিত্বের অনিবার্যতা। তাঁরা বলেন, মানুষ যতই সভ্যতা নির্মাণ করুক না কেন, তার ভেতরের একাকীত্ব থেকে পালাতে পারে না। বেলা তার একবার বলেছিলেন, 'My films are about the end— the end of stories, the end of people, the end of time.'। এই উক্তিটি যেন ক্রাসনাহর্কাই'এর সাহিত্যকেই প্রতিফলিত করে। দুজনেই বিশ্বাস করেন, শেষের মধ্যেই এক নতুন শুরু লুকিয়ে থাকে; মৃত্যু আসলে ধীর এক পুনর্জন্ম।

বেলা তার-এর ছবি ও ক্রাসনাহর্কাইয়ের সাহিত্য রাজনৈতিক নয়, কিন্তু গভীরভাবে রাজনীতির পরবর্তী এক সময়। তাঁদের জগতে রাষ্ট্র নেই, আদর্শ নেই, আছে কেবল মানুষ, যে নিজের ক্ষয় দেখতে দেখতে বেঁচে থাকে। হাঙ্গেরির সমাজতন্ত্র-উত্তর বিভ্রান্ত সময়, ইউরোপীয় মূল্যবোধের ভাঙন এবং আত্মপরিচয়ের সংকট— এ সবই তাঁদের শিল্পে প্রবাহিত। তাঁরা চিৎকার করেন না; নীরব থাকেন।  নীরবতাই তাঁদের প্রতিবাদ। তাই, লাসলো ক্রাসনাহর্কাই'এর নোবেল জয় শুধু সাহিত্য নয়, বরং চলচ্চিত্র ও দর্শনের জগতেও এক পুনর্মূল্যায়ন। তা প্রমাণ করে, আজকের শব্দ ও ছবির যুগে ধীরতা, নীরবতা ও চিন্তাই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে।

বেলা তার চলচ্চিত্র নির্মাণ বন্ধ করেছেন, কিন্তু তাঁর উত্তরাধিকার এখন ক্রাসনাহর্কাই'এর লেখার ভেতর বেঁচে আছে। তাঁদের শিল্পে আমরা দেখি এক অচল পৃথিবী, কিন্তু সেই স্থবিরতার মধ্যেও এক অনন্ত গতি, যেখানে সময় ধীরে বয়ে যায়, কিন্তু থেমে থাকে না। তাঁরা আমাদের শেখান, শিল্প মানে শুধু সৌন্দর্য নয়; শিল্প মানে অবক্ষয়ের সৌন্দর্য, নৈরাশ্যের নন্দন, প্রলয়ের ভেতর অর্থের অনুসন্ধান। তাঁদের কাজ আমাদের বলে, 'যদি সবকিছু শেষও হয়ে যায়, তবু আমরা গল্প বলব।' এই গল্পই মানবতার শেষ আশ্রয় এবং শিল্পই তার একমাত্র ভাষা।

ব্যক্তিগত ভাবে আমাদের শৈশবে সিনেমাকে 'বই' বলত, কারণ বাংলা সিনেমা ছিল উপন্যাস নির্ভর!  বেলা তার'কে আবিষ্কারের পর বুঝেছিলাম 'বই' বিষয়টা কী! যেন প্রতিটি দৃশ্যকল্প উপন্যাসের চরণ!!


Wednesday, 8 October 2025

উত্তরবঙ্গে এই বিপর্যয় কেন?

প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান বিনা রাস্তা নেই 

আবু সঈদ আহমেদ

অকুতোভয় ডাঃ ইরফান মোল্লা নাগরাকাটায় নিজের জীবন বাজি রেখে দড়ি ধরে ঝুলে ঝুলে চলেছেন ভূমি ধস ও বন্যায় আটকে পড়া বিপন্ন রোগীদের শুশ্রূষায়


এই প্রতিবেদনটি যখন লিখতে বসেছি, খবরে প্রকাশ, মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) সন্ধ্যে ৬-৩০ নাগাদ হিমাচল প্রদেশের বিলাসপুর জেলায় বার্থি গ্রামের কাছে যাত্রীবাহী একটি চলন্ত বাসের উপর প্রবল ভূমি ধসে অন্তত ১৮ জনের প্রাণ গেছে। বলাই বাহুল্য, বর্ষাকালে উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ, সিকিম ও ভুটানে ভূমি ধস, ক্লাউড বার্স্ট, ভূমিকম্প ও তুষার ধস নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৩ সালের কেদারনাথ বিপর্যয়, ২০২৩ সালের মাণ্ডি জেলার বন্যা এবং সিমলার ভবন ধস — এসব ঘটনা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ভয়াবহতাকে তুলে ধরে। পাশাপাশি, হিমালয় অঞ্চলে টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষ ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে আর জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অতি বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ভয়াবহ বিপদের কারণ হয়ে উঠছে।

এবারের এই সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের পার্বত্য-তরাই অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা ও ভূমি ধস গত কয়েক দশকের মধ্যে অন্যতম ভয়াল প্রাকৃতিক বিপর্যয় হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। ৪-৫ অক্টোবরের মধ্যে মাত্র ১২ ঘণ্টায় ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতে দার্জিলিং, কালিম্পং, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার ও আলিপুরদুয়ার জেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। দার্জিলিং জেলার মিরিক, সুকিয়াপোখরি, জোরেবাংলো ও নাগরাকাটা এলাকায় প্রায় ১০০টি ভূমি ধস হয় এবং বালাসন নদীর উপর দুধিয়া লোহার সেতু ভেঙে পড়ে, ফলে, মিরিক ও কার্শিয়াং-এর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। জাতীয় সড়ক ১০ ও ৫৫ সহ বহু গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়, সিকিম কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ৩২ জনের মৃত্যু হয়, যার মধ্যে নেপাল ও ভুটানের নাগরিকও ছিলেন। শতাধিক পর্যটক দুর্গাপূজার ছুটিতে আটকে পড়েন। এই বিপর্যয়ের জন্য ভুটানের তালা জলবিদ্যুৎ বাঁধ থেকে অতিরিক্ত জল ছেড়ে দেওয়া এবং তিস্তা নদীর জলস্তর হঠাৎ বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করা হয়েছে। তরাই অঞ্চলের জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার, এমনকি উত্তর দিনাজপুর জেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়; তিস্তা, তোর্সা ও কালজানি নদীর জলস্তর বিপজ্জনকভাবে বেড়ে গিয়ে বহু গ্রাম প্লাবিত করে, ময়নাগুড়ি, ধূপগুড়ি, ফালাকাটা, দিনহাটা ও তুফানগঞ্জ এলাকায় শতাধিক বাড়ি ধ্বংস হয় এবং হাজারও মানুষ ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। ইসলামপুর ও চোপড়ায় অতিবৃষ্টির ফলে রেল ও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, স্কুল ও সরকারি ভবন জলমগ্ন হয়, বিদ্যুৎ ও পানীয় জলের সরবরাহ ব্যাহত হয় এবং কৃষি ও স্থানীয় ব্যবসা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। 

দু-তিনদিনের এই ব্যাপক বিপর্যয়ে অন্তত ৩৬ জন মারা গেছেন বলে খবরে প্রকাশ। জল যত নামছে আরও লাশ মিলছে। প্রশাসন জরুরি ত্রাণ ও উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করলেও অপর্যাপ্ত নিকাশি ব্যবস্থা ও ভাঙাচোরা রাস্তার কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় লাগছে, যা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপ সৃষ্টি করে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলিকে ৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ, অস্থায়ী সেতু নির্মাণ, পর্যটকদের বিনামূল্যে হোটেল ও পরিবহন সুবিধা এবং জলে ভেসে যাওয়া নথিপত্র পুনরায় ইস্যুর জন্য বিশেষ ক্যাম্প ঘোষণার মাধ্যমে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করেন।

উত্তরবঙ্গ, নেপাল, সিকিম ও ভুটানের পার্বত্য অঞ্চলে সাম্প্রতিক সময়ে ধস, তুমুল বৃষ্টিপাত, আকস্মিক বন্যা এবং প্রাণহানির ঘটনা এক ভয়ঙ্কর বাস্তবতাকে তুলে ধরেছে। এই বিপর্যয়গুলো কি শুধুই প্রকৃতির রুদ্ররূপ, নাকি আমাদের অতি উন্নয়ন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং বনভূমি ধ্বংসেরই প্রতিফলন? গত ২৫ বছরে ভারতের পার্বত্য অঞ্চলে প্রায় ৩০ শতাংশ বনভূমি হারিয়ে গেছে। কলকারখানা, রিসর্ট, আবাসন প্রকল্প, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও পর্যটনের চাপ পাহাড়ি পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে। জোশীমঠ শহরে ভূমি ধসের ফলে তা 'সিঙ্কিং টাউন' হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে, যা মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ের জ্বলন্ত উদাহরণ।

সকলেই জানেন, পাহাড়ি অঞ্চলে ভূমিক্ষয় রোধ, জলধারণ, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে গাছপালা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বনভূমি না থাকলে পাহাড়ি ঢালুতে মাটি ধুয়ে যায়, ঝর্না শুকিয়ে আসে এবং প্রাণী-উদ্ভিদের আবাসস্থল লুপ্ত হয়। ভারত ও বাংলাদেশের বন সংরক্ষণ নীতিমালায় পাহাড়ি অঞ্চলে অন্তত ৫০ শতাংশ বনভূমি থাকা আদর্শ বলে বিবেচিত। ফরেস্ট সার্ভে অফ ইন্ডিয়া'র তথ্য অনুযায়ী, ভারতের মোট বনভূমির পরিমাণ বেড়েছে মূলত সমতল অঞ্চলে সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে। কিন্তু পাহাড়ি অঞ্চলে বন ধ্বংসের হার উদ্বেগজনক। এর ফলে ভূমিক্ষয়, জলধারণ ক্ষমতা হ্রাস, জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়া এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা বিপন্ন হওয়ার মতো ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। সাম্প্রতিককালে উত্তরবঙ্গ ও সংলগ্ন অঞ্চলে বিতর্কিত নির্মাণ প্রকল্পগুলোর মধ্যে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র, জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণ এবং পাহাড় কেটে হোটেল নির্মাণ এইসব অঞ্চলকে আচম্বিত দুর্ঘটনা, অযাচিত প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও বিপুল প্রাণহানির আশঙ্কার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

১৯৮০-এর দশক থেকে শুরু করে ২০০৬, ২০১১ ও ২০২৩ সালে সিকিমে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে, যার ফলে ব্যাপক ভূমি ধস ও অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে। ২০০৭ ও ২০১৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং, কালিম্পং ও জলপাইগুড়ি জেলায় প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে শতাধিক ভূমি ধস হয়, যা বহু মানুষের প্রাণহানি ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা ঘটায়। ২০২৩ সালের অক্টোবরে সিকিম ও উত্তরবঙ্গ অঞ্চলে অতিবৃষ্টি ও জলবিদ্যুৎ বাঁধ ভেঙে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়, যার ফলে ১৭ জনের মৃত্যু এবং জাতীয় সড়ক-১০ সহ বহু রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৬৮ সালের ঐতিহাসিক বন্যার পুনরাবৃত্তি হিসেবে ২০২৩ সালের বিপর্যয়কে বিবেচনা করা হয়, যেখানে তিস্তা নদীর জল বিপজ্জনকভাবে বেড়ে গিয়ে বহু সেতু ও বসতির ক্ষতি করে। ২০২৩ সালে সিকিমে দক্ষিণ লোনার্ক হিমবাহ বাঁধ ভেঙে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়, যার প্রভাবে পশ্চিমবঙ্গের কালিম্পং ও জলপাইগুড়ি জেলাও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ ছিল জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ও অপরিকল্পিত নির্মাণ, যা নদীর স্বাভাবিক গতিপথে বাধা সৃষ্টি করেছিল। এছাড়া চারধাম প্রকল্পের অধীনে পাহাড় কেটে টানেল নির্মাণ এবং জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের কাজও বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। কারণ, এইসব প্রকল্প ভূমি ধস প্রবণ এলাকায় পরিবেশগত সতর্কতা উপেক্ষা করে পরিচালিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বার বার সতর্ক করেছেন যে, এইসব অঞ্চলে অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ ও পর্যটনের সুবিধা বৃদ্ধির জন্য পাহাড়ের গঠন ও নদীর নিকাশি ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা তৈরি করছে।

ডঃ ইসফাক হুসেন মালিক ও ডঃ জেমস ডি ফোর্ড'এর গবেষণার বিষয় ছিল 'হিমালয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের ভঙ্গুরতা পর্যবেক্ষণ'। এই গবেষণাটি ২০১৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত একটি দীর্ঘমেয়াদী মূল্যায়ন, যা বিশেষ করে ভূমি ধস, বন্যা, গ্লেসিয়ার লেক আউটবার্স্ট (GLOF) এবং মানুষের বাস্তুচ্যুতি বিষয়ের উপর আলোকপাত করে। তাঁদের গবেষণাপত্রটি রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অফ সায়েন্সেস'এর জার্নাল Ambio'তে ২০২৪ সালে অনলাইনে প্রকাশ পায়। গবেষণায় উঠে আসে, 'জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রা পরিবর্তন পাহাড়ি অঞ্চলে বিপর্যয় বাড়াচ্ছে। পর্যটন, নারী ও আদিবাসী জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও বন ধ্বংস ভূমি ধসের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।' এর বিষময় ফলাফল-- স্বাস্থ্যঝুঁকি, মানসিক চাপ, অর্থনৈতিক ক্ষতি এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা।

২০২১ সালে World Development Perspectives জার্নালে ডঃ প্রবীণ ভূষাল ও তাঁর গবেষক দলের একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ পায় যার শিরোনাম ছিল: হিমালয় অঞ্চলে পরিবেশগত অভিবাসন। সেখানে তুলে ধরা হয় হিমালয় অঞ্চলে জলবায়ু-প্রভাবিত বাস্তুচ্যুতি ও অর্থনৈতিক সংকটের চিত্র। এই গবেষক দলে কবিরাজ অবস্থি ও জুড কিমেংসি'র মতো বিশিষ্ট বিজ্ঞানীরাও ছিলেন। তাঁদের বিবরণে জানা যায়, ভূমি ধস ও বন্যা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা ও কৃষি উৎপাদনে প্রভাব ফেলছে। শহরমুখি অভিবাসন বাড়ছে, যার ফলে নগর এলাকায় চাপ বাড়ছে। শ্রমশক্তির অভাব গ্রামীণ অর্থনীতিকে দুর্বল করছে। ২০২২ সালের আরেকটি গবেষণা অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার ৩৪ শতাংশ ভূমি ধস ঘটে হিমালয় অঞ্চলে। অপরিকল্পিত বসতি, বন উজাড় ও ভূতাত্ত্বিক গঠন ভূমি ধসের প্রধান কারণ। জলবায়ু পরিবর্তন ও নগরায়ণ ভূমি ধসের হার বাড়াচ্ছে।

এখনই সময় প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান গড়ে তোলার, না হলে এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি আরও ঘন ঘন, আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে। এই ভয়াল পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজন পরিকল্পিত বন সংরক্ষণ, স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ, পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন নীতি গ্রহণ এবং দুর্যোগ প্রস্তুতি। পরিকাঠামো নির্মাণে পরিবেশগত মূল্যায়ন বাধ্যতামূলক করা উচিত, যাতে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা পায়।


Saturday, 4 October 2025

পুজো অর্থনীতি থেকে জনতার ট্যাঁক

দেখার চোখটাকেই পালটাতে হবে

মালবিকা মিত্র



খবরে প্রকাশ, এ বছর দুর্গাপুজোর অর্থনীতি আনুমানিক ৬৫,০০০ কোটি টাকা ছুঁয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে— যার ৬৫-৭০ শতাংশ অবদান কলকাতার (উৎসবের আগে রেকর্ড বৃষ্টিপাত হওয়া সত্ত্বেও)। অর্থনীতিবিদ অজিতাভ রায়চৌধুরী বলেছেন যে গত বছরের তুলনায় এ বছরের পুজোর সময় অর্থমূল্যের দিক থেকে ব্যবসায়িক লেনদেন কমপক্ষে ৮-১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্রিটিশ কাউন্সিল দ্বারা ২০১৯ সালে পরিচালিত একটি সমীক্ষা কলকাতার দুর্গাপুজোর অর্থনীতিকে প্রায় ৩৩,০০০ কোটি টাকা হিসেবে ধার্য করেছিল। (টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ৪ অক্টোবর ২০২৫)।

খবরটি পড়ে আমার বান্ধবী শকুন্তলাকে মনে পড়ল। আমি ওকে কুন্তলা বলেই ডাকি। মন প্রাণ দিয়ে হৃদয় ঢেলে শিক্ষকতা করেছে। সেই মন প্রাণ আর আবেগ দিয়েই রাজনীতি-অর্থনীতি সব কিছু বুঝতে চেষ্টা করে। ও বলে, আমি রাজনীতি অর্থনীতির তত্ত্বকথা জানি না, রিকার্ডো, মার্শাল, অ্যাডাম স্মিথ, কেইনস, মার্কস কাউকে চিনি না, আমি বুঝি আমার সাহিত্য শিক্ষা আর বোধবুদ্ধি দিয়ে। ওর মতে, জাতীয় আয় যেমনই হোক না কেন, তা যদি শ্রাবণের ধারার মতো ঝরে না পড়ে, সমস্ত ভূমিকে সিক্ত না করে, কেবলমাত্র কিছু বিশেষ বিশেষ গর্তে জল জমা হয়, তাহলে সামাজিক বৈষম্য বাড়তে থাকে। সামাজিক অস্থিরতা বাড়ে। সামাজিক অপরাধ বৃদ্ধি পায়। সমস্ত বিপত্তির মূলে আছে বন্টনের অসাম্য। 

এ পর্যন্ত কুন্তলা যা বলে থাকে সেটা কম বেশি সকলেরই বোধগম্য, খুবই সাদামাটা কথা। কিন্তু এর পরের অংশটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কুন্তলার মতে, সব সময়েই যে সামাজিক আয় একটা শ্রাবণের ধারা হয়ে ঝরবে এমন নাও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে আমার দায়িত্ব, মানে আমার মতো সুবিধেভোগী শ্রেণির দায়িত্ব, তার বাড়তি সুবিধার অংশটি চারদিকে সমান ভাবে ছড়িয়ে দেওয়া। তাহলেই সমস্যা কমে আসে। যেমন, প্রতিটি বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট'এর পর সে কাজের মেয়ের বেতন বাড়ায়। তার প্রাত্যহিক রিকশা চালকের বেতন বাড়ায়। ভিখারি বা সাহায্যপ্রার্থীর বরাদ্দ বাড়ায়। সাধারণভাবে এতদিন যে রিকশা ভাড়া ১০ টাকা দিয়ে এসেছে, এখন সে ১২ বা ১৫ টাকা দেয়। স্কুলের অসহায় দরিদ্র ছাত্রীদের বইপত্র, পোশাক, ডাক্তার খরচ, তাদের বাড়িতে অসুস্থ মা-বাবার পথ্য জোগানো, সব করতে থাকে।

এর জন্য বহু মানুষের কাছে ওকে তো কম গালাগাল শুনতে হয়নি। কারণ, দশ টাকার রিকশা ভাড়াটা প্রতি বছর ইনক্রিমেন্ট আর ডিএ'র সুবাদে বাড়তে বাড়তে ২৫ টাকা হয়েছে। এখন ওই পাড়ায় গেলে রিকশাওয়ালা বলেন, এই বাড়িতে এলে ভাড়া বেশি দেয়। শুনে সওয়ারির রাগ হওয়ারই কথা। কুন্তলার বিশ্বাস, অর্থ যত গতিশীল হবে, মানে বাজারে রোল করবে, তত সকলের মধ্যে তা বিতরিত হবে ও জাতীয় আয় ছড়িয়ে পড়বে। ও দেখেছে, সাধারণভাবে শিক্ষকদের বেতন এখন এতটাই ভদ্রস্থ যে, ইনক্রিমেন্ট বা মহার্ঘ ভাতা বাড়লে জিপিএফ'এ তাঁরা সঞ্চয়ের পরিমাণ বাড়িয়ে দেন। আবার এও দেখা গেছে, সেই বর্ধিত অর্থ অঞ্জলি জুয়েলার্স বা পিসি চন্দ্রে গিয়ে জমা হয়। উইক-এন্ডে বেশি বেশি আনন্দ-ফূর্তি, গাড়ির মডেল পাল্টানো, নিত্যনতুন ধাবায় গমন, এসবের পেছনে ব্যয় হয়। মাঝে মাঝেই বন্ধু-বান্ধবদের ডেকে এনে কিছু আনন্দফূর্তির অনুষ্ঠান, যার পোশাকি নাম পার্টি। এগুলিতেই অর্থ আটকে যায়। তাই ওর ছোট বুদ্ধিতে বুঝেছে, অর্থকে ছড়িয়ে পড়তে হবে, গড়িয়ে যেতে দিতে হবে, তবেই বাজার সচল হয়, সবার হাতে অর্থ পৌঁছয়।

আমফানের পর বা কোভিড লকডাউন পর্বে দেখেছি, সরকারি সাহায্যের পাশাপাশি আমার বান্ধবী নিজে মানুষের কাছে নানাবিধ সাহায্য পৌঁছে দিয়েছে। সরকার তো চাল ডাল তেল নুন ডিম এসব বিতরণ করেছে। আর আমার বান্ধবী ভিন্ন জাতীয় শুকনো খাবার, বিস্কুট, চিঁড়ে ভাজা, মুড়ি, ছোলা ভাজা, বাদাম ভাজা, গুঁড়ো দুধ এবং সকলের প্রয়োজনীয় ওষুধ যা নিত্য সেবন করতে হয়, সেগুলো বিতরণ করেছে। বাড়ির দুই কাজের মেয়েকে সবেতন ছুটি করে দিয়েছে কোভিড পর্বে। এর ফলে অন্যান্য বাড়িতে যে সব কাজের মহিলারা আসেন, তাঁরাও ছুটির দাবি বা আবদার শুরু করেন, যেটা গৃহকর্ত্রী ও কর্তাদের পক্ষে খুবই অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। 

ও বলে, আমরা তো ক্লাসে পড়াই কামিনী রায়ের কবিতা 'সুখ': 'আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে/ আসি নাই কেহ অবনী 'পরে,/ সকলের তরে সকলে আমরা,/ প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।' এই কথার অনেক ব্যাখ্যা করেছি ক্লাসে। উদাহরণ দিয়েছি। কিন্তু আমার কাছে পরে জলজ্যান্ত উদাহরণ হিসেবে হাজির হয়েছে স্কুলের ক্লাস লীগের ফুটবল খেলায় মাঠের দৃশ্য। সেখানে ক্লাসের শেষ মেধার ছাত্রটি আর উচ্চ ও মধ্য মেধার ছাত্রটি মিলেমিশে মাঠে বল আদানপ্রদান করে। আর যারা খেলায় অংশ নিতে পারে না, তারাও কি প্রবল উৎসাহে মাঠের বাইরে বন্ধুদের উদ্যম সঞ্চার করে। ওয়াটার বটলে ছোট ছোট স্টোন চিপস ভরে, মুখ আটকে সারা মাঠে ঝনঝন আওয়াজে মুখরিত করে। মাঠে কোনও সহপাঠী খেলোয়াড় আঘাত পেলে, মাঠের বাইরে এনে তাকে কী পরম যত্নে শুশ্রূষা করে। এমনকি যে ছাত্রের বাবা বা মা, ডাক্তার, নার্স ইত্যাদি পেশায় যুক্ত, তারা অতিরিক্ত ফার্স্ট এইড'এর বন্দোবস্ত করে আনে।

শিক্ষকতা থেকে অবসর গ্রহণের পর বেতনের অর্ধেক হয়ে গেছে পেনশন। প্রশ্ন করেছিলাম, এখন ওই সমস্ত সামাজিক ক্রিয়াকর্ম চালাস কী করে? উত্তরে বলেছে, এখন আর করার সুযোগ কোথায়? স্কুল থেকেই বইপত্র, পোশাকআশাক, দুপুরের আহার সব পায়। এমনকি জুতো সাইকেল সরকারি আবাস প্রকল্প পর্যন্ত; এখন চারিদিকে ছাদের বাড়ি ফলে কোনও ঝড়ঝাপটা হলেই যে বাড়ি মেরামতের জন্য সাহায্য দিতে হত সেটাও লাগে না। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, বিয়ের জন্য রূপশ্রী, ছাত্রীদের জন্য কন্যাশ্রী এবং আরও উচ্চ শিক্ষার জন্য ব্যাঙ্কের লোন, এছাড়াও বিধবা ভাতা, বার্ধক্য ভাতা, এইসব মিলিয়ে মানুষের হাতে কিছু পয়সা পৌঁছচ্ছে। ফলে, আমি সামান্য সামর্থ্যে যে কাজগুলো করতাম, সেগুলো এখন সরকার নিজেই করে দেয়। তাহলে সেই বিচারে আমার আয় বেড়েছে। পেনশন বেতনের অর্ধেক হয়েছে এটা যেমন সত্য, তেমনই আমার বিরাট পরিমাণ ব্যয়ভার এখন সরকার বহন করে। সেই কারণেই আমি মনে করি, ডিএ না দিলেও সরকার আসলে ডিএ দিচ্ছে। অবশ্যই জিপিএফ'এ কাটানো বা উইক-এন্ডে মস্তি করার জন্য নয় । 

আমি বললাম, চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্য সাথী কার্ড তো সব হাসপাতালে গ্রহণ করে না। তখন কুন্তলা তার অভিজ্ঞতার কথা বলল। তার এক ছাত্র নিজের জ্যাঠামশাইকে নিয়ে কলকাতার নানা বেসরকারি হাসপাতালে ঘুরেছে ভর্তির জন্য। অনেক জায়গায় তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। সেই ছাত্র বলেছে, জানেন রেশন কার্ডটা যেমন কাজে লাগে না, কিন্তু একটা জোরের জায়গা আছে, বাজারে চালের দাম কেউ ২০০ টাকা চাইতে পারবে না। কারণ, আমার কাছে বিকল্প আছে রেশনের চাল। এখানেও স্বাস্থ্য সাথী কার্ডটা থাকার ফলে একটা বার্গেনিং ও আর্গুমেন্ট করার ক্ষেত্র আছে। শেষ পর্যন্ত এক জায়গায় স্বাস্থ্য সাথী কার্ডেই ভর্তি করা হয়েছে। মনে রাখতে হবে, কার্ডটা একটা অধিকার দিয়েছে, কিন্তু এই অধিকারকে আদায় করার অস্ত্র, কৌশল ও নাছোড় প্রচেষ্টা থাকা দরকার। ভাবা যায়, আমার পরিবারে তিনজন রোগীর ওষুধের মোট ব্যয় ছিল এখনকার অর্থমূল্যে ৯০০০ টাকা প্রতি মাসে। সরকারের ফেয়ার প্রাইস শপ'এর কল্যাণে সেই খরচটা এখন লাগে ৩০০০ টাকা। আমার পা ভাঙলো, অপারেশন করতে হল, ইনপ্ল্যান্টস বসানো হল, হাসপাতাল থেকে ছুটির সময় একটি পয়সাও বিল হল না। বরং আমার যাতায়াত বাবদ ২০০ টাকা নগদ হাতে ধরালো। এছাড়াও পাঁচ দিনের ওষুধ দিয়ে দিল। 

কুন্তলার কথা শুনে আমি বললাম, তুই যা বলছিস এসব শুনলে তো লোকে তোকে 'চটিচাটা' বলবে। শুনে কুন্তলা বলেছিল, ১৯৮২ সালে আমার বাবার মৃত্যুর পর তাঁর পেনশন পেতে ১৯৯২ সাল হয়ে গিয়েছিল। আমার কত জোড়া চটির সোল ক্ষয়ে গেল তার হিসেব নেই। আর আমি রিটায়ার করার পর জুলাই মাসে শেষ বেতন পেলাম আর অগস্ট মাসে পেনশন চালু হল। একদিনের জন্যও আমাকে বসে থাকতে হয়নি। একদিনের জন্যও ডিআই অফিস যাইনি। পিপিও এসে হাজির, নিয়ম মতো একাউন্টে পেনশন জমা পড়ল। আমার পেনশনটা পেতে গিয়ে কাউকে কোথাও এক কাপ চা-সিগারেট খাওয়াতে হয়নি। এই সত্যটাকে আমি স্বীকার করবই। তার ফলে যদি আমাকে 'চটিচাটা' বলা হয়, আমি সে কথা আনন্দে নতমস্তকে গ্রহণ করব। সরকারের কোষাগার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সরকারি চাকরিজীবীদের পৈতৃক সম্পত্তি নয়। এই কোষাগার আমাকে যেমন মহার্ঘ ভাতা দেবে, বেতন দেবে, তেমনই যে মানুষ চাকরিজীবী নয় তার হাতেও নানা প্রকল্পের মধ্য দিয়ে কিছু অর্থ পৌঁছে দেবে। কারণ, এই কোষাগারটি পূর্ণ করার ক্ষেত্রে প্রতিটি মানুষেরই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অবদান আছে। নানাবিধ 'শ্রী' প্রকল্পকে অনেকে ভিক্ষা বলে বিদ্রূপ করেন; এই ভাতা ভিক্ষা নয়, এগুলি অধিকার। 

কুন্তলা তার পাণ্ডিত্য ও মেধা দিয়ে নয়, হৃদয় ও আবেগ দিয়ে সমস্যা বুঝতে চেয়েছে এবং সম্ভবত বুঝতে পেরেছে।

অর্থের এই ছড়িয়ে পড়ার রাজনৈতিক তাগিদ থেকেই দুর্গাপুজোর অর্থনীতির আজকের রমরমা। ফলে, আমাদের প্রত্যক্ষ দায় কমছে, প্রকৃত আয় বাড়ছে। আসলে, অর্থনীতিকে দেখার চোখটাকেই এবার পাল্টে ফেলার সময়। ২০২৪'এ Nobel Memorial Prize in Economic Sciences বিজয়ী দুই অর্থনীতিবিদ James A. Robinson ও Daron Acemoglu রচিত 'Why Nations Fail: The Origins of Power, Prosperity And Poverty' পুস্তকে বলছেন: 'Explaining world inequality still needs economics to understand how different types of policies and social arrangements affect economic incentives and behavior. But it also needs politics.'


Sunday, 28 September 2025

নিজ অন্ধকারে আলো খুঁজতে

এক অন্তহীন রঙের মহাকাব্য

অয়ন মুখোপাধ্যায়



দুর্গা কেবল এক পৌরাণিক দেবী নন, তিনি আসলে এক বর্ণময় প্রতীক। তাঁর প্রতিমায়, শাড়িতে, চোখের ভেতর, বিসর্জনের জলে— সর্বত্রই রঙ কথা বলে। দুর্গাপুজো তাই কেবল ধর্মীয় আচার নয়, এক বিশাল রঙের দর্শন। প্রতিটি রঙের ভেতরে লুকিয়ে থাকে মানুষের অবচেতন, সমাজের ইতিহাস, শিল্পের নন্দনতত্ত্ব আর দার্শনিক প্রতিফলন।

লাল দিয়ে শুরু করা যাক। দেবীর শাড়ি, সিঁদুর, বিসর্জনের সিঁদুরখেলা— সবখানেই লাল। লাল মানে রক্ত, আগুন, শক্তি। মনোবিজ্ঞানে লাল এক দ্ব্যর্থক প্রতীক— একদিকে কামনার উত্তাপ, অন্যদিকে হিংসা আর ভয়। ফ্রয়েডের চোখে এই লাল আমাদের দমিত আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ। সিঁদুরখেলায় মহিলারা যখন একে অপরকে লালে ঢেকে দেন, তখন অবচেতনের কামনা সামাজিক রূপ নেয়। আবার দেবীর হাতে লাল ত্রিশূল মানে ধ্বংসের আগুন। যুদ্ধ আর প্রেমের এক অদ্ভুত মিশ্রণ লালের ভেতরে। জুং বলতেন, লাল হল archetypal রঙ— শক্তি, জীবনশক্তি, প্রজননশক্তির প্রতীক। মহিষাসুরের রক্ত লালে ভেসে ওঠে এই archetype-এর ছাপ।

সাদা দেবীর আরেক মুখ। তাঁর চোখের সাদা, শঙ্খের সাদা, প্রসাদের খিচুড়ির সাদা— সবই শান্তির প্রতীক। কিন্তু সাদা মানেই আবার শূন্যতা। বিসর্জনের পরে নদীতে ভেসে থাকা সাদা বুদবুদ যেন সেই অনুপস্থিতির প্রতীক, যা আমাদের তাড়া করে। লাকাঁ বলতেন, দেবী আসলে সেই অনুপস্থিতির রূপ, যিনি থাকেন আবার থাকেন না। ফ্রয়েডের ভাষায়, সাদা মৃত্যুরও প্রতীক— অবচেতনের গভীর ভয়। অথচ দুর্গার সাদা শান্তির ভেতরে সেই ভয়কেও আশ্রয় দেওয়া হয়।

হলুদ মানে আলো। প্রদীপের শিখা, গাঁদা ফুল, ধূপের ধোঁয়া— সবকিছুতেই হলুদ উজ্জ্বলতা। মনোবিজ্ঞানে হলুদ আনন্দের প্রতীক, আবার কখনও অস্থিরতারও। জুং বলতেন, হলুদ সূর্যের প্রতীক, যা আলো দেয়, আবার জ্বালায়ও। দুর্গার হলুদ মানে সেই দ্ব্যর্থক আলো। কৃষির সঙ্গেও হলুদ যুক্ত। শরৎকালে ফসল পাকে, মাঠে ধানের শীষ হলুদ হয়ে ওঠে। দেবীর আগমন তাই কৃষিজীবনের উৎসবেরও প্রতীক।

সবুজ মানে প্রকৃতি আর পুনর্জন্ম। কাশবন, কলাপাতা, প্যান্ডেলের সাজ— সবুজের উপস্থিতি। সবুজ মানে নবজীবন, শরতের পুনর্জন্ম। ফ্রয়েড বলবেন, সবুজ হল দমিত জীবনশক্তির বহিঃপ্রকাশ। জুং বলবেন, সবুজ এক archetypal রঙ, পুনর্জন্মের প্রতীক। কিন্তু সবুজ কেবল প্রকৃতির নয়, রাজনীতিরও রঙ। পতাকা, কৃষক আন্দোলন, ধর্মীয় প্রতীকের সঙ্গেও সবুজ জড়িত। দুর্গার সবুজ তাই প্রকৃতি ও রাজনীতির দ্বৈত প্রতীক।

নীল রঙ দুর্গার আরেক রহস্য। আকাশের নীল, নদীর নীল, প্রতিমার চোখের নীল আভা। নীল মানে অসীমতা, শান্তি, গভীরতা। কিন্তু নীল মানেই আবার বিষাদ। বিসর্জনের সময় প্রতিমার প্রতিফলন যখন নদীর নীল জলে ভেসে ওঠে, তখন আনন্দের সঙ্গে বিষাদও এসে মেশে। লাকাঁ বলবেন, নীল হল সেই অনন্ত শূন্যতা, যা আমাদের অস্তিত্বের অংশ। জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, 'নীল নির্জনে ঝরে পড়ে বকুল ফুল।' দেবীর নীল চোখ যেন সেই নির্জনেরই প্রতিচ্ছবি।

কালো হল অন্ধকারের প্রতীক। দেবীর ভ্রূকুটি, রাতের ছায়া, মহিষাসুরের দেহ— সবই কালো। কালো মানে মৃত্যু, ভয়, আবার একইসঙ্গে সম্ভাবনারও প্রতীক। ফ্রয়েড বলবেন, কালো আমাদের অবচেতন ভয়। জুং বলবেন, কালো shadow archetype— আমাদের ভেতরের অন্ধকার। মহিষাসুর সেই shadow, যাকে দেবী দমন করেন। কিন্তু কালো শুধু ভয়ের নয়, সৃজনশীলতারও প্রতীক, কারণ, অন্ধকার থেকেই আলো জন্ম নেয়।

অতএব, দুর্গা এক বহুরঙা দেবী। লাল তাঁর কামনা আর শক্তি, সাদা তাঁর শান্তি আর শূন্যতা, হলুদ তাঁর আলো আর অস্থিরতা, সবুজ তাঁর প্রকৃতি আর রাজনীতি, নীল তাঁর গভীরতা আর বিষাদ, কালো তাঁর ভয় আর সম্ভাবনা। প্রতিটি রঙ তাঁর মধ্যে প্রতিফলিত, প্রতিটি রঙ আমাদের মনের গভীরে প্রতিধ্বনিত। ফ্রয়েড'এর চোখে এই রঙগুলো আমাদের দমিত প্রবৃত্তি আর আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ। জুং বলবেন, এগুলো archetype— চিরন্তন প্রতীক, যা সমষ্টিগত অবচেতনে গেঁথে আছে। লাকাঁ বলবেন, দেবীর রঙ আসলে সেই অনুপস্থিতির খেলা, যা আমাদের পূর্ণ করে আবার শূন্যতায় ফেলে।

বাংলা সাহিত্যেও দেবীর রঙ বারবার ফিরে এসেছে। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় লাল মানে প্রেম, সাদা মানে মৃত্যু। জীবনানন্দের কবিতায় নীল মানে melancholy। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় লাল মানে উন্মাদনা, কালো মানে ভয়। শিল্পকলায়ও রঙের খেলা স্পষ্ট— পটচিত্রে লাল, জমিদারবাড়ির প্রতিমায় সাদা, আধুনিক থিম প্যান্ডেলে নীল আলো। প্রতিবারই রঙ আমাদের নতুন মানসিক অভিজ্ঞতা দেয়।

শেষ পর্যন্ত দুর্গাপুজো মানে এক রঙের নাট্যমঞ্চ। নদীর জলে প্রতিমার প্রতিফলন, লাল সিঁদুরের আগুন, সাদা শঙ্খের শূন্যতা, হলুদ প্রদীপের আলো, সবুজ কাশবন, নীল আকাশ, কালো অন্ধকার— সব মিলে দেবী আমাদের ভেতরের আলো-ছায়া দেখান। তিনি কেবল দেবী নন, তিনি আমাদের রঙ-মনোবিশ্লেষণের আয়না। আমরা তাঁকে পূজা করি, আসলে নিজেদের ভেতরের রঙ খুঁজতে।

যেন এক কাব্যিক সমাপ্তি...

হয়তো কোনও বিসর্জনের রাত, নদীর জলে প্রতিমার প্রতিফলন ভেসে যাচ্ছে। লাল আলো ছড়াচ্ছে ঢাকের শব্দে, সাদা ফেনায় ভাঙছে চাঁদের ছায়া, হলুদ প্রদীপ নিভে আসছে, সবুজ পাতা দুলছে বাতাসে, নীল জলে ডুবে যাচ্ছে চোখের দৃষ্টি, কালো অন্ধকার গিলে ফেলছে সবকিছু। কিন্তু ওই ভেতরেই দেবী রয়েছেন। রঙে রঙে, আলোতে আর ছায়ায়, কামনা আর শূন্যতায়, মৃত্যু আর জন্মের অদৃশ্য যাত্রায়। তিনি আসলে এক অনন্ত রঙ, যিনি আমাদের ভেতরেই আঁকা।

আমরা তাঁকে পূজা করি আসলে নিজেদের ভেতরের রঙকে চিনতে, নিজেদের অন্ধকারে আলো খুঁজতে। দুর্গা তখন হয়ে ওঠেন এক অন্তহীন রঙের মহাকাব্য, যেখানে প্রতিটি মানুষের চোখে প্রতিফলিত হয় লাল, সাদা, হলুদ, সবুজ, নীল, কালো। আর সেইসব মিলিয়ে তৈরি হয় এক অদৃশ্য দেবী, যিনি নদীর জলে ভেসে যান, আবার আমাদের হৃদয়ে থেকে যান চিরকাল।


Saturday, 27 September 2025

সকলেই উদ্বাস্তু হব!

প্রকৃতি এবার বদলা নেবে

সুব্রত কুণ্ডু



সুন্দরবন। মৌসুনি দ্বীপ। ২০০৯-এর আয়লা ঘূর্ণিঝড়ের পরেও এই দ্বীপের একটি অংশে বাস করতেন কিছু হত দরিদ্র পরিবার। কিন্তু ২০২১-এ গিয়ে তাঁদের কোনও হদিস পাননি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। তাঁদের বক্তব্য, নিরন্তর ছোট, বড় নানা ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপে ভিটে-মাটি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে পরিবারগুলি। ঘন ঘন এই ঘূর্ণিঝড়ের কারণ জলবায়ু বদল। 

কাজের জন্য সারা সুন্দরবনেই ঘুরেছি। দেখেছি, ভিটে-মাটিহারা মানুষের হাহাকার। কান্না। মন ভারী হয়েছে বারবার। সারা পৃথিবীতে চরম আবহাওয়ায় উদ্বাস্তুর সংখ্যা বাড়ছে। বেড়েই চলেছে।

কিরিবাস দ্বীপ রাষ্ট্র। মোট ৩৩টা দ্বীপ নিয়ে এই রাষ্ট্র। প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যবর্তী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই ও অস্ট্রেলিয়ার প্রায় মাঝামাঝি, বিষুবরেখা এবং আন্তর্জাতিক তারিখ রেখার (বা ডেট লাইনের) ওপর অবস্থিত। বর্তমানে রাষ্ট্রটির কুড়িটি দ্বীপে মানুষের বসবাস। ২০২০ সালের গণনা অনুযায়ী জনসংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার। কার্বন নির্গমন সব থেকে কম। খুবই দরিদ্র দেশ। দেশটির মানুষ এখন ভয়ঙ্কর সংকটের সম্মুখীন। কারণ, জলবায়ু বদল। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি দ্বীপের কিছু অংশ ডুবে গেছে। বাকিটা ডুবে যাওয়ার অপেক্ষায়। সম্ভবত দেশটাই কিছুদিনের মধ্যে সমুদ্রে তলিয়ে যাবে। সেখানকার নাগরিকরা তাই ফিজি এবং নিউজ়িল্যান্ডে গিয়ে বসবাস করছেন উদ্বাস্তু হয়ে। তাঁদের ছবি দেখেছি। কিরিবাসী মানুষের ভয়ার্ত মুখ, হাহাকার, কান্নার মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই সুন্দরবনের ভিটেহারা মানুষের কান্না, হাহাকারের সঙ্গে। 

কলকাতা। সোমবার রাতে আকাশভাঙা বৃষ্টিতে পুরো শহরই জলমগ্ন। মূল শহরে বরাবরই জল জমে। আবার বৃষ্টি থামলে নেমেও যায়। পশ্চিম দিকে হুগলী নদী হলেও শহরের ঢাল পূর্ব দিকে। তাই পূবের জলাভূমি কলকাতার জল নিকাশের প্রধান মাধ্যম। তবুও ইএম বাইপাসের ধারে আয়লার সময় জল জমেনি। আমফানের সময় গলি-ঘুপচিতে সামান্য জল জমলেও বড় রাস্তা বা আবাসনের মধ্যে জল জমেনি। অসংখ্য খাল, নালা, বিল, পুকুরের মাধ্যমে বৃষ্টির শহর ধোয়া জল গিয়ে পড়েছে জলাভূমিতে, সেখান থেকে সুন্দরবনের দিকে বয়ে গেছে বিদ্যেধরী নদী হয়ে। পূবের এই জলাভূমি হল শহরের কিডনি।

বৃহস্পতিবার সকালে ফোন ঘাঁটতে গিয়ে দেখলাম, বাইপাসের সেরা এক আবাসন, যেখানে কলকাতা শহরের খ্যাতনামা ব্যক্তিরা থাকেন, ওপরতলার নীতিকার, স্থপতিরা থাকেন, সেখানকার আমার এক পরিচিত সত্তরোর্ধ অগ্রজ ও তাঁর স্ত্রী এবং এইরকম ৬-৭টি পরিবার ‘টাটা হাতি’ চড়ে চলেছেন। ভাবলাম, দুর্গা পুজোর সময় হয়তো ঠাকুর আনতে চলেছেন। ফোন করলাম— এই বয়সে কেন ওইরকম একটা গাড়ি চড়ে চলেছেন ঠাকুর আনতে! প্রায় আর্তনাদের সুরে বললেন, ঠাকুর আনতে! তুমি জানো গত দু' দিন ধরে নীচে ৪-৫ ফুট জল। ইলেক্ট্রিসিটি নেই। লিফট বন্ধ। ফ্রিজে খাবার পচে গেছে। ফোনের চার্জ শেষ। পুরো আবাসন জলমগ্ন। ওপর থেকে দেখলে মনে হচ্ছে একটা গামলার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের জীবন সংকটে। তাই আজ কোনওক্রমে জল ঠেঙিয়ে, এক গাদা পয়সা খরচ করে আত্মীয়ের বাড়ি এসে উঠেছি। আমরা এখন উদ্বাস্তু। প্রায় এক নিঃশ্বাসে কথাগুলি বলে গেলেন। 

উদ্বাস্তু— কথাটা চাবুকের মতো লাগল। অপ্রস্তুত হয়ে হাবিজাবি কয়েকটা কথা বলে ফোন রেখে দিলাম। ওপরতলায় থাকা এই মানুষের আর্তনাদের সঙ্গে সুন্দরবনের মানুষের হাহাকারের কোনও পার্থক্য আছে বলে মনে হল না। শুনলাম, বাইপাসের দু’ ধারে তৈরি ঝাঁ-চকচকে আবাসনের বেশ কয়েকটির একইরকম জলমগ্ন অবস্থা। 

জল জমে কেন? কারণ নিকাশি বেহাল বলে। চাষের জমির ক্ষেত্রেও এটা সত্যি। কলকাতা শহরের ক্ষেত্রেও সত্যি। জল জমে কেন? কারণ আমরা জমাই বলে। কংক্রিট ফেলে। বাঁধ বেঁধে। নদীর চলার পথ আটকে। বিদ্যুৎ, সেচের জল আর বন্যা নিয়ন্ত্রণের অর্ধসত্য প্রতিশ্রুতি দিয়ে। জল জমে কেন? কারণ আমরা জমাই বলে। খাল, বিল, জলা, পুকুর বুজিয়ে। প্রাণ-প্রকৃতির জলা-জংলা নষ্ট করে, ইট কাঠ পাথরের অনিয়ন্ত্রিত জঙ্গল তৈরি করে। মানুষকে নগর বসতির সুবিধার মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে। উদাহরণের কোনও শেষ নেই। তবে, প্রকৃতি শোষণে যাদের কোনও ভূমিকা নেই, যারা জীবন-জীবিকার স্বার্থে প্রকৃতি বা পরিবেশ বাঁচিয়ে কোনওক্রমে টিকে রয়েছে, সেই নির্দোষ মানুষগুলিকেই প্রকৃতির রোষের প্রথম মূল্য চোকাতে হয়। কিন্তু পর পর কয়েকটা ঘটনা প্রমাণ করছে, ধীরে ধীরে এই রোষ গ্রাস করছে ওপরতলার মানুষকেও। 

জলবায়ু উদ্বাস্তুর ক্ষেত্রে এটাই বাস্তবতা। 'ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টার'এর তথ্য অনুসারে, ২০০৮ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে বন্যা, ঝড়, দাবানল ও খরার মতো আবহাওয়া-সম্পর্কিত ঘটনাগুলির কারণে প্রতি বছর গড়ে ২ কোটি ১৫ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ২০২২ সালে এই সংখ্যা রেকর্ড ৩ কোটি ২৬ লক্ষে পৌঁছেছিল। আন্তর্জাতিক 'থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ইন্সটিটিউট অফ ইকোনমিক্স অ্যান্ড পিস' নানা হিসেব-নিকেশ করে দেখেছে, এই সংখ্যা আরও অনেক বাড়বে। তারা বলেছে, চরম আবহাওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি এবং জলবায়ু বদলের কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে সারা বিশ্ব জুড়ে ১২০ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে। 

জলবায়ু বদলের ফলে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলির মধ্যে অন্যতম হল সুন্দরবন। এই বন আবার লাগোয়া কলকাতা এবং তার আশেপাশের আধা-শহর এবং গ্রামীণ এলাকার ফুসফুস বলে চিহ্নিত। সেই ২০১০ সালে 'ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচার' এবং ২০১১ সালে বিশ্ব ব্যাংক তাদের গবেষণা রিপোর্টে জানিয়েছিল, সুন্দরবন বিপর্যস্ত হলে কলকাতা শহরের অস্তিত্বও সংকটে পড়বে। ২০১৫ সালের ১২ মার্চ 'ডেকান হেরাল্ড' পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, জ্বালানি ব্যবহারের ধরন অনুসারে ভারতের ২৫টি শহরের মধ্যে কলকাতায় কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের মাত্রা সবচেয়ে বেশি। প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছিল, কলকাতা এশিয়ার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ চতুর্থ শহর। আর জলবায়ু বদলের ঝুঁকি মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে কম প্রস্তুত শহরগুলির মধ্যে তৃতীয় স্থানে রয়েছে কলকাতা।

ব্রিটিশ ডেপুটি হাইকমিশন এবং কলকাতা মিউনিসিপ্যাল ​​কর্পোরেশন যৌথ উদ্যোগে তুলনামূলক কম কার্বন নির্গমন এবং জলবায়ু সহনশীল কলকাতার জন্য ২০১৫ সালে একটি ‘রোডম্যাপ’ তৈরি করেছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির তালিকায় কলকাতা শহরটি সপ্তম স্থানে এবং বন্যার ক্ষেত্রে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। রোডম্যাপটিতে ১২ ধরনের কার্যক্রমের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল; তার মধ্যে ছিল দুর্যোগের জন্য প্রস্তুতি, জলবায়ু বদলরোধী পরিবহন ব্যবস্থা, সবুজ ভবন তৈরি এবং তার প্রচার ও প্রসার, সম্ভাবনাময় ৩২০,০০০ মিলিয়ন লিটার বৃষ্টির জল সংগ্রহ, জলবায়ু সহনশীল ভূমি ব্যবহার, কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নতি, বিদ্যুতের জন্য সৌর প্যানেলের ব্যবহার, শক্তির দক্ষ ব্যবহার, সবুজ জীবিকার জন্য ব্যবসায়িক পরিকল্পনা, পৌরসংস্থার জলবায়ু পরিবর্তন সেলের মাধ্যমে ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য তথ্য এবং জ্ঞান বিনিময়, ওয়ার্ড-ভিত্তিক জলবায়ু বদলের ফলে তৈরি বিপর্যয়ের মোকাবিলার পরিকল্পনা। শোনা যাচ্ছে, সম্প্রতি শহরের জন্য নাকি আরও একটি জলবায়ু পরিকল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু এসবের প্রয়োগ কে করবে, কীভাবে হবে? কারণ, চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী।  

অতি লাভ ও লোভের অর্থনীতি এবং সম্পদশালীদের কাণ্ডজ্ঞানহীন ধান্দার আদর্শে আত্মমগ্ন হয়ে রয়েছি আমরা। সাম্প্রতিক অতিমারির মাধ্যমে প্রকৃতি আমাদের বুঝিয়েছে, অতি বাড় ভালো নয়। তবুও অ্যানথ্রোপোসিন কালে আমরা ভাবছি প্রকৃতি হল লুঠের মাল। তাই তার টানাবানা নষ্ট করে আমরা নগর বসিয়ে চলেছি। প্রাণ-প্রকৃতি তাই বদলা নিচ্ছে। পাঞ্জাব, হিমাচল, উত্তরাখণ্ডের নদী শাসনকে ভেঙে তছনছ করে দিচ্ছে প্রকৃতি। কলকাতায় আকাশভাঙা বৃষ্টিও সেরকমই একটি সূচক। প্রকৃতি বলছে, বদল চাই, বদল। না শুনলে বদলা হবে। আর তাই প্রকৃতি লুঠের এই ধান্ধা বন্ধ না করতে পারলে আমরা সকলেই উদ্বাস্তু হব। কেউ আগে কেউ পরে।


Tuesday, 16 September 2025

দেশপ্রেম Incorporated

খেলার মাঠে কি মঞ্চস্থ হচ্ছে নাটক?

অয়ন মুখোপাধ্যায়



'Cricket is a gentleman’s game'— এক সময় এভাবেই ক্রিকেটকে দেখা হত। ভদ্রতা, সৌজন্য, প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরও মানবিকতা— এগুলোই ছিল খেলার মর্ম। অথচ সাম্প্রতিক ভারত-পাক ম্যাচ শেষে ভারতীয় ক্রিকেটাররা যখন পাকিস্তানি খেলোয়াড়দের সঙ্গে হাত মেলাতে অস্বীকার করলেন, তখন সেই ঐতিহ্যকে যেন ছিঁড়ে ফেলা হল। শিষ্টাচারের সম্মান লুটিয়ে পড়ল।

অধিনায়ক সূর্যকুমার যাদব ও তাঁর দলের এই আচরণ নিছক আবেগের বহিঃপ্রকাশ নয়। এটা বড় এক প্রবণতার চিহ্ন। সাংবাদিক বৈঠকে তিনি পহেলগাঁও'এর প্রসঙ্গ টেনে নিজের অবস্থান বোঝানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু তা আসলে আত্মপ্রবঞ্চনা ছাড়া আর কিছু নয়। খেলার মাঠে খেলোয়াড়ি মনোভাবকে মেরে দেশপ্রেমের বকলমে অভিনীত হল এক নাটক।

ভারত-পাক ম্যাচ বহুদিন ধরেই 'হাই-ভোল্টেজ' মহারণ বলে প্রচার পায়। মিডিয়া থেকে বোর্ড কর্তা— সবাই মিলে এটাকে যুদ্ধের মতো করে তুলেছে। দর্শকের উত্তেজনা বাড়ে, বিজ্ঞাপনে টাকার স্রোত বয়, সম্প্রচার সংস্থার আয় ফুলে ওঠে। ক্রিকেট আজ আর নিছক খেলা নয়, হয়ে উঠেছে বড় কর্পোরেট ব্যবসার ভেতরের খেলা।

সবচেয়ে বড় হাস্যকর ব্যাপার হল এই দ্বিচারিতা। একদিকে মাঠে খেলোয়াড়দের বলা হচ্ছে পাকিস্তানিদের সঙ্গে হাত মেলানো দেশদ্রোহ, অন্যদিকে একই বোর্ড আবার পাকিস্তানি ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ নিয়ে আলোচনায় বসছে, কারণ তাতে আসে বিপুল আর্থিক লাভ। এমনকি যারা মিডিয়ায় যুদ্ধোন্মাদ ভাষণ দেন, তারাই আবার পর্দার আড়ালে সম্প্রচার অধিকারের ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনায় বসেন। প্রকাশ্যে শত্রুতা, আড়ালে ব্যবসায়িক সহযোগিতা— এই দ্বিচারিতার মধ্যেই আসল সত্য লুকিয়ে আছে। দেশপ্রেমের নামে দর্শককে আবেগে ভাসানো হয়, অথচ টাকার স্বার্থেই চালু থাকে সম্পর্কের দরকষাকষি। এটাই হল দেশপ্রেম Incorporated— একটা ব্র্যান্ড, এক ধরনের পণ্য।

ইতিহাসও বলে দেয়, ক্রিকেট শত্রুতা নয়, বরং সম্প্রীতির সেতু। যে ইংরেজ আমাদের ২০০ বছর পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ রেখেছিল, জালিয়ানওয়ালাবাগের মতো নৃশংস হত্যাকাণ্ড সহ দেশকে লুটপাট করে ছিন্নভিন্ন করেছিল, স্বাধীনতা অর্জনের পর সেই দেশের সঙ্গেই ভারত কিন্তু নিজ দেশের মাটিতেই ১৯৫১-৫২ সালে টেস্ট ক্রিকেট সিরিজ খেলেছিল। রাজনৈতিক টানাপোড়েন থাকলেও ক্রিকেট বহুবার প্রমাণ করেছে, সম্পর্কের নতুন আবহাওয়া তৈরি করার ক্ষমতা তার আছে। উপরন্তু, এ কথাও সত্য, যে কোনও একটি দেশের শাসক ভয়ঙ্কর ও স্বৈরাচারী হতে পারে, তার অর্থ কখনই সে দেশের সমস্ত সাধারণ মানুষও খারাপ, এমনটা কখনই নয়। তা যেমন আমাদের দেশের ক্ষেত্রে খাটে, তেমনই পৃথিবীর প্রতিটি দেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। 

আসলে, ক্রিকেটের ইতিহাস আমাদের অন্য শিক্ষা দিয়েছে। কপিল দেব যখন ১৯৮৩-তে বিশ্বকাপ জিতলেন, তাঁর প্রথম ছবি ছিল প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড়দের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ানো। সৌরভ গাঙ্গুলির লর্ডস'এর বারান্দায় জার্সি ওড়ানো নিয়ে বিতর্ক আছে, কিন্তু প্রতিপক্ষের সঙ্গে সৌহার্দ্য তাতে বাদ যায়নি। শচীন টেন্ডুলকার যখন সিডনিতে শতরান করলেন, তখন অস্ট্রেলিয়ার দর্শকরা দাঁড়িয়ে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। এটাই ক্রিকেট— দেশভেদ ভুলে প্রতিপক্ষের কৃতিত্বকে স্বীকৃতি দেওয়া।

ডন ব্র্যাডম্যান একবার বলেছিলেন, ক্রিকেট তাঁর জন্মের বহু আগে থেকেই ছিল এবং মৃত্যুর বহু বছর পরেও থাকবে। তিনি নিজেকে শুধু একজন খেলোয়াড় নয়, বরং ব্যাখ্যাকার মনে করতেন, যেমন, একজন পিয়ানিস্ট বেঠোফেনকে বাজিয়ে নতুন ব্যাখ্যা দেন। ক্রিকেটকে তিনি প্রতিযোগিতা হিসেবে দেখেননি, দেখেছিলেন এক ধরনের শিল্প আর নৈতিকতার প্রতীক হিসেবে। ক্রিকেটের মূলে আছে সৌজন্য, মর্যাদা ও মানবিকতা। কিন্তু আজকের ভারতীয় ক্রিকেট সেই ঐতিহ্য থেকে সরে গেছে। ফলে, খেলার মাঠে এখন খেলা নয়, মঞ্চস্থ হচ্ছে নাটক। দর্শকের মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে ঘৃণা, তরুণ প্রজন্ম শিখছে প্রতিপক্ষকে শত্রু ভাবতে। এর প্রভাব শুধু খেলায় নয়, সমাজে পড়ছে— হিংস্র মানসিকতা বাড়ছে, ভারতের বহুত্ববাদী ঐতিহ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, আন্তর্জাতিক স্তরে দেশের ভাবমূর্তি কলঙ্কিত হচ্ছে। ক্রিকেট, যা ছিল সেতুবন্ধনের খেলা, আজ ছদ্ম দেশপ্রেমের হাতুড়িতে সেই সেতুই ভেঙে যাচ্ছে।

ক্রিকেট সমালোচক নেভিল কারডাস লিখেছিলেন, ক্রিকেট শুধু খেলা নয়, এক ধরনের নৈতিক শিক্ষা। সেই শিক্ষা আজ বিসর্জিত হয়েছে। ব্র্যাডম্যানও শেষ জীবনে সতর্ক করেছিলেন, দুঃখজনক কিছু ঘটনা সত্ত্বেও ক্রিকেট টিকে থাকবে এবং সবচেয়ে মহান খেলা হিসেবেই থাকবে। কিন্তু সেই 'দুঃখজনক ঘটনা'র তালিকায় আজ যোগ হল ভারতীয় ক্রিকেটারদের এই অকাঙ্ক্ষিত আচরণ। অথচ, ইতিহাসের পাঠ স্পষ্ট— ক্রিকেট শুধু ব্যাট-বলের খেলা নয়, সৌজন্যের প্রতীক। জয় মানে প্রতিপক্ষকে হেয় করা নয়, জয় মানে মানবতার জয়। ভারত যদি এই শিক্ষা ভুলে যায়, তবে ক্রিকেট আর gentleman’s game থাকবে না, হয়ে উঠবে কর্পোরেট যুদ্ধের বাজারি নাটক।

ভারত ম্যাচ জিতেছে, কিন্তু হেরেছে শিষ্টাচার। ক্রিকেটের গৌরব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, দেশপ্রেম বিক্রি হয়ে গেছে শেয়ার বাজারের মতো। দেশপ্রেম কোনও ব্র্যান্ড নয়, কোনও ইনকর্পোরেটেড প্রোডাক্ট নয়। দেশপ্রেম হল হৃদয়ের গভীর মানবিকতা। যেদিন ক্রিকেট আবার সেই শিক্ষা মনে রাখবে, সেদিনই মাঠে ফিরবে খেলাধূলার আসল আত্মা।


Saturday, 13 September 2025

বিহার: ইন্ডিয়া জোটের পরীক্ষা

এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁক 

কল্যাণ সেনগুপ্ত



বিহার নির্বাচন ঘাড়ের উপর এসে পড়েছে। ইতিমধ্যে রাহুল, তেজস্বী ও দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের উপস্থিতিতে এবং ইন্ডিয়া জোটের আরও বহু নেতার যোগদানে বিহারের একটা বড় অংশে (ভোট চুরি বন্ধে) যাত্রা বেশ খানিকটা সাড়া ফেলেছে। তবে এর ফলেই জয় নিশ্চিত, বলা সম্ভব নয়। ভোটের দিন বুথ লেভেলে কী ঘটে এবং প্রকৃত ভোটারদের সবার নাম শেষ পর্যন্ত তালিকায় স্থান পায় কিনা ও ভোট প্রদানপর্ব শান্তিপূর্ণ রূপে সাঙ্গ হয় কিনা, এসবের উপরেই নির্ভর করছে ভোটের ফলাফল। ভোটের নোটিস জারি হবার পর প্রধান নির্বাচন কমিশনারই সর্বশক্তিমান। তাঁর কথাই আইন এবং তাহাই চূড়ান্ত। এখন সবার কাছেই এটা পরিষ্কার যে, বিজেপিকে জেতাতে তিনি কোনও কিছুরই তোয়াক্কা করবেন না। এমনই এক প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ভরসা শুধুমাত্র সাধারণ মানুষের রাস্তায় নেমে ঐক্যবদ্ধ শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে এবং তা একমাত্র সম্ভব যদি ইন্ডিয়া জোট তথা সমস্ত বিরোধী পক্ষ ঐক্যবদ্ধ থাকে।

বিহার নির্বাচনকে সামনে রেখে এই মুহূর্তে সর্বাধিক জরুরি বিষয় হচ্ছে, প্রকৃত ভোটারদের নাম যেন কোনওভাবেই বাদ না যায়, সেটি নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তারা কী রায় দেয় বা নির্বাচন কমিশন শেষ পর্যন্ত তা কতখানি মানে, সবটাই এখন ভবিষ্যতের গর্ভে। কারণ, নির্বাচন কমিশন যতখানি আগ্রাসী ভূমিকা পালনে ব্যগ্র, তা সম্পূর্ণ প্রতিরোধ করার সাহসী মনোভাব দেখাতে কি সক্ষম হবে সর্বোচ্চ আদালত? বিষয়টি যথেষ্ট আশঙ্কার। তবে, দ্বাদশ নথি হিসেবে আধার কার্ডকে গণ্য করার সুপ্রিম নির্দেশ নির্বাচন কমিশন শেষমেশ মানতে বাধ্য হয়েছে। তবুও, যদি প্রতিকূল পরিস্থিতির উদয় হয়, তা বদল ঘটাতে পারে একমাত্র গণ জাগরণ এবং তা অবশ্যই হতে হবে অহিংস ও শান্তিপূর্ণ। এর সামান্য বিচ্যুতি হলেই দমন পীড়ন নামিয়ে আনবে সুযোগের অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে থাকা হিংস্র শাসক। অবশ্য শান্তিপূর্ণ অহিংস আন্দোলনকেও কীভাবে ঝামেলায় জড়ানো যায় তার সাম্প্রতিক উদাহরণ আমরা দেখলাম, বিহারের 'ভোটার অধিকার যাত্রা' অভিযানের পথে নেতাবিহীন ফাঁকা মঞ্চের সুযোগ নিয়ে মধ্যপ্রদেশের এক বিজেপি কর্মীর কংগ্রেসি ভেক ধরে মোদীর মায়ের নামে গালি দিয়ে হাঙ্গামা বাঁধাবার সুচতুর প্রয়াসে। অতএব, সাধু সাবধান।

বর্তমান কঠিন পরিস্থিতিতে মোদিরাজকে শাসন ক্ষমতা থেকে সরাতে না পারলে দেশের সংবিধান ও গণতন্ত্র শুধু নয়, এ যাবৎ টিকে থাকা যেটুকু বা যা কিছু শুভ অবশিষ্ট আছে, সবই ধ্বংস হয়ে যাবে। বিশেষত বিভিন্ন বিজেপি শাসিত রাজ্যে যে ভাবে বাংলা ভাষী, অর্থাৎ, বাংলায় কথা বলার অপরাধে পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, অত্যাচার করছে, থানায় বা অন্য কোথাও আটকে রাখা হচ্ছে, তা অতীতে কখনই হয়নি। সেখানকার পুলিশ কোনওরকম প্রমাণপত্র যেমন, আধার বা ভোটার কার্ড কিছুই মানছে না, সব নকল বলে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে। এমনই গা-জোয়ারি বেআইনি কার্যকলাপ ও চরম হেনস্থা করা হচ্ছে ভিন্ন রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া গরিব খেটে খাওয়া বাঙালি, বিশেষত মুসলমানদের। বহু মুসলমানকে পুশ ব্যাক করে বাংলাদেশে পাঠানো হচ্ছে। কাউকে কাউকে জেভিসি মেশিনের সাহায্যে সীমান্তের কাঁটাতারের উপর দিয়ে ওপারে ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে, মাঝসমুদ্রে নিয়ে গিয়েও ফেলে দিচ্ছে। এই সমস্ত ঘটনাই হিটলারের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের নানাবিধ অত্যাচারের কথা মনে করিয়ে দেয়। ভাষণ দিয়ে, সাধারণভাবে প্রচার করে সোজা রাস্তায় বাংলা জয় সম্ভব নয় বুঝে এখন ভয় দেখিয়ে চূড়ান্ত আতঙ্কিত করে বাঙালিকে পদানত করার চেষ্টা চলছে। বাংলার মানুষ অবশ্য সে সব বুঝে নেবেন ঠিকই, কিন্তু তা হয়তো অনেকটা কঠিন হয়ে যাবে যদি বিজেপি বিহারে জিতে যায়। ফলে, বাংলাকে বিজেপির হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে বিহারে বিজেপির পরাজয়কে নিশ্চিত করতেই হবে। সে কারণেই বিজেপির বিরুদ্ধে ইন্ডিয়া জোটের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ জরুরি।

খুব শিগগিরই হয়তো বিহারে নির্বাচনী বিজ্ঞপ্তি জারি হবে। ফলে, এখনই সব দলকে ভোট প্রক্রিয়ার ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এখন আর সময় নেই ইন্ডিয়া জোটের সাংগঠনিক বৈঠক করার। সুতরাং, ইন্ডিয়া জোট শরিকদের মধ্যে নির্বিঘ্নে আসন বণ্টন এখন সর্বাধিক জরুরি। এই পর্বটি বেশ কঠিন ও গোলমেলে। কিন্তু তবুও প্রত্যেককেই খানিক ত্যাগ স্বীকার করে বিষয়টির সুষ্ঠু সমাধান আবশ্যিক। এরপরেই জরুরি হচ্ছে ভোটার তালিকায় প্রকৃত ভোটারদের নাম রক্ষার লড়াই। সেটির সুষ্ঠু সমাধান হলে তখন নামতে হবে বুথ রক্ষার লড়াইয়ে এবং পরবর্তী দায়িত্ব হবে গৃহীত মতদান পূর্ণ ইভিএম সমূহের সংরক্ষণ কেন্দ্রে পাহারাদারি। অতঃপর ভোট গণনা কেন্দ্রে সঠিক রূপে গণনা প্রক্রিয়া সম্পন্ন ও ফল ঘোষণা এবং জয়ের শংসাপত্র গ্রহণ। উপরোক্ত প্রতিটি পর্বে কমিশনের তরফে গড়বড়ির আশঙ্কা পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান এবং এর তিক্ত অভিজ্ঞতার সাক্ষী আছে অনেকেই। বিহারে ২০২০ সালের নির্বাচনেও বিজেপি জেতেনি এমন বেশ কয়েকটি আসনে জয়ী প্রার্থীকে বহুক্ষণ বসিয়ে রেখে শেষমেশ বলা হয়, তুমি হেরে গেছ। এভাবে গা জোয়াড়ি করে জেতা প্রার্থীকে পরাজিত ও হারা প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। এটা  করা সম্ভব হয়েছে কারণ, সেবার বিরোধী পক্ষ যথেষ্ট ঐক্যবদ্ধ ও এ বিষয়ে আদৌ সজাগ ছিল না। এবার কিন্তু ছবিটা সম্পূর্ণ বদলে গেছে, বিরোধীরা এখন ঐক্যবদ্ধ ও সজাগ।

বিহারের নির্বাচন বর্তমানে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে এসে উপস্থিত। সামনে হয় গভীর অন্ধকার খাদ, নয়তো এক আলোকিত মুক্তির পথ। ফলে, এসপার-ওসপারের লড়াইয়ে নামা ছাড়া উপায় নেই। মনে রাখা জরুরি, কোনওক্রমেও বিজেপি বিহারে জয় হাসিল করতে সক্ষম হলে দমন পীড়ন চালিয়ে যে কোনও প্রকারেই হোক তারা বাংলার দখল নেবেই। সে কারণেই বিহারের প্রচারে বিরোধী নেতাদের ঐক্যবদ্ধ চেহারা তুলে ধরাটা অতীব জরুরি। পাটনার গান্ধী ময়দানে ইন্ডিয়া জোটের সাম্প্রতিক মহাসমাবেশ এক ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে নিঃসন্দেহে।

দেশকে রক্ষা করতে হলে মোদি শাসনের কালা অধ্যায়ের অবসান চাই দ্রুত। এ বিষয়ে কোনওরকম গাফিলতি দেশের সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। বিপদ বুঝলে তারা যে কোনও সময় যে কোনও ভয়ঙ্কর পথ অবলম্বন করতে পারে, এমনকি প্রয়োজনে জরুরি অবস্থা জারি করে সমস্ত বিরোধীপক্ষের নেতাদের জেলে পুরলে তখন পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাবে। দেশের সংবিধান, গণতন্ত্র সব ধ্বংস হয়ে যাবে। 

মাথায় রাখতে হবে, শক্তিশালী ইন্ডিয়া জোট ভিন্ন আর এই মুহূর্তে অন্য কোনও উপায়ই নেই। ফলে, সব কিছু ধ্বংস হওয়ার আগেই সমস্ত বিরোধী শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, পুনর্গঠিত করতে হবে ইন্ডিয়া জোটকে সাংগঠনিক রূপে এবং বিস্তৃত ও আলোচিত এক প্রকৃত জনমুখি কর্মসূচির প্রস্তাবকে গ্রহণ করে ভবিষ্যৎ রূপায়ণের লক্ষ্যে এগোতে হবে। ইতিমধ্যেই বিরোধী পক্ষ সুযোগ হারিয়ে নিজেদের ভুলে হরিয়ানা, দিল্লি ও মহারাষ্ট্র হাতছাড়া করেছে। তাই, মনে রাখতে হবে, 'বেটার লেট দ্যান নেভার'। 

এ বিষয়ে ইন্ডিয়া জোটের প্রধান স্তম্ভ ও জাতীয় বড় দল কংগ্রেসের দায়দায়িত্ব অনেক বেশি। এই দলের সামান্য বিচ্যুতি আমাদের ধ্বংসের মুখে দাঁড় করিয়ে দিতে পারে। সে কারণেই মনে রাখা জরুরি যে, আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও ইতিহাসের কাছে এ বিষয়ে দায়বদ্ধ।


Tuesday, 9 September 2025

বিস্মৃত গাছেদের গান

মনের আর্তিই শিল্পীর চৈতন্য

অয়ন মুখোপাধ্যায়



ইতালির ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল'এর নাম উচ্চারণ করলেই সিনেমাপ্রেমীদের চোখে অন্য আলো জ্বলে ওঠে। কারণ, এই উৎসব শুধু সিনেমা নয়, শিল্পের মর্যাদার প্রতীক। এখানে দাঁড়ানো মানে দুনিয়ার সিনেমার রাজপথে নাম লিখে দেওয়া। আর সেই মঞ্চেই ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে পুরুলিয়ার মেয়ে অনুপূর্ণা রায় (মাত্র ৩১ বছর বয়সী) ইতিহাস লিখলেন। তাঁর প্রথম ছবি 'Songs of Forgotten Trees' Orizzonti সেরা পরিচালক পুরস্কার পেল। বাংলার এক প্রান্তিক জেলা থেকে উঠে আসা এক তরুণী, যে নিজেই নিজের ও সমাজের পূর্ব-ধারণার বিরুদ্ধে, অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়েছেন, তিনি আজ ভেনিসে দাঁড়িয়ে সারা দুনিয়ার সামনে বললেন নিজের মাটির কথা, বললেন প্যালেস্টাইনের যুদ্ধাহত শিশুদের কথা, আর বিশ্বশান্তির বার্তা ছড়ালেন।

মনে পড়বে, ১৯৫৭ সালে এই ভেনিসেই আরেক বাঙালি আদায় করেছিলেন সেরা ছবির ('অপরাজিত') পুরস্কার (Golden Lion)। 

অনুপূর্ণা'র খবর যখন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় আলোড়ন তুলছে, তখন এ দেশের বড় বড় বাংলা টিভি চ্যানেল বা পত্রিকার পাতায় সে আলো নেই। কারণ, আমাদের সংবাদব্যবস্থা এখন কর্পোরেট-বাণিজ্যের এক্সটেনশন। তাদের চোখে খবর মানে বাজারি গসিপ, ফটোশ্যুট আর বক্স অফিসের অঙ্ক। অনুপূর্ণা রায়ের মতো এক স্বাধীন পরিচালকের স্বীকৃতি ও প্রাপ্তি তাদের কাছে বড্ডই 'বোরিং'। দেব'এর ছবির নায়িকা বদলানো, বিবেক অগ্নিহোত্রীর নতুন স্লোগান, কিংবা রঘু ডাকাত সিরিয়ালের খলনায়ক হওয়া— এসবই তাদের হেডলাইন। দিনে পঞ্চাশবার এইসব খবরের আপডেট চলে।

এ আসলে ভারতীয় চলচ্চিত্র রাজনীতিরই প্রতিচ্ছবি। আমাদের ছবির মেইনস্ট্রিম এতটাই কর্পোরেটাইজড যে, শিল্প সেখানে কেবল এক প্রোডাক্ট। বড় প্রযোজনা সংস্থা, ওটিটি প্ল্যাটফর্ম, বিজ্ঞাপনদাতা— সবাই মিলে ঠিক করে কোন সিনেমা চলবে, কোনটা চলবে না। সিনেমা তৈরি এখন প্রায় কর্পোরেট পণ্য লঞ্চের মতো। নায়ককে সুপার-হিরো ও গানকে টিকটক-রিল বানাতে হবে, আর মুক্তির আগেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রেন্ডে তুলতে হবে। এখানে স্বাধীন ছবি নির্মাণের জায়গা কোথায়? পুরস্কার গ্রহণ-অনুষ্ঠান ভাষণে অনুপূর্ণাও তাই জানিয়েছেন, তাঁর ছবিটি নির্মাণে তিনি কোনও প্রযোজক পাননি, কারণ, সকলেরই অভিমত ছিল যে এই ছবি বক্স অফিস সাফল্য পাবে না। 

অনুপূর্ণা'র ছবি, তাই, এই মূলধারার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর এক প্রস্তাবনা। তাঁর ছবিতে কর্পোরেটের চকচকে স্পনসরশিপ নেই, নেই বাজারি কোনও ফর্মুলা। আছে প্রান্তিক অভিবাসী মহিলাদের জীবন, শহরের অন্ধকার কোণে বেঁচে থাকার সংগ্রাম, আর নারীর স্মৃতি ও পারস্পরিক ভরসার গল্প। এই নির্মাণের মধ্যে দিয়ে তিনি দেখালেন, ছবি মানে নিছক বিনোদন নয়; ছবি মানে সমাজের অন্দরমহলের কথা বলা। তাই তাঁর নির্মিতি ও স্বীকৃতি আসলে শুধু ব্যক্তিগত সাফল্য নয়, কর্পোরেট-চালিত ছবির মতাদর্শের বিরুদ্ধে এক নীরব বিদ্রোহ।

Songs of Forgotten Trees ছবিটির মূল বিষয়বস্তুর কেন্দ্রে রয়েছে দুই পরিযায়ী মহিলার জীবন, যেখানে তারা একে অপরের সঙ্গে এক অপরিচিত পরিবেশে নিজেদের টিকে থাকার লড়াই ও একাকীত্বকে ভাগ করে নেয়। ছবিটি তল্লাশ করে মানবিক সম্পর্ক, বেঁচে থাকার সংগ্রাম ও নারীত্বের গভীর দিকসমূহ। ছবিটির দুটি মাত্রা অতীব গুরুত্বপূর্ণ: 

এক) অনুপূর্ণা ছবিটি তৈরি করেছেন লম্বা শটে; সে অর্থে, প্রতিটি sequence'এ 'কাট' খুবই কম। এটা হয়তো তাঁর ব্যক্তিগত স্টাইল বা স্টেটমেন্ট;

দুই) ছবির দুই নারী চরিত্রের মধ্যে কথোপকথনের প্রায় সবটাই গৃহীত হয়েছে মুম্বই'এর একটি ঘুপচি বা জীর্ণ ফ্ল্যাটে যেখানে অনুপূর্ণা বসবাস করতেন তাঁর আইটি কর্মজীবনের সুবাদে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, পয়সার অভাবে এ ভাবে শ্যুটিং'এর খরচ বাঁচানো ছাড়া তাঁর সামনে আর কোনও উপায় ছিল না।       

অসম সাহসী অনুপূর্ণা পুরস্কার নেওয়ার সময় বললেন, 'Every child deserves peace, freedom, liberation, and Palestine is no exception.'। এ দেশে যেখানে সামান্য সমালোচনার জন্যই শিল্পীরা ট্রোল্ড‌ ও হয়রানির শিকার হন, সেখানে আন্তর্জাতিক মঞ্চে দাঁড়িয়ে এক ভারতীয় নারী প্যালেস্টাইনের যুদ্ধাহত শিশুদের কথা তুললেন। এবং তারপর এও বললেন, তাঁর দেশ হয়তো তাঁকে এ কথা বলার অনুমোদন দেবে না, কিন্তু তবুও তিনি বলবেন। এ শুধু রাজনৈতিক সাহস নয়, শিল্পের আসল উদ্দেশ্যকেও তুলে ধরা। কর্পোরেট বলিউড এই সাহস দেখাবে না, কারণ, তাদের লোক-ঠকানো বৃহৎ ব্যবসা চালাতে হয়। কিন্তু স্বাধীন পরিচালকদের সে দায় নেই। তাই তাঁরা ইতিহাসে জায়গা করে নেন।

অনুপূর্ণা রায়ের ভেনিস জয় আমাদের সামনে তিনটি বড় শিক্ষা রেখে গেল। প্রথমত, প্রান্তিক অবস্থানে থেকেও বিশ্বমানের শিল্প তৈরি করা যায়। দ্বিতীয়ত, কর্পোরেট-চালিত মিডিয়া আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে রাখলেও সমকাল সত্যিকারের শিল্পীকেও চিনে নেয়। আর তৃতীয়ত, শিল্পের আসল উদ্দেশ্য চটকদারি নয়, মানুষের অন্তঃস্থলের কথা বলা।

কথা প্রসঙ্গে অনুপূর্ণা তাঁর হারিয়ে যাওয়া এক বাল্যবন্ধুর কথা বলেছেন। ঝুমা নাথ। বালিকাবেলায় তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। সে বেদনা এখনও তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। তাঁকে তিনি এখনও খুঁজছেন। এই মানবিক অনুভূতিগুলিই চলচ্চিত্রের ভাষা ও বিষয় হয়ে ওঠে।

অনুপূর্ণা তাঁর কাজ দিয়ে আমাদের আরও সংবেদনশীল করে তুলুন। তাঁর পরের ছবির অপেক্ষায়।


 

Sunday, 7 September 2025

বামপন্থার ভূত হইতে ভবিষ্যৎ

কী করিতে হইবে?

কৃশাণু মিত্র



নিজেকে বামপন্থী ভাবার স্পর্ধা আমার নেই। এই পথ একই সঙ্গে তপস্যা এবং যুক্তিবোধের পথ। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্র এর প্রয়োগের ভূমি।

'জয় বাবা ফেলুনাথ' ছবির অর্জুনের হাতের ছুরি আসলে বিঁধছিল জটায়ু নয়, প্রদোষ মিত্র'র মরমে। কারণ, তার ভুলেই উক্ত পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল। জটায়ুকে ভুগতে হয়েছিল। প্রতিনিয়ত নিজেকে কাটাছেঁড়া করে দেখতে হবে। সদর দফতরে কামান দাগতে হবে। সদর দফতর এখানে পার্টি বা সরকার নয়, আপন সত্তা। বিদ্যাপতির লেখায়, 'তৃণাদপি সুনীচেন তরোরিব সহিষ্ণুনা...' (যে সাধক তৃণ অপেক্ষা নিজেকে ক্ষুদ্র জ্ঞান করেন, যিনি তরুর মতো সহিষ্ণু...)। নিজেকে দাগিয়ে বিশ্লেষণ করার নাম বামপন্থা। তা না হলে তুমি রাবণ, লঙ্কার অধিকার পেলেই খসে পড়বে ছদ্মবেশ।

এখন বিপ্লব বিদ্রোহ প্রতিবাদ দু' ভাগে ভাগ হয়ে গেছে-- শান্তিপূর্ণ মার্কসবাদী ও গান্ধীবাদী। প্রথম দলে থাকা মানুষজন শতধা বিভক্ত। দ্বিতীয় দল গণতন্ত্র রক্ষায় বেনারস থেকে দিল্লি হাঁটছে, এখন সংবিধান বাঁচাও, ভারত জোড়ো, ভোটার অধিকার সহ বহু আন্দোলনে সামিল। বহু বাম মনোভাবাপন্ন মানুষ যুক্ত হয়েছেন দ্বিতীয় দলে। আরেক দলও সংবিধান রক্ষার্থে বিহারে হাঁটছে। তারা আপাত গণতন্ত্র প্রকাশের মাধ্যম ভোটচুরি হয়তো আটকাতে সম্ভব হবে, কিন্ত দেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের হদিশ দিতে পারবে বলে মনে হয় না। 

শ্রম ক্ষেত্রে কর্মরত মানুষজন হাঁটছেন বা বলা উচিত দৌড়চ্ছেন জোম্যাটো বা ব্লিংকিটের বাইকে, পেটের জন্য। পরিষেবা ক্ষেত্র ব্যাপ্ত হচ্ছে 'আরবান কোম্পানি' বা অন্য কারও হাত ধরে। পাড়ার কলের মিস্ত্রি জয়, নিজস্ব পরিধি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে বাইরে। আর বড় হাউজ বা সরকারি কর্মীরা নিরলস ভাবে অলস যাপনে লজ্জাহীন। বামপন্থা এই মধ্যবিত্তদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বিনাশের পথে এগিয়ে চলেছে। অন্যদিকে কর্মক্ষেত্রে প্রযুক্তির বাড়বাড়ন্ত, এআই এসে গেছে। তলিয়ে যাবে ভুলভাল বহু কাজ। যেমন, খাটা পায়খানা থেকে মাথায় করে মাটি বইতে আসে না এখন কেউ। খাটা পায়খানাই উধাও হয়ে গেছে। আজও যদি মার্কসবাদী বীক্ষণে ধরা না পড়ে প্রকৃত পথের নতুন রূপ, তাহলে নেতৃত্বের কারণেই মার্কস এ পোড়া দেশ ছেড়ে চলে যাবেন। 

যে দল মানুষের জমি, জঙ্গল, বাঁচার উপায় ধ্বংস করছে সে দলই মানুষকে কলাটা মূলোটা দিয়ে লোভাতুর, বশীভূত করছে। কোথাও লাডলি বহিন, কোথাও পাঁচ কেজি আনাজ। যারা বিরোধী তক্তে নেই, তারা টাকা দেওয়া ভালো চোখে দেখছে না অথচ নিজেদের প্রচারের সময় বলছে আমরা অনুদান বাড়িয়ে দেব। যদি অনুদান ভালো হয় তাহলে অধিষ্ঠিত দলকে সমালোচনা করলে চলবে না, কেন কতটা হলে ভালো বলতে হবে। আর যদি খারাপ হয় তাহলে বললে চলবে না যে আমরাও দেব। ভোটের রাজনীতিতে এই ঠকবাজি, দ্বিচারিতা চলছে চলবে ভাবলে বামপন্থীরা নিজেদের ঠকাবে। 

রাজনীতির সামনে অন্য কোনও পথ খোলা আছে কী? 

কেন, যে পথ গান্ধীবাদীরা দেখাতে পারল সেই পথ মার্কসবাদীরা দেখাতে পারল কই? এখানেই লুকিয়ে আছে সমাজে আজ বামপন্থীদের অনাদরের মূল কারণ। গান্ধীবাদ আজ পথ দেখাচ্ছে সকল অবউন্নয়ন বিকাশের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে। তাদের মোক্ষ নয় রাজ্যপাট। তাদের লক্ষ্য গণতন্ত্র। আর রাজ্যে একদা ক্ষমতায় থাকা বাম দল আজও টাটা'র ন্যানো (যে ন্যানোই আজ উঠে গেছে) নিয়ে হা-হুতাশ করে যাচ্ছে। এই অটোমেশন, এআই'এর যুগে বৃহৎ কারখানা কোনও সমাধান নয়, তা বুঝতে হবে। আজ বড় কারখানায় কর্মসংস্থান অতীব সীমিত। অতীতে প্রযুক্তিকে ফিরিয়ে দিয়ে আমরা ভুল করেছি, এই সত্য যত তাড়াতাড়ি মানা যায় ততই ভালো। আমাদের দেশে মার্কসবাদী লেনিনবাদী পথ হল তক্তে বসার কৌশল। যারা জীবন বাজি রেখে বন্দুক সহযোগে নেমেছিলেন, তারা বিলুপ্তপ্রায়। অন্যরা ভোট সহযোগে মোক্ষ লাভে ক্ষমতায় পৌঁছনোর আশে বসে। 

কিন্তু তারপর?

ভারতবর্ষে বর্তমানে ফ্যাসিস্ট শক্তি কায়েম হয়ে গণতন্ত্রের অপলাপ ঘটিয়ে যা খুশি করে যাচ্ছে। একইভাবে রাজ্যে স্বৈরাচারী শক্তি বিকশিত হচ্ছে, কারও কিছু বলার নেই। বামপন্থীরা সরকারে এলেও একই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি ঘটবে এবং এটা হওয়াই স্বাভাবিক। ইতিহাসের শিক্ষা তেমনই।

তাহলে বামপন্থা কি কফিনে?

আপাতত টুকিটাকি উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে কীভাবে এরা নিজেদের পায়ে কুড়ুল মারে:

এক) এক কেন্দ্রীয় দফতরের সরকারি ইউনিয়ন, যাদের গায়ে বামপন্থার তকমা লাগানো আছে, তারা একটি মিটিং করছে। ওয়ার্কশপে মাল যাতায়াত করার রাস্তায় ওপর দিয়ে ইলেকট্রিকের তার গেছে, বক্তব্য রাখছেন যিনি তাঁর স্ট্যান্ড মাইক্রোফোনে। লোডেড লরি আটকে আছে, নেতা নড়বেন না জায়গা ছেড়ে। কেউ কেউ অনুরোধ করল। গবুচন্দ্র কমরেডরা বলল, মিটিং শেষ হলে গাড়ি বের হবে। মানুষ যখন নিজে ক্ষমতার প্রতিভ হয় তখন ভবিতব্য লেখা হয়ে যায়। 

দুই) ইংরেজি তুলে দেওয়া হল, আবার চালু হল। কেন? মধ্যবিত্ত পোলাপান ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবে। শ্রেণি সমঝোতার প্রকৃষ্ট উদাহরণে সাফার করল তারা, যাদের কোনওকালে ইংরেজি লাগবে না কোনও প্রয়োজনে। গণতন্ত্রকে আঘাত করা বামপন্থী মধ্যবিত্ত নেতৃত্বের চেতনায় মাখো-মাখো। এই সুযোগে গড়ে উঠল ছাতারে পাখির মতো হাজারও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, যেখানে না আছে যোগ্য শিক্ষাব্রতী না পরিকাঠামো। কিউবা তৃতীয় বিশ্ব থেকে ডাক্তারি পড়ুয়া নিত এবং ছয় মাসে স্প্যানিশ শিখিয়ে ওই ভাষায় শিক্ষা দিত। যার দরকার সে শিখে নেবে, এই সত্যই পরম। 

তিন) যে কোনও গণতান্ত্রিক নির্মাণকে নস্যাৎ করে দিতে মুহূর্ত সময় নেয়নি। মরিচঝাঁপি যার প্রমাণ।

আত্মীকরণ না হওয়া এবং অজ্ঞানতার কারণেও নতুন পথের সন্ধান করার সাহস নেই বামপন্থীদের। দক্ষিণ আমেরিকার বহু উদাহরণ আমরা কাজে লাগাতে পারি। পাথরপ্রতিমাতেও আমাদের সেরকম অভিজ্ঞতা আছে। ব্রাজিলে অগস্ট বোয়াল (এক নাট্য ব্যক্তিত্ব) প্রসিডেন্ট লুলা'র সময় কাউন্সিলর ছিলেন। তাঁর নিজস্ব নির্বাচনী কেন্দ্রে তিনি আঞ্চলিক আইন প্রণয়ন করেছিলেন গণতন্ত্রকে জোরদার করতে। আসলে গণতন্ত্র ছাড়া এই সময়ে কোনও রাজনীতি গ্রহণযোগ্য নয়। কিছুদিন আগে শ্যামল মুখার্জি, পথসেনা দলের এক সৈনিক-সেনাপতি যখন লিখলেন, বুদ্ধবাবু কীভাবে বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে গণতান্ত্রিক আদান-প্রদানে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন যে তিনি জোর করে কিছু করেননি। বুদ্ধিজীবীরা তাকে মান্যতা দিয়েছিলেন। আমি প্রতিপ্রশ্ন রেখেছিলাম, এই আলোচনা জমি অধিগ্রহণের আগে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কেন করা হয়নি? আসলে বুদ্ধিজীবী বুদ্ধদেব অপর এক ক্ষমতার সমর্থন ও মান্যতা চেয়েছিলেন। সেখানে সাধারণ মানুষ গৌণ। বুদ্ধিজীবীদের কাছে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল কিন্তু শ্রমজীবীদের কাছে যাওয়া সম্ভব হয়নি। কেন রেফারেন্ডাম নেওয়া হয়নি? কেন জমির মালিককে তার ভালো কীসে জানতে চাওয়া হল না? গণতন্ত্রের ঠিকাদার কেবলমাত্র মানুষই হতে পারে, কোনও রাজনৈতিক দল নয়। বামপন্থী রাজনৈতিক চেতনার অর্থ হবে মানুষের দাবি, মানুষের মতামতকে মূল্য দেওয়া। 'সর্বহারার একনায়কত্ব' আজ গণতন্ত্র বিরোধী। উল্টোদিকের দলগুলিকে ভোটাররা ভোট দেবে, অনুদান নেবে, কখনও যুদ্ধের কখনও ধর্মের বড়ি খেয়ে।  

তাহলে শূন্য থেকে শুরু করা যাবে কীভাবে? 

১.০) অবশ্যই বিচার ব্যবস্থার দোরে দোরে ঘুরে ও তাদের নজরে পড়ে নয়। সরাসরি কাজে নেমে পড়ার মাধ্যমে। করোনার সময় যে ভাবে কাজ শুরু করা গিয়েছিল। মুশকিলটা অবশ্য এখানেও। করোনার সময় শুধুমাত্র 'রেড ভলেন্টিয়ার্স' কাজ করেনি। কাজ করেছিল হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ সাধারণ সমাজ বন্ধু। যাদের কাজটাই উদ্দেশ্য ছিল, তক্তের খুড়োর কল তাদের সামনে ছিল না। বালি অঞ্চলে নির্ভীক সংগঠনের পল্টু করোনার সময় কাজ করতে গিয়ে মারা গেছে। কাজ শেষ হয় না, পুরুলিয়াতে চলেছে পল্টুর নামে পাঠশালা। অথচ শ্রমজীবী ক্যান্টিন শুরু হল আর সেই ক্যান্টিনের দায়ভার গেল কন্ট্রাকটরের কাছে। ব্যাস, প্রায় সব ক্যান্টিনের আঁচই নিবু নিবু। অর্থাৎ, দলে একজনও শ্রমিক নেতা নেই যিনি এই কাজে নিজে হাত লাগিয়ে পরিচালনা করতে পারেন, অথচ আমি বলছি আমার পার্টি শ্রমিক কৃষকের প্রতিভূ। একটু খোঁজ নিলে জানা যাবে, সারা পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষে কীভাবে কত ক্ষেত্র রাজনৈতিক দর্শনকে শিরোধার্য করে অরাজনৈতিক জায়গা থেকে উদাহরণ তৈরি করে যাচ্ছে। তার নির্যাস নিতে আমরা ব্যর্থ। আমরা দল হিসেবে কোনও লাগাতার নির্মাণের সঙ্গী হচ্ছি না। শংকর গুহ নিয়োগী একটি দর্শনের জন্ম দিয়ে গেছেন: 'সংঘর্ষ এবং নির্মাণ'। অথচ কোনও বামপন্থী দল এই দর্শনকে বুকে টেনে নিতে পারল না। অর্ধ শতাব্দী ধরে এই দর্শনের ফলিত রূপ দল্লি-রাজহারায় শহিদ হাসপাতালের অর্থবহ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হয়ে বেঁচে আছে। সেই মডেলের নির্যাস নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে কাজ করে চলেছে বেলুড় শ্রমজীবী স্বাস্থ্য প্রকল্প সমিতি; যারা শ্রমকেই পুঁজি ধরে পাঞ্জা কষে চলেছে ক্রোনি পুঁজিবাদের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে। 

শুরু হবে কীভাবে? ধরাধাম আজ ক্লিষ্ট প্লাস্টিক বর্জ্যে। দল বেঁধে বাজার দোকানে অহিংস প্রচার চলুক। দরকার মতো চাঁদা তুলে ডিগ্রেডেবল মেটিরিয়ালে অভ্যস্ত হোক মানুষ। এই ইন্ডাস্ট্রি বিকাশ লাভ করুক। রাসায়নিক সার, কীটনাশকহীন চাষ হবে, ক্ষেত্র প্রস্তত আছে। শুধু চাই রাজনৈতিক ইচ্ছা। 

২.০) গণতন্ত্রের প্রহরী হিসেবে থাকব, সরকারে যাব না। সরকারি দল চাইবে মদত। নির্বিকার পূজারী হব প্রকৃতির। অধিকারের দাবি সামনে আনব। লক্ষ থাকবে শিক্ষা-স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে। আইনানুগ কাজ না হলে প্রতিবাদ করব। যে মানুষ কাঁদছে তার পাশে দাঁড়াব। মানুষ হয়তো একদিন দাবি করবে, ক্ষমতায় এসো। তোমাদের চাই আমরা। 

৩.০) অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চাই অভিনিবেশ। ইউরোপের দিকে তাকালে বোঝা যাবে, ভাবনাতেও আমাদের দেশিয় বামপন্থীরা কত পিছিয়ে। সেখানে ডাক্তারের ছেলের ডাক্তার হওয়ার মানসিক চাপ নেই, স্বচ্ছন্দে সে সেলসম্যান হয়ে রোজগার করে বেহালা কিনে বাজায়। হয়তো কেউ সরকারি অনুদান নিয়ে বেঁচে আছে আর মনের মতো কাজ করছে। এই পরিস্থিতি-কাল এখানেও আসবে। কারণ, এআই কর্মহীন করে দেবে মানুষকে। কেরানি নেই, ওপিডিতে ডাক্তার লাগছে না, আদালতে বিচার হবে অতীত জাজমেন্টের ভিত্তিতে। ব্রিজ ডিজাইন করবে এআই। যখন প্রযুক্তি উদ্বৃত্ত দেবে তখন রাষ্ট্রীয় অনুদানকে কে হ্যাটা করবে? তখন দাবি উঠবে অনুূদান বাড়ানোর। তখন মূল্যায়ন হবে, কোন্‌ মানুষকে নিজ ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করতে হচ্ছে, তাকে দিতে হবে বেশি অনুদান। চাষের কাজ আধুনিক পদ্ধতিতে হবে সমবায় করে। তখন কৃষি ক্ষেত্রে শ্রম দেওয়া মানুষকে দিতে হবে বেশি অনুদান। নজরদারি  চলবে সব ক্ষেত্রে। বামপন্থীরা ছাড়া কে করবে এই নজরদারি? আর অনুদানের সমবন্টন চাই কর্ম অনুযায়ী, 'ফসলের সমবন্টনের' প্রকৃত রূপ হয়ে । কারণ, সরকারকে ফসলের জোগান দিতে হবে তার জনগণকে।   

বামপন্থার প্রাসঙ্গিকতা এখানেই।