ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই, ছোটো সে তরী
মালবিকা মিত্র
'সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে।
কে থামিতে পারে এই আলোয় আঁধারে
সহজ লোকের মতো; তাদের মতন ভাষা কথা
কে বলিতে পারে আর; ...
সকল লোকের মতো বীজ বুনে আর
স্বাদ কই, ফসলের আকাঙ্ক্ষায় থেকে,
শরীরে মাটির গন্ধ মেখে,
শরীরে জলের গন্ধ মেখে,
উৎসাহে আলোর দিকে চেয়ে
চাষার মতন প্রাণ পেয়ে
কে আর রহিবে জেগে পৃথিবীর ’পরে?'
--বোধ/ জীবনানন্দ দাস।
এ এক অদ্ভুত সমাজ, যেখানে পারফিউমের নাম এনভি অথবা সিক্রেট। অর্থাৎ, সকলের তরে নয়। এটা বিশেষের জন্য এবং যিনি এটার ভোক্তা তার গর্ব এটা। সেই যে একটা বিজ্ঞাপনের ক্যাচলাইন ছিল 'নেবার্স এনভি ওনার্স প্রাইড'। এমন একটা সমাজে সকলের মতো, সকলের সঙ্গে, সকলের তরে-- এ কথাগুলো খুবই মামুলি, বস্তাপচা, ব্যাকডেটেড। এ সমাজে 'যো জিতা ওহি সিকান্দার'। তাহলে কাউকে তো হারতেই হবে, তবেই কেউ জিততে পারবে। আর হার-জিতের এই খেলাতে জীবনকে মাপা হবে-- কে সফল কে ব্যর্থ। তাহলে বলুন দেখি, পরীক্ষা হবে আর পাশ ফেল থাকবে না, এ কি কখনও হয়! উত্তমর্ণ আর অধমর্ণ দেগে দিতে হবে না? তবেই তো সিকান্দার কে, চেনা যাবে।
২০০৯ সালে দেশ জুড়ে প্রণয়ন করা হয়েছিল শিক্ষার অধিকার আইন। সেই আইন অনুসারে, ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সী প্রতিটি শিশুর বিনামূল্যে বাধ্যতামূলক শিক্ষা পাওয়ার অধিকার আছে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সমস্ত শিশুর শিক্ষা সম্পূর্ণ করার দায় রাষ্ট্রের। সরকার পরিচালিত কোনও স্কুলে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত থাকবে না পাশ-ফেল প্রথা। এরপর ২০১৮ সালে মোদী সরকার পাশ-ফেল প্রথা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়। ওই বছরই লোকসভায় এবং পরের বছর (২০১৯) রাজ্যসভায় গৃহীত হয় সংশোধনী বিল (যদিও স্কুলশিক্ষার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে রাজ্যগুলি)। ইতিমধ্যেই ১৬টি রাজ্য এবং দু’টি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল কেন্দ্রের নীতি অনুযায়ী পাশ-ফেল প্রথা চালু করেছে।
এবারে গত ১৬ ডিসেম্বর থেকে লাগু হয়েছে 'Right to Free Compulsory Child Education Amendment Rules 2024' যা মোতাবেক পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির অন্তে পরীক্ষায় যদি কোনও ছাত্র ফেল করে, তাকে দু' মাসের মধ্যে আরও একবার পরীক্ষার সুযোগ দেওয়া হবে; কিন্তু তারপরেও যদি কেউ ফেল করে তাহলে তাকে উক্ত শ্রেণিতে আটকে দিতে হবে। পশ্চিমবঙ্গ এখনও এই সিদ্ধান্ত না নিলেও সম্ভবত নেওয়ার পথে।
এ তো শুধু কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার, তাদের শিক্ষানীতি-- এসবের দিকে আঙ্গুল তোলার বিষয় নয়। তা করলে দায় এড়ানো যায় মাত্র। ওই যে এআইডিএসও, যারা কত দশক ধরে দাবি করে চলেছে প্রাথমিক স্তরে পাশ-ফেল ফিরিয়ে আনতে হবে; বিদ্যালয়ে যান, বহু শিক্ষক, বা বলতে পারেন প্রায় সব শিক্ষক মনে করেন, পাশ-ফেল নেই বলে পড়াশোনা লাটে উঠেছে। অভিভাবকরা মনে করেন, পাশ-ফেল নেই বলে ছাত্রদের মধ্যে পড়ার তাগিদ নেই। শিক্ষকের ভেতরও পড়ানোর তাগিদ নেই, কারণ, শিক্ষকের সাফল্যের মাপকাঠি তো ওই পাশ-ফেল।
আসুন একটু খুঁটিয়ে বিচার করে দেখি। পাস কি ছিল না? গ্রেডেশন ছিল তো। এ, এ প্লাস, ডাবল এ, বি, বি প্লাস, সি, সি প্লাস, আর ডি মানে ছিল নন-কোয়ালিফাইড, দুর্বলতম চিহ্নিত করা। তাহলে কেন পাশ-ফেল ফিরিয়ে আনার প্রশ্ন আসছে, ছিলই তো। যেটা ছিল না, 'ফেল' শব্দের অর্থটা একটু পরিবর্তিত হয়েছিল। দুর্বলতমকে চিহ্নিত করা হত কিন্তু তাকে শিক্ষার চলন্ত গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়া হত না। তোমার দ্বারা হবে না, তুমি এ গাড়ি থেকে নেমে যাও, এটা ছিল না। তাকে বলা হত, এই বিষয়গুলো আরেকটু যত্ন নাও না হলে পরের ক্লাসে তুমি এগোতে পারবে না, উচ্চ বুনিয়াদির গণ্ডি পেরতে পারবে না। একটা স্তর পর্যন্ত সেই দুর্বলতম শিশুটিকে সঙ্গে নিয়ে চলা হত। এর ফলে তার মধ্যে হীনম্মন্যতা কাজ করত না। অনিবার্য ড্রপ-আউট ঘটত না। বিদ্যালয় শ্রেণি কক্ষ, শিক্ষক, ছাত্র, বন্ধুবান্ধব, এই সামগ্রিক পরিবেশে তার সামাজিক কিছু একটা অর্জন হত। আর হয়তো কিছু কিছু পুঁথিগত শিক্ষাও অর্জন হত। 'ফেল' প্রথা চালু করে তাকে ড্রপ-আউট হতে বাধ্য করা হল।
বহুবারের চর্চিত বহু লেখায় কথিত উদাহরণটি আর একবার বলতে হয়। যে ছাত্রটি ফেল প্রথা না থাকার ফলে সকল বিষয়ে শূন্য, তিন, পাঁচ, এরকম নম্বর পেয়ে দিব্যি পরের ক্লাসে উঠে যায়, সেই ছেলেটিকে খেলার মাঠে দেখেছি ক্লাশ লিগে মাঠের পাশে এক্সট্রা প্লেয়ার হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। উত্তেজনায় ছটফট করছে। হঠাৎই ওদের সতীর্থের একটা সজোর ক্রস সেন্টার ফাঁকা বক্সের সামনে ওরই আরেক বন্ধু নাগাল পেল না। সকলেই হায় হায় করল, ইস একটু পা ঠেকালেই অনিবার্য গোল। কিন্তু সাইড লাইনের পাশে দাঁড়ানো ফেল করা ছাত্রটি বলল, না স্যার, বলটায় যা পাঞ্চ ছিল ওটা অনেক জোরে ঘোরাতে হত, তবে গোলে থাকত, ঠেকালে ওটা বাইরেই চলে যেত। একটা প্রচণ্ড গতিতে ধাবমান বস্তুকে তার ডিরেকশন চেঞ্জ করানোর জন্য বা ৯০ ডিগ্রি ঘোরানোর জন্য কতটা শক্তি প্রয়োজন, অঙ্কে ও জানে না। কিন্তু খেলার মাঠে বাস্তবে সেটা জানে। 'ফেল' চালু করলে মাঠে এই ছেলেটাকে আমি মিস করতাম। পড়াশোনায় মন নেই যে ছেলেটার, সে কিন্তু বাড়তি শক্তি প্রয়োগ না করেই অবলীলায় মাঠের বাইরে ছক্কা হাঁকায়। নিজের অজান্তে মাটি থেকে ৪৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে বলটাকে রাখে অঙ্ক না জেনেই।
শুধু তো 'ফেল' বন্ধ করা ছিল না। বলা হল, সবচেয়ে পিছিয়ে পড়াদের নিয়ে রেমিডিয়াল ক্লাস হবে। যে ছাত্র যে বিষয়ে পশ্চাদপদ, তাদের নিয়ে গ্রুপ করে রুটিনে রেমিডিয়াল ক্লাস রাখা হত। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, বিদ্যালয়ের সবচেয়ে ফাঁকিবাজ শিক্ষকরা ক্লাস রুটিনে রেমিডিয়াল ক্লাসগুলোর দায়িত্ব নিত। কারণ, তাদের দর্শন হল, পরের ছেলে পরমানন্দ/ যত গোল্লায় যায় ততই আনন্দ। অতএব, ক্লাস রুটিনে শেষের দিকে থাকবে রেমিডিয়াল ক্লাস। আর সেই ক্লাসগুলি কার্যত কখনই নেওয়া হবে না। আরেকটা প্রবণতাও দেখেছি, শিক্ষকরা রেমিডিয়াল ক্লাস নিতে হবে এই আশঙ্কায় সেই অতিরিক্ত দায়িত্ব এড়ানোর জন্য নিজেরা আগেই ঠিক করে নিল, পরীক্ষায় কাউকেই কোনও বিষয়ে 'ডি' দেখানো হবে না। তাহলে রেমিডিয়াল ক্লাসেরও দরকার হবে না। ফলে, শিক্ষক যদি হন রাজহংস, তাহলে যেভাবেই দাও না কেন, উনি ঠিক নিজের মতো করে দুধটুকু খেয়ে নেবেন, জল পড়ে থাকবে।
আমি নিজে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে যুক্ত ছিলাম যেখানে ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির ড্রপ-আউট ছাত্রদের খুঁজে আনা হত তথাকথিত পশ্চাৎপদ পাঁচটি জেলা থেকে-- বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর ও হাওড়া-হুগলির প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে। লক্ষ্য ছিল, একটি নতুন সিলেবাস তৈরি করে ওই ছাত্রদের প্রথম এক বছর সমস্ত বিষয় যা বিদ্যালয়ে পড়ানো হয় তার যুক্তিভিত্তিক শিক্ষা দেওয়া হবে কিন্তু বিদ্যালয়ের পরীক্ষার সিলেবাসটি অনুসরণ করা হবে না; দ্বিতীয় বছর ওই ছাত্রদের নবম ও দশম শ্রেণির সিলেবাস অনুসরণ করে পড়ানো হবে। ওই এক বছরেই তারা মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসবে। স্থানীয় একটি স্কুল এ কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে এল। মোট কুড়িজন এসেছিল। দু' বছর পর তারা প্রত্যেকে মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হল, কেবল একজন ছাড়া। পরের ব্যাচে (২০+১)=২১ জন বসল, সকলেই পাস করল। ক্লাস সিক্সের ড্রপ-আউট ছাত্র, সে মাত্র দু' বছরে মাধ্যমিক পাস করেছে। যারা 'ফেল প্রথা' চালু করার প্রশ্নে এত সরব, তারা ভেবে দেখবেন আমাদের ওই প্রজেক্ট কীভাবে সম্ভব হয়েছিল। আমার নিজের কাছেই এটা ছিল অবিশ্বাস্য।
শিখন পর্বের একটা স্তর পর্যন্ত তুমি ফেল, তুমি ব্যর্থ, তোমাকে দিয়ে হবে না, এ কথা বলা যায় না। শিশুকে কতবারের চেষ্টায় হাঁটতে হবে, এটা নির্দিষ্ট করা যায় না। কতবারের চেষ্টায় গাছে উঠতে পারবে, এটা নির্দিষ্ট করে দেওয়া যায় না। শিশু কতবারের চেষ্টায় মা-বাবা শব্দগুলি বলতে শিখবে, তা নির্দিষ্ট করা যায় না। ঠিক একই কারণে উচ্চ বুনিয়াদি স্তর পর্যন্ত এই সমগ্র আট বছর শিশুর কাছে একটা প্যাকেজ; এর মধ্যে কেউ ৩০ শতাংশ কেউ ৬০ শতাংশ কেউ ৮৫ শতাংশ শিখবে। আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় যে সমস্ত বিষয় বোধগম্য হত না, পাঁচ বছর পর সেগুলোই বোধগম্য হচ্ছে। এটাই বাস্তব। আমার মনে আছে, একটি বই হাতে এসেছিল, যেটা পড়ে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। ফলে, ১০-১২ পাতার বেশি এগোতে পারিনি। ভাষা ও যুক্তি, কোনওটাই বোধগম্য ছিল না। একজন শিক্ষককে আমি সে কথা বলেছিলাম। সঙ্গে এটাও বলেছিলাম, আমাকে একটু বুঝিয়ে দেবেন? সেই শিক্ষক বলেছিলেন, যেখানে আটকে গেছ সেটাকে উপেক্ষা করেই পরের অংশে এগিয়ে যাও। এভাবে ছোটখাটো বাঁধাগুলো পেরিয়ে যাবার পর এক সময় দেখবে, আগের না বোঝা অংশগুলো তোমার কাছে স্পষ্ট হচ্ছে। ঠিক এই কারণেই, কোথাও আটকে গেলেই তুমি ব্যর্থ, তুমি ফেল, তুমি ড্রপ-আউট, তোমাকে দিয়ে হবে না, এই নীতি শিখন পদ্ধতির পরিপন্থী।
আমার বিশ্বাস, ফেল করানো ও তাকে শিক্ষা প্রণালী থেকে ছেঁটে ফেলা গণশিক্ষার পরিপন্থী। একবার ভাবুন, প্রথম প্রজন্মের যে ছাত্র বিদ্যালয়ে এল, সে তো সফলভাবে শিক্ষা প্রণালীর সঙ্গে অভিযোজন করতে পারবে না। এটাই স্বাভাবিক ধরা আছে। জানা আছে। আমাদের ঘরের সন্তানটি বিদ্যালয় থেকে বাড়িতে ফিরেও মা-বাবা কাকা পিসি দাদু ঠাকুমা বন্ধুবান্ধব পাড়ার কাকা পিসি মামা মাসি সকলের সাহচর্যে শেখে। বিদ্যালয়ের শিক্ষা গৃহের চৌহদ্দিতেও চলতে থাকে। ফলে, সে কৃতকার্য হবে পাশ করবে, ওটাই তো স্বাভাবিক। আর প্রথম প্রজন্মের যে শিশুটি বিদ্যালয়ে পড়তে এল, তার কাছে বইয়ের ভাষা বিমূর্ত, ওই ভাষায় সে কথা বলে না। পরিবারের কেউ বলে না। বিষয়বস্তু বিমূর্ত, তার প্রাত্যহিক জীবন চর্চার বিষয় নয়। বাড়ি ফিরে যে পরিবেশ, সেখানেও তার বিদ্যালয়ের শিক্ষা বিষয়ক চর্চার সুযোগ নেই। ও তো ড্রপ-আউট হবার জন্যই এসেছে। আমার সন্তানের নৌকা চড়ায় আটকে গেলে পরিবারের সকলে মিলে সেই নৌকা ঠেলে দিই। নৌকা তরতর করে এগিয়ে যায়। কিন্তু প্রথম প্রজন্মের ছাত্র, তার নৌকাটি আটকে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। বাড়িতে সেটাকে কেউ ঠেলে দেওয়ার নেই। ফলে, বিদ্যালয়ের দায়িত্ব তাকে কিছুতেই ড্রপ-আউট হতে না দেওয়া। খাবার দিয়ে, পোশাক দিয়ে, নানা আর্থিক সহায়তা দিয়ে, সাইকেল, জামা জুতো দিয়ে, ওর মনের মতো বইপত্র তৈরি করে, ওকে ধরে রাখাটাই কাজ। ফেল পদ্ধতি এসে গণশিক্ষার এই কাজটাকেই ধ্বংস করতে চাইছে।
যে সব মানুষ পাশ-ফেল উঠে গেল, সব গেল, সব গেল করে চেঁচিয়েছেন, তাদের কাছে একটাই প্রশ্ন, ইঞ্জিনিয়ারিং'এর এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ৬৮ হাজার, ৭২ হাজার স্থান পেয়েও ইঞ্জিনিয়ার হওয়া যায়। এখন তো ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের আসন ফাঁকা পড়ে থাকে। পুরো প্যানেল শেষ হয়ে যায়। অর্থাৎ, শেষতম ব্যক্তিও ইঞ্জিনিয়ার হতে পারে। আর ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষায় ফেল করে অকৃতকার্য, এমনটাও শোনা যায় না। ডাক্তারি পরীক্ষায় এমবিবিএস'এ ফেল শুনেছেন নাকি? আর ডাক্তারির পিজি এন্ট্রান্সে যারা অংশ নেয়, তারা সকলেই পিজিতে চান্স পায়। প্যানেলের শেষ ব্যক্তিটিও। শুধু পছন্দের মতো বিষয় পায় না হয়তো। কই, এ নিয়ে তো কোনও হইচই নেই? আসলে এখানেই সমস্যা। ইঞ্জিনিয়ার-ডাক্তার হতে আসে আমারই ঘরের ছেলেমেয়েরা। আমরাই তার বেনিফিশিয়ারি গ্রুপ। অতএব, এখানে পাশ ফেল না থাকা সমস্যা না। কিন্তু সরকারি বিদ্যালয়ে প্রাথমিক স্তর ও উচ্চ বুনিয়াদি থেকে পাশ-ফেল চালু না করলে, প্রান্তবাসী, সমাজের অন্ত্যজ জন প্রবেশাধিকার পেয়ে যাবে। একলব্যের মতো, ঘিনুয়ার মতো, বাঘারুর মতো, কোগার মতো সহজ মানুষগুলোকে শুরু থেকেই শিক্ষার অঙ্গনে প্রবেশাধিকার দেওয়া যাবে না এবং একালের দ্রোণাচার্যরা তাই 'ফেল ব্যবস্থা' চালু করার জন্য এত সোচ্চার।
বন্ধু বলল, শুধু সামাজিক দিকটাই দেখলে। অর্থনীতিটা ভাবো একবার। নিম্ন স্তরে বুনিয়াদি শিক্ষায় সরকারি স্কুলগুলিতে দরিদ্রতম মানুষ পড়তে যায়। ওখানে রাজকোষের পয়সা যাতে না ব্যয় হয় সেটা লক্ষ্য। কোটি কোটি প্রান্তবাসীকে ন্যূনতম শিক্ষা দেওয়ার খরচটুকু করা যাবে না আর উচ্চশিক্ষায় সরকারি কলেজ, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ কৌলিন্যের শীর্ষে। সেখানে উচ্চবিত্ত প্রবেশাধিকার পায়। অতএব, ওখানে পাশ-ফেল'এর বিষয়টা রাখা চলবে না। তাহলে বেসরকারি কলেজ ছাত্র পাবে কোথায়, আর ব্যবসাই বা জমবে কী করে। কেপিসি হলদিয়াকে ছাত্র পেতে হবে তো। তাই, ওখানে সকলেই পাশ।
'মানুষ বড় বেশি গেলে, এত খেলে চলে' বের্টোল্ড ব্রেখটের সেই কবিতা। গরিব মানুষের জন্য রাজকোষ খুলে দিলে পেটুক জনতা সব শেষ করে দেবে। অতএব, রাজকোষের যা কিছু তা বরাদ্দ থাকবে দুধে ভাতে ঘিয়ে, হলুদ মাখা গায়ের জন্য সংরক্ষিত। সেখান থেকে নিচের তলায় ফিলট্রেশন পদ্ধতিতে যেটুকু চুঁইয়ে চুঁইয়ে পৌঁছবে সেটাই ওদের পক্ষে যথেষ্ট। কল্যাণকামী রাষ্ট্রের ধারণার ঠিক বিপরীতে এই অর্থনৈতিক ধারণার অবস্থান। সকলকে নিয়ে উন্নতির শিখরে পৌঁছনো যায় না। তাই, বাছাই করা অল্প কিছুকে নিয়ে শিখরে আরোহন করার অর্থনীতি।