রাজনীতি যখন দৃশ্যমান কথোপকথন
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
সম্প্রতি নেপালের অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান ও প্রধানমন্ত্রী ওলি’র পদত্যাগের পরেই প্রায় সর্বত্রই রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে Gen Z শব্দটি। দেখা যায়, শুধু নেপালে নয়, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ এবং অতি সম্প্রতি মাদাগাস্কার, কেনিয়া, পেরু, মরক্কো, ইন্দোনেশিয়া সহ আমাদের দেশে লাদাখ, বিহার ও অসমের কিছু অঞ্চলে এর অনুরণন পৌঁছেছে। অর্থনীতির সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতির পরিসরেও যে অবশ্যম্ভাবী এক বিপুল পরিবর্তনের সামনে আমরা আজ এসে দাঁড়িয়েছি, এ তারই এক সুস্পষ্ট ও সুদূরপ্রসারী ইঙ্গিত।
Gen Z হল ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে যাদের জন্ম, সেইসব কিশোর (কিশোরী) ও তরুণী (তরুণ)’দের দল, এই ২০২৫ সালে যাদের বয়স ১৩ থেকে ২৮’এর মধ্যে। এদের ‘ডিজিটাল নেটিভস’ও বলা হয়, কারণ, এরা ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া ও স্মার্ট ফোনের যুগে বড় হয়েছে। একইসঙ্গে তারা তাদের আগের প্রজন্মের থেকে এক বড় break (চ্যুতি) ও continuity (ধারাবাহিকতা)। তাদের বাবা-মা, চাচা-চাচী, বিশেষত দাদু-দিদা’দের প্রজন্ম অবিরাম বকাঝকা করে চলেছে, নিত্য হা-হুতাশ করছে, এমনকী গালিগালাজও দিচ্ছে এই বলে যে, তারা সকলে নাকি সব উচ্ছন্নে গেছে, বই-টই কিছু পড়ে না, এমনকি খবরের কাগজও নয়, টিভি’ও দেখে না, স্কুল-কলেজে খুব যে মতিগতি আছে তাও নয়, সারাদিন স্মার্ট ফোন নিয়ে বসে থাকে, রিল বানায়, অন্যের রিল চাটে, চ্যাট করে, ইউটিউব অথবা ওটিটি দেখে, নিদেনপক্ষে কোথাও হ্যাং-আউট করে, কে মরল কে বাঁচল তা নিয়েও নাকি তাদের কোনও হুঁশ নেই। অথচ এতসব গালমন্দ ও অপবাদের পরেও, ‘গল্প হলেও সত্যি’র মতো তারাই আবার হাজারে হাজারে রাস্তায় নেমে নিজেদের জীবন বাজী রেখে অপশাসনের শীর্ষ স্তম্ভকে গুড়িয়ে দেয়। পুরনো প্রজন্মের বুড়ো ভামেরা নিজেদের অক্ষমতাকে আড়াল করতে এই Gen Z’কে যখন নীতি-নৈতিকতার তরজা শোনায়, নিজেদের ভরা যৌবনকালের পাণ্ডিত্যের কৌলিন্য ও বীরত্বের দোহাই দিয়ে ‘আজকালকার ছেলেপিলেরা সব ভোগে গেছে’ বলে মদের গেলাস ঠোকে, তখনই সোশ্যাল মিডিয়ার পাতাল থেকে Gen Z আচম্বিতে রাস্তায় নেমে দেখিয়ে দেয় যাকে বলে, ‘Where order is injustice, disorder is the beginning of justice.’ (রমাঁ রল্যাঁ)। পুরনো, পচাগলা সমাজ ও রাজনীতির শৃঙ্খলকে তারা নিমেষে ভেঙে ফেলে, কারণ, তাদের অগ্রগণ্য ভূমিকায় প্রাণিত ও সাহসী হয়ে পথে নেমে আসে অগণিত শ্রমজীবী মানুষের দল যারা এক ঘৃণ্য অব্যবস্থায় দিনের পর দিন নিষ্পেষিত হয়েছে। তবে, সেই উদ্গত বিশৃঙ্খলা আদপে ন্যায়ের সূচনা করে কিনা, সে প্রশ্ন থেকে যায় বটে, কিন্তু অচলায়তনকে যে নিশ্চিত ভেঙে ফেলতে হয়, সে প্রত্যয়ী পাঠ Gen Z অর্জন করে। এটাই এখন বিশ্বের উদীয়মান new normal। Gen Z’র রাজনীতি।
কিন্তু সে নতুন রাজনীতির ভাষা কেমন? তার আদর্শ অথবা মতাদর্শই বা কী? এ এক জটিল প্রশ্ন। তা পুরনো প্রজন্মের কাছে আরও জটিল, কারণ, তাদের চোখে ছানি, কানে তুলো, মনে কালি আর মুখে ক্লিশে বাণী। ফলে, তাঁদের পক্ষে সে রাজনীতিকে উপলব্ধ করার বৃথা চেষ্টা বিনা আর উপায়ই বা কী? যারা কিছু বুঝলেন তো খুব ভালো, একটা আলাপের পরিসর গড়ে উঠতে পারে; যারা পারলেন না, তারা যদি আরও কষ্টকল্পিত মাথা ঠোকেন তবে হতাশাই প্রাপ্তি।
প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো, Gen Z’র ভাষা প্রথাগত বক্তৃতা বা সংবাদপত্রের নিবন্ধের মতো নয়; অল্প কথায়, তা অধি-দৃশ্যমান, সংক্ষিপ্ত ও প্রচ্ছন্নভাবে ব্যঙ্গাত্মক। যেমন,
১) মিম ও জিফ: জটিল রাজনৈতিক বা সামাজিক আলোচনাকে একটি ব্যঙ্গাত্মক ছবির মাধ্যমে প্রকাশ করা। দীর্ঘ প্রবন্ধের পরিবর্তে একটি মিমের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে দ্রুত বার্তা পৌঁছে দেওয়া। ফলে, রাজনৈতিক সক্রিয়তাকে মজাদার ও সহজে ভাগ করে নেওয়া যায়।
২) যথাযথ বক্তব্য: দীর্ঘ টেক্সট’এর পরিবর্তে ইনস্টাগ্রাম রিল, টিকটক ভিডিও ও হোয়াটসঅ্যাপ স্ট্যাটাসের মতো সংক্ষিপ্ত, যথাযথ ও দ্রুত ফরম্যাট ব্যবহার করা। তথ্যকে যথার্থ করে তোলা। Gen Z বিশ্বাস করে, কোনও ইস্যুতে মানুষের মনোযোগ ধরে রাখার জন্য ৩০ সেকেন্ডের রিল অনেক বেশি সক্ষম।
৩) ডিজিটাল ও ইনক্লুসিভ (অন্তর্ভুক্তিমূলক) ভাষা: ‘FOMO’, ‘Vibe’, ‘No Cap’, ‘Delulu’ জাতীয় স্ল্যাং (আমাদের দেশে ইংরেজি-মিশ্রিত Gen Z স্ল্যাং বা শব্দ) ও লিঙ্গ-নিরপেক্ষ শব্দ ব্যবহার করা। ফলে, একটি অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীগত পরিচয় তৈরি হয়, যা নিজেদের মধ্যে সংহতি ও বোঝাপড়ার সহায়ক। এইভাবে তারা নিজেদের মধ্যকার কথাবার্তাকে আরও আন্তরিক ও ঘরোয়া করে তোলে।
৪) প্রামাণ্যতাকে গুরুত্ব দেওয়া: অত্যধিক চাকচিক্য ভূষিত, আনুষ্ঠানিক ও কর্পোরেট ধরনের বার্তাকে তারা ফেক মনে করে। তারা এমন লেখক, কন্টেন্ট ক্রিয়েটর ও ইনফ্লুয়েন্সারদের বিশ্বাস করতে চায় যারা নিজেদের ব্যক্তিগত জীবন বা দুর্বলতাকে প্রকাশ করতে ভয় পান না।
৫) বয়ানের মধ্যে বয়ান: একটি বয়ানে একাধিক সাংস্কৃতিক রেফারেন্স (যেমন, পপ-সংস্কৃতি, অ্যানিমে, পুরনো ইন্টারনেট ট্রেন্ড) ব্যবহার করা এদের অভ্যাস। যারা এই কোড বোঝে, কেবল তারাই যোগ দিতে পারে। ফলে, তা হয়ে ওঠে গভীর বোঝাপড়ার এক কমিউনিটি যা বার্তাটিকে বাইরের লোকেদের কাছে দুর্বোধ্য করে তুলে নিজেদের সুরক্ষিত রাখে।
এবারে তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্নটি হল, Gen Z কি সর্বতোভাবেই এক নতুন মতাদর্শগত আধার গড়ে তুলেছে? তারা কি এক নতুন রাজনীতির ভিত্তির উপর দাঁড়াতে চাইছে? এইসব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে তর্কের অবকাশ আছে, তবে তারা যে পুরনো প্রজন্মের থেকে এক অর্থবহ দূরত্বে সমান্তরাল পথ খুঁজে পেয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। যেমন, তাদের রাজনৈতিক অবস্থান বিশেষ ভাবে প্রয়োজন ভিত্তিক ও নির্দিষ্ট ইস্যু-কেন্দ্রিক, যা আগের প্রজন্মের দল-ভিত্তিক ও আদর্শ-কেন্দ্রিকতা থেকে একেবারেই ভিন্ন। আমরা দেখেছি, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, নেপাল, মাদাগাস্কার’এ সরকারি দুর্নীতি একটি বড়সড় ইস্যু হিসাবে Gen Z’কে পথে নামতে প্ররোচিত করেছে। পাশাপাশি, রাজনৈতিক স্বৈরাচার, গণহত্যা, ইন্টারনেট শাটডাউন, মূল্যবৃদ্ধি এইগুলিও বড় কারণ। এইসব ক্ষেত্রে, ইনফ্লুয়েন্সার, কন্টেন্ট ক্রিয়েটার ও নিজ নিজ গোষ্ঠী থেকে পাওয়া তথ্যকেই তারা গ্রাহ্য করে, যদিও যথেষ্ট ভাবে যাচাই করে নিয়েই। নেপালের অভ্যুত্থানে ‘হামি নেপাল’এর প্রতিষ্ঠাতা সুদান গুরুং’এর বিপুল প্রভাব স্মর্তব্য। লাদাখের জনজাগরণে সোনম ওয়াংচুকের প্রভাব খুবই শক্তিশালী। প্রথাগত মিডিয়াকে (সংবাদপত্র, টিভি) তারা একেবারেই পরোয়া করে না। বিশেষ করে আজকের সময়ে ধর্ম-বর্ণ-জাতপাত-জাতি-লিঙ্গগত বিভাজন যখন রাজনীতির প্রায় মূল অক্ষরেখা হয়ে উঠেছে, তখন তারা ঐক্য ও অন্তর্ভুক্তিকরণের রাজনীতিকেই আঁকড়ে ধরে, যেখানে লিঙ্গ, জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে নানাবিধ বৈচিত্র্যকে স্বাভাবিক মনে করা হয়। সংক্ষেপে, পুরনো প্রজন্ম যেখানে রাজনীতিকে একটি পদ্ধতিগত ও আনুষ্ঠানিক আলোচনা হিসেবে দেখে, Gen Z সেখানে রাজনীতিকে গতিশীল, ব্যক্তিগত ও দৃশ্যমান কথোপকথন হিসেবে গণ্য করে। হয়তো তা আপাতদৃষ্টিতে স্মার্টফোন কেন্দ্রিক, কিন্তু তা বাস্তবোচিত ও বিবিধ কর্মসূচিরও অন্তর্গত। সবচেয়ে বড় কথা, তা চলমান পরিস্থিতিকে যথার্থ ও পক্ষপাতহীন ভাবে বোঝার চেষ্টা করা এবং তার মোকাবিলায় উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া, অহেতুক মিথ্যার বেসাতি করে অথবা গুজব ছড়িয়ে পক্ষপাতদুষ্ট কোনও দলীয় রাজনৈতিক অভিসন্ধিকে পূরণ করা নয়। কারণ, এই প্রজন্মের কাছে রাজনীতির অর্থ নিছক ভোট দেওয়া নয়, প্রতিদিনের জীবনে মিম তৈরি, হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ডিং, পথে নামা, বিদ্রোহ করা এবং ন্যায়বিচার চাওয়া।
কিন্তু শুধু এটুকু বললে গল্পের অর্ধেকটা বলা হয়। বুঝতে হবে, ইতিমধ্যে সমাজ ও অর্থনীতিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যে আমূল পরিবর্তন এনেছে ও কার্যত এক প্যারাডাইম শিফট সাধন করেছে, তা বহুলাংশে Gen Z’কে নবতর এক সামাজিক স্তর হিসেবে নির্মাণ করেছে।
প্রথমত, যুগপ্রজন্ম হওয়ার কারণে Gen Z যেহেতু AI-দক্ষ, ফলে, AI-প্রুফ দক্ষতাগুলিকে— সৃজনশীলতা, মৌলিক চিন্তাভাবনা ও ব্যক্তিক যোগাযোগের কারুকৌশল— তারা সহজেই অর্জন করতে পারে আর সেইহেতু বহুমুখি আয়ের উৎস তৈরি করে কর্মজীবনকে বহুমুখি করতে তারা পারদর্শী।
দ্বিতীয়ত, তারা AI’র চরিত্র-চিত্রণে সড়গড় হওয়ায় যেহেতু জানে যে কাজের নিরাপত্তা নিয়ে প্রভূত সংশয়ের কারণ আছে, তাই, উচ্চ বেতনের পিছনে অন্ধভাবে না দৌড়ে অর্থপূর্ণ কাজ, সামাজিক উদ্দেশ্য পূরণ, জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে নমনীয়তা অবলম্বন ও মানসিক স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দিয়ে এক স্বাস্থ্যকর জীবনপ্রবাহ গড়ে তুলতে আগ্রহী হয়। যেমন, কলেজের অনর্থক ডিগ্রি অর্জনের পিছনে সময় নষ্ট না করে অনেকেই নিজ গুণে সচ্ছল কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে নেয়। ফলে, তারা খুব স্বাভাবিক ভাবেই সামাজিক সচেতনতার উপাদানগুলিকে সযত্নে বহন করে। আর এই কারণেই তারা রাজনৈতিক স্বৈরাচার ও দুর্নীতির উপরে সাড়ে ষোলোআনা খড়্গহস্ত। প্রায় প্রতিটি দেশের Gen Z অভ্যুত্থানে এই আক্রোশটি বেশ নজর কেড়েছে। নেপালে ‘নেপো কিড’দের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভের প্রকাশ আমরা দেখেছি।
তৃতীয়ত, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নৈতিকতা ও তথ্য সুরক্ষার বিষয়েও তারা অতিসচেতন।
সব মিলিয়ে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে এমন এক রূপান্তরের শক্তি যা সামগ্রিক ভাবে Gen Z’র অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভূমিকা, কর্মজীবনের পথ ও মূল্যবোধকে মৌলিকভাবে সংজ্ঞায়িত করছে। আর এই উৎসভূমি থেকেই জারিত হচ্ছে সমাজ-বিপ্লবের এক অভিনব অগ্নুৎগীরণ, যা তুলনারহিত।
আমরা নতুন এক যুগ সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছি। যে কোনও রাজনৈতিক দল বা শাসন ক্ষমতা যে কোনও মুহূর্তে চকিতে ভূলুন্ঠিত হতে পারে। Gen Z আজ বিশ্বে সব থেকে শক্তিশালী সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তি। আমাদের দেশের শাসকেরাও যেন তা পদে পদে স্মরণে রাখে।