ধর্মীয় মেরুকরণও আরেক উদ্দেশ্য
নজরুল আহমেদ জমাদার
সংসদের দুই কক্ষেই ওয়াকফ সংশোধনী বিল পাস করিয়ে তাদের রাজনৈতিক ও আদর্শগত এজেন্ডার সাফল্যের জন্য আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল আরএসএস-বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার। হিন্দু রাষ্ট্র রূপায়ণের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে প্রাথমিকভাবে তিনটি এজেন্ডা নিয়ে রাজনৈতিক ময়দানে নেমেছিল গেরুয়া বাহিনী। প্রথমটি হল, বাবরি মসজিদ ভেঙে রাম মন্দির তৈরি করা। দ্বিতীয় এজেন্ডা, কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা বাতিল করা। এই দুটি এজেন্ডা ইতিমধ্যেই সফল হয়েছে। তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হল ইউনিফর্ম সিভিল কোড (অভিন্ন দেওয়ানী বিধি) চালু করা। সেটা এখনও বাস্তবিক সফল হয়নি। সংবিধান বিরোধী ওয়াকফ বিল পাস করিয়ে তৃতীয় রাজনৈতিক এজেন্ডার সাফল্যের প্রাথমিক কাজটা সম্পূর্ণ করল তারা। সার্বিক ভাবে ভারতীয় সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার উপর এটা একটা বড় আঘাত। শুধু তাই নয়, ওয়াকফ সম্পত্তির উপর কর্পোরেট লুট চালানোর উদ্দেশ্যও এই বিল আনার অন্যতম কারণ।
আসলে, ওয়াকফ বিষয়টা নিয়ে আমাদের সমাজের বিরাট অংশের মানুষ সেই অর্থে ওয়াকিবহাল নয়। এতটুকুই জানে যে এটা মুসলমানদের ব্যাপার। বৃহত্তর সমাজের মানুষের অজ্ঞতার কারণেই বিজেপি ও আরএসএস'এর সুবিধা হয়ে যায় অসাংবিধানিক বিল পাস করিয়ে নিতে, আর সংসদের দুই কক্ষেই যখন তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। বৃহত্তর সমাজের মানুষ যদি বিজেপি'র রাজনৈতিক অভিসন্ধি জানত তাহলে একটা প্রতিবাদ আগে থেকেই আসত। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংসদের বাইরে বৃহত্তর সমাজের মতামতও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
ওয়াকফ বিষয়টা কী? এটার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক ভিত্তিটাই বা কী? পৃথিবীতে ইসলামের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই ওয়াকফের ধারণাটি চালু হয়েছিল। যদিও এই লেখার মধ্যে মূলত ভারতবর্ষে ওয়াকফের ইতিহাসটি বলা হবে। 'মুসলিম পার্সোনাল ল' অনুযায়ী কোনও ব্যক্তি যখন নগদ বা দান হিসেবে নিজের স্থাবর এবং অস্থাবর সম্পদের আংশিক বা পুরো অংশটি দলিলের মাধ্যমে আল্লাহ'র উদ্দেশ্যে দান করেন সেটাকেই ওয়াকফ বলা হয়। এটা মাথায় রাখতে হবে, যারা অমুসলিম তারাও এই দান করতে পারেন। কিন্তু ওয়াকফ সম্পত্তি শুধু মুসলমানদের উন্নয়নেই কাজে লাগাতে হবে। এই দান অপরিবর্তনীয় এবং স্থায়ী। একবার যদি কোনও সম্পত্তি ওয়াকফ হিসাবে ধার্য হয় সেটা আর ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। যিনি ধর্মীয় বা দাতব্য উদ্দেশ্যে 'ওয়াকফ' তৈরি করেন তাকে 'ওয়াকিফ' বলা হয়। যেহেতু আল্লাহ দৃশ্যমান নয়, আল্লাহ'র উদ্দেশ্যে দান করা এই সম্পত্তি পরিচালনার জন্য একজনকে নিয়োগ করা হয়, যাকে বলা হয় 'মুতাওয়াল্লি'।
আল্লাহ'র উদ্দেশ্যে দান করা সম্পত্তিগুলি কোন কোন কাজে ব্যবহার করা হবে বা কোনগুলোকে ওয়াকফ সম্পত্তি বলে বিবেচনা করা হবে? মসজিদ, ঈদগাহ, খানকাহ, দরগা, কবরস্থান, এতিমখানা-- এইগুলির কাজে ওয়াকফ সম্পত্তিকে ব্যবহার করা হবে। এছাড়াও মুসলমানদের অন্যান্য উন্নয়নের বিভিন্ন কাজেও ওয়াকফ সম্পত্তি ব্যবহার করার বিধান আছে। প্রতিটি রাজ্যে ওয়াকফ বোর্ড রয়েছে। এটি একটা আইনগত প্রতিষ্ঠান। ওয়াকফ সম্পত্তি অর্জন, ধারণ এবং হস্তান্তরের ক্ষমতা একমাত্র বোর্ডের হাতেই থাকে। ভারতে ওয়াকফের ইতিহাস জানতে হলে সুলতানি যুগে ফিরে যেতে হবে। সুলতান মইজুদ্দিন সাম তৎকালীন জামে মসজিদকে দুটো গ্রাম উৎসর্গ করেছিলেন। ইতিহাসের ওই ঘটনাটিকেই ওয়াকফের প্রথম ধারণা ধরে নেওয়া হয়। সুলতানি ও মুঘল যুগ ধরে যত ইসলামী রাজবংশ ভারতে বিস্তার লাভ করেছে তার সঙ্গে সমানভাবে ওয়াকফ সম্পত্তিও বেড়েছে।
এবার দেখে নেওয়া যাক স্বাধীন ভারতে ওয়াকফের ইতিহাস। স্বাধীন ভারতে প্রথম ওয়াকফের কেন্দ্রীকরণ হয় ১৯৫৪ সালের আইনে। এই আইনের ভিত্তিতেই ১৯৬৪ সালে প্রথম কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিল (Central Waqf Council) নামে একটি আইনগত সংস্থা তৈরি করা হয়। এই কাউন্সিল বিভিন্ন রাজ্যের ওয়াকফ বোর্ডগুলির অধীনে থেকে কাজ তদারকি করে। এরপর ১৯৯৫ সালের আইনে বিভিন্ন রাজ্যের ওয়াকফ বোর্ড, কেন্দ্রীয় কাউন্সিল ও মুতাওয়াল্লিদের ক্ষমতা ও কার্যাবলী আরও বিশদে ঠিক করে দেওয়া হয়। এই আইনের দ্বারা ওয়াকফ ট্রাইব্যুনালের ক্ষমতাও ঠিক করে দেওয়া হয়। ওয়াকফ বিষয়ে কোনও বিবাদ এবং গণ্ডগোল হলে এই ট্রাইব্যুনাল তার বিচার করবে। এরপর ওয়াকফ ব্যবস্থাকে আরও দৃঢ় ও সুষ্ঠু করার জন্য ২০১৩ সালে আরেকটি সংশোধনী আনা হয়। কিন্তু কখনই ওয়াকফ সম্পত্তি নির্ধারণ ও পরিচালনার ব্যাপারে সরকার সরাসরি হস্তক্ষেপ করেনি।
বিজেপি সরকার যে বিলটি সংসদে পাস করল তাতে এই প্রথম ওয়াকফের বিষয়ে সরাসরি সরকারি হস্তক্ষেপ করার সুযোগ থাকছে। এই বিল অনুযায়ী ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিম সদস্য রাখার কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে ওয়াকফ বোর্ডের ক্ষমতাও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওয়াকফের বিষয়ে কোনও গণ্ডগোলের মামলা হলে তার বিচার আগে ট্রাইব্যুনাল করত। কিন্তু নতুন বিলে ওয়াকফ সম্পত্তি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষমতা ওয়াকফ ট্রাইব্যুনালের বদলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা কালেক্টরের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। ফলে, যে ওয়াকফ সম্পত্তি মুসলমানদের উন্নয়নের জন্য তৈরি হয়েছিল সেখানে সরাসরি এবার সরকার হস্তক্ষেপ করবে। এটা ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক অধিকারকে লঙ্ঘন করছে। এই বিলে এটাও বলে দেওয়া আছে, কেউ যদি তার সম্পত্তি ওয়াকফ হিসাবে দান করতে চায় তাহলে তাকে পাঁচ বছর ইসলাম ধর্ম পালন করতে হবে। এটাও ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী ধর্মীয় স্বাধীনতার যে মৌলিক অধিকার তার পরিপন্থী। ভারতীয় সংবিধানের ২৫ থেকে ২৮ অনুচ্ছেদে ধর্মের অধিকারের কথা বলা আছে। এখানে হিন্দু ধর্মীয় ট্রাস্ট, শিখদের গুরুদুয়ারা ও চার্চের ওপর সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু নতুন ওয়াকফ সংশোধনী বিল সরাসরি মুসলমানদের নিজস্ব অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ।
বিজেপি সরকারের এই ওয়াকফ বিল আনার রাজনৈতিক অভিসন্ধিটা কী? দুটি কারণে এই বিল আনা হয়েছে। একটা হল, চিরাচরিত ভাবে সমাজে হিন্দু-মুসলমান ভাগ করে নির্বাচনের ময়দান থেকে ফসল তোলা। আর তার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে হিন্দু রাষ্ট্র রূপায়ণের সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য। দ্বিতীয় অভিসন্ধিটা হল, ওয়াকফের জমির উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে ধীরে ধীরে এই জমিগুলি কর্পোরেট সংস্থাগুলির হাতে তুলে দেওয়া, যে সংস্থাগুলি গত এক দশকের উপর মোদি সরকারকে ভারতের ক্ষমতায় থাকতে সহযোগিতা করেছে। বাবরি মসজিদ ভেঙে রাম মন্দির নির্মাণ ও কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপের পর আরএসএস'এর তৃতীয় বড় এজেন্ডা হল ইউনিফর্ম সিভিল কোড চালু করা। ইউনিফর্ম সিভিল কোড চালুর সঙ্গে হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণের গভীর যোগ রয়েছে। অর্থাৎ, মুসলিমদের যে নিজস্ব আইন রয়েছে যেটা ভারতীয় সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত সেটাকে তুলে দেওয়া বিজেপির অন্যতম লক্ষ্য। ইউনিফর্ম সিভিল কোড চালু করার প্রাথমিক পদক্ষেপই হল নতুন ওয়াকফ বিল।
ওয়াকফ বিষয়টি 'মুসলিম পার্সোনাল ল'এর সঙ্গে যুক্ত। ওয়াকফ সম্পত্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ মানে 'মুসলিম পার্সোনাল ল'তেই হস্তক্ষেপ করা। এটা করা মানে ইউনিফর্ম সিভিল কোড চালুর দিকে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া। ইতিমধ্যেই নতুন বিলকে সাফাই দিতে বিজেপি যুক্তি দেখিয়েছে, ট্রাইব্যুনাল হল আলাদা বিচার ব্যবস্থা যা অসাংবিধানিক এবং একটা সমান্তরাল বিচার ব্যবস্থা তৈরি করে। ওয়াকফ ট্রাইব্যুনালকে তারা খাপ পঞ্চায়েত বলেও বর্ণনা করেছে। নতুন ওয়াকফ বিল যে ইউনিফর্ম সিভিল কোডেরই প্রাথমিক পদক্ষেপ, বিজেপির এই কথা থেকে সেটা পরিষ্কার। বিজেপি'র এই বক্তব্য অত্যন্ত অযৌক্তিক এবং ভারতের সংবিধান বিরোধী। তাছাড়া ওয়াকফ ট্রাইব্যুনালের বিচারক সাধারণত হাই কোর্ট বা জেলা জজ পদমর্যাদার একজন মানুষ হন। আসলে, ওয়াকফ সম্পত্তিকে বিশেষ সুবিধা হিসেবে দেখিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ভোটব্যাঙ্ককে একত্রিত করার কৌশলই হল এই বিলের অন্তর্নিহিত রাজনীতি। ওয়াকফ বোর্ডের ওপর নিয়ন্ত্রণ আসলে মুসলিম সম্প্রদায়কে 'অন্যান্য' (Other) হিসেবে চিহ্নিত করে রাজনৈতিক মেরুকরণ ঘটানোর প্রয়াস। আর অন্যদিকে, এর বিরোধিতা করতে গিয়ে মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ যদি কোনও ভাবেই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে সেটা দেখিয়ে সংখ্যাগুরু হিন্দু ভোট ব্যাঙ্কের মেরুকরণ ঘটাতেই বিজেপি'র সুবিধা হবে। ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্রে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। ২০২৬ বিধানসভা নির্বাচনে মেরুকরণের রাজনীতি হবে বিজেপির হাতিয়ার। ঠিক সেই যুক্তিতে ওয়াকফ বিলকে সামনে এনে সমাজকে বিভাজনের একটা চেষ্টা তারা করছে।
গোটা পৃথিবীর মধ্যে ভারতেই সব থেকে বেশি ওয়াকফ সম্পত্তি আছে। সেনাবাহিনী ও ভারতীয় রেলের পরেই সব থেকে বেশি সম্পত্তি ওয়াকফের। ভারতে প্রায় ৯ লক্ষ একর জমি নিয়ন্ত্রণ করে ওয়াকফ বোর্ড যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ১.২ লক্ষ কোটি টাকা। বোঝাই যাচ্ছে, এই বিশাল পরিমাণ সম্পত্তির প্রতি কর্পোরেটের একটা নজর আছে। এই ওয়াকফ সম্পত্তির উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ কর্পোরেটের স্বার্থসিদ্ধি করবে। আরও পরিষ্কার করে বললে, আদানি, আম্বানিদের হাতে এই সম্পত্তি তুলে দেওয়ার একটা কৌশলও হতে পারে এই বিল। বিজেপি সরকারের নিও-লিবারাল অর্থনীতি নির্ভর শাসনব্যবস্থা কর্পোরেট স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়, যেখানে ধর্মীয় বা জনকল্যাণমূলক জমির ব্যবহারকে 'আর্থিক লাভ'এর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়। ফলে, ওয়াকফ বোর্ডের ক্ষমতা খর্ব করে সরকার এই জমিগুলি কর্পোরেট বা উন্নয়ন প্রকল্পে হস্তান্তরের রাস্তা তৈরি করছে বলে মনে হয়।
এই বিলকে হয়তো সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ খুব সাধারণ ভাবেই দেখবে। তাদের মনে হতেই পারে, ওটা আর এমন কী? সরকার তো কতই বিল পাস করে এইরকম। ব্যাপারটা ঠিক সেরকম নয়। বাবরি মসজিদ ভেঙে রাম মন্দির বানানো, ৩৭০ ধারা তুলে দেওয়ার মতোই নতুন ওয়াকফ বিল হল বিজেপি পরিচালিত রাষ্ট্রের একটা উগ্র আধিপত্যের প্রকাশ। ইতালীয় মার্কসীয় চিন্তক অ্যান্টোনিও গ্রামসির মতে, রাষ্ট্র শুধু বলপ্রয়োগ করে না, বরং সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করে নিজেদের আদর্শ চাপিয়ে দেয়। এই নতুন ওয়াকফ বিলের মাধ্যমে বিজেপি সরকার মুসলিমদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বায়ত্তশাসনে হস্তক্ষেপ করছে, যা সংখ্যাগুরুবাদী (হিন্দুত্ববাদী) সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার একটি কৌশল। ওয়াকফ বোর্ড এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেটি মুসলিম সমাজের আত্মপরিচয়, সামাজিক কল্যাণ ও সংহতির বাহক। এই প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা হ্রাস করে সরকার গণতান্ত্রিক চর্চার পরিসরকেও (যেটাকে জার্মান দার্শনিক জারগন হেবারমাস বলেছেন 'পাবলিক স্ফিয়ার') সংকুচিত করছে। ভারতবর্ষে মুসলমানরা শুধু ধর্মীয়ভাবে সংখ্যালঘু নয়, তারা আর্থ-সামাজিক ভাবেও অত্যন্ত পিছিয়ে। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে বলতে গেলে পুঁজিবাদ যখন স্বাভাবিকভাবে (উৎপাদনের মাধ্যমে) মুনাফা করতে ব্যর্থ হয়, তখন রাষ্ট্র ও বাজার একত্র হয়ে দরিদ্র, প্রান্তিক জনগণের সম্পদ, জমি, বসতি বা প্রাকৃতিক সম্পদ কেড়ে নেয় এবং তা পুঁজির আওতায় নিয়ে আসে। ব্রিটিশ মার্কসীয় দার্শনিক ডেভিড হার্ভের 'Accumulation by Dispossession' তত্ত্ব অনুসারে, পুঁজিবাদী রাষ্ট্র দুর্বল গোষ্ঠীর সম্পদ কেড়ে নিয়ে ধনীদের হাতে তুলে দেয়। বিজেপি পরিচালিত সরকার একইভাবে মুসলমানদের হাত থেকে ওয়াকফ সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে আদানি-আম্বানিদের হাতে তুলে দিতে চাইছে। যে ভাবে গোটা ভারত জুড়ে দলিত, আদিবাসীদের জমি এবং জঙ্গল কেড়ে নেওয়া হচ্ছে কর্পোরেট স্বার্থে, ঠিক একই কায়দায় ওয়াকফ সম্পত্তিও মুসলমানদের হাত থেকে কেড়ে নিতে চাইছে সরকার।
বিজেপি সরকারের এই নতুন বিলের বিরুদ্ধে কংগ্রেস ও বাম দল সহ বিরোধী দলগুলি সোচ্চার হয়েছে। এই বিলের বিরুদ্ধে সংসদে ভোট দিয়েছে তারা। কিন্তু বিজেপির দুই জোট শরিক নীতিশ কুমার ও চন্দ্রবাবু নাইডুর দল এই বিলকে সমর্থন করা নিয়ে প্রথম দিকে ধন্দে থাকলেও শেষ পর্যন্ত তারা জোট রক্ষার স্বার্থে এই বিলে সমর্থন দিয়েছে। যদিও এটা নিয়ে নীতিশ কুমারের দলের মধ্যে ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। এই বিলের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই কোর্টে মামলা হয়েছে। যদিও সম্প্রতি অতীত বলে, আদালতের রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের পক্ষেই গেছে। বিজেপি সরকারের আমলে আদালত সহ সমস্ত গণতান্ত্রিক সংস্থাগুলি কার্যত নিজেদের মতো করে তাদের কাজ পরিচালনা করতে পারছে না বলে অভিযোগ। এমতাবস্থায় আদালতের কাছ থেকে ওয়াকফ বিল নিয়ে আশাজনক রায় কতটা পাওয়া যাবে সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কেননা, সমস্ত গণতান্ত্রিক সংস্থাগুলোর ইতিমধ্যে রাজনীতিকরণ ঘটে গেছে। এটা বুঝতে হবে, ওয়াকফ সম্পত্তির উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ শুধু মুসলমানদের অধিকারের ওপর আঘাত নয়, এটি সার্বিক ভাবে ভারতীয় সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা ও বহুত্ববাদের উপর একটা বড় ধাক্কা।