Wednesday, 2 April 2025

নীল অর্থনীতি

সমুদ্র উপকূলে রাজ্যেরও অধিকার থাকা উচিত

দীপঙ্কর দে



আগামী দিনে যে বিষয়ে ভারতের সমুদ্র উপকূলবর্তী রাজ্যগুলির সঙ্গে ভারত সরকারের বিরোধ অবশ্যম্ভাবী, সেটি হল, 'কন্টিনেন্টাল শেলফ' বা মহীসোপানকে কেন্দ্র করে যে বিশাল অর্থনীতি তৈরি হচ্ছে তার ভাগ-বাঁটোয়ারা কী ভাবে হবে তা নিয়ে! তবে আগে বোঝা উচিত, 'কন্টিনেন্টাল শেলফ' বা মহীসোপান কাকে বলে। 'কন্টিনেন্টাল শেলফ' বা মহীসোপান হচ্ছে সমুদ্র তীরবর্তী দেশগুলোর সমুদ্রের দিকে জলের নীচে যে ভূখণ্ড ধীরে ধীরে ঢালু হয়ে নেমে যায়; ভূগোলের ভাষায় 'মহীসোপান', যাকে উপকূলীয় ওই দেশের বর্ধিত অংশ বলে ধরা হয়ে থাকে।

এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইন কি বলে? ১৯৫৮ সালের কনভেনশন অনুযায়ী, সমুদ্র তীরবর্তী দেশগুলোর স্থলভাগের বেসলাইন থেকে লম্বালম্বিভাবে সমুদ্রের ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত এলাকার মালিকানা সম্পূর্ণ ওই দেশের। একে বলা হয় Exclusive Economic Zone (EEZ) বা একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল, যেখানে সমুদ্রের জল ও তলদেশের ওপর ওই দেশের একচ্ছত্র অধিকার থাকে। সেখানকার সমুদ্রে অন্য কোনও দেশ মাছ ধরতে পারে না। এরপর থেকে দেড়শো নটিক্যাল মাইল সীমা পর্যন্ত সমুদ্র তলদেশের খনিজ সম্পদের মালিক হবে ওই দেশ, তবে সমুদ্রের জলে থাকা মাছ ধরতে পারে অন্য দেশও। এই পুরো সাড়ে তিনশো নটিক্যাল মাইলকে ওই দেশের 'মহীসোপান' বলা হয়।

এই যে মহীসোপানকে কেন্দ্র করে ক্রম-নির্মিত বিশাল অর্থনীতি, তার সঙ্গে কীভাবে আমাদের দেশে কেন্দ্র-রাজ্য বিরোধ তৈরি হচ্ছে তা উদাহরণ দিয়ে বললে বুঝতে সহজ হবে! যেমন, এখন যেহেতু উপকূল সংক্রান্ত যাবতীয় সিদ্ধান্তের একচেটিয়া অধিকারী ভারত সরকার তাই বোম্বে হাই থেকে যে তেল ও গ্যাস উৎপাদন হয় তা থেকে মহারাষ্ট্র সরকার রয়্যালটি বাবদ এক কানাকড়িও পায় না! সবটাই যায় কেন্দ্রের পকেটে; যেমন, ২০১২-১৩ সালে ONGC সমুদ্রতল থেকে তোলা তেলের রয়্যালটি বাবদ ৩৯৪০ কোটি টাকা ভারত সরকারকে দিয়েছে। অথচ, অসম বা ত্রিপুরার স্থলভূমি থেকে উৎপাদিত তেল ও গ্যাসের রয়্যালটি কিন্তু পায় সংশ্লিষ্ট রাজ্য। কয়লার ক্ষেত্রেও রাজ্যগুলি রয়্যালটি পায়। তাহলে একইভাবে মহীসোপানে প্রাপ্ত সম্পদের ওপরেও রাজ্য সরকারের রয়্যালটি পাওয়ার ন্যায্যতা থাকবে না কেন? স্বভাবতই, বাংলার সমুদ্র উপকূলে যদি তেল ও গ্যাসের সন্ধান মেলে সেই সম্পদের উপর বাংলার কোনও অধিকার কি থাকা উচিত নয়? 

ভারতের নয়টি উপকূল রাজ্যগুলির সমুদ্রতটের দৈর্ঘ্য ৫৪২২.৬ কিমি। মনে রাখতে হবে, নয়টি উপকূলীয় রাজ্য ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন দ্বীপপুঞ্জকে ঘিরেও যে মহীসোপান বিদ্যমান, সেগুলির মালিকানাও ভারত রাষ্ট্রের! এই সংখ্যাকে ৩৫০ নটিক্যাল মাইল দিয়ে গুন করলে যে বর্গ ক্ষেত্রটির আয়তন পাওয়া যাবে সেটি আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে ভারত রাষ্ট্রের অংশ। এই বিশাল মহীসোপান অঞ্চলের সম্পদের মালিক ভারত রাষ্ট্র। মোট মহীসোপান অঞ্চলের আয়তন ভারতের মোট স্থলভূমির (৩২,৮৭,২৬৩ বর্গ কিমি) প্রায় সমান।

কিন্তু অদ্ভূতুড়ে বাস্তবতা হচ্ছে, এই বিশাল নীল অর্থব্যবস্থায় (Blue economy) বাংলার মতো উপকূলবর্তী রাজ্যগুলির কোনও ভাগ নেই। ভারতের নয়টি রাজ্যের সবচেয়ে বড় উপকূল রয়েছে গুজরাতে (দৈর্ঘ্য ১২১৪.৭ কিমি)। সবচেয়ে ছোট উপকূল গোয়ার (দৈর্ঘ্য ১০১ কিমি)। আর পশ্চিমবঙ্গের উপকূলের দৈর্ঘ্য ১৫৭.৫ কিমি। তাহলে বাংলার সামুদ্রিক অঞ্চলের (মহীসোপান) আয়তন কত? মনে রাখতে হবে, উপকূল থেকে মহীসোপানের ব্যাপ্তি ৩৫০ নটিক্যাল মাইল। এক নটিক্যাল মাইল সমান ১.৮৫২ কিমি। তাই অঙ্কের হিসেবে বাংলার সমুদ্র অঞ্চলের আয়তন হচ্ছে: ১৫৭.৬ x ৩৫০ x ১.৮৫২ বর্গ কিমি, মানে, ১০২০৯১.৫ বর্গ কিমি। আর বাংলার স্থলভাগের পরিমাণ মাত্র ৮৮,৭৫২ বর্গ কিমি। 

ভারতের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৯৭ বলছে, (১) ভারতের আঞ্চলিক জলসীমা, মহাদেশীয় তাক অথবা একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে সমুদ্রের নীচে অবস্থিত সমস্ত জমি, খনিজ ও অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র কেন্দ্রের অধীনে থাকবে এবং তাদের উদ্দেশ্যে অধিকৃত হবে; (২) ভারতের একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলের অন্যান্য সমস্ত সম্পদও কেন্দ্রের উপর ন্যস্ত থাকবে এবং তাদের উদ্দেশ্যে ধারণ করা হবে। তাই বোঝাই যাচ্ছে, মহীসোপানের সব সম্পদের একচেটিয়া মালিক কেন্দ্রের সরকার। উপকূলবর্তী রাজ্যের কোনও অধিকার নেই। বলাই বাহুল্য, সংবিধান রচিত হয়েছিল ১৯৫০ সালে। গত ৭৫ বছরে সমুদ্র বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে সমুদ্রাঞ্চলের অর্থনৈতিক গুরুত্ব দিন দিন বেড়েছে। আগেই বলেছি, ব্লু ইকোনমি বা নীল অর্থনীতি নামে তৈরি হয়েছে একটি স্বতন্ত্র অর্থনীতির পরিসর। এই বিশাল সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র থেকে রাজ্যগুলিকে বঞ্চিত করা অনৈতিক। তাই যুক্তরাষ্ট্রীয় মতাদর্শের স্বার্থে সংবিধানের ২৯৭ অনুচ্ছেদ নতুন করে লিখতে হবে। এটা সময়ের দাবি !

আরও একটি কারণে মহীসোপানের সুস্থায়ী উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণে উপকূলবাসী ও রাজ্য সরকারের অংশগ্রহণ খুব জরুরি। সেটি হল, সমুদ্রের গভীর বা তলদেশ থেকে যদি অত্যধিক মাত্রায় খনিজ সম্পদ উত্তোলনের কাজ শুরু হয়, তাহলে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস হয়ে যাবে, যার ভয়াবহ প্রভাব মানবজাতিও এড়াতে পারবে না। এ নিয়ে ইতিমধ্যেই বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করতে শুরু করেছেন। বিশ্ব জুড়ে প্রতিবাদ আন্দোলনও চলছে। ইতিমধ্যে ভারতের আওতাধীন সামুদ্রিক এলাকায়, যেমন, কেরালা, গুজরাত এবং আন্দামান ও নিকোবরের উপকূলীয় অঞ্চল বরাবর দূরবর্তী গভীর জলভাগ থেকে সামুদ্রিক খনিজ উত্তোলনের জন্য খনন কাজ শুরু করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। এমনকী, এই মর্মে টেন্ডারও ডাকা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু উপকূলবাসীর কোনও মতামত গ্রহণ করা হয়নি। উপকূলে বসবাসকারী আমজনতা এই খনন কাজ শুরু করার পক্ষপাতী নয়। তাদের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যেই প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। কিন্তু সাংবিধানিক অধিকারের বলে কেন্দ্রীয় সরকার তাদের সিদ্ধান্তে অটল। এখানেই বিপদ লুকিয়ে।

তাই, নীল অর্থনীতিতে উপকূলবর্তী রাজ্যগুলিরও সমান হক আছে, সে দাবি এবার সজোরে ওঠা উচিত।


1 comment:

  1. নয়া ভাবনা নয়া বিষয় ।

    ReplyDelete