হত্যা বিনা ধর্ষণও অমার্জনীয় অপরাধ
শ্রীপর্ণা চক্রবর্তী
আরজিকর ধর্ষণ কাণ্ডের পর এক সপ্তাহের বেশি অতিবাহিত। আপাতভাবে নাগরিক সমাজ তার এ যাবৎকালীন নিরবচ্ছিন্ন মৌনব্রত ভঙ্গ করার প্রমাণ দিয়ে যারপরনাই লড়েছে-লড়ছে, ফলস্বরূপ দেশ ও দেশের গণ্ডির বাইরেও সে যজ্ঞের আহুতির ধূম্র পৌঁছেছে একপ্রকার। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন, 'The world is a dangerous place, not because of those who do evil, but because of those who look on and do nothing.'।
তদন্ত আপাতত সিবিআই'এর হাতে, কলকাতা হাইকোর্টের নজরদারিতে। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিও সুয়ো মটো এই ঘটনা ও বিষয়টিকে নিজের বেঞ্চে এনেছেন; শুনানি ২০ অগস্ট। এই মুহূর্তে তদন্তের ফয়সালা সিবিআইকেই করতে হবে। কেসটিকে গ্রহণ করার পর ৪-৫ দিন কেটেও গেল, কিন্তু এখন পর্যন্ত নতুন কোনও অগ্রগতি হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে না। এটা কি তদন্তে ব্যর্থতা, নাকি যা ঘটেছে সেই মোতাবেকই তদন্ত এগোচ্ছে?
অতীত ঘাঁটাঘাঁটি করলে আরজিকর হাসপাতালটি সম্পর্কে কিছু তথ্য উঠে আসে যা না চাইলেও বুননে জুড়ে যায় আপনা আপনি। ২০০১ সালে ডাঃ সৌমিত্র বিশ্বাসের দেহাংশ মেলে শহরেরই আরেকটি নামী চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে ভ্রমণবাক্স বন্দী হয়ে। ২০০৩'এ ডাঃ অরিজিৎ দত্ত হাতের শিরা কেটে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেন, তাঁর রক্তে মিলেছিল মাত্রাতিরিক্ত সিডাটিভ। ২০১৬ সালে অধ্যাপক গৌতম পালকে পাওয়া যায় তাঁরই নিজের বাড়ির মধ্যে গলিত অবস্থায়। ২০২০ সালে ডাঃ পৌলমী সাহা এই হাসপাতালের আপৎকালীন বিভাগের ছ' তলা থেকে লাফ দিয়ে মারা যান। ২০২৩'এ ডাঃ শুভ্রজ্যোতি দাসের মৃতদেহে পাওয়া যায় অতিরিক্ত মাদক। সর্বশেষ ২০২৪'এর অগস্ট মাসে এই হত্যাকাণ্ড। আরজিকর হাসপাতালটির সঙ্গে যুক্ত এই কর্মীদের একটি 'আত্মহত্যা'র ক্ষেত্রেও মৃত্যুপত্র পাওয়া যায়নি এবং চর্চিত মতানুযায়ী উল্লিখিত প্রতিটা মৃত্যুই ঘটে এই সরকারি প্রতিষ্ঠানে হয়ে চলা অসামাজিক কার্যলাপের (কথিত কখনও তা চেতনানাশক ওষুধ চক্র, কখনও তা যৌনচক্র) বিরুদ্ধ স্বর হয়ে দাঁড়াতে গিয়ে। এবারের মৃত্যুটিও প্রতিবারের মতোই সংশয়ের জন্ম দিয়েছে।
লক্ষণীয়, ঘটনার পরম্পরা না বদলালেও ইতিমধ্যে রাজ্যের শাসনভার কিন্তু পরিবর্তিত হয়েছে। অর্থাৎ, এটুকু স্পষ্ট যে, এই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তাদেরই কর্মীদের মৃত্যু এ রাজ্য অতীতেও দেখেছে। আর দুর্নীতি যে এই দেশের ভিত্তি তা আজ আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
বলা যায়, এ মৃত্যু যেন আড়ালে রাখা এক জিজ্ঞাসাপত্র জনগণের সামনে নিয়ে এসেছে। তাদের জিজ্ঞাস্য: (১) এই সরকারি হাসপাতালটির চিরাচরিত দুর্নীতি ও তাতে যুক্ত উচ্চপদাসীন ব্যক্তি কিংবা ব্যক্তিবর্গের কতটা ক্ষমতা? (২) প্রথম ভাষ্যে হাসপাতাল বা পুলিশের পক্ষ থেকে ঘটনাটিকে 'আত্মহনন' হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাওয়ার অপপ্রচেষ্টা কেন? (৩) একজন আপাত ক্ষমতাহীন 'সিভিক ভলান্টিয়ার' কীভাবে সর্বেসর্বা হয়ে উঠতে পারে? (৪) কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষা বিশেষত নারী সুরক্ষার এত দুরবস্থা কেন? এবং সর্বোপরি তদন্ত ও সুবিচার প্রসঙ্গে মানুষের আস্থাহীনতা।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো'র ২০২১'এর তথ্যানুযায়ী, ভারতে প্রতিদিন গড়ে ৮৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ভারতে বিবাহিত নারী ও শিশুদের ক্ষেত্রে ধর্ষণের মোট পরিসংখ্যানের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই গার্হস্থ্য বা পারিবারিক ধর্ষণের অন্তর্গত। উল্লেখ্য, মধ্যপ্রদেশের রেওয়া এলাকায় গত ২৪ এপ্রিল নয় বছর বয়সী এক শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। দেহ উদ্ধার হয় তার বাড়ির উঠোন থেকে। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ঘটনার রাতে ওই বালিকা তার দাদার সঙ্গে ঘুমোচ্ছিল। অভিযুক্ত কিশোর, অর্থাৎ, তার ১৩ বছর বয়সী দাদা সেই সময় নীলছবি দেখে সেটির নকল করতে গিয়ে বোনটিকে ধর্ষণ করে। পরে বোনটি বাড়িতে ঘটনা বলে দেওয়ার কথা জানালে, ভয়ে দাদা শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এরপর সে তার মাকে ডেকে সব জানায়। মা এসে দেখে তার মেয়ে তখনও জীবিত। ছেলেকে বাঁচাতে মা নিজেই মেয়ের শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যা করে।
ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে (NFHS) অনুসারে, দেশের বিবাহিত নারীদের ক্ষেত্রে যৌন সহিংসতার ৯০ শতাংশেরও বেশি ঘটনা তাদের স্বামীর দ্বারা সংঘটিত হয়। এ ধরনের গার্হস্থ্য ধর্ষণ আইনগতভাবে এখনও 'ধর্ষণ' হিসেবে স্বীকৃত নয়, কারণ ভারতীয় আইন অনুযায়ী বৈবাহিক ধর্ষণ অপরাধ হিসেবে গণ্যই করা হয় না!
তাই কৌতূহলের বশে জানতে ইচ্ছা করে, এরপর? আন্দোলন অব্যাহত রাখতে অঙ্গীকারবদ্ধ যে সমাজকে আমরা আজ দেখছি, তাদের আন্দোলনের মূল ভিত্তি নিয়েই যে বড় সংশয়! দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক তরজার ফাঁকে 'ধর্ষণ'এর মতো 'ছোট ঘটনা' সত্যিই কোথাও যেন গৌণ হয়ে যায় এ রাজ্য বা দেশে তো বটেই, গোটা পৃথিবীতেই। আমরা কবে উপলব্ধ হব যে হত্যা ব্যতিরেকেও একটি ধর্ষণ এক অমার্জনীয় অপরাধ এবং কখনই তা 'স্বাভাবিক' জৈবিক ক্রিয়া নয়? আর কতটা কাল পেরিয়ে আমরা ধর্ষণের প্রতিটি ঘটনাকে চরম হিংস্র ও অন্যায় হিসেবে স্বীকার করে তার বিরুদ্ধে সরব হব? চূড়ান্ত নৃশংসতার রূপ না নিলে সে ধর্ষণের ঘটনা প্রতিবাদের বিষয় হিসেবে অযোগ্য - এ ভ্রান্ত ধারণা থেকে মুক্তিই বা কবে ঘটবে? আমরা কি কোনও এক আশ্চর্য মাপকাঠি তৈরি করেছি এই পৈশাচিকতাকে পরিমাপ করতে?
অজুহাতের পর্দায় নারী কিংবা প্রান্তিক লিঙ্গের বক্ষ কোটি ছোঁওয়া, কখনও গায়ে ঢলে জোর খাটানো, করমর্দনের অছিলায় হাত নিষ্পেষণ, অনাহূত স্পর্শ, আচম্বিতে ঊরুতে চপেটাঘাত বা কুরুচিপূর্ণ বার্তা—এই আচরণগুলোর মধ্যেই সংকীর্ণতার সূত্রপাত। 'আজি এ প্রভাতে রবির কর/ কেমনে পশিল প্রাণের পর' এবং পুরুষ দাঁড়িয়ে পড়ল- পুরুষাঙ্গ দাঁড়িয়ে পড়ল ধর্ষণের স্বার্থে- এমনটা বোধহয় একেবারেই না। প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠ শুরু হয় এ সকল 'ছোট ছোট' আপত্তিকর আচরণ থেকেই, যা পরে ভয়ঙ্করের স্পর্ধা দেয়। সিমোন দে বোভোয়ার তাঁর বিখ্যাত এবং বিতর্কিত সৃষ্টি 'The Second Sex'এ বলছেন, 'The myth of rape as a sexual act masks its true nature as an act of violence.'।
আজকের সমাজে সন্তানকে পড়াশোনা নিয়ে বকাঝকা করলেও তার চিত্ত চাঞ্চল্য এবং সুদূরপ্রসারী প্রভাবের কথা বলা হয়ে থাকে। অথচ শিশু অবস্থা থেকেই মামা-কাকা-দাদা, এমনকি কোনও কোনও ক্ষেত্রে বাবার দ্বারাও যে শারীরিক নিগ্রহ ঘটে চলে, তার কথা বলা হয় না এ সমাজে। বিকৃত সমাজে শিশুকে কোলে নেওয়ার অছিলায় তার যৌনাঙ্গ পেষণ কিংবা পুংযৌনাঙ্গে জোর করে হাত দেওয়ানো এসব খুব প্রচলিত অভ্যাস। অতঃপর প্রাকযৌবনে পৌঁছেই আমরা ধীরে ধীরে সংবেদনশীলতা হারিয়ে ফেলি, এই আচরণগুলোকে ‘স্বাভাবিক’ বলে মেনে নিই, যতক্ষণ না তা কোনও অলীক সীমা অতিক্রম করে। বহু ক্ষেত্রেই আমরা জানি চিনি আমাদের চারপাশের এই শিকারীকুলকে, কিন্তু আমরা তাদের সমাজের স্বাভাবিক অংশ হিসেবে মেনে নিই, আর সম্ভাব্য নিঠুর পরিণতিগুলোকে উপেক্ষা করি। তাই বারবার সেই একই কথা বলা, সুযোগ-সন্ধানী এ সকল পুরুষ সমমানের অপরাধী, এর মধ্যে লঘু-গুরু খোঁজ এক ধরনের বোকামি অথবা অবেহেলার অলংকরণ।
এ প্রসঙ্গে বারংবার আমাদের দেশে প্রকৃত শিক্ষা বা সচেতনতার অভাবের অজুহাত দিয়ে এই কঠিন সত্যকে ঢাকতে যাওয়াও অজ্ঞানতার পরিচয় রাখে। তথাকথিত 'উন্নত' দেশগুলোর ক্ষেত্রেও এর কোনও ব্যতিক্রম নেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর প্রায় ১ লক্ষ ২৫ হাজার ধর্ষণের অভিযোগ জমা পড়ে। যুক্তরাজ্যে বছরে তার সংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার এবং সুইডেনে প্রতি ১ লক্ষ জনসংখ্যায় প্রায় ৬০টি ধর্ষণের অভিযোগ, যা বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ। কারণস্বরূপ, যেখানে আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য এবং ক্ষমতার অপব্যবহারই মুখ্য সেখানে পশ্চিমা বিশ্বে আধিপত্য ও যৌনতা সংক্রান্ত উদ্ভট কল্পনা প্রভাবশালী বলে মনে করা হয়। প্রাচ্যের কিছু সমাজে ধর্ষণ প্রায়ই সম্মান রক্ষার বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই ধর্ষণের হেতু নিয়ে কথা বাড়ানো নিষ্প্রয়োজন; ধর্ষক যে কোনও পরিস্থিতিকেই তার অনুকূলে আনতে সচেষ্ট হবে, এই বলা ভালো। বরং ভুলে গেলে চলবে না আমাদেরই মধ্যের সেইসব মানুষদের কথা, যারা ঘটে যাওয়া কোনও ধর্ষণের দৃশ্যচিত্র দেখতে বারবার পর্দায় চোখ রাখে, প্রতিটি ঘৃণ্য খুঁটিনাটি উপভোগ করে পরতে পরতে, এই ঘটনার প্রতি স্তরের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ ঠোঁটস্থ করেই যেন তারা জনসমাবেশে উচ্চতায় পৌঁছয়। অথচ, অনেক সময়ে তাদের নিজেদেরও হয়তো সংশয় থাকে এসব দৃশ্যচিত্রের সত্যতা নিয়ে; হয়তো এভাবে ঘটনার বিবরণ আত্মস্থ করার ফলে তাদের মননে তা যৌন উত্তেজক হিসেবে কাজ করে।
শেষ করি অরুন্ধতী রায়ের উদ্ধৃতি দিয়ে: 'Rape is more than a violation of a woman’s body; it is a violation of her soul, a crime that scars her deeply.' (সূত্র: The Ministry of Utmost Happiness)। তাই ঘরে বাইরে, সংসারে, কর্মক্ষেত্রে নারী নিরাপত্তা বাড়ানো ও অপরাধের সুচারু ও স্বচ্ছ তদন্তভার শাসকগোষ্ঠীর ওপর বর্তালেও, সামগ্রিকভাবে 'মানুষ' হয়ে ওঠার দায় কিন্তু একান্ত মানুষেরই; তাই সে চেতনার হাতেখড়ি হোক এবং 'নারী' হয়ে বাঁচার লড়াইয়ের অন্ত এ গোলকের আগামী প্রজন্ম অন্তত দেখুক।
খুব ই যুক্তিপূর্ণ লেখা।
ReplyDeleteকথাটা হচ্ছে অহরহ এই যে সর্বক্ষেত্রে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে চলেছে, স্বীকার করতেই হবে যে তা সর্বদা এক অভিঘাত তৈরি করেনা।
নির্যাতিতার সামাজিক অবস্থান যে একটা খুব ই গুরুত্বপূর্ণ শর্ত
তা কি অস্বীকার করতে পারি?
কখনও ধর্ষককে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করব আবার কখনও তার শাস্তি চেয়ে জনজীবনকে বিপন্ন করব।
ইঁটভাটার মহিলা শ্রমিক যখন কাজের জায়গায় নিয়মিত ধর্ষিতা হন, আমাদের কিচ্ছুটি এসে যায়না।
এখানে আছে রাজনীতির ফায়দা লোটার খেলা।
নির্লজ্জভাবে যা প্রকাশিত হয়ে পড়ে।
আর জি কর কাণ্ডেই তো দেখতে পাচ্ছি শ্লোগান পাল্টে যাচ্ছে
ভালো লাগলো লেখাটি। ভাবনায় স্পষ্টতা আছে।
ReplyDeleteধর্ষণের জীবানু প্রতিটি পুরুষের মধ্যে থাকে, কোথাও প্রকট হরমোনের ক্রিয়াশীল বাড়বাড়ন্তে। আর অপরাধ সংঘটিত হলে তার চরমতম রূপ হলো হত্যা। ফলে ক্ষমতা স্পর্ধা এখানে মাপকাঠি।।ধর্ষণের বিচার ভারতীয় বিচারব্যবস্থায় নেই।
আরা২০/৮
উন্নত সুশিক্ষিত দেশে ধর্ষণের এত বিস্তৃতি সত্যিই খুব উদ্বেগজনক।এই আলোচনায় বিভিন্ন দেশের প্রশাসন সেনাবাহিনী বিভিন্ন সময়ে দমন পীড়নের অঙ্গ হিসাবে ধর্ষণকে ব্যবহার করে বা করেছে সেই বিষয়টি উল্লেখ থাকলে ভালো হতো।সেক্ষেত্রে গণধর্ষণ শুধু কিছু ব্যক্তির দ্বারা সংগঠিত অপরাধ নয় বরং রাষ্ট্রযন্ত্রের দ্বারা সংগঠিত পরিকল্পিত অপরাধ। দুঃখের বিষয় এই ঘৃণ্য অপরাধের প্রায়শ কোনো বিচার হয় না
ReplyDelete