Tuesday, 13 August 2024

আবার হিন্ডেনবার্গ

ব্যক্তিগত দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন

পার্থ হালদার



দু' দিন আগে হিন্ডেনবার্গের আবার আক্রমণ দেখে সত্যিই চমকে উঠেছিলাম। বারবার মনে হচ্ছিল, 'শিব ঠাকুরের আপন দেশে আইনকানুন সর্বনেশে' লাইনটি। সত্যি বলতে কি, সাধারণ ছোট লগ্নিকারীরা  প্রকৃতই বিভ্রান্ত, কারণ শেয়ার বাজারের মূল ভরসা যে রেগুলেটার (SEBI, সেবি), তার  সর্বোচ্চ প্রধানের বিরুদ্ধে এবারে অভিযোগ। অভিযোগে বলা হয়েছে, সেবি প্রধান মাধবী পুরী বুচ ও তাঁর স্বামী অফ্শোর ফান্ডের মাধ্যমে আদানির কোম্পানিগুলিতে বিনিয়োগ করেছেন এবং অন্যায় ভাবে আদানির শেয়ারগুলির দাম বাড়ানো হয়েছে।

একটা সত্য আমরা সকলেই দেখছি যে, আদানির উপর অতীতে যে আরোপ এসেছে, সেগুলির সেভাবে কোনও তদন্তই হল না। আমরা খালি চোখে যা দেখতে পাচ্ছি, তা কোনও আইনি বৃত্তের মধ্যে কোথাও চোখে পড়ছে না, সেটাই আশ্চর্যের। পুরো বিষয়টা বোঝার জন্য কোনও বিশেষজ্ঞ না হলেও চলবে, কেবল গুগল সার্চ করে গত ৫ বছরে আদানির শেয়ারগুলির উত্থানের গ্রাফ দেখলেই তা বোঝা যাবে। আদানির কোম্পানিগুলি যে যে ক্ষেত্রে ব্যবসা করে, সেই ক্ষেত্রগুলিতে তো আরও অনেক প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিই ব্যবসা করে, সেই কোম্পানিগুলির শেয়ারের দাম কত শতাংশ বেড়েছে একই সময়ে, সেটাই দেখার। 

সেবি'র পক্ষ থেকে এই অভিযোগের বিরুদ্ধে উত্তর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যদি কিছু নাই ঘটে থাকবে তাহলে তো হিন্ডেনবার্গের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তা কিন্তু এখনও আমরা দেখতে পাচ্ছি না। কারণ, কেবলমাত্র শর্ট সেল করার  জন্য (সাধারণ মানুষের অবগতির জন্য জানাই, শেয়ার শুধুমাত্র কিনে তারপরে বেচে লাভ করাই একমাত্র পথ নয়, আগে বিক্রি করে পরে নিচু দামে কিনেও মুনাফা অর্জন করা যায়, যাকে 'শর্ট সেলিং' বলে) তারা যদি এটা করে থাকেন তা হলে তা নিশ্চয় অপরাধ। কিন্তু এর স্বার্থ জড়িয়ে আছে বহু ক্ষুদ্র লগ্নীকারীর ভবিষ্যতের সঙ্গে। তাছাড়া, যেহেতু সাধারণ মানুষের টাকা বিভিন্ন ফান্ডের মাধ্যমে বাজারে লগ্নী হয় ও সেই মানুষগুলোর ভবিষ্যতের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে, তাই এই খেলা রোজ রোজ চলতে পারে না। এর থেকে যে ক্ষতি হয়েছে, হচ্ছে এবং হতে পারে তার দায় কাউকে তো নিতেই হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার এবং বাজার নিয়ামক সংস্থার কাছে মানুষের একমাত্র প্রত্যাশা হল স্বচ্ছতা। তাই, সাধারণ মানুষ ও দেশের অর্থনীতির বৃহত্তর স্বার্থে অবিলম্বে সেবি চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবি, যা দেশের বিরোধী দলগুলি করছে, তা প্রকৃতই যুক্তিযুক্ত। 

গল্পের অন্যদিকে যদি হিন্ডেনবার্গ'এর মতো সংস্থা নিয়মিত এই ধরনের কাজ করতে থাকে, আইন ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রকৃত সত্য তদন্তের মাধ্যমে সামনে এনে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা তো সরকারের দায়িত্ব। এখন প্রশ্ন হল, সবেতেই এত বিলম্ব কেন? এত অস্বচ্ছতা কেন? কেবলমাত্র বিবৃতিতেই কি সব শেষ? JPC'তে আপত্তি কেন? আর এখানেই মনে হচ্ছে, 'চলতে গিয়ে কেউ যদি চায় এদিক ওদিক ডাইনে বাঁয়ে/ রাজার কাছে খবর ছোটে/  পল্টনেরা লাফিয়ে ওঠে, দুপুর রোদে ঘামিয়ে তায়, একুশ হাতা জল গেলায়'। তাই প্রশ্ন একটাই: স্বচ্ছতা। আপত্তি কোথায়? তাছাড়া যার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তার তো নিজেরই সরে দাঁড়ানো উচিত। 

অর্থনীতি একটি দেশের মূল চলিকাশক্তি। যদি সেই অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলির উপর প্রশ্নচিহ্ন লাগতে শুরু করে, তাহলে দেশের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে এবং অর্থনীতি ও গণতন্ত্রের কফিনে পেরেক মারার কাজ যে শুরু হল, তা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়। হিন্ডেনবার্গের নিয়মিত এই আক্রমণ যদি সঠিক না হয় তা তো দেশের অর্থনীতির উপরই আক্রমণ। সে ক্ষেত্রে বিরোধী দলগুলির বড় ভুমিকা আছে।  সরকার এবং বিরোধীপক্ষ যৌথ ভাবে তার মোকাবিলা করবে সেটাই স্বাভাবিক; কিন্তু এতে যদি সরকারি মহলের গাত্রদাহ হয় তা সন্দেহের। ১৯৯২ সালে হর্ষদ মেহেতা কেলেঙ্কারির সময় প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিমা রাও তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিংহ'এর মাধ্যমে সাংসদীয় যৌথ কমিটি তৈরি করেছিলেন এবং সেটাই স্বাভাবিক। তাই বর্তমানের এই লুকোচুরি খেলাটি সত্যিই দুর্বোধ্য। সাধারণ মানুষের স্বার্থে এই তদন্ত দীর্ঘায়িত হলে ভারতের অর্থনীতি ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রতি তা জেনেবুঝে গাফিলতি বলেই ধরে নেওয়া যেতে পারে। 

আরেকটা হাস্যকর ব্যাপার যা আজকাল রাস্তাঘাটে চোখে পড়ছে তা হল, এক ধরনের মানুষ যাদের বিন্দুমাত্র শেয়ার বাজারের সাথে যোগ নেই, তারাও সেবি এবং আদানিকে বাঁচাতে বাসে-ট্রামে-রাস্তায় ও চারিদিকে নেমে পড়েছে। এক শ্রেণির সাধারণ মানুষের আদানি ভক্তি চোখে পড়ার মতো। এটা কিছুটা আশ্চর্যের এবং হাস্যকর বলেই মনে হয় । 

যাই হোক, যত দ্রুত এই ঘটনা উন্মোচিত হবে ও স্বচ্ছতা বজায় রাখা যাবে ততই মঙ্গল। কিন্তু ব্যক্তিগত দুর্নীতি যদি প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন পেতে শুরু করে, তা দুর্ভাগ্যের। অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতা যদি বন্ধ হতে থাকে, স্বাভাবিক গণতন্ত্রও যে অবরুদ্ধ হয়, তা বলাই বাহুল্য।


No comments:

Post a Comment