শতেক শতাব্দী ধরে
নামে শিরে অসম্মানভার
শ্রেয়া ঘোষ
জঘন্যতম, ঘৃণ্য এক অপরাধ সংঘটিত হল কলকাতার আরজিকর মেডিক্যাল কলেজে গত ৯ অগস্ট। স্বতঃস্ফূর্ত নিন্দা ও প্রতিবাদে উত্তাল পশ্চিমবঙ্গ, সমগ্র ভারত এবং দুনিয়া।
মুখ্যমন্ত্রী ও প্রশাসনের তরফে এই অপরাধের দ্রুত তদন্ত, দোষীদের যথা শীঘ্র কঠোরতম শাস্তি বিধানের ঘোষণা করা হল। ২৪ ঘন্টার মধ্যে এক অপরাধী ধরা পড়ল। আরজিকর ও অন্য সব সরকারি হাসপাতালে জুনিয়র ডাক্তার'রা প্রতিবাদে সামিল হয়ে লাগাতার কর্মবিরতি ঘোষণা করলেন। তাঁরা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তদন্ত প্রক্রিয়া এবং কলকাতা পুলিশের ওপর আস্থা রাখতে না পেরে আদালতের তত্ত্বাবধানে সিবিআই তদন্ত দাবি করেন। পরিবারের তরফ থেকেও সিবিআই তদন্তের দাবিতে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করা হয়। তাঁদের দাবি অনুসারে হাইকোর্টের নির্দেশে তদন্তের দায়িত্ব সিবিআই'এর হাতে যায়।
১৪ অগস্ট মধ্যরাত্রে অগুন্তি মানুষ পথে নেমে প্রতিবাদে সামিল হন। সে প্রতিবাদের কেন্দ্রবিন্দু এই নির্দিষ্ট ঘটনা হলেও দুর্বলের প্রতি সবলের যে কোনও অপরাধ বন্ধের ডাক দেওয়া হয়। স্বাভাবিক ভাবে চিকিৎসকদের এই কর্মবিরতি ও ধর্না বা মধ্যরাতের 'মেয়েরা, রাতের রাস্তা দখল করো' কর্মসূচি রাজনৈতিক দলাদলির ঊর্ধে থাকাটাই প্রত্যাশিত ছিল। রাজনৈতিক দলগুলির দৌড়দৌড়ি ও অতি-তৎপরতা সে অসম্ভবকে কি সম্ভব করল?
রাজনৈতিক দলগুলির প্রেক্ষিতে ১৬ অগস্ট অবধি ঘটনাপ্রবাহ এই প্রকার ছিল:
১) SUCI'এর ডাকে ১২ ঘন্টা বাংলা বন্ধ ডাকা হল;
২) দুপুর ২টো থেকে বিকেল ৪টে অবধি বিজেপি'র রাস্তা রোকো কর্মসূচি ছিল;
৩) ১৬ অগস্ট থেকে আরজিকর হাসপাতালের সামনে বিজেপি'র ধর্না;
৪) বিজেপি মহিলা মোর্চার মোমবাতি মিছিল মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি অবধি;
৫) মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে মিছিল ও দোষীদের মৃত্যুদণ্ডের দাবি।
শুভেন্দু অধিকারী বারবার বললেন - 'দফা ১, দাবি ১ - মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ'। নিঃসন্দেহে নতুন এক শ্লোগান। আর এই নতুন শ্লোগান হাসপাতাল প্রাঙ্গণে কর্মবিরত কিছু চিকিৎসকদের মুখেও। বিরোধী দলনেতা বললেন, ১৪ অগস্ট রাতে হাসপাতালের সামনে বিশেষ সম্প্রদায়ের লোক ডেকে এনে হামলা চালানো হয়েছে। এই ঘটনাটির প্রেক্ষিতেও তাঁর বক্তব্যে যথারীতি গরুর রচনার মতো খোকাবাবু-পিসি থিয়োরি।
এক সপ্তাহের মধ্যেই মৃতা চিকিৎসক কি ধীরে ধীরে পিছু হটছেন?
১৪ অগস্টের মধ্যরাতে মেয়েদের রাস্তা দখল কর্মসূচি ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিল। এক নিরপরাধ মহিলা চিকিৎসকের সরকারি হাসপাতালেই নৃশংস ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় প্রতিবাদ, ক্রোধ, বেদনা, আবেগে উদ্বেলিত মেয়েদের ঢল নামল রাজপথে; সারা রাজ্য, দেশ ও বিদেশ জুড়ে। কারণ ছাড়াই মহিলাদের সর্বত্র অপমান, প্রতারণা, বিপন্নতার চিরাচরিত ধারা এই একটি ঘটনায় আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলে উঠল।
কিন্তু কিছু অদ্ভুত কথাবার্তাও শোনা গেল। শুনলাম যা, সমাবেশ প্রত্যাগত মহিলা বলছেন, 'এত জনসমাগম, এত সমর্থন দেখে আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। এত সমর্থন যেন প্রশাসন নির্বাচনের সময়ে মনে রাখে।' দোষীর শাস্তি, মেয়েদের প্রতি অপমানের অবসান, মৃতা চিকিৎসকের প্রতি সহমর্মিতা জ্ঞাপন নয়, তিনি চাইলেন পরের নির্বাচনে কাঙ্ক্ষিত ফল।
একজন লিখলেন, 'অনুপ্রাণিত ধর্ষণতন্ত্রের অবসান হোক।' শুধু ধর্ষণ না বলে একটু চালাকির ছোঁয়া লাগিয়ে নিজের মতো খানিক মজা পেলেন তিনি। অপর্ণা সেনের সঙ্গে অত্যন্ত দৃষ্টিকটু ও অন্যায় আচরণ করা হল।
হাজার হাতে হাজার পোস্টার, কিন্তু হাজার মনের অভ্যন্তরে কী উদ্দেশ্য, কে জানে?
মেয়েদের প্রতি অন্যায়ের প্রতিবাদে, মেয়েদের এই মিছিলেও মেয়েদের প্রতি নিয়ম মতো অশ্লীল ইঙ্গিত করা হল। মেট্রো রেলে রূপান্তরকামী ব্যক্তি চিরাচরিত ভাবে অশ্লীল স্পর্শ ও মন্তব্যের শিকার হলেন।
সংশয় ছিল -
সমাজের সব স্তরের মেয়েরা কি অংশ নিয়েছিলেন? অসংগঠিত ক্ষেত্রে খেটে খাওয়া মেয়েরা, যৌনকর্মী, গৃহ পরিচারিকা, যাঁদের অহরহ দুঃসহ নিপীড়নের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, তাঁরা? আমার সংশয় নিরসন করে মিছিলে অংশ নেওয়া বন্ধু বললেন, 'হ্যাঁ, অরগানাইজড ভাবে ডাকা হয়েছিল, আর তাছাড়াও ছিল সম্ভবত স্বতঃস্ফূর্তভাবে।'
এই বিপুল উদ্যোগ যেন দাগ রেখে যেতে পারে সেটাই সর্বান্তঃকরণে চাইছি। একটা মর্মান্তিক ঘটনা যেন স্ফুলিঙ্গ হয়ে দাউদাউ দাবানল ছড়িয়ে দিল। পুড়ে যাক সে আগুনে যত আবর্জনা।
৯ থেকে ১৭ অগস্ট। এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেল। চিকিৎসক ও পরিবারের দাবি অনুসারে তদন্তভার সিবিআই'এর ওপর ন্যস্ত। কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি স্বয়ং তদন্তের অগ্রগতি তদারক করছেন।
তবুও,
সমস্ত সরকারি হাসপাতালের জুনিয়র চিকিৎসকরা কর্মবিরতি চালিয়ে যাচ্ছেন। আজ ১৭ অগস্ট দেশ জুড়ে সমস্ত হাসপাতালে কর্মবিরতির ডাক দিয়েছেন ইণ্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন। তার মানে সমস্ত দেশের জনসাধারণ অসুস্থ হলে চিকিৎসা পাবে না? নারী, শিশু, বৃদ্ধ কারও চিকিৎসা হবে না? কাগজে, টিভি'তে ছবি দেখছি, অসুস্থ স্ত্রীকে কোলে নিয়ে প্রৌঢ় ফিরে যাচ্ছেন, মাথা জোড়া ব্যান্ডেজ-বাঁধা শিশুকে কোলে নিয়ে বাবা ফিরে যাচ্ছেন। মৃত্যুও ঘটে গেছে। আমার পরিচিত এক মহিলার পুত্রবধূর প্রসবের দিন এসে গিয়েছে কাছে, আমাকে বললেন, বাচ্চাটা কি তবে পেটের মধ্যেই মরে যাবে?
মুখ্যমন্ত্রী আবেদন করেছেন, 'দয়া করে, অনুগ্রহ করে, আপনাদের পায়ে ধরে বলছি, মানুষকে পরিষেবা দিন।' আবার তিনিই জানালেন, বহু হাসপাতালে সিনিয়র ডাক্তাররা কাজ করছেন, জুনিয়র ডাক্তারদের একাংশও কাজে আছেন।
আমি ভাবছিলাম কবে সব চিকিৎসকরা কাজ শুরু করবেন? কাল রাতে শুনলাম, আরজিকর কাণ্ডে আন্দোলনরত ডাক্তাররা দাবি করেছেন ৪৮ ঘন্টার মধ্যে সব অভিযুক্তকে গ্রেফতার করতে হবে সিবিআইকে, নিহতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, পুলিশকে ক্ষমা চাইতে হবে ইত্যাদি। দাবি পূরণ না হওয়া অবধি কর্মবিরতি চলবে।
নিরপরাধ অসুস্থ ব্যক্তিকে চিকিৎসা না করে যন্ত্রণা ও মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া যেন প্রতিশোধের মতো।যে কোনও পরিণত মানুষ নিশ্চয়ই বোঝেন, ৪৮ ঘন্টায় প্রমাণ সংগ্রহ করে, দোষীদের চিহ্নিত করে গ্রেফতার করা অসম্ভব। তথাপি...
এই একটা সপ্তাহ প্রাত্যহিক সব কাজকর্ম, দায়িত্ব সব পালন করে গিয়েছি একেবারে যন্ত্রের মতো। মন থেকে এক মুহূর্তের জন্যেও এই ঘটনাকে সরাতে পারছি না। নানা প্রশ্ন ক্রমাগত ধাক্কা মারছে মনে।
আজন্মকাল দেখে আসছি সরকারি হাসপাতালে শ'য়ে শ'য়ে বহিরাগত লোকজনের ভীড়। কেন এখানে সুষ্ঠু শৃঙ্খলা থাকে না? অবাঞ্ছিত লোক সর্বদাই যথেচ্ছ ঘুরে বেড়াচ্ছে। আজ যে শৃঙ্খলার দাবি করা হচ্ছে তার জন্য এই হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটতে হল কেন?
হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন অসহায় মানুষ আর চিকিৎসকরা তারস্বরে মাইক বাজিয়ে সুবিচারের দাবি করছেন। শুধু চিকিৎসকরাই নন, রাজনৈতিক দলগুলিও শব্দসীমা লঙ্ঘন করে মাইক বাজিয়ে সুবিচার চাইছে। অসহায়, অসুস্থ মানুষের প্রতি এতটুকু সংবেদনশীলতা দেখানো যেত না?
এই সাংঘাতিক অপরাধ ঘটার পর আরজিকর মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষকে অপসারণ করা স্বাভাবিক ছিল। অথচ কেন তাঁকে শুধুমাত্র বদলি করা হল তার উত্তরও অলভ্য। প্রশাসনের তরফে এই ঘটনা সদিচ্ছার অভাব সূচিত করে।
অবাক লাগছে, এই সাত দিনের অজস্র কথা আর গুজবে। শোনা যাচ্ছে, হাসপাতালের অভ্যন্তরের অভাবনীয় নোংরামি ও দুর্নীতি নাকি চলে আসছে গত কুড়ি বছর বা তারও বেশি সময় ধরে। আর শুনছি, সবাই নাকি সব জানত। তবে কেন তা প্রকাশ্যে আনা হল না এত বছরেও। এমনকি কারা এই ধর্ষণ ও খুনের মতো ঘটনায় জড়িত সেটাও নাকি সকলেই জানেন। তবু কেন তাঁরা তদন্তকারী সংস্থাকে সে সব জানাচ্ছেন না, তাও বোধগম্য হচ্ছে না।
বিরোধী দলনেতা প্রবল বিক্রমে সিবিআই'কে তদন্তের পদ্ধতি নিয়ে উপদেশ দিচ্ছেন কোন অধিকারে? অভিযুক্তকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার কথা তিনি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন সর্বোচ্চ কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাকে?
২৭ নভেম্বর ১৯৭৩।
He reaches under his shirt, and pulls out the dog chain. She swallows. He magnifies the sound of its rattle as he trails the dog chain on the desk in front of her. Her eyes follow the chain, she swallows again, moves back....
One man. Plus a savage twist of one chain. And the thirty seconds for his sperm to release.
Equals one broken woman. With brain damage so irreversible that it does not even register images.
বারবার মনে পড়ছে ১৯৭৩ সালে মুম্বাই'এর KEM হাসপাতালের নার্স অরুণা শনবাগের নির্যাতনের ঘটনা। অপরাধী ছিল হাসপাতালের সুইপার সোহনলাল বাল্মীকি। প্রথমত সেখানে ধর্ষণের ধারাই দেওয়া হয়নি। সামান্য চুরির ধারায় তার সাত বছর জেল হয়। আর অরুণা সেই ১৯৭৩ থেকে ২০১৫ অবধি সব চেতনা হারিয়ে, অন্ধ হয়ে, পঙ্গু হয়ে বেঁচে থাকতে বাধ্য হলেন। এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে তাঁকে স্বেচ্ছা মৃত্যুর অধিকারটুকুও দেওয়া হল না। কেন?
পরিস্থিতি ক্রমশই জটিল হয়ে উঠছে। সমাধান সূত্র খোঁজার বদলে বিশৃঙ্খলাকেই যেন প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। ঘোলা জলে মাছ ধরতে কোমরে গামছা বেঁধে, খাপলা জাল হাতে নেমে পড়েছে ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতির ময়দানের চেনা মুখগুলো। যেমন বরাবর।
মৃতা চিকিৎসক কি ধীরে ধীরে পিছু হটছেন?
এই আন্দোলন করছেন মধ্যবিত্ত মানুষ ।কারণ মৃত ও ধর্ষিত ছাত্রী একজন চিকিৎসক।সমাজের নিচুতলার কোনো অশিক্ষিত মহিলার ক্ষেত্রে এই বিপর্যয় ঘটলে ঠিক এমন গণ আন্দোলন হতো না।নিচুতলার মানুষের অংশগ্রহণ সেভাবে দেখা যায় নি এই আন্দোলনে। বরং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি অনেক বেশি সক্রিয়।
ReplyDeleteIt appears that the administration supported by vested interests are bent upon to dilute the whole issue. It's an open n shut case, could easily be solved at local level . But there are too many skeletons in the cupboard.
Deleteএই মধ্যবিত্তের আন্দোলনে একটা বেপরোয়া দিক আছে। বিপন্নতা গ্রাস করছে বাস্তবে চেয়ে কল্পনায়। প্রতি তিন মিনিটের ধর্ষণ দেশে বৈধতা পেয়েছেন তখন প্রশাসনের বৈধতায় হত্যা ও ধর্ষণ মধ্যবিত্ত মেনে নেবে।
ReplyDeleteসব কিছু নিয়ে বলার ইচ্ছে নেই, তবে ডাক্তারদের শনিবারের ডাকা আউটডোর ও চেম্বার বয়কটকে কেন্দ্র করে শ্রেয়া যা বলেছেন তাতে তাঁর আন্দোলন বিরোধী মনোভাব গোপন রইল না। ইমার্জেন্সি রোগী দেখা বন্ধ হয়নি। ইন্ডোরের রোগী দেখা হয়েছে। ইমার্জেন্সি অপারেশন করা হয়েছে।
ReplyDeleteহাসপাতাল ও ডাক্তারি অন্য সব প্রতিষ্ঠানে এর থেকে ঢের বেশি কাজ বিঘ্নিত হয় দুর্গাপুজোর সময়, এবং সেটা বেশ কয়েকদিন ধরে চলে। সেটা সম্ভবত অবশ্যকরণীয়। প্রতিবাদটাই কেবল খারাপ।