Friday, 9 August 2024

দুনিয়া কাঁপানো কুড়ি দিন (১)

'স্বর্গের চেয়ে প্রিয় জন্মভূমি'

শাহেদ শুভো


প্রথম পর্ব

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিনির্মাণের ইতিহাসে জুলাই ২০২৪'এর ছাত্র-জনতা বিপ্লব এক অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হয়ে থাকবে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার পর জিন্নাহ'র উর্দু রাষ্ট্রভাষার বিরুদ্ধে প্রথম যে প্রতিবাদের স্বর উঠেছিল-- শুরু হয়েছিল ৫২'এর ভাষা আন্দোলন, ৬২'র শিক্ষা কমিশন আন্দোলন, ৬৯'এর গণ-অভ্যুত্থান-- তা থেকেই বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে দেশের ছাত্ররা জনতার সাথে হাতে হাত মিলিয়েই পরিবর্তন এনেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশ যখন পথ হারিয়েছে ছাত্র সমাজ পথ দেখিয়েছে এই দেশের মানুষদের। তাই বাংলাদেশের জনগণের কাছে ছাত্ররা সবসময় সত্য আর ন্যায়ের মূর্ত প্রতীক। 

আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ১৫ বছরের দুঃশাসনে গুম, খুন, দেশের বিভিন্ন জায়গায় তাদের নানা ধরনের বাহিনীর তৈরি করা নির্যাতন সেল, যেখানে বিরুদ্ধ মতের মানুষকে জঙ্গি সাজিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া, বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নানারকম নিপীড়নমুলক আইন, যেমন, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন ইত্যাদির তাণ্ডবে দেশের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। অথচ, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে মূল ভূমিকা রেখেছিল; এই দেশের সাধারণ নিপীড়িত মানুষের হাতেই আওয়ামী লীগের জন্ম। কিন্তু, এই রাজনৈতিক দলটাই তার মিত্র আমলাতন্ত্র এবং অলিগার্ক  ব্যবসায়ীদের স্বার্থে দেশব্যাপী এমন এক আধিপত্যকামী রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরি করে, যেখানে বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে গণ শৌচাগারগুলিকে পর্যন্ত নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়াটাই ছিল অন্যতম কর্মকাণ্ড। 

'কম গণতন্ত্র, বেশি উন্নয়ন'-- এই শ্লোগান ছিল তাদের মূলমন্ত্র। নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধংস করে দেওয়া, সংবিধানে সর্বজন গ্রহণযোগ্য তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল-- এইসব কাজের জন্য দেশের সাধারণ মানুষের কাছে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে যাচ্ছিল। এর মধ্যে ছিল উন্নয়ন তত্ত্বের নামে 'কুইক রেন্টাল'এর মাধ্যমে দেশের বিদ্যুৎ খাত কর্পোরেটের হাতে দিয়ে অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের নামে প্রায় দশ গুন ব্যয় দেখানো। অহেতুক বড় প্রকল্পের নামে বিদেশি ঋণ (চীনের মতো রাষ্ট্রের কাছে প্রচুর  ঋণ), উন্নয়ন কাঠামোর মধ্যে প্রাণ-প্রকৃতি-মানুষকে অস্বীকার করা, দলের ব্যবসায়ী অলিগার্কদের বিদেশে অর্থ পাচার, এইসব বিষয় নিয়ে বিদেশের বিখ্যাত মিডিয়াগুলো সরব থাকলেও বাংলাদেশের প্রায় সমস্ত গণমাধ্যম ছিল নিশ্চুপ। কারণ, ওইসব গণমাধ্যম ছিল আওয়ামী লীগের ওই অলিগার্ক ব্যবসায়ীদের মালিকানাধীন। সমাজের কতিপয় সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষ ছাড়া বাংলাদেশের গোটা জনগোষ্ঠী আওয়ামী লীগের বৈষম্যের শিকার হয়েছে। তাই, কোটা সংস্কার আন্দোলন গোটা বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারের সৃষ্টি করা সকল বঞ্চিত মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। এই আন্দোলন তাই ২০১৮ সালের নিছক কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পরিবর্তিত হয় ।

এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ছিল, ২০২৪ সালের ৫ জুন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকারের জারি করা পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণার পর কোটা পদ্ধতির সংস্কার আন্দোলন আবার নতুনভাবে আলোচনায় ফিরে আসা। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে উক্ত পরিপত্র জারি করা হয়েছিল। ঐ পরিপত্রের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে নবম গ্রেড (পূর্বতন প্রথম শ্রেণি) এবং ১০ম-১৩তম গ্রেডের (পূর্বতন দ্বিতীয় শ্রেণি) পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সকল কোটা বাতিল করা হয়েছিল। শুরুতে আন্দোলন সভা-সমাবেশের মধ্যে স্থির থাকলেও ১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর এক বক্তব্যে কোটা আন্দোলনকারীদের 'রাজাকারের নাতি-পুতি' হিসেবে অভিহিত করেন। প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া হিসেবে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ব্যঙ্গ করে, 'তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার; কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার' এবং 'চাইতে গেলাম অধিকার; হয়ে গেলাম রাজাকার' স্লোগান দেয়। এর পরের দিন ১৫ জুলাই আওয়ামী লীগ ও সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তা ও মন্ত্রী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ নষ্ট করার অভিযোগ আনেন। 

আওয়ামী লীগের রাজনীতির সবচেয়ে ঘৃণ্য দিক ছিল কোনও বিষয়ে বিক্ষুব্ধ মানুষকে বিভিন্ন রাজনৈতিক ট্যাগ দেওয়া, যেমন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী, রাজাকার, জামাত–শিবির, বিএনপি মৌলবাদী চক্র, নাশকতা ইত্যাদি। এই জন্য সকল শ্রেণির রাজনৈতিক আন্দোলন ছাড়াও নানারকম সামাজিক আন্দোলনেও মানুষ সম্পৃক্ত হতে ভয় পেত! আর সাথে তো তাদের নিজস্ব দলীয় বাহিনী আর প্রশাসনের নারকীয় অত্যাচার ছিলই। যার জন্য ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন, ২০১৮ জুলাই থেকে অগস্টের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, যে আন্দোলন ছিল স্কুল-কলেজের ছাত্রদের দ্বারা সংগঠিত, সেখানেও  দমন-নিপীড়ন চালানো হয়েছিল। এই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকেও আওয়ামী লীগ বিএনপি-জামায়াত দমনের দৃষ্টিতে দেখেছিল। তাই, দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্র লীগ শিক্ষার্থী ও আন্দোলনকারীদের উপর রড, লাঠি, হকি স্টিক, রামদা, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা করে। একই সাথে পুলিশও লাঠি, রাবার বুলেট দিয়ে হামলা করে। প্রতিবাদে আন্দোলনকারীরাও তাদের দিকে ইটের টুকরা ছোড়ে ও উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। এইসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৬ জুলাই থেকে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হলে আন্দোলন স্ফুলিঙ্গের মতো পুরো দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ে।  

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সূচনা ছিল তিন দফা দাবি নিয়ে --

     সরকারি চাকরিতে কার্যকর বর্তমান কোটা পদ্ধতি বাতিল;

     অনগ্রসর গোষ্ঠী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের ন্যায্য হারে কোটা প্রদান;

     কোটার সর্বোচ্চ সীমা ৫ শতাংশে নামিয়ে সংসদে নতুন আইন পাশ করা। 

প্রথম থেকেই  অন্যান্য সামাজিক আন্দোলনের মতোই এই আন্দোলনের চরিত্র খুব নিরীহ ছিল। কিন্তু যেহেতু শেখ হাসিনা সরকার যে কোনও আন্দোলনকেই ভয় পেত, তাই নানারকম কৌশল অবলম্বন করে আন্দোলনকে মাঠেই দমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। ২৪'এর জুলাই থেকে অগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সরকার তার বাহিনীকে দিয়ে এমন এক নারকীয় পরিস্থিতি তৈরি করে যা বাংলাদেশের আন্দোলনের ইতিহাসে সকল নির্মমতা ও বর্বরতাকে হার মানিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, শিশু, সাধারণ মানুষ, কত যে নিহত ও আহত হয়েছেন হাসিনা সরকারের রাষ্ট্রীয় বাহিনী আর দলীয় ক্যাডারদের হাতে তার হিসেব নেই। স্বাধীন বাংলাদেশ এক জেনোসাইড দেখল তার দেশের জনগণের ট্যাক্সের টাকায় গঠিত বাহিনীর হাতে। এখন পর্যন্ত হতাহতের পরিমাণ হাজার ছাড়িয়ে গেছে, গ্রেফতার অগণিত। হেলিকপ্টার থেকে গুলি বর্ষণ করা হয়েছে, এমনকি জাতিসংঘপ্রাপ্ত যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার করতে দেখা গেছে নিরস্ত্র মানুষের উপর। ইন্টারনেট ব্ল্যাক আউট করে গণ গ্রেফতার চালানো, এলাকাগুলোতে ব্লক রেইড, বাসায় বাসায় ছাত্র আছে কিনা খুঁজতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের নিয়ে পুলিশ-বিজেবি'র অভিযান, যেন ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশের ছাত্রসমাজকে। বাংলাদেশ কখনও দেখেনি, আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন ছাত্র লীগ, শ্রমিক লীগ, যুব লীগের ক্যাডার বাহিনী, যারা কিনা হেলমেট বাহিনী হিসেবে এই দেশে দীর্ঘদিন ধরেই পরিচিত, তাদের সাথে মিলে রাষ্ট্রীয় বাহিনী দেশের নিরস্ত্র ছাত্র–জনতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তাই, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ আর সহ্য করতে পারেনি, তারা ছাত্রদের পাশে এই সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। 

বিশ্ববিদ্যালয় হলগুলোতে যখন সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্র লীগকে প্রতিহত করে, তখন অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন এই সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়; তারা হল ভ্যাকেট করানোর জন্য পুলিশ দিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর ইতিহাসের বরবর্তম হামলা চালায়, যে শিক্ষার্থীরা তাদের সন্তান সমতুল্য। সরকারি বাহিনীর নিপীড়নের সাথে আন্দোলনে যুক্ত হওয়া শিক্ষার্থী আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়তে থাকে, বাংলাদেশের প্রাইভেট বিশবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যারা কিনা বাংলাদেশের একটা এলিট সোসাইটিকে প্রতিনিধিত্ব করে এবং কথিত আছে তারা রাজনীতি এবং সমাজ বিমুখ, তারাও এই নিপীড়ন না মেনে নিতে পেরে সংগঠিত হয়। ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নির্বিচারে গুলি চালায় রাষ্ট্রীয় বাহিনী। এর মধ্যে হাসিনা সরকারের গেস্টাপো বাহিনীর অন্যতম কুচক্রী কর্মকর্তা ডি বি হারুন আন্দোলনরত  শিক্ষার্থীদের অন্যতম সমন্বয়কদের আটক করে নিয়ে আসে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় ছিলেন। আন্দোলনের চাপ তীব্র হওয়ায় ডিবি তাদের গ্রেফতার করতে অস্বীকার করে। 'বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নেটওয়ার্ক' নামক সংগঠনের প্রতিনিধিরা ডিবি কার্যালয়ে উপস্থিত নেতৃত্বদানকারী সমন্বয়কদের অবস্থা জানতে যায়, কিন্তু ডিবি কার্যালয় জানায়, গ্রেফতার নয়, তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে হেফাজতে রাখা হয়েছে। বাইরে থাকা অন্য সমন্বয়করা আন্দোলন কর্মসূচি অব্যাহত রাখে, আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ছাত্রদের আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে চলে; তাদের ছাত্র সংগঠনগুলোকে সক্রিয় ভাবে মাঠের আন্দোলনে দেখা গেছে। আওয়ামী লীগের নির্যাতনে আক্রান্ত প্রবাসী অনেক মানবাধিকার কর্মী, আন্তর্জাতিক সাংবাদিক এই আন্দোলনে আন্দোলনকারীদের ভ্যানগার্ড হিসেবে কাজ করেছে। 

বাহিরে থাকা সমন্বয়করা অনলাইনে ৯ দফা দাবির ভিত্তিতে আন্দোলনের কর্মসূচি নির্ধারণ করে-- 

১) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ছাত্র-নাগরিক হত্যার দায় নিয়ে জাতির কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে;

২) আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও দলীয় ক্যাডার এবং সন্ত্রাসী কর্তৃক ছাত্র-নাগরিক হত্যার দায় নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে মন্ত্রী পরিষদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে। ইন্টারনেট শাটডাউন করে দেশে ডিজিটাল ক্র্যাকডাউন করায় তথ্য প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলককে পদত্যাগ করতে হবে। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় শহীদ শিক্ষার্থী এবং আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের 'ড্রাগ এডিক্ট' বলে কুরুচিপূর্ণ ও মিথ্যা বক্তব্য দিয়ে এবং আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করায় তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাতকে পদত্যাগ করতে হবে;

৩) ঢাকা সহ যত জায়গায় ছাত্র-নাগরিক শহিদ হয়েছে সেখানকার ডিআইজি, পুলিশ কমিশনার ও পুলিশ সুপারদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে হবে;

৪) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সহ সারা দেশের প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে ক্যাম্পাসে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে হামলা হয়েছে, প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এবং প্রক্টরদের পদত্যাগ করতে হবে;

৫) যে পুলিশ-বিজিবি-রাব ও সেনা সদস্যরা শিক্ষার্থীদের উপর গুলি করেছে, ছাত্র লীগ-যুব লীগ সহ যে সব সন্ত্রাসীরা শিক্ষার্থীদের ওপর নৃশংস হামলা পরিচালনা করেছে এবং যে সব নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাদেরকে নিরস্ত্র ছাত্র-নাগরিকদের ওপর গুলি করার নির্দেশ দিয়েছে, তাদেরকে আটক করে হত্যা মামলা দায়ের করতে হবে ও দ্রুততম সময়ের মধ্যে গ্রেফতার করতে হবে;

৬) দেশব্যাপী যে সকল ছাত্র-নাগরিক শহীদ এবং আহত হয়েছে তাদের পরিবারকে অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে;

৭) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সহ সারা দেশের প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র লীগ নামক সন্ত্রাসী সংগঠন সহ সব দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করে দ্রুততম সময়ে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ছাত্র সংসদ কার্যকর করতে হবে;

৮) অবিলম্বে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হলগুলো খুলে দিতে হবে। কারফিউ তুলে নিয়ে সারা দেশের সমস্ত ক্যাম্পাসে মোতায়েনকৃত পুলিশ, রাব, বিজিবি, সোয়াট এবং আর্মি তুলে নিতে হবে;

৯) বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কোনও ধরনের হয়রানি করা হবে না এই মর্মে অঙ্গীকার করতে হবে। ইতোমধ্যে গণ গ্রেফতার ও পুলিশি হয়রানির শিকার সমন্বয়কবৃন্দ ও ছাত্র-নাগরিকদের অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে ও সব মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। 

এর সাথে ছাত্ররা আরও কর্মসূচি দেয়। যেহেতু ঘোষিত কর্মসূচির দিন বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ১৫ অগস্ট হত্যা দিবস, তাই আওয়ামী লিগ গোটা অগস্ট মাস জুড়ে শোক কর্মসূচি পালন করত এবং বিরোধী মত সহ অনেক সময় কোনও সাধারণ সংগঠন বা সাংস্কৃতিক সংগঠনকে কোনও প্রকার অনুষ্ঠানের অনুমতি দেওয়া হত না। কিন্তু ছাত্ররা জাতীয় শোক দিবসকে প্রত্যাখান করে চোখে-মুখে লাল কাপড় বেঁধে ছবি তোলা এবং অনলাইনে ব্যাপক প্রচার কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা দেয়। সাথে সাথে দেশকে স্থিতিশীল করতে নয় দফা দাবি মেনে নেওয়ার আহ্বান জানায়। অভূতপুর্ব ঘটনা ঘটে-- বাংলাদেশ সহ বাইরের বসবাসকারী বাংলাদেশিদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মেটার প্রোফাইল লাল রঙের আকার ধারণ করে, দ্রোহের মন্ত্রে গোটা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ একদিকে, বিপরীতে আওয়ামী লীগের দুর্বৃত্তরা। পরবর্তীতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র সমাজ এই নয় দফা দাবিতে ৩ আগস্ট সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল করে ও ৪ আগস্ট থেকে সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়। 

বাংলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণি, পেশার মানুষেরা ভয় কাটিয়ে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামতে থাকে। বেশ কয়েকজন মানবাধিকার কর্মী হাইকোর্টে রিট পিটিশন করে আইনশৃঙ্খলার নামে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে নির্বিচারে গুলি চালানোর বিষয়ে বিচার বিভাগের হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করে। হাইকোর্ট শুনানি না করলেও স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে অবজারভেশন দেয় ডিবি অফিসে বন্দী ছাত্রনেতাদের বিষয়ে। মানবাধিকার সুজনের সিনিয়র সিটিজনরা ২৪ ঘন্টার আল্টিমেটাম দেন ডিবি অফিস থেকে সমন্বয়কদের ছেড়ে  দেওয়ার জন্য, সরকার সকল শ্রেণির মানুষের চাপে কিছুটা দিশেহারা হয়ে পড়ে, ডিবি হারুনকে বদলি করা হয় ও ছাত্র নেতাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। সরকারের বিরুদ্ধে চাপ শুরু হয়, জাতিসংঘের কড়া বিবৃতি, জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধানের বিবৃতি, যুক্তরাষ্ট্র স্টেট ডিপার্টমেন্ট, ইউরোপিয় ইউনিয়ন সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে। দিশেহারা হয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ সরকার। এই গণহত্যার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে হাসিনাশাহী সহ তাঁর গেস্টাপো প্রশাসনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়।

ক্রমশ...

দ্বিতীয় ও শেষ পর্বের লিঙ্ক:

https://ekakmatra2013.blogspot.com/2024/08/blog-post_10.html


2 comments:

  1. লেখার ধাঁচটা ভালো। কিন্তু কয়েকটা জায়গায় কিছুটা একপেশে লাগল ।

    কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিবাদী ছাত্রদের মধ্যে কেউ লিখলে একটু আবেগপ্রবন হবে সেটা স্বাভাবিক ।

    কিন্তু এই প্রথম কোনো বাংলাদেশি ছাত্র ভারতীয় কোনো পত্রিকায় নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনাটি বর্ণনা করলেন।

    কয়েকটা জিনিস এখানে পেলাম যেটা অন্য কোথাও পাইনি । যেমন শেখ হাসিনার কাছে যে ৯ দফা দাবি তুলে ধরেন শিক্ষার্থীরা, তার পূর্ন বিবরণ । অন্য অধিকাংশ রিপোর্টে এটার ভাসা ভাসা বিবরণ পেয়েছি , এখানেই একমাত্র পূর্ন বিবরণ পেলাম ।

    ReplyDelete
  2. জামাত বা বিএনপি’র প্ররোচনায় বা হঠাত আবেগে ভেসে উঠে যে এই বিদ্রোহ শুরু হয়নি সেটা এই লেখায় বেশ ভালোভাবে স্পষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের নির্গমন হল এই আন্দোলন। অযৌক্তিক কোটা, সীমাহীন দূর্নীতি আর স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের এই প্রতিবাদ একদিন বড় আকার নিত‌ই। বরং হাসিনাই দেওয়ালের লিখন পড়তে পারেননি। যাই হোক, পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় র‌ইলাম।

    ReplyDelete