বড্ড প্রশ্ন তোলে, ওকে নিকেশ করো...
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
কাজীর বিচারেও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকে। সন্ত্রাসবাদীদের 'ক্যাঙারু আদালতে' সে বালাই'ও নেই। কোন বিচারের প্রহসনে সংসদের নয়া ভবনের অন্দরে আজ সুপরিকল্পিত ভাবে হত্যা করা হল গণতন্ত্রের সামান্য প্রদীপটুকুকেও, সে আলোচনা আগামী দিনের হাতে অর্পিত থাক।
ব্রিজভূষণের মতো ধর্ষকামে অভিযুক্ত, রমেশ বিদুরি'র মতো উগ্র হন্তারক বক্তা- যাদের বিরুদ্ধে আসা ভয়ঙ্কর সব অভিযোগ নিয়ে সংসদের 'এথিক্স কমিটি'র বসারই সময় নেই (কারণ, এরা সব বিজেপি'র সাংসদ), সেই কমিটিই দর্শন হিরানন্দানি নামে এক ব্যবসায়ীর অভিযোগপত্র পেয়ে রাতারাতি বৈঠকে বসে গেল এবং কোনও তদন্ত ব্যতিরেকেই এবং এমনকি সেই ব্যবসায়ীকে তলব পর্যন্ত না করে, তার তোলা অভিযোগ কতটা সত্য সে বিচারেও না গিয়ে, ৪৯৬ পাতার একটি রিপোর্ট সংসদে দাখিল করে সাংসদ মহুয়া মৈত্রকে বহিষ্কারের সুপারিশ করল। অর্থাৎ, অভিযোগ যার বিরুদ্ধে, কোনও বিচার প্রক্রিয়াতে না ঢুকেই তাকে সর্বোচ্চ শাস্তির নিদান দেওয়া হল। বাজারে ছড়িয়ে দেওয়া হল, হিরানন্দানি যেহেতু বলেছে তাই তা ধ্রুব সত্য (কারণ, তিনি তো কোনও বিজেপি'র সাংসদের বিরুদ্ধে এমনতর অভিযোগ আনেননি), অতএব, মহুয়া যে নগদের বিনিময়েই প্রশ্ন তুলেছেন, তা মেনে নিতেই হবে। তথ্যপ্রমাণ এখানে 'জরুরি নয়'।
আরও অভিযোগ, সংসদে প্রশ্ন তোলার জন্য মহুয়াকে দেওয়া লগিন-পাসওয়ার্ড তিনি হিরানন্দানি'র সঙ্গে শেয়ার করেছেন। যদিও, এই মুহূর্তে র্যানডামলি ১০ জন সাংসদকে ডেকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, দেখা যাবে, তাদের মধ্যে ৯ জনই অন্যকে লগিন-পাসওয়ার্ড শেয়ার করেই সংসদে প্রশ্ন তোলেন। আর এ নিয়ে সংসদের কোনও আইন বা বিধিও নেই। কারণ, যে পোর্টালে সেই লগিন-পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা হয় তা শুধুমাত্র প্রশ্ন তোলার জন্যই এবং সেই প্রশ্ন জমা করার জন্য একটি ওটিপি নির্দিষ্ট সাংসদের মোবাইলে আসে যা পোর্টালে দেওয়ার পরই প্রশ্নটি যথাযথ ভাবে জমা পড়ে। অর্থাৎ, সাংসদের গোচরেই প্রশ্নগুলি জমা পড়ে, প্রশ্নগুলিও তাঁর, হয়তো তিনি টেকনিকালি অন্য কাউকে দিয়ে কাজটি করিয়ে নিয়েছেন। এ হামেশাই হচ্ছে। হিরানন্দানি যেহেতু মহুয়া মৈত্র'র বন্ধুস্থানীয় ছিলেন, তাই কখনও সখনও তাঁর অথবা তাঁর অফিসের সাহায্য তিনি নিয়ে থাকতে পারেন, যেমন আর সকল সাংসদেরা নিয়ে থাকেন। কিন্তু এখানে নিদান হল, অন্য সাংসদরা তা করলেও এমনটা মহুয়া করতে পারবেন না! 'শিব ঠাকুরের আপন দেশে/ আইন-কানুন সর্বনেশে...'।
বাকী রইল কী?
তিনি ভয়ঙ্করতম 'অপরাধ করেছেন' আদানির বিরুদ্ধে সংসদে প্রশ্ন তুলে। তা বটে। অগ্নি-বায়ু-জল-স্থল-পাতাল যাকে স্পর্শ করতে পারে না, তিনি আদানি। দেশের প্রায় সমস্ত পোর্ট, বিমানবন্দর, খনি, তেল, রেল স্টেশন, হাইওয়ে, রাস্তাঘাট সহ যাবতীয় পরিকাঠামো ও শিল্প যেনতেন প্রকারেণ যার হাতে তুলে দিলে তবে দেশ বিকাশের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছতে পারবে- তিনি গৌতম আদানি ও তাঁর শিল্পগোষ্ঠী। এ হেন বিকাশপুরুষের বিরুদ্ধে, তায় আবার কিনা পবিত্র সংসদে, ভুরি ভুরি অভিযোগ তুলছে একজন মহিলা? পুরুষোত্তমদের তো মাথা কাটা যাওয়ার কথা! অতএব, এখুনি সে মহিলার মাথা কাটো!
৮ ডিসেম্বর ২০২৩। বেলা বারোটা নাগাদ ৪৯৬ পাতার এথিক্স কমিটি'র রিপোর্ট জমা পড়ল সংসদে। সংসদ মুলতুবি হল বেলা ২টো অবধি। একদম ঘড়ির কাঁটা ধরে অধিবেশন আবার শুরু হতেই স্পিকার স্পষ্ট করে দিলেন যে, মহুয়া'র 'মস্তক কর্তনের' আলোচনার জন্য সময় দেওয়া হল মাত্র আধঘন্টা, কিন্তু শর্ত, মহুয়া মৈত্রকে কিছু বলতে দেওয়া হবে না। রায়দানের আগেই শাস্তি প্রদান। কিন্তু, এতগুলো পাতা পড়ে ওঠার জন্যও তো সাংসদদের এক-দুদিন সময় দিতে হবে! নাহ! আপনারা দিগগজ লোক, এখুনি পড়ে ফেলুন, আধঘন্টার মধ্যেই আলোচনা সেরে ফেলে এথিক্স কমিটির প্রস্তাব তুরন্ত পাশ করাতে হবে। মোদানি'র যে তর সইছে না। বিজেপি'র সাংসদরা যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গতিতে পড়ে ফেলতে পারেন, তাহলে বিরোধী সাংসদরাও বা পারবেন না কেন! অধীর চৌধুরী থেকে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, মণীশ তিওয়ারি থেকে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়- সকলেই বললেন, অন্তত পাঁচ মিনিটের জন্য মহুয়াকে নিজের আত্মরক্ষার জন্য বলতে দেওয়া হোক, আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার তো Natural Justice'এর মৌলিক ভিত্তি। কাকস্য পরিবেদনা!
একদম উপর থেকে নির্দেশ এসেছে, ঘাড় ধরে বের করে দাও ওই মহিলাকে। তাই, তিনি কিছু বলতেও পারবেন না নিজের সপক্ষে। আদালতে ফাঁসির আসামীকেও বলবার সুযোগ দেওয়া হয়, কিন্তু তিনি সে সুযোগেরও যোগ্য নন। যিনি তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন, তাঁকেও জেরা করা যাবে না অভিযোগের সত্যাসত্য নিয়ে। বাকী সাংসদরা লগিন-পাসওয়ার্ড শেয়ার করলেও তিনি তা করতে পারবেন না।
আধঘন্টায় সব মিটেছে তো? কথা দেওয়া ছিল যে!
এবার মহুয়া'র বিরুদ্ধে সিবিআই-ইডি লেলিয়ে দাও। ওকে জেলে পোরো, যাতে রাস্তাঘাটে গলা তুলে আর কথা না বলতে পারে। জীবন একেবারে নরক করে দাও। কারণ, ও বড্ড বেয়াড়া প্রশ্ন তোলে। সুযোগ পেলে আবারও তুলবে। ওকে নিকেশ করো। বলির বাজনা বাজাও। যে ভাবে সতীদাহ'র সময় তুমুল বাদ্যির ডাকে চাপা পড়ে যেত জ্বলন্ত 'সতীদের' তীব্র আর্তনাদ।
যে কোন উপায়ে প্রতিবাদী কন্ঠ রুদ্ধ করো।গারইপরিণাম এটা।
ReplyDeleteখুবই প্রাসঙ্গিক এই লেখা।
ReplyDeleteModani hatao / Desh Banchao
ReplyDeleteঅনিন্দ্য সাংসদের এই অত্যন্ত নিন্দনীয় অতি- অগণতান্ত্রিক যে সিদ্ধান্তের যা বিশ্লেষণ দিলেন তার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ সহমত পোষণ করি।
ReplyDelete