চিন্তাশক্তি কি বাজেয়াপ্ত হয়?
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
৮ এপ্রিল ১৯২৯। হিন্দুস্তান
সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন’এর তরফে ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত দর্শক আসন
থেকে দিল্লির সংসদে দুটি নিরীহ বোমা ছোঁড়েন। চারপাশ ধোঁয়ায় ভরে গেলেও তাঁরা কেউই
পালাবার চেষ্টা করেননি। কিছু লিফলেট ছুঁড়ে দেন মাত্র ও ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’
শ্লোগানে মুখরিত করেন সভাকক্ষ; আর অপেক্ষা করেন সমস্ত কিছু স্বাভাবিক হলে কখন
পুলিশ এসে তাঁদের গ্রেফতার করবে। বোমা দুটি থেকে ক্ষয়ক্ষতিরও কোনও আশঙ্কা ছিল না।
তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল, নাটকীয় এই ঘটনাটি ঘটিয়ে দেশবাসীর কাছে এক বার্তা পাঠানো, যে
বার্তায় নিহিত ছিল সামাজিক-অর্থনৈতিক শৃঙ্খল ও পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তির আহ্বান।
তাঁরা বিচারেরও অপেক্ষায় ছিলেন, যেখানে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তাঁরা দেশবাসীর উদ্দেশ্যে
বহু কথা বলতে পারবেন। কারণ, ঘটনার নাটকীয়তা এতটাই প্রবল ছিল যে তা সমস্ত মিডিয়ার
দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং দেশবাসী ভগৎ সিং’এর কথা শোনার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে পড়েন।
ঠিক ৯৫ বছর পর গত ১৩ ডিসেম্বর নতুন
সংসদ ভবনে অনুরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল। এবারে ছিলেন চারজন। দুজন সংসদ কক্ষের
ভেতরে, দুজন বাইরে। ফেসবুকে ‘ভগৎ সিং যুবা ফ্যান’ নামে একটি পেইজের ফলোয়ার তাঁরা। রঙমশাল
ধরনের নিরীহ বাজি এনে চেষ্টা করলেন দৃষ্টি আকর্ষণ ও নিজেদের বক্তব্য পেশের। এক
দুঃসাহসিক অভিযান। এই চারজন কারা?
সাগর শর্মা- লক্ষ্ণৌ শহরে
ই-রিক্সাচালক; অমল শিণ্ডে- লাতুরের এক দলিত পরিবারের ছেলে; মনোরঞ্জন ডি- মাইসুরু’র
কম্পিউটার বিজ্ঞানের স্নাতক ও স্বেচ্ছাকৃত বেকার, স্বামী বিবেকানন্দ’র ভক্ত; নীলম আজাদ-
এমফিল ও হরিয়ানার টেট পাশ এক যুবতী। আরও কেউ কেউ হয়তো পিছন থেকে এঁদের সহায়তা
করেছেন।
বিজেপি’র এক সাংসদের থেকে প্রবেশ-পাস
জোগাড় করে সাগর শর্মা ও মনোরঞ্জন ডি সংসদের দর্শক গ্যালারিতে পৌঁছে যান কতকগুলি
লিফলেট ও রঙমশাল নিয়ে। এরপরের ঘটনাবলী আমরা সকলে জানি। লিফলেটগুলি সম্ভবত তাঁরা
বিলি করতে পারেননি। উপরন্তু, সাংসদদের হাতে ধরা পড়ে সাগর বেধড়ক মার খান। আশ্চর্যের
ঘটনা হল, চোর ধরার পর যে ভাবে গণ-পিটুনি দেওয়া হয়, যা সর্বৈব ভাবে বেআইনি, সে
ভাবেই আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ছেলেটিকে পাকড়াও করে কয়েকজন সাংসদ তাকে আচ্ছা করে
ধোলাই দেন। ছেলেটি তখন কাতর স্বরে বলছেন, আমি তো কারও ক্ষতি করিনি, আমাকে মারছেন
কেন? যে কক্ষ আইন পাশ করে, সে কক্ষেই আইন রচয়িতারা এইভাবে নিজেদের হাতে আইন তুলে
নিয়ে নিজেদের বাহুবল দেখাবেন, তা ৭৫ বছর বয়সী ভারতীয় প্রজাতন্ত্র কখনও কল্পনা করতে
পেরেছে কী? বিশ্বের তারিফ আদায়ে ব্যাকুল যে সব নেতারা, তাঁরা কি মনে করেন, এই ছবি
বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের মুখকে আরও উজ্জ্বল করল? অন্যদিকে, সংসদের বাইরে বাকী
দুজন রঙমশাল জ্বালিয়ে ‘তানাশাহি নেহি চলেগি’ শ্লোগান তুলে বক্তব্য রাখেন; ভারত সরকারের
উদ্দেশ্যে বলেন, শ্রমিক-কৃষক-ছোট ব্যবসায়ীরা নির্যাতিত হচ্ছেন, কেউ মুখ খুলতে
পারছে্ন না, সবার কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে, আমরা ছাত্র ইত্যাদি।
চারজনকেই ইউএপিএ’তে গ্রেফতার করা
হয়েছে। যুক্তি হিসেবে সরকার আদালতে জানায়, সংসদে ‘হল্লাবাজি’, ‘মোদি নিরুদ্দেশ’ এই
শিরোনামে তির্যক লিফলেট বিলির চেষ্টা ইত্যাদি ইত্যাদি ভয়ঙ্কর গর্হিত কাজ; অতএব,
সন্ত্রাসবাদ নিরোধক আইন দিয়েই এই ‘ঔদ্ধত্য’কে নিকেশ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম
কোর্টের এক আইনজীবী বলরাম সিং ‘দ্য জনতা লাইভ’ ইউটিউব চ্যানেলে দ্ব্যর্থহীন ভাষায়
বলেন, কিছু বাচ্চা ছেলেমেয়ে তাদের ক্ষোভের কথা ব্যক্ত করেছে, সংসদ ভবনের
টুটাফাটা নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ধরিয়ে দিয়েছে, দেশের সার্বিক অবস্থা নিয়ে নিজেদের
মতামত রেখেছে, তার জন্য তাদের ওপরে একেবারে ইউএপিএ প্রয়োগ? বরং, ভঙ্গুর নিরাপত্তা
ব্যবস্থাকে উন্মোচিত করে তারা তো ভবিষ্যতের সুরক্ষাকে নিশ্চিত করে দেশরক্ষার কাজ
করেছে, এ জন্য তাদের সংসদের তরফে পুরস্কৃত করা উচিত।
অবশ্য, এ কথা সত্যি, সংসদের ভিতরে ওই
দুই যুবক আইন ভেঙ্গেছেন; বটেই তো, যে ভাবে রাজনৈতিক দলগুলি ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে
আইন-অমান্য আন্দোলন করে। তার জন্য কি তাদের ওপর ইউএপিএ প্রয়োগ করা হয়? তাহলে এই
চারজনের ‘অপরাধের মাত্রা’কে কেন এত বিষিয়ে দেখা হচ্ছে? সরকারের অন্তরেই কি
বিষভাণ্ড? প্রতিবাদ বিষয়টাই অন্যায্য? ইতিমধ্যে হরিয়ানার কৃষক সমাজ নীলম আজাদের
গ্রেফতারির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেছেন ও পথে নামছেন। তাঁদের বক্তব্য,
নীলম তো সংসদের বাইরে সামান্য কিছু শ্লোগান তুলেছেন ও বক্তব্য রেখেছে্ন; তার
অপরাধটা কী? ঠিকই তো! নীলম ও অমল, যারা সংসদের বাইরে কিছু শ্লোগান তুলেছেন, তা কী
করে সন্ত্রাসবাদী আইনের আওতায় আসে? আমরা কোন শিব ঠাকুরের দেশে বাস করছি?
মোটের ওপর, এই ঘটনা ভারতীয় রাজনীতিতে
এক অভিনবত্ব যোগ করেছে। প্রথমত, যে বিজেপি সাংসদের পাস নিয়ে দুই তরুণ সংসদে প্রবেশ
করলেন, সেই সাংসদকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে তদন্ত শুরু করা তো দূর অস্ত, এমনকি জিজ্ঞাসাবাদ
পর্যন্ত করা হয়নি। অথচ, যে সব সাংসদেরা সংসদের নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা দাবি করলেন,
তাঁদের প্রায় প্রত্যেককে সাসপেন্ড করা হল। দ্বিতীয়ত, এমনতর এক ভয়ঙ্কর নিরাপত্তা
জনিত সমস্যা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী সংসদে হাজির তো হলেনই না, এমনকি একটা বিবৃতি
পর্যন্ত দিলেন না। খবরে শোনা গেল, তিনি তাঁর মন্ত্রীসভার সদস্যদের বিষয়টিকে
সংবেদনশীল ভাবে মোকাবিলা করার উপদেশ দিয়েছেন। এর অর্থ কী? তৃতীয়ত, গ্রেফতার হওয়া ছ’
জনের মধ্যে একজনকেও পাওয়া গেল না যার নাম আরবি ভাষা থেকে উদ্গত। চতুর্থত, সংসদে
প্রবেশের পাস কোনও বিরোধী সাংসদও ইস্যু করেননি। ফলে, শাসকের তরফে বারবার উচ্চারিত
ক্লিশে শব্দগুলোকে এখনও বাজারে নামানো যাচ্ছে না, যেমন, জিহাদি মড্যুল,
সন্ত্রাসবাদ, দেশদ্রোহী, হামাস-যোগ ইত্যাদি। সবটা মিলিয়ে সাপের ছুঁচো গেলার মতো
অবস্থা।
তবে প্রধানমন্ত্রী একজন অভিজ্ঞ
রাজনীতিবদ। তিনি সম্ভবত সমস্যাটা বুঝেছেন, বুঝেই তাঁর মন্ত্রীদের সংবেদনশীলতার
উপদেশ দিয়েছেন, যার তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। ২০২৪ সালে আগত লোকসভা নির্বাচনে হিন্দি বলয়ের
কিছু ‘রামভক্ত’ এলাকা বাদ দিলে গোটা দেশের অবস্থাটা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন।
যে চার যুবা প্রতিবাদের ঝড় তুললেন, তারা এসেছেন ভারতের চার প্রান্ত থেকে। এটাই
প্রধানমন্ত্রীকে ভাবাচ্ছে। যে দুঃসাহসে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, ভবিষ্যতের পরোয়া না
করে এই চার যুবা দেশের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট ও বিপন্নতার কথা রঙমশাল জ্বালিয়ে কয়েকটি
শ্লোগান ও লিফলেটে তুলে ধরেছেন তা কোটি কোটি মানুষের ভাবনার প্রতিফলন। এই ভাবনা তাঁদের
এমনকি চূড়ান্ত আত্মত্যাগেও অনুপ্রেরণা দিয়েছে, যা কোনও বিচ্ছিন্ন, আলটপকা ঘটনা নয়।
আত্মত্যাগের এই অনির্বচনীয় দৃঢ়তা আসে গভীর বোধ থেকে, যা সমাজ জুড়ে প্রবহমান। সেই
ইঙ্গিত সম্ভবত শাসক দলের প্রধান নেতা টের পেয়েছেন।
সাগর শর্মা ডায়েরি লিখতেন। সেই
ডায়েরিতে তিনি গভীর চৈতন্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। মনোরঞ্জনের বাবা জানিয়েছেন, তাঁর
ছেলে একজন অত্যুৎসাহী পাঠক, স্বামী বিবেকানন্দ’র রচনা গুলে খেয়েছেন। এবার কি তাহলে
স্বামীজীর বই বেআইনি ঘোষণার কথা ভাববে শাসক? অমল শিণ্ডের ইচ্ছে ছিল সেনাবাহিনীতে
যোগ দেওয়ার। নীলম আজাদ সাধারণ মানুষের যে কোনও আন্দোলনের পাশে বলিষ্ঠ ভাবে দাঁড়িয়ে
পড়েন, মানুষের দুঃখ-কষ্টে পাশে থাকেন। নীলমের পারিবারিক পদবী ভার্মা হলেও তিনি
তাঁর নামের পাশে আজাদ ব্যবহার করেন।
আপাতত তাঁরা পুলিশের হেফাজতে। পুলিশই
বা কী উদ্ধার করবে আর জেরা করে! অন্তরের বোধ আর চিন্তাশক্তি তো বাজেয়াপ্ত করা যায়
না। আর সেই চিন্তার যোগও থাকে সমাজ-প্রবাহের সঙ্গে। আগামী দিন হয়তো তার সাক্ষ্য
দেবে।
জয় হিন্দ।
সারা দেশের ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছে এরা। এটা টের পেয়েই তাড়াতাড়ি তাদের পুরে ফেলা। কিন্তু যার কাছ থেকে পাশ পেল তার বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেওয়া হলো? বড় জানতে ইচ্ছে করে।
ReplyDelete