চারধামের রাজনীতি বনাম জীবন সংশয়
মালবিকা মিত্র
সতেরো/ আঠারো দিনের টানটান উত্তেজনার অবসান হল। আমরা দেশের জাতি, ধর্ম, দলমত নির্বিশেষে কামনা করেছি, অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করেছি একচল্লিশ জন শ্রমিকের উদ্ধারের আশায়। একটা করে উদ্যোগ একটা নতুন আশা জাগিয়েছে। তারপর সেই উদ্যোগের ব্যর্থতা, আমেরিকান মেশিনের বিকল হওয়া, উল্লম্ব খনন প্রক্রিয়া, একটির পর একটি আশা ও হতাশা অতিক্রম করেছি। অবশেষে হাতুড়ি ছেনি গাঁইতিতে ভরসা করে, সাবেক প্রাচীন পদ্ধতির কায়িক শ্রমে সাফল্য এল।
টানটান উত্তেজনার ঘোর কাটার পরেই এবার আমাদের মধ্যে কিছু প্রশ্ন উঠবে, অন্তত ওঠা উচিত। এ তো রেল লাইনের নিচ দিয়ে দশ/ বারো গজ লম্বা সাবওয়ে তৈরি করা নয়, সাড়ে চার কিলোমিটার সুড়ঙ্গ। সেই ১০/১২ গজের অনুমতিও রেল দফতর ৩০ বছরে দেয় না। তাহলে?
∆ সংবাদে প্রকাশ, গোড়ার দিকে সুড়ঙ্গে হিউম পাইপের ব্যবহার ছিল। ওই হিউম পাইপ দিয়ে ভেতরের বিষাক্ত বাতাস বাইরে বের করা হয়। আর বাইরের মুক্ত বাতাস ভেতরে প্রবেশ করানো হয়। কোনও ধস নামলে শ্রমিকরা আপৎকালীন অবলম্বন হিসেবে ওই পাইপে আশ্রয় নিতে পারেন ও তারপর বাইরে বেরিয়ে আসতে পারেন। জানা গেল, দীপাবলীর কিছুদিন আগে ওই হিউম পাইপ সুড়ঙ্গ থেকে বের করে আনা হয়েছিল। পাইপটি থাকলে এত বড় বিপদ ঘটত না।
∆ প্রশ্ন উঠছে, শ্রমিকদের বাঁচাতে ট্রেঞ্চ কেজ ব্যবহার হয়ে থাকে। ধস নামার সম্ভাবনা দেখলেই শ্রমিকরা কংক্রিটের ওই কেজ বা খাঁচাগুলিতে আশ্রয় নিতে পারেন। সুড়ঙ্গে এমন কোনও ট্রেঞ্চ কেজ ছিল না। সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য মোটামুটি সাড়ে চার কিলোমিটার। সাধারণত দেড় কিলোমিটারের বেশি সুড়ঙ্গ হলেই সেখানে আপৎকালীন বাইরে আসার রাস্তা বা এসকেপ প্যাসেজ থাকার কথা। সুড়ঙ্গের নকশায় সেই প্যাসেজ দেখানো হলেও বাস্তবে সেটা ছিল না। নির্মাণকর্তারা তবে কি খরচ বা সময় বাঁচাতে এটা এড়িয়ে গিয়েছিলেন?
∆ প্রশ্ন উঠছে খোদ সুড়ঙ্গ বানানোর যৌক্তিকতা নিয়ে। কারণ, ওই অঞ্চলের ভূমির চরিত্র নিয়ে বলা হয়েছে এটি ভূমিকম্প-প্রবণ অঞ্চল। ১৯৯১ সালে উত্তর কাশিতে ভূমিকম্পে ২০০০'এর বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল। রিক্টার স্কেলে ভূমিকম্পের তীব্রতা ছিল ৬.৮। বলা হয়, কতকগুলি টেকটনিক প্লেটের উপর সমগ্র পৃথিবীর অবস্থান। টেকটনিক প্লেটের অবস্থান পরিবর্তনের কারণে ভূমিকম্প হয়ে থাকে। প্লেটগুলির সংযোগস্থল ও সেই বরাবর চ্যুতি রেখার নিকটস্থ অঞ্চলে ভূমিকম্পের সম্ভাবনা থাকে বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতীয় প্লেট ও ইউরেশিও প্লেট এই দুইয়ের সংযোগস্থলে যে চ্যুতি রেখা, তার খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে সিলকিয়ারা সুড়ঙ্গ। সুড়ঙ্গের লোকেশন এই সংযোগস্থল ও চ্যুতির রেখার খুব কাছাকাছি হওয়া সত্ত্বেও কেন এই সুড়ঙ্গ নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হল? বলাই বাহুল্য, সম্ভাব্য বিপদ, পরিবেশ, বিশেষজ্ঞদের মতামতের থেকেও এ ক্ষেত্রে ধর্মীয় আবেগ উস্কানির উদ্দেশ্যে চারধাম প্রকল্পটি অধিক গুরুত্ব পেয়েছে। দক্ষিণ ভারতের তুলনায় এখানকার পাহাড় চরিত্রগতভাবে অনেক বেশি ভঙ্গুর, মূলত পাললিক শিলা ও স্লেট পাথরের আধিক্য বেশি, যা অনেক নরম ও ভঙ্গুর। এইরকম ক্ষেত্রে সুড়ঙ্গ তৈরির অনুমতি দেওয়া হল কীভাবে?
∆ ভাবতে আশ্চর্য লাগে, সাড়ে চার কিলোমিটার সুড়ঙ্গ তৈরির আগে তার ভূ-বিশ্লেষণ হয়েছে মাত্র তিনটি নমুনাকে ভিত্তি করে। শ্রমিকদের কথায় জানা যায়, উপরি স্তরে শক্ত অংশ ভেদ করার পর ভেতরে অধিকাংশই মাটি। ফলে, ধস নামা খুব স্বাভাবিক। আমাদের পরিচিত বন্ধুরাও, যারা পর্বতারোহণ করেন নিয়মিত, বলেছিলেন, গঙ্গোত্রী যমুনোত্রীর পথে মাটি ও ছোট নুড়ি পাথরের আধিক্য বেশি। ফলে, ধসের সম্ভাবনা থাকে। অভিযাত্রী বা তীর্থযাত্রীদের নিয়ে সমস্যা নয়, তাঁরা কৃচ্ছ্রসাধন করতেই যান, তাঁবু অস্থায়ী ছাউনিতে রাত কাটান। নিয়মিত পর্যটন ও বিনোদন হল সমস্যা। যত বেশি দূর অবধি বাস রাস্তা নিয়ে যাওয়া হবে, ততই ব্যবসার রমরমা। অতএব পায়ে চলার রাস্তা নয়, পাকা রাস্তা চাই। মেটাল রোড, চওড়া ফোর লেন রাস্তা চাই। তারকা হোটেল চাই। আরও বিদ্যুৎ চাই, বিদ্যুৎ কেন্দ্র চাই।
∆ এ তো গেল নেপোদের দই মারার কথা। এই ১৭/ ১৮ দিনের উৎকণ্ঠা কি আরও কিছু শিক্ষা দিল না? যান্ত্রিক শ্রম আর মানবিক শ্রমের তফাত'টা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। তাহলে গল্পটা বলি। আমার ইস্যু করা একটা চেক ব্যাঙ্কের সিস্টেম রিফিউজ করেছে। কারণ হিসেবে অটো-জেনারেটেড মেসেজ এল। আমি একই সঙ্গে তিন/ চারটি চেক বই ইউজ করছি। এটা অন্যায়। তাই আমার ইস্যু করা চেক রিফিউজড। একটা অবাস্তব অভিযোগ। ব্যাঙ্কে গেলাম। ব্যাঙ্ক কি একজনকে একাধিক বই ইস্যু করে? ব্যাপারটা হল, একটা লোনের ইএমআই হিসেবে পোস্ট-ডেটেড চেক, একটা এলআইসি'কে ইস্যু করা চেক বইয়ের শেষ চেক, আর একটি নতুন চেক বইয়ের প্রথম চেক। তিনটি একই সঙ্গে ক্লিয়ার হতে গিয়ে কম্পিউটার সিস্টেম দেখছে, তিনটি চেক পৃথক পৃথক সিরিজের। তাই সিস্টেম গ্রহণ করছে না। ম্যানুয়েল কাজে এই সমস্যা ক্লার্কের বোধগম্য হয়। যন্ত্রে হয়নি। আগার মেশিন সুড়ঙ্গ খুঁড়তে গিয়ে পাথর, মাটি, লোহা চেনেনি। ফলে, সুড়ঙ্গের ভিতরে লোহায় তার কাটার বা ব্লেড ক্ষতিগ্রস্ত। আর মানবিক কায়িক শ্রম চিনে-জেনে-বুঝে খুঁড়তে জানে। এখানেই তফাত।
∆ আমেরিকার আগর মেশিন খননকার্যের জন্য আনা হয়েছিল। জানা নেই সেই মেশিনের জন্য কত টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু মানবিক ও কায়িক শ্রমের মজুররা জানিয়েছেন, আমরাও শ্রমিক। ৪১টি শ্রমিক পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে পারাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। এর জন্য কোনও অর্থ নেব না। এই মজুররা শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিকতাবাদ জানেন না, 'দুনিয়ার মজুর এক হও' শ্লোগানের মর্মার্থ বোঝেন না। এরা রাষ্ট্রের চোখে খনি এলাকার বেআইনি খননকারী। শ্রমিক শ্রেণির দর্শন থাকলেই হয় না। গতরে মগজে শ্রমিক হতে হয়। অন্যথায় হাঁসজারু বকচ্ছপ।
∆ এই ১৭/১৮ দিনের আরও কিছু মূল্যবান শিক্ষা আমরা পেয়েছি। না আমি বলব না, বিশ্বকাপ ক্রিকেটে জয়ী হলে বা পরাজিত হলে যেমন ভিন্ন ভিন্ন চিত্রনাট্য অগ্রিম তৈরি থাকে, তেমনি উদ্ধারকার্য সফল বা ব্যর্থ হলে কোন নাটকের অবতারণা হবে, সে সব কথা বলব না। ৪০ জন জওয়ানের জীবনের দাম নিয়ে যারা রাজনীতি করতে পারে, ৪০/৪১ জন মজুরকে নিয়েও তারা সেটা করবে এতে আশ্চর্য হই না। বিজেপির প্রচার কমিটি 'মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়' প্রচার করবে ও করেছে। এমনকি এই ঘটনাকে পাঠ্যপুস্তকে স্থান করে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
∆ এমনকি সংবাদ মাধ্যমগুলি এই ঘটনাকে নিয়ে কীভাবে স্টোরি তৈরি করবে, গদি মিডিয়া কীভাবে তা পরিবেশন করবে, সবই আমাদের জানা। সংবাদ মাধ্যমের দেউলিয়াপনা প্রকাশ পায় পিটিআইয়ের প্রকাশ করা ওই রাতের একটি ছবি। জাতীয় পতাকা হাতে সুড়ঙ্গে দাঁড়িয়ে রয়েছেন উদ্ধারকর্মীরা। বিভিন্ন পত্রিকায় সেটা প্রকাশ পেল। আবার পরদিন পিটিআই জানালো ছবিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় নির্মিত, অতএব, ছবিটি যেন প্রকাশ করা না হয়। এও বিচিত্র শঠতা- ছবিটি সংবাদপত্রে প্রকাশ করে উদ্দেশ্য সিদ্ধ করা গেল, তারপর আবার সৎ ভাবমূর্তি বজায় রাখতে তুলেও নেওয়া হল। ততক্ষণে যা হবার তা হয়েও গেল।
∆ আরও উল্লেখযোগ্য, শেষ পর্বের উদ্ধারের ১২ জন নায়ক, তাদের মধ্যে সাত জনের নাম মনে রাখার মতো। ওয়াকিল হাসান, নাসির খান, মুন্নাহ কুরেশি, ইরশাদ আনসারি, রশিদ আনসারি, নাসিম মালিক। এরা সবাই দিল্লির সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পীড়িত অঞ্চলের বাসিন্দা । আর যে দেশের প্রধানমন্ত্রী পোশাক দেখে, দাঁড়ি দেখে শনাক্ত করেন জঙ্গি দাঙ্গাবাজ কারা, তিনি নিশ্চয়ই নামগুলি থেকেই এঁদের শনাক্ত করতে পারবেন। কদিন আগে ক্রিকেটে ভারতের পেসার মহম্মদ শামি একবার প্রধানমন্ত্রীর মুখে কালি মাখিয়েছেন। সিল্কিয়ারা আরও একবার। শুধু তো মোদি না, আমরা অনেকেই তো বলে থাকি, যত খুন খারাবি অপরাধ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নামগুলো দেখবেন। আসারাম বাপু, বাবা রামরহিম বা ব্রিজভূষণ নামগুলো আমাদের কানে ঠেকে না। তাই সিল্কিয়ারা আমাদের সামনে প্রকৃত ভারতকে আরও একবার স্পষ্ট করে দিল। আমাদেরও মুখে একটু কি কালি লাগেনি! লুকাবো কোথায়?
সাবাশ !
ReplyDeleteভালো লেখা
ReplyDeleteFor every event some persons seek only the faults, some others search good things if there be any , the author belongs to the first category. Without consulting the concerned Departments about WHY , what is the necessity of such a difficult project undertaken in known fragile area the author is spreading some idea .
ReplyDeletePerfectly said.
ReplyDeleteভাল লিখেছেন।
ReplyDelete