যাহা পাই তাহা গিলি?
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
কিছুদিন আগেও বিশ্ব জুড়ে DeepFake বা গভীর ছলনা নিয়ে এক ঝড় বয়ে গেল। ফটোশপ বা
সুপার-ইমপোজিশনের যুগ পেরিয়ে আমরা চলে এসেছি এমন এক নিখুঁত ও নির্ভুল ছলনার জগতে
যেখানে সত্য-মিথ্যার সমস্ত সূক্ষ্ম রেখাগুলিও বোধহয় অযাচিত হয়ে পড়েছে। যেন কোনও
উপায় নেই, ফাঁকিটুকু বুঝে ওঠার! ‘আশার ছলনে ভুলি কী ফল লভিনু, হায়, তাই ভাবি মনে?’-
এ তো আশার ছলনে ভুলি নয়, বাটপাড়ির ষোলআনা। ‘ছিল বেড়াল হয়ে গেল রুমাল’এর মতো
হাঁটছিল কলকাতার গলি ধরে, চলে গেল বাকিংহাম প্রাসাদের সদর দরজায়। হামেশাই হচ্ছে।
সোরগোল উঠল, যখন এই মাসের গোড়ায় কন্নড়
অভিনেত্রী রশ্মিকা মানদানা’র একটি ফেক ভিডিও ইন্টারনেটে তুমুল ভাইরাল হল এবং অভিনেত্রী
স্বয়ং তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। ব্রিটিশ অভিনেত্রী জারা প্যাটেলের একটি খোলামেলা ভিডিও’তে
রশ্মিকা’কে প্রতিস্থাপন করে নকলটিকে ভাইরাল করা হয়। যতক্ষণ না সেই ভিডিও রশ্মিকা’র
দৃষ্টিগোচর হয়েছে ও তিনি প্রতিবাদ জানিয়েছেন, ততক্ষণ অবধি কেউ ঘুণাক্ষরেও বুঝতেই
পারেননি যে ভিডিও’টি ফেক। এই অবধি না হয় কিছুটা বোঝা গেল। কিন্তু সেই ফেক ভিডিও’টি
কে তৈরি করে সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করেছে, তা আজও জানা যায়নি। কারণ, দিল্লি
পুলিশের তদন্তে মেটা জানিয়েছে, ইতিমধ্যে সেই ভিডিওটি হৈচৈ শুরু হওয়ার পরে শুধুমাত্র
ডিলিট করা হয়নি, যে অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করা হয়েছিল তাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
আর অ্যাকাউন্ট’টি যেহেতু বানানো হয়েছিল ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন)’এর
মাধ্যমে ভুয়ো পরিচয় দিয়ে, তাই তার নাগাল পাওয়া আর সম্ভব নয়।
এরপর দেখা গেল, বিনোদন জগতে ক্যাটরিনা
কাইফ, কাজল প্রমুখদের ছাপিয়ে ডিপফেক ভিডিও তৈরি হল এমনকি রতন টাটা’র নামেও, যেখানে
একটি অনলাইন বেটিং’এ অংশ নেওয়ার জন্য তাঁকে সকলকে আহ্বান জানাতে দেখা গেল।
সাম্প্রতিক ইজরায়েল-হামাস সংঘাতের আবহেও দেখা দিল এমনতর নানাবিধ ফেক ভিডিও’র রমরমা
যা দিয়ে জনমতকে প্রভাবিত করার প্রবল চেষ্টা। অর্থাৎ, সোশ্যাল মিডিয়ায় অসত্য প্রচার
এখন এমন গভীরতা পেয়েছে যাকে সাদা চোখে সত্য বলে মেনে নেওয়া অতীব সহজতর হয়েছে। কৃত্রিম
বুদ্ধিমত্তা তার প্রাথমিক স্তর পেরিয়ে এখন এসে পৌঁছেছে ‘generative AI’এর স্তরে; যেখানে তার তথ্য ভাণ্ডার আরও স্ফীত
হয়েছে এবং গণনা সক্ষমতা এমন উচ্চতায় পৌঁছেছে যে সে নিত্য নতুন ‘সৃষ্টিশীল’ নির্মাণেও
সক্ষম। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ডিজিটাল ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ হ্যানি
ফারিদ জানাচ্ছেন, ‘প্রতি ১২ মাসে প্রযুক্তি দ্বিগুনতর সক্ষম ও দ্রুততর হয়ে উঠছে।’
এই প্রবণতা আমাদের কোন ভবিষ্যৎ পানে নিয়ে চলেছে, আমরা জানি না, কিন্তু চ্যাটজিপিটি’র
উদ্গাতা ওপেনএআই’এর প্রতিষ্ঠাতা স্যাম অল্টম্যান’কে নিয়ে গত এক সপ্তাহ ধরে যা হয়ে
গেল, তাও এক আশ্চর্যজনক ঘটনা বৈকি! ডিপফেক’এর সঙ্গে এই ঘটনার কি কোনও সংযোগসূত্র
আছে?
আচম্বিতে দেখা গেল, স্যাম
অল্টম্যানকে ‘ওপেনএআই’এর পরিচালন বোর্ড বরখাস্ত করেছে এই অভিযোগে যে, তিনি কৃত্রিম
বুদ্ধিমত্তাকে বাণিজ্যিক লাভালাভের বাসনায় এমন এক পর্যায়ে নিয়ে চলেছেন যেখানে সমগ্র
মানবজাতির সামনে এক সমূহ বিপদ উপস্থিত। সেই বিপদ কী, তা নিয়ে ততটা বিস্তৃত না হলেও
বলা হল, Project Q* নামক এমন এক অ্যালগরিদমের উদ্ভাবন
করা হয়েছে যার দরুণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কোনও প্রশিক্ষণমূলক তথ্য ব্যতিরেকেই নিজের সক্ষমতাতে
প্রাথমিক গণনার সমস্যাগুলোকে সমাধান করতে পারে। তা যদি পারে, তাহলে আজকের কৃত্রিম
বুদ্ধিমত্তা পৌঁছে যাবে Artificial General Intelligence (AGI)’এর এমন এক স্তরে যা তাকে মানব মস্তিষ্কের সমকক্ষ করে তুলতে পারে। এই AGI
হল মানুষের যুক্তি-তর্ক সমতুল্য এক পরিণত সক্ষমতা। তেমন হলে,
মনুষ্যজাতির পক্ষে তা এক চরম বিপদের কারণ হতে পারে- এই অনুমানে ওপেনএআই’এর একদল
গবেষক বোর্ডের কাছে চিঠি দিলে ভীত-চকিত বোর্ড তাদের কর্ণধার স্যাম অল্টম্যানকে
সংস্থা থেকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নেয়।
এরপর আমরা জানি, জল অনেক দূর অবধি
গড়ায়। মাইক্রোসফট বরখাস্ত হওয়া স্যাম অল্টম্যানকে তাদের কোম্পানিতে নিয়োগ করে এবং পাশাপাশি, ওপেনএআই’এর প্রায় ৭০০ কর্মচারী স্যামকে নিজেদের কোম্পানিতে পুনর্বহালের জন্য পরিচালন
বোর্ডের কাছে আবেদন জানায়। স্যাম ফিরে আসেন এবং যে বোর্ড তাকে বরখাস্ত করেছিল, তা তৎক্ষণাৎ
ভেঙ্গে দেন। আপাতত স্যাম আবার ওপেনএআই’এর সিইও হিসেবে পুনর্নিয়োজিত হয়েছেন। তাহলে
কি AGI সম্পর্কিত যে আশঙ্কা ঘনীভূত হয়েছিল তা
অমূলক ছিল, নাকি, সেই লক্ষ্যেই আবার নতুন করে ওপেনএআই তাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে এগোতে
থাকবে?
এই প্রসঙ্গের উত্থাপন এই কারণেই যে, ‘ডিপফেক’
প্রবণতা বা AGI- এমন এক সম্ভাবনা ও আশঙ্কার
ইঙ্গিত দিচ্ছে, যেখানে সত্য-মিথ্যার সমস্ত রসায়ন দ্রবীভূত হয়ে এক আশ্চর্য মায়াজগৎ
নির্মাণ করে চলেছে। সাদা চোখে দেখে বোঝার উপায় থাকবে না, কোন তথ্যটা মিথ্যে বা
উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সাধারণজনের কাছে সেইসব উন্নত টুল’ও নেই যা দিয়ে তারা দুধ থেকে
জলকে আলাদা করতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলোও মিথ্যাচারের উৎস সন্ধানে সদা
বাধ্য নয়। তার ওপর, এমন সব প্রযুক্তিরও উদ্ভাবন হয়েছে, যা দিয়ে মেঘনাদের মতো মেঘের
আড়াল থেকে তীর বর্ষণ করা যায়, যাদের নাগাল পাওয়া কখনও কখনও নিতান্তই
দুষ্কর।
আমরা এসে উপস্থিত হয়েছি এমন এক কঠিন
বাতাবরণে যেখানে বহু এলেমদার প্রযুক্তিবিদদেরও মাথার ঘাম ছুটে যাচ্ছে যথাযথ তথ্যের
নাগাল পেতে। উল্টোদিকে, ডিপফেক তৈরি করতে এমন সব সহজ টুল এসে গিয়েছে যে তা যে কোনও
সামান্য স্মার্ট ফোনে আঙ্গুল চালানো প্রতারকের পক্ষে একেবারেই আয়াসসাধ্য।
সেলিব্রিটিদের ভিডিও ও অডিওকে একশো শতাংশ নিখুঁত রেখে যে কোনও পণ্যের প্রমোশনে ডিপফেক
বানানো এখন জলভাত। কোনও কোম্পানির কর্ণধার আরেক কোম্পানির কর্ণধারের কাছ থেকে এমন
সব ‘বিশ্বাসযোগ্য’ কল পাচ্ছেন যে সেই সুবাদে কোটি কোটি টাকার প্রতারণামূলক ট্রান্সফারের
মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনাও এখন আকছার দেখা যাচ্ছে। অভিভাবকদের কাছে তাদের কচি
বাচ্চাদের ‘অপহরণ’ হয়ে যাওয়ার এমন সব কল ও ইমেজারি আসছে যে তারা বিশ্বাস করে ‘মুক্তিপণ’
দিয়ে ফেলছেন। এরপর AGI আমাদের কোথায় নিয়ে
ফেলতে পারে, তা ভাবতে গিয়েও শিউরে উঠছেন কেউ কেউ। আর সে কারণেই স্যাম অল্টম্যানকে
নিয়ে এত হাঙ্গামা হয়ে গেল।
তাহলে উপায়? অবশ্য এমনও নয় যে, জামতারার
মতো ডিপফেক, প্রতারণা ও রোজগারের এক সর্বজনীন উপায় হয়ে উঠবে অথবা AGI’এর ‘স্বাধীন’ যুক্তি-তর্ক আমাদের সর্বদাই ভুল পথে নিয়ে
যাবে। তা সত্ত্বেও পরিস্থিতিটা এই যে, এক নতুন লড়াইয়ের জমিতে এসে আমরা উপস্থিত
হয়েছি যেখানে সত্য-মিথ্যার প্রাথমিক বয়ানটুকুও হয়তো হারিয়ে যেতে বসেছে। হ্যানি
ফারিদ বলছেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূর হঠো। সংবাদ পরিবেশনের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া
নির্মিত হয়নি; তা হয়েছিল বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং অবসর যাপনের জন্য। অতএব, আমাদের
অলস প্রবৃত্তিকে ত্যাগ করতে হবে। ‘যাহা পাই তাহা গিলি’ নয়, যা পেলাম তাকে যদি যথার্থই
দেখতে-বুঝতে হয় তাহলে চিন্তাশক্তিকে প্রখর করতে হবে, অন্যান্য সমজাতীয় তথ্য ও
সংবাদের সঙ্গে তাকে মিলিয়ে নিতে হবে। জগৎ বড়ই জটিল, তাকে ৩০ সেকেন্ডের টিকটক ভিডিও’তে
বন্দী করে ফেললে নিজেরই মুশকিল।’
এ এক মহারণ বটে। এতদিন প্রযুক্তি ছিল মানুষের সহায়ক হিসেবে। এখন উলটো পথে বরং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়ক হিসেবেই মানুষ কাজ করতে পারদর্শী হয়ে উঠছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দুরন্ত অভিঘাত প্রযুক্তির হাতে মহাকালের রথের ঘোড়ার রশিকে অর্পণ করেছে। AGI হয়তো সেই প্যারাডাইম শিফটকে আপাত এক সম্পূর্ণতা দেবে। হয়তো এটাই ভবিতব্য। কিন্তু মানুষের লড়াই তো চৈতন্যের ভূমিতে নির্মিত হয়। একদিন প্রকৃতির খামখেয়ালিকে নিজ চৈতন্যে অধিষ্ঠিত করেই মানুষ তার নিয়ম ও সূত্রকে বুঝে নিজের সভ্যতা নির্মাণ করেছে। আজও সেই চৈতন্যের আলোকেই সে বুঝে নেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সামগ্রিক সত্তাকে। সেদিনও যেমন উদ্বৃত্তভোগী ও প্রতারকেরা সমকালের প্রযুক্তির সহায়তায় মানুষের বৃহৎ অংশকে বঞ্চিত করেছে, আজও সে প্রক্রিয়া সমভাবেই সক্রিয়। একইভাবে সেই বঞ্চিত বৃহৎ অংশ যেমন প্রতিরোধের লড়াই দিয়েছে, নতুন পথ নির্মাণ করেছে, আজও সে লড়াই অব্যাহত। প্রশ্নটা আদপে তাই প্রযুক্তির নয়, নিজ নিজ চৈতন্যের।
খুব ভালো হয়েছে লেখাটা। অনেক ধোঁয়াশা কেটে গেল। ধন্যবাদ জানাই লেখককে।
ReplyDeleteঅসাধারন বিশ্লেষণ
ReplyDeleteExcelllllllent
ReplyDelete