খানিক অ-ক্রিকেট চর্চা
মালবিকা মিত্র
পাড়ার ছেলেরা রোহিত-বিরাট-শামির পোস্টার পতাকা জায়ান্ট স্ক্রিন টিভি সব আয়োজন সারছে ভোটের মরশুমের ব্যস্ততা, তৎপরতায়। শনিবার, ফাইনাল খেলার আগের দিন। মৃদু স্বরে বললাম, বাবারা, এত আনন্দ আয়োজন করছিস, সবই যেন পণ্ড না হয় দেখিস। কিছু আবেগ উত্তেজনা বাঁচিয়ে রাখতে হয়। যদি হেরে যাস, তখন এই চেয়ার, এই ছাউনি সব গোছানোর সামর্থ্য থাকবে তো?
ছেলেপুলেরা সমস্বরে প্রতিবাদ জানালো, হারের প্রশ্নই নেই। 'আন বিটন আন বিটন, ক্যাঙারুদের লিগের ম্যাচে হারিয়েছি, ফাইনালেও হারাব'... 'আর অস্ট্রেলিয়া তো বাদ যেতে যেতে টিঁকে গেছে কপালের জোরে'। আমি যে নিয়মিত সব খেলা দেখেছি তা নয়। বরং বেশির ভাগ দেখিনি। তাই খেলার পোস্ট-মর্টেম করলাম না। আমি আমার সমাজ চর্চার অভ্যেস উগরে দিলাম।
∆ একবারও না হারার ফলে প্রতিটি ছোট-বড় বিপর্যয়ের সামনে কীভাবে হাল ধরতে হয় তা অজানা থাকাই স্বাভাবিক। ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট শিক্ষা অসমাপ্ত। টিমের সামান্য বিপর্যয়ে দিশেহারা দেখাবে। মনে নেই, স্থল যুদ্ধে অপরাজেয় নেপোলিয়ন স্পেনের মাটিতে প্রথম প্রতিরোধের সামনে দিশেহারা হয়ে গেলেন। দরকার ছিল একটু বিরাম, একটু আত্মবিশ্লেষণ। পরিবর্তে তিনি আরও দ্বিগুণ আক্রমণাত্মক হলেন ও একের পর এক বিপর্যয় ডেকে আনলেন।
∆ প্রথম দুটো খেলায় পরাজিত হয়ে সংশয় ও অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যে দলটা প্রথম চারে উঠে এল, সেই দল বাড়তি সমীহ দাবি করে। সমর্থকদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম ১৯৯২'এর ক্রিকেট বিশ্বকাপ। প্রথম পাঁচ ম্যাচে মাত্র তিন পয়েন্ট পাকিস্তানের। মোট আটটি খেলা। পরের তিনটি ম্যাচ জিতে, নয় পয়েন্ট নিয়ে, কোনওমতে সেমিফাইনালে চার নম্বর দল। ওই বিশ্বকাপ পাকিস্তানের ঘরে গিয়েছিল।
∆ আর ওই বিশ্বকাপের লিগ টেবিলে শীর্ষে নিউজিল্যান্ড শেষ ম্যাচ হারলো পাকিস্তানের কাছে। সেমিফাইনালে এক নম্বরের সাথে চার নম্বরের খেলায় পুনরায় হারলো পাকিস্তানের কাছে। ফাইনালে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে পাকিস্তান চ্যাম্পিয়ন। এমন ঘটনা খেলার জগতে বড় বেশি দেখেছি। ইতিহাসেও কম নজির নেই।
∆ গাভাস্কারের একটি মন্তব্য খেলা, রাজনীতি, পরিবার, সমাজ সব ক্ষেত্রেই মনে রাখি। রোহিত শর্মার প্রথম ODI ছিল ২০০৭ সালে আয়ার্ল্যান্ডের বিরুদ্ধে। কিন্তু সেই ম্যাচে রোহিতের ব্যাট করার প্রয়োজন হয়নি। সেই বিচারে প্রথম ODI দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে, যেখানে তিনি প্রথম রান করলেন ৮ (আট)। গাভাস্কার অসাধারণ নিখুঁত ওই আট রান দেখেই বুঝতে পারেন রোহিতের মধ্যে লুকানো প্রতিভাকে। মন্তব্য করেন, ওকে শুধু জানতে হবে, কোন বলকে সমীহ করে ছেড়ে দেবে। নিখুঁত ব্যাটিং, কিন্তু আউট হল যে বলে, সেটাও ছিল মারাত্মক নিখুঁত।
∆ হ্যাঁ, সমীহ দাবি করে। ওসব হার্ভার্ডওয়ালা জানি না, চিনি না। আমি হার্ড-ওয়ার্কে বিশ্বাসী। এই উদ্ধত বিশ্বাস মূল্যবান মতামতকে অগ্রাহ্য করে। এই মনোভাব ছাড়ার বলকে মেরে বসে।
∆ রোহিতের মধ্যে সেই সমস্যা থেকেই গেল। অসাধারণ ব্যাটসম্যান কিনা হিটম্যান হিসেবে পরিচিত হল। ২০২৩'এর বিশ্বকাপ স্কোর বোর্ড দেখুন, একটাই সেঞ্চুরি। বাকি সব ৪৭, ৪০, ৬১, ৮৭ এইরকম। রোহিতের মতো ব্যাটসম্যান দশ ওভার ক্রিজে থাকলে এমনিতেই রান আসবে। পরিবর্তে অ্যাডভেঞ্চারিজম দেখলাম সব খেলায়। বিপদ ঘটেনি, কারণ, বিরাট, শুভমন, শ্রেয়াস, রাহুল, জাদেজা মেক-আপ দিয়েছে। যেদিন দেবে না? রোহিতের মধ্যে দায়িত্ব নিয়ে ম্যাচ ফিনিশ করার মানসিকতা দেখলাম না।
∆ মহম্মদ শামি প্রতি খেলায় ৪/৫টি উইকেট পাচ্ছে। সেমিফাইনালে ৭টি। বুঝতে পারছিলাম, বোলিং সাইড শামি নির্ভর হয়ে যাচ্ছে। যেদিন শামি ম্যাজিক কাজ করবে না?
∆ অধিকাংশ ম্যাচে ইন্ডিয়া মিডল অর্ডার ও টেল এন্ডারদের ছাড়াই ৪/৫ উইকেট হারিয়ে জয়ী হয়েছে। ফলে, বিশ্বসেরা ব্যাটিং লাইন আপ কার্যত রিজার্ভ বেঞ্চেই বসে থেকেছে।
∆ সর্বোপরি বলি, খেলা পাগল দর্শক একপ্রকার। ওটা সব দেশে থাকে। কিন্তু খেলার সঙ্গে রাজনীতি, দেশপ্রেম, ২০২৪'এর নির্বাচন, জয়শ্রীরাম, ১৪২ কোটি আশা জুড়ে খেলোয়াড়দের ওপর প্রত্যাশার বিপুল বোঝা। 'নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়াম' ও এক লক্ষ বত্রিশ হাজার দর্শকের সিংহনাদ- এ সবই নেতিবাচক চাপ তৈরি করে। অন্য দেশগুলির সমর্থকেরা তো ভয়ঙ্কর ভাবে এবার অনুপস্থিত। জামায় 'ফ্রি প্যালেস্টাইন' লেখা এক অস্ট্রেলিয়া নিবাসী মাঠে নেমে বিরাটের কাছে চলে যাওয়ায় তাকে গুজরাতের পুলিশ বেধড়ক মেরে দেশপ্রেমের 'সবক' শিখিয়েছে। বিপরীতে, অস্ট্রেলিয়ার কাছে ফাইনাল খেলা নিছক আরও একটি খেলা। যাদের সেমিফাইনালে পৌঁছনো ছিল অনিশ্চিত। ফলে, চাপ মুক্ত।
∆ একবার যদি খেলার সাথে তথাকথিত দেশপ্রেম জুড়ে যায়, তখন খেলায় জেতার অর্থ তারা দেশনায়ক। আর হারের অর্থ দেশদ্রোহী। জাহির খান, আজহার, মহম্মদ শামি, রাহুল দ্রাবিড়, শচীন কেউ এই জাতীয় আগ্রাসন থেকে রেহাই পাননি। সেই চাপ যথেষ্ট ছিল।
∆ আমরা যে ক্রিকেটকে দায়িত্ববোধ বলে থাকি, সেটা টি-টোয়েন্টি'র যুগে অচল। আগে ব্যাট করে দল ১২৫ রান করার পর গাভাস্কার বলতে পারতেন, একশো পঁচিশ রান কম কীসের, শূন্য তো নয়। মার কাটারি সনৎ জয়সূর্য-কালুভিথরন জুটি প্রথম দুই ওভারে আউট হবার পর অরবিন্দ ডি সিলভা আর রোশন মহানামার অবিস্মরণীয় জয়সূচক ইনিংস ভুলতে পারি না। এখন ব্যাটিং মানসিকতাই পাল্টে গেছে।
∆ ম্যাচ যখন কার্যত হাতের বাইরে তখন বিরাট গ্যালারির দিকে দুই হাত তুলে সিংহনাদ তুলতে চাইছেন। তখন সিংহ বাস্তবিকই মৃত। মাঠে বিরাট কোহলির আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে সমালোচনা আছে। ওয়ার্নার আউট হবার পর সেটা দেখলাম। কিন্তু তারপর? খেলা যত গড়ালো আগ্রাসন উধাও। আগ্রাসন, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ওসব পরিস্থিতি সাপেক্ষ। নিউজিল্যান্ড ম্যাচে সেমিফাইনালে দুটি পর্বে ভারতীয় ফিল্ডিং বোলিং'কে হতাশ করেছে, জলে ভেজা মুড়ি হতে দেখেছি। তখনই অনুভব করেছিলাম অঘটন ঘটতে চলেছে। মহম্মদ শামি সে যাত্রা বাঁচিয়েছে।
কোথাও একটা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস কাজ করছিল মনে হয়। মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায় গোছের।
খেলার বাইরেও প্রযোজ্য
ReplyDeleteখুব ভাল লাগল। জীবনের পাঠ নিলাম।
ReplyDeleteতীক্ষ্ণ অন্তর্ভেদী নজর না থাকলে এমন আলোচনা সম্ভব নয়। লেখকের এই লিখন বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যারা কমবেশি পরিচিত তাঁরা সবাই নিশ্চয়ই এই বিষয়ে সহমত পোষণ করবেন। ভালো অথবা মন্দ, জিত অথবা হার একই মুদ্রার দুটো পিঠ। সব সময় নিজেকে উচ্চতম অবস্থানে দেখার ইচ্ছের মধ্যে এক ধরনের আগ্রাসনের মনোভাব প্রচ্ছন্ন থাকে। এটা কখনোই স্বাস্থ্যকর প্রবণতা নয়। সত্যকে স্বীকার করে নিতে হয়, নাহলে মিথ্যার আস্ফালন বাড়ে। ইতিহাস এমনই বলে ।লেখককে ধন্যবাদ এই চিরায়ত উপদেশ আবার স্মরণ করিয়ে দেবার জন্য।
ReplyDeleteসঠিক বিশ্লেষণ
ReplyDeleteসঠিক বিশ্লেষন।
ReplyDelete