Monday, 11 December 2023

'ভঙ্গুর স্বপ্ন...'

মায়ানমারের ছবি: চলচ্চিত্রের নতুন ভাষা

সোমনাথ গুহ



২০২১'এর ১ ফেব্রুয়ারি মায়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান হয়, জুন্টা ক্ষমতা দখল করে। দেশের অবিসংবাদী গণতান্ত্রিক নেত্রী আঙ সান সু চি গ্রেফতার হন। তাঁর দল ‘ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি’ নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয়। 

সচ্ছল পরিবারের এক মেয়ে কলেজের পরীক্ষায় অসামান্য রেজাল্ট করেছে, তার ভবিষ্যৎ দিগন্ত জুড়ে ডানা মেলার অপেক্ষায়। সেই সময় বন্ধুরা গাড়ি করে এসে হাজির, জুন্টা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামতে হবে। নির্দ্বিধায় সে তাদের সঙ্গে সামিল হয়। রাজপথ জুড়ে মানুষের মহামিছিল। চারিদিকে তিন আঙুলের প্রতিবাদের স্যালুট ও জয়েন সিডিএম (সিভিল ডিসঅবিডিয়েন্স মুভমেন্ট)'এর পোস্টার, ব্যানার। মেয়েটি তড়াক করে একটি ড্রামে উঠে বক্তৃতা দিতে শুরু করে। বারবার সু চিকে উদ্ধৃত করে বলে, আমাদের ভয় থেকে মুক্তি পেতে হবে, ফ্রিডম ফ্রম ফিয়ার! কয়েক মিনিট মাত্র। পুলিশ পজিশন নেয়, শুরু হয় লাগামছাড়া গুলি বর্ষণ। মেয়েটি ঢলে পড়ে। পুলিশ তার লাশ গায়েব করে দেয়। তার মা যখন মেয়ের মৃতদেহ চায়, পুলিশ জানায়, তিনি যদি তার কন্যার বন্ধুদের চিহ্নিত করেন তবেই তা পাবেন, নচেৎ নয়। 

কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে সদ্য প্রদর্শিত মায়ানমারের ছবি ‘ব্রোকেন ড্রিমস: স্টোরিজ ফ্রম দ্য মায়ানমার ক্যু’র নয়টি গল্পের একটি উপরের ঘটনাটি। প্রতিটি গল্পে মায়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ের বিষাদ, যন্ত্রণা, ট্রমা, বিভীষিকা তুলে ধরা হয়েছে। কিছু মানুষ মারা যায়, বহু লোক দুর্বিষহ যন্ত্রণা নিয়ে দিন গুজরান করে। ‘ডার্ক ট্যাঙ্গেল’ গল্পে কারাবাস ও দৈহিক নির্যাতন যে কী সাংঘাতিক ট্রমা তৈরি করে তা আমরা প্রত্যক্ষ করি। মেয়েটি দিবারাত্র কাটা পশুর মতো যন্ত্রণায় ছটফট করে। নিপীড়নের একেকটি ঘটনা তার মনে পড়ে, সে হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে কঁকিয়ে ওঠে, তার ভয়ার্ত আর্তনাদ বদ্ধ ঘরের মধ্যে অনুরণিত হয়। পুলিশের হুঙ্কার, জনতার মরীয়া শ্লোগান, গুলিগোলার আওয়াজ, মুমূর্ষু প্রতিবাদীর কান্না- সব কিছু মিলেমিশে তার শরীর, মনকে বেসামাল করে দেয়। শিরা কেটে সে আত্মহত্যার চেষ্টা করে, তাতেও ব্যর্থ হয়। কয়েক দিনের কারাবাস তাকে অনন্তকালের নরক যন্ত্রণায় ঠেলে দেয়। এক মহিলা তার জেল জীবনের বর্ণনা দেন। বলেন, রক্ষীরা লিঙ্গ উত্থিত করে প্রতি মুহূর্তে ধর্ষণ করার হুমকি দেয়। সীমাহীন অত্যাচার, অনেকে মারা যায়, লাশ লোপাট হয়ে যায়।

প্রায় চল্লিশ বছর আগে চিত্র পরিচালক মিগুয়েল লিতিন, স্বৈরাচারী অগস্তো পিনোচেতের শাসনাধীন চিলিতে ফিরে গিয়ে গোপনে সেখানকার রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে দীর্ণ মানুষের যাপনকে ক্যামেরাবন্দী করেছিলেন। ১৯৮৬ সালে তাঁর সেই রোমহর্ষক অভিজ্ঞতাকে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ ‘চিলিতে গোপনে’ (ক্ল্যানডেস্টাইন ইন চিলি) নামে একটি ডকু-নভেলে রূপান্তরিত করেছিলেন। ২০১১'এ ইরানের প্রখ্যাত পরিচালক জাফর পানাহিকে সরকার তথাকথিত রাষ্ট্র বিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে গৃহবন্দী করে। অদম্য শিল্পী ঘরে বসেই তাঁর আই-ফোনের সাহায্যে ‘দিস ইজ নট আ ফিল্ম’ নামক ছবি শ্যুট করেন এবং কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাঠিয়ে দেন। বরেণ্য শিল্পীদের এই প্রতিবাদী ঐতিহ্যের সঙ্গে এবার কিছু তরুণ মায়ানমারিজ চিত্র পরিচালকও যুক্ত হলেন। 

‘ব্রোকেন ড্রিমস….’ একই বিষয়ের ওপরে নয়টি ঘটনা/গল্পের একটি কোলাজ। ছবিটির পরিচালক ‘নাইনফোল্ড মোজাইক’- নয়জন অকুতোভয় পরিচালকের একটি সংঘবদ্ধ দল। জুন্টা সরকার এবং থাইল্যান্ডের উদ্বাস্তু ক্যাম্পে পুলিশের প্রখর নজরদারি এড়িয়ে, প্রবল ঝুঁকি নিয়ে, মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে মোবাইল ফোনের সাহায্যে এঁরা এই ছবিগুলি তুলেছেন। বলাই বাহুল্য, জানাজানি হয়ে যাওয়ার কারণে এঁরা সবাই বর্তমানে দেশছাড়া। এঁদের মধ্যে কয়েকজন ‘মায়ানমার ডায়ারিজ’ নামক তথ্যচিত্রের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন, যে ছবি বার্লিনে সেরা তথ্যচিত্রের পুরস্কার পায়।        

প্রতিটি গল্পে স্বৈরাচারী সামরিক শাসনের ভয়ঙ্কর রূপ ফুটে উঠেছে। প্রবল অত্যাচারের কারণে পুরো সমাজে একটা ত্রাস-আতঙ্কের পরিবেশ, মানুষকে অহরহ তা তাড়া করে বেড়ায়। জীবনের আনন্দ ফুরিয়ে যায়। স্বাভাবিক, সুন্দর সম্পর্কগুলো ভয়, দুশ্চিন্তার তাড়নায় বিষাক্ত হয়ে যায়। ‘টু সোলস’ নামক গল্পে দুই বিপ্লবী থাইল্যান্ডের একটি শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। একজন কারাবাসের পর পালিয়ে চলে এসেছে। তার পিঠ জুড়ে প্রহারের দগদগে ঘা, রাতে ঘুমের মধ্যে তার শরীর কেঁপে ওঠে, সে চিৎকার করে। বন্ধুর কাছে সে কবুল করে বিপ্লবের ওপর তার আর কোনও আস্থা নেই। পরস্পরের মধ্যে অবিশ্বাস গড়ে ওঠে। দুজনেই সন্দেহ করে অন্যজন বোধহয় অত্যাচার সহ্য না করতে পেরে বন্ধুদের খোঁজখবর জানিয়ে দিয়েছে। আরেকটি গল্পে দুটি মেয়ে, ন্যাও ও জিট, ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তারা পরস্পরকে চোখে হারায়, কোনও বিচ্ছেদ সহ্য করতে পারে না, সামাজিক ডামাডোল তাদের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি করে। দূরে বিস্ফোরণের শব্দ, আকাশে ফাইটার প্লেন, তারা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে, তাদের নির্মল প্রেম, ভালোবাসার মধ্যে তিরতিরে আশঙ্কার স্রোত প্রবেশ করে। মোবাইল ফোন বেজেই যায়, জিট প্রস্তর মূর্তির মতো বন্ধুর ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকে।  

এরই মধ্যে ঘটে চলে বিদ্রোহ। ‘ডিক্টেটরস বাথরুম’ গল্পে একনায়ক নিজেই আতঙ্কের শিকার! বাথরুমে কমোডের ওপরে এক বিদ্রোহী তাকে চেপে ধরে, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে, প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে। কেন তোমার মধ্যে এত ঘৃণা? কেন তুমি মানুষ হত্যা করতে এত ভালোবাসো? তুমি কি জানো না কয়েক প্রজন্ম পরে লোকে তোমায় কীভাবে বদনাম করবে? প্রশ্নের কোনও জবাব নেই তার কাছে, সে ভয়ে গুটিয়ে যায়, দিশাহারা হয়ে বারবার জানতে চায় কেন তাকে এভাবে হেনস্থা করা হচ্ছে। 

জুন্টার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেশের জনজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। পরিচালক বো থেট হানের ‘ড্যান্সিং ইন দ্য ডার্ক’ সত্যি ঘটনার ওপর নির্মিত। রাজনৈতিক সংকট কী ভাবে কারেন উপজাতিদের জীবনকে বিপর্যস্ত করে সেটা আমরা এই ছবিটিতে দেখি। এই অঞ্চলের মানুষের জীবন স্থির, বাহুল্য বর্জিত। তাদের ফ্রিজ নেই, টিভি নেই, মোবাইলের টাওয়ার পেতে তাদের টিলায় আরোহণ করতে হয়। তাদের শান্তি ক্ষণস্থায়ী। সামরিক বাহিনীর দাপটে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যায়, মানুষ লোটাকম্বল নিয়ে অনিশ্চিতের দিকে যাত্রা শুরু করে। পাহাড় জঙ্গল পেরিয়ে তারা সীমান্তে পৌঁছনোর চেষ্টা করে। চারিদিকে সেনাদের সতর্ক আনাগোনা, তারই মধ্যে এক মহিলা তার স্বামীকে নিয়ে ছোট বোনকে খুঁজে বেড়ায়। দল থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, টহলদার সেনাদের সন্নিকটে ঘোরাফেরা করে। তাদের আশঙ্কা সত্যি হয়, খাদের প্রান্তে মেয়েটির ছিন্নভিন্ন শরীর পাওয়া যায়। এই ছবিতে থাই শিবিরের উদ্বাস্তুরা অভিনয় করেছেন। বো তিন সপ্তাহ ধরে গোপনে এই ছবি শ্যুট করেন। 

মায়ানমার আজ এক লৌহ যবনিকার অন্তরালে। সারা বিশ্ব জানে সেখানে এক চরম অস্থিরতা চলছে, কিন্তু নির্দিষ্ট খবর পাওয়া দুষ্কর। জানা যায় যে মণিপুর, মিজোরামের আন্তর্জাতিক সীমান্তে বহু বিদ্রোহী সেনা এসে আশ্রয় নিচ্ছে। শোনা যায়, দেশের একটা বৃহৎ অংশ এখন এই বিদ্রোহী বাহিনীর দখলে। বো থেট হানরা আশায় বুক বেঁধেছেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার এই লড়াইয়ে চলচ্চিত্রও সংগ্রামের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। 


1 comment:

  1. খুব ভালো লাগলো এই প্রতিবেদন।সেই সঙ্গে ছবিগুলো দেখতে পারলে আরো ভালো লাগতো।জানিনা সেই সুযোগ আবার আসবে কি না

    ReplyDelete