শিন্ডে থেকে দ্রৌপদী
প্রশান্ত ভট্টাচার্য
মোদীর পাখির চোখ চব্বিশে। একের পর এক ঘুঁটি সাজিয়ে যাচ্ছেন সেই লক্ষ্যে। মাতশ্রী থেকে রায়সিনা- বিজেপি প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলছে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনকে কণ্টকশূন্য করতে। মাঝখানে রয়েছে দেড় বছরের মধ্যে ১০ লাখ লোকের চাকরির ললিপপ। রয়েছে 'অগ্নিবীর' বানানোর সংকল্প। এখন পর্যন্ত যা মনে হচ্ছে, বড় ধরনের কিছু না ঘটে গেলে নরেন্দ্র মোদীর তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়াটা শুধু সময়ের অপেক্ষা। তবু একটি প্রকৃত ফ্যাসিস্ট দল চায়, দেশের কোনও প্রান্তেই কোনও ভিন্ন স্বর থাকবে না। থাকবে না অন্য রঙ। তারই ছবি ফুটে উঠেছে মরাঠা মুল্লুকে।
আরব সাগরে ঢেউ উঠেছে, ভেঙে গিয়েছে সেনার শৃঙ্খল। একনাথের দাবি অনুযায়ী, বিক্ষুব্ধ বিধায়কের সংখ্যা যা তাতে সরল পাটিগণিতের হিসেবেই মহাবিকাশ আগাড়ি সরকার সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছে। কিন্তু রাজনীতি এক মহাগণিতশালা। সেখানে কখন যে পাটিগণিতের সঙ্গে বীজগণিত মিশে যায়, কখন যে অ্যাবস্ট্র্যাক্ট অ্যালজেব্রা খেলে দেবে তা বোঝা মুশকিল। এই যে সুরাতের থেকে গুয়াহাটি বেশি সুরক্ষিত ভেবে বিজেপি একনাথ ও তাঁর বাহিনীকে উড়িয়ে নিয়ে গেল, তারপরেও কিন্তু শিন্ডে বলছেন, বিজেপিতে যোগ দেবেন না। যদিও সুরাতের হোটেলে এই বিধায়কদের জন্য ৩৫টি ঘর কে ফোনে বুক করেছিলেন তা এখনও স্পষ্ট নয়, উপরন্তু, হোটেলের ভাড়া ও খরচ না মিটিয়েই বিধায়কেরা গুয়াহাটি পালিয়েছেন বলে অভিযোগ। এই যথেচ্ছাচার করার সাহস এ দেশে কার আছে তা সকলেই জানেন! বালাসাহেবের ব্র্যান্ড ভ্যালু ভাঙাতে চাইছেন বিজেপি মদতপুষ্ট বিদ্রোহী শিবসৈনিকরা। গুয়াহাটি বিমানবন্দরে নেমেই তাই একনাথ শিন্ডেকে বলতে হয়, ‘আমার সঙ্গে মহারাষ্ট্রের আরও ৪০ জন বিধায়ক রয়েছেন। আমরা বালাসাহেব ঠাকরের শিবসেনা ছাড়িনি, ছাড়বও না।’ এই যে নাম্বার থ্রো- তা পার্টনারের হাতে কী কী তাস আছে অনুমান করে কল দেওয়ার মতো। রিয়েলিটি এখানে অনেক দূরের ব্যাপার।
তবে লক্ষণীয়, শিন্ডে বিজেপিতে যোগ দেবেন না বলছেন। এর প্রধান কারণ, বালাসাহেব ঠাকরের উত্তরাধিকার ছাড়লে একনাথও একা হয়ে যেতে পারেন। মরাঠা অস্মিতা ত্যাগ করার শামিল হবে বিজেপির পতাকা হাতে নিলে। শোনা কথা, মঙ্গলবার বিদ্রোহী দলপতি একনাথ শিন্ডের সঙ্গে ফোনালাপ হয় উদ্ধব ঠাকরের। সেই ফোনালাপে শিন্ডে বিজেপির সঙ্গেই জোট বাঁধার দাবি জানিয়েছেন। জবাবে নাকি মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, এর আগে বিজেপির সঙ্গে জোট বাঁধার মূল্য চোকাতে হয়েছে শিবসেনাকে। ফের কী করে বিজেপির ওপর ভরসা রাখা সম্ভব! এটাও ঠিক, একনাথও প্রকাশ্যে বিজেপির সঙ্গে জোট বাঁধার কথা না বললেও, মঙ্গলবার তিনি বালাসাহেব ঠাকরের হিন্দুত্ববাদের যে শিক্ষার কথা উল্লেখ করেছিলেন ট্যুইটে, তাতে পরবর্তী ধাপে হিন্দুত্ববাদকে বাঁচিয়ে রাখতে বিজেপির সঙ্গেই হাত মেলাতে আগ্রহী। এখন তো বলাই যায়, শিন্ডে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন।
গুয়াহাটিতে ঘাঁটি গেড়েও বিধায়কদের জন্য লাগছে ওয়াই ক্যাটেগরির কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা। কেন? ওঁরা কি ফের পালটি খেতে পারেন? এটা ঠিক, জঙ্গি হিন্দুত্ববাদী হিসেবে শিবসেনার যে পরিচয় ছিল, গত আড়াই বছরে উদ্ধবের হাতে তা জাত খুইয়েছে। বিজেপি এটাকে ক্যাশ করে দান ফেলছে মোদীয় মডেলে। যেমন, নরেন্দ্র মোদীর মাস্টারস্ট্রোক দ্রৌপদী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী করা। বিরোধী শিবিরের ডিফেন্স চিরে থ্রু। ২০২৪-এ যদি উনিশের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ফিরে আসতে পারে, তবে মোদী সরকার আরএসএস'এর সবকটা অ্যাজেন্ডা পূরণ করে দেবে। সেই দিক থেকে এবারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ মোদী-শাহদের কাছে। রামনাথ কোবিন্দর মতোই তাঁদের একজন পুতুল রাষ্ট্রপতি চাই। যদিও অ-পুতুল রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় মোদী সরকারকে কোনও বাগড়া দেননি। কিন্তু এবারের বিরোধীদের প্রার্থী যশবন্ত সিনহা, যিনি আবার গত পাঁচ-ছ' বছর ধরে মোদীর তুমুল সমালোচক। ফলে, কোনও ঝুঁকি নিতে নারাজ মোদী। তবে এরপরেও মনে করি, এবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের লড়াইটা এক কথায় নরম হিন্দুত্ববাদী বনাম চরম হিন্দুত্ববাদীর লড়াই। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, বাজপেয়ীপন্থী বিজেপির সঙ্গে মোদীপন্থী বিজেপির লড়াই। রায়সিনায় পৌঁছে গিয়েছে গেরুয়া শিবিরের গোষ্ঠী কোন্দলের আঁচ।
এ নিয়ে বিস্তারিত কথা বলার আগে নবীন পাঠকদের জানিয়ে রাখি, যেদিন ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসেবে বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদকে মেনে নিয়েছিলেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, সেদিনই রায়সিনা হিলসে প্রবেশ করেছিল হিন্দুত্ববাদী কর্তৃত্ব; ১৯৫২ সালেই সোমনাথ মন্দির পুনঃপ্রতিষ্ঠার শিলান্যাসে রাজেন্দ্র প্রসাদের যোগ দেওয়া নিয়ে যা প্রকাশ্যে এল। নেহরুর মত ছিল, একটি ধর্মনিরপেক্ষ ভাবনার দেশে সরকার কোনও একটি বিশেষ মন্দির নির্মাণে টাকা ঢালবে না। পাশাপাশি, সোমনাথ মন্দির ধ্বংসের প্রাচীন ইতিহাসকে সামনে নিয়ে এসে নেহরু সাম্প্রদায়িক আবেগে উসকানি দিতে চাননি। দক্ষিণপন্থী ঐতিহাসিক কানহাইয়া লাল মুন্সির ‘পিলগ্রিমেজ টু ফ্রিডম’ বইটিকে উদ্ধৃত করে নেহরু সম্পর্কে আরএসএস নেতাদের আক্রমণ, তিনি সোমনাথ মন্দিরের প্রাণ প্রতিষ্ঠা ঘিরে হওয়া উৎসবকে ‘হিন্দুত্বের পুনর্জাগরণ’ হিসেবে উল্লেখ করে সমালোচনা করেছিলেন। দুই, নেহরুর আপত্তি তোয়াক্কা না করে রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ ওই শিলান্যাসের পুজোয় উপস্থিত ছিলেন এবং বক্তৃতাও দেন। সংঘের দাবি, সেই বক্তৃতাকেও নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন নেহরু। নাগপুরের তৃতীয় অভিযোগ, কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে মন্দির নির্মাণে কোনও অর্থ দিতে চাননি নেহরু। আলবাৎ চাননি। নেহরু বিশ্বাস করতেন, আধুনিক ভারতের মন্দির হচ্ছে নদী বাঁধ। ঠিক যেমন ২০০১ সালের ১৯ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী বেঙ্গালুরুতে একটি আইটি পার্ক উদ্বোধনে গিয়ে নেহরুর সুরেই বলেছিলেন, 'আমার মতে, আধুনিক অর্থনীতিতে আধুনিক ভারতের মন্দির হল আইটি পার্ক ও সফটওয়্যার সংস্থার ক্যাম্পাস।' দেখুন, দুই লিবারেল হিন্দুর কী অসাধারণ মিল!
আজ রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রসঙ্গে ৭০ ও ২০ বছর আগের ঘটনা টেনে এনে অ্যানালজি টানছি কেন? কারণ, দেশটা এখন দক্ষিণপন্থীদের সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল অংশের দ্বারা চালিত হচ্ছে। তাঁরাই আদিবাসী তাস খেলছেন দ্রৌপদী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী করে। মধ্য-দক্ষিণ ও মধ্য-বামদের ট্র্যাজেডি হল, এই খেলায় তাঁরা বাজপেয়ীপন্থী এক হিন্দুত্ববাদী নেতাকে সামনে নিয়ে এলেন। হয়তো বাধ্য হয়েই এনেছেন, কেন না, শরদ পাওয়ার, ফারুক আবদুল্লাহ বা গোপালকৃষ্ণ গান্ধী- কেউই লড়াইয়ে নামতে রাজি নন। যশবন্ত সিনহার ঘরানা যেহেতু মূলত বিজেপি তাই মোদী-শাহদের ঘর ভাঙার একটা আশঙ্কা আছে। বাজপেয়ী ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত যশবন্ত সিনহা দলের গোষ্ঠী রাজনীতির শিকার। নরেন্দ্র মোদীর লার্জার দ্যান পার্টি ইমেজ নিয়ে ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পরেই যশবন্তের দুর্দিন শুরু হল। যদিও এই যশবন্ত সিনহাই কিন্তু গুজরাত দাঙ্গার সময় লালকৃষ্ণ আদবানির মতো মোদীর হয়ে ব্যাট করেছিলেন। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী অমিত শাহকে সঙ্গে নিয়ে দলের নিয়ন্ত্রণ কব্জা করতে গিয়ে প্রথমেই 'খরচার খাতায়' রাখলেন তাঁর প্রধান পৃষ্ঠপোষক লালকৃষ্ণ আদবানিকে। তারপর ডানা ছাঁটলেন আরেক আদবানি ঘনিষ্ঠ রাজনাথ সিংয়ের। একইসঙ্গে একজন স্বৈরাচারী নেতার মতো অটলবিহারী বাজপেয়ীর ঘনিষ্ঠ ও লেখাপড়া জানা, প্রশাসন চালানোয় দড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের ব্যাক বেঞ্চে পাঠালেন। মোদী-শাহ শিবিরের চাপে পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে ২০১৮ সালে যশবন্ত দলত্যাগে কার্যত বাধ্য হন। তারপর থেকেই মোদী ক্যাম্পকেই তিনি চাঁদমারি বানিয়েছেন প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। ২০২১ সালে তৃণমূলে যোগ দেন যশবন্ত। আজ যশবন্ত সিনহা বাম-কংগ্রেস-তৃণমূল-সহ বিরোধী দলগুলোর প্রার্থী হলেও মোদী শিবিরের প্রার্থী দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গে লড়াই আসলে যশবন্তের সঙ্গে মোদী শিবিরের লড়াই।
প্রতিশোধ স্পৃহায় জ্বলতে থাকা ক্ষতবিক্ষত এক প্রাক্তন বিজেপি নেতা মরিয়া চেষ্টা করছেন দলের বর্তমান ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীকে ধাক্কা দেওয়ার। গেরুয়া শিবিরের অন্দরের লড়াইকে সুকৌশলে রায়সিনা হিলস পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়েছেন যশবন্ত। বিরোধী শিবিরকে কাছে টেনে এই লড়াই জেতার জন্যই নিজেকে গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্যাকেজিং-এ পেশ করেছেন। আর বিজেপি-বিরোধী ঐক্যের স্বার্থে সিপিআইএম-কংগ্রেস সহ বিরোধী দলগুলোকে প্রাক্তন বিজেপি সহ-সভাপতি ও তৃণমূলের সদ্য প্রাক্তন সহ-সভাপতিকে সমর্থন করতে রাজি হতে হয়েছে। এটাই সম্ভবত এই সময়ের রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ফলাফল যা-ই হোক, এর ফলে বিজেপি-বিরোধী ঐক্যের বাতাবরণ আরও জোরালো হবে বলে কেউ কেউ মনে করছেন। কিন্তু এসবই ঘোলাজলে মাছ ধরার ব্যাপার। আমার বিশ্বাস, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে ঘিরে বিরোধী জোটের ছবি লোকসভা ভোটের দামামা বাজলেই ধাক্কা খাবে। যে ধাক্কা ইতিমধ্যেই মহারাষ্ট্রে দিয়ে দিয়েছে বিজেপি। মহারাষ্ট্রের সাফল্যের পরই দীনদয়াল মার্গের ম্যানেজারদের নজরে রাজস্থান। সেখানেও ইডি-সিবিআই সক্রিয় আর শচিন পাইলটের মতো বিক্ষুব্ধরা তো আছেনই। ভোটে না জিতে সরকার করার রাজনৈতিক আর্ট নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ রপ্ত করে নিয়েছেন। ফলে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মতো ছেলে-ভোলানো নির্বাচন নিয়ে মোদীর তেমন কোনও মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু লড়াইটা যখন গেরুয়া শিবিরের অন্তর্দ্বন্দ্বের প্রকাশ তখন যশবন্ত কিছুটা হলেও মোদী-শাহকে চিন্তিত করেছে। নইলে মনোনয়ন জমা দিয়েই দ্রৌপদী সনিয়া গান্ধী-মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফোন করতেন না। শুধু মমতা আর সনিয়াকে ফোন করলেও না হয় বুঝতাম যে, মহিলা হিসেবে দেশের দুই প্রধান মহিলা রাজনীতিককে ফোন করেছেন। কিন্তু দ্রৌপদী মুর্মু এনসিপি প্রধান শরদ পাওয়ারকেও ফোন করেছেন। অনেকের মতে এটা প্রথা হলেও, আমার স্থির বিশ্বাস, মোদীর ইঙ্গিত না পেলে 'আদিবাসী' দ্রৌপদীর হিম্মত হত না এই ফোন করার। আসলে মোদীও মেনে নিয়েছেন, দ্রৌপদী-যশবন্তের লড়াই মূলত বিজেপির নরমপন্থী বনাম চরমপন্থীর লড়াই। এ লড়াইয়ে মোদী যত সাফল্য পাবেন, বিরোধী শিবির ততই ছত্রখান হবে আর ২০২৪ -এর লোকসভা ভোটে বিজেপির আসন সংখ্যা হয়তো জেনিথ পয়েন্টে পৌঁছে যাবে।
Very good analysis
ReplyDelete