পল্লবিত ঘৃণার রাজনীতি
সুমন সেনগুপ্ত
যেদিন থেকে নরেন্দ্র মোদীর সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসেছে, সেদিন থেকেই দেশের বেশির ভাগ গণমাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর একটা বিরাট ভাবমূর্তি তৈরি করার চেষ্টা চলেছে। সেই চেষ্টার পিছনে শুধু যে গণমাধ্যমের ভূমিকা আছে এমনটা নয়, কেন্দ্রের শাসক দলের প্রচুর শক্তিশালী সামাজিক মাধ্যমের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। এই গোটা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে দেশের বেশ কিছু মানুষের কাছে একটা বার্তা পৌঁছনো গেছে যে, প্রধানমন্ত্রী সব কিছু পারেন। তিনি ইচ্ছে করলে কালো টাকার ব্যবসায়ীদের শায়েস্তা করতে পারেন, নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ করতে পারেন, প্রতিবেশী দেশকে সমুচিত জবাব দিতে পারেন, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা তুলে দিয়ে এতদিনের অবিচার বন্ধ করতে পারেন, রাম মন্দিরও বানাতে পারেন। অর্থাৎ, তিনি সর্বশক্তিমান। তিনি বিশ্বগুরু। তিনি মানবিক, তাই তিনি কোভিডের টিকা অন্যান্য বহু দেশে দান করতেও পিছপা নন।
এই সমস্ত কর্মকাণ্ডে তিনি কতটা সফল আর কতটা বিফল, তা নিয়ে চুলচেরা বিতর্কের দরকার নেই। যে কোনও সুস্থ মানুষকে প্রশ্ন করলেই এর উত্তর মিলবে। কিন্তু তাঁর ভাবমূর্তির কোনও ক্ষতি উনি হতে দেননি। যখনই তাঁর ভাবমূর্তির ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে, তখনই তাঁর পোষা গণমাধ্যম অন্য কিছুতে বিতর্কগুলোকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে।
অনেকেই হয়তো মনে মনে ভাবেন, নরেন্দ্র মোদীর গুজরাট দাঙ্গার ইতিহাস থাকলেও এখন তিনি যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী, তাঁর মধ্যে যে মুসলমান বিদ্বেষ আছে তা হয়তো তিনি সামনে আসতে দিতে চান না। তিনি এককালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের সদস্য থাকলেও আজ তিনি ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস’, অর্থাৎ, সব ধর্ম, জাতি, বর্ণের মানুষদের সঙ্গে নিয়ে দেশের বিকাশ বা উন্নয়ন ঘটাতে চান। কিন্তু সত্যি কি তাই? তাঁর মধ্যকার মুসলমান বিদ্বেষ কি একেবারে চলে গেছে? যদি যেত, কিছুদিন আগে যখন হরিদ্বারের ধর্ম সংসদ থেকে দেশের মুসলমানদের গণহত্যার হুমকি দেওয়া হল, তখন তো তিনি তার বিরোধিতা করলেন না? যখন দেশের বহু মানুষ ওই গণহত্যার হুমকি দেওয়া মানুষজনদের গ্রেফতারির দাবি তুললেন, তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী তো একটি কথাও বললেন না। একবারও বললেন না যে, দেশেরই এক শ্রেণির নাগরিকদের শুধুমাত্র সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে গণহত্যায় মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া সংবিধানের পরিপন্থী।
এই কথাগুলো আবারও নতুন করে কেন বলতে হচ্ছে? বলতে হচ্ছে, কারণ, প্রধানমন্ত্রী আবারও চুপ করেই আছেন। কিছুদিন আগে বিজেপির এক কেন্দ্রীয় মুখপাত্র নূপুর শর্মা একটি জাতীয় সংবাদমাধ্যমের বিতর্কসভায় পয়গম্বর হজরত মহম্মদ সম্পর্কে মানহানিকর মন্তব্য করেন। দেশের বহু মানুষজন যখন তার বিরোধিতা করেন, তাকে আমল দিতে চায়নি কেন্দ্রীয় সরকার। উত্তরপ্রদেশে যখন এই নিয়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন সংখ্যালঘু মানুষজন, সেই বিক্ষোভে নির্মম লাঠিচার্জ করা হয়।
এই অবধি মোটামুটি ভারত সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল। গোল বাঁধল, যখন আরব দেশ থেকে হজরত মহম্মদের এই অপমানের বিরুদ্ধে মুসলমান প্রধান দেশগুলোর তরফে আপত্তি করা হল। তাদের তরফ থেকে ভারত সরকারকে প্রশ্ন করা হয়েছে- তারা কী চোখে দেশের মুসলমানদের দেখে। অবস্থা এতটাই জটিল হয়েছে যে ভারত সরকারকে বলতে হয়েছে, যাঁরা মুসলমান বিরোধী কথা বলছেন বা টুইট করছেন তাঁরা বিজেপির কেউ নন। তাঁদের তড়িঘড়ি বহিষ্কার করে জানানো হয়েছে তাঁরা বিজেপির প্রান্তিক লোক। দলের তরফে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তারা সব ধর্মকে সম্মান করে। কিন্তু সত্যিটা কি তাই? বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কি মুসলমান বিদ্বেষী কথা বলেননি? মুসলমানদের খোলা জায়গায় নামাজ পড়া নিয়ে কি এই দলেরই নানান মুখপাত্ররা নানান কথা বলেননি? মাঝে মধ্যে যখন মসজিদে মাইক লাগিয়ে আজান দেওয়া নিয়ে বিতর্ক হয়, তখন কি প্রধানমন্ত্রী তাঁর দলের লোকজনদের সাবধান করেছেন? এই প্রধানমন্ত্রী তো নিজে বলেছেন, যাঁরা নাগরিকত্ব আইন বিরোধী আন্দোলনের সামনের সারিতে আছেন তাঁদের পোশাক পরিচ্ছদ দেখেই বোঝা যায় তাঁরা কারা! তাহলে আজ বিজেপির তরফে নূপুর শর্মাকে সাসপেন্ড ও নবীন জিন্দালকে বহিষ্কার করলেই কি সমস্যার সমাধান হবে?
সরকারের পক্ষ থেকে যে কথা বলা হয়েছে তা কিন্তু মুসলমান প্রধান আরব দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার উদ্দেশ্যেই। দেশের মধ্যে বসবাসকারী সংখ্যালঘু মানুষজনদের জন্য কিন্তু কোনও বার্তা সরকারের তরফে দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ, এবারেও কিন্তু নরেন্দ্র মোদী তাঁর সহিষ্ণুতার পরিচয় দেননি। তিনি ধর্মসংসদে গণহত্যার হুমকির সময়েও যেমন মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন, এবারও কিন্তু তিনি এবং তাঁর সরকার নিশ্চুপই আছেন। তাঁর সংখ্যালঘু বিরোধী ভাবমূর্তিতে কিন্তু এতটুকু আঁচড় পড়েনি। গুজরাট দাঙ্গায় নিহত হাজার হাজার সংখ্যালঘু মানুষের মৃত্যুর জন্য তাঁর যে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই, তা তিনি নিরন্তর বুঝিয়ে দিচ্ছেন। তাঁর ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’ যে সংখ্যাগুরুর জন্য তা তিনি জানেন, আর জানেন বলেই তাঁর মুখোশ খুলে গেলেও তিনি লজ্জিত নন। তাই তিনি চুপ করে আছেন এবং আবারও সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছেন কখন নিজের বিশ্বগুরুর ভাবমূর্তি সামনে নিয়ে আসা যায়। কিন্তু তাঁর এই কর্মকাণ্ডের ফলে যে গরিব ভারতীয়রাই ভুগবে, তা কি তিনি জানেন না? অবশ্যই জানেন। ইতিমধ্যেই মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু দেশ থেকে উড়োজাহাজে ভারতীয় শ্রমিকদের দেশে ফেরানোর কাজ শুরু হয়ে গেছে। ফলে, আবারও ভুগতে চলেছেন অসংখ্য গরিব মানুষ। এই প্রক্রিয়া যদি চলতেই থাকে তাহলে নরেন্দ্র মোদীর আরও সুবিধা হবে। তাঁর দলের মেরুকরণের রাজনীতি করতে আরও সহজ হবে। প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দলের পক্ষ থেকে বিবৃতি দেওয়া হবে আরব দেশগুলোর এই অমানবিক আচরণের বিরুদ্ধে; তাতে যে বিজেপির দ্বিগুণ লাভ হবে তা কি বলার অপেক্ষা রাখে?
অনেকে হয়তো ভাবছেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর কাছে বিজেপির মুখ পুড়েছে। কিন্তু সেই ভাবনা অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। আমাদের দেশের সংখ্যালঘু মানুষজন অনেকেই হয়তো মনে করছেন, আরব দেশগুলোর কাছে ভারত সরকার একটা ভালো শিক্ষা পেল। কিন্তু এই কথাটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, এই ঘটনায় বিজেপির এতটুকুও ক্ষতি হবে না উল্টে লাভ হবে। ঠিক যেভাবে এই ঘটনার বিরুদ্ধে বাংলার ডোমজুড়ে দীর্ঘ সময় ধরে অনাবশ্যক পথ অবরোধ হল, এইরকম নানান গণ্ডগোল সারা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়বে, ফলে আবারও মেরুকরণ ঘটবে। আমাদের দেশের সংখ্যালঘু মানুষের সম্মানের লড়াইটা দেশের ধর্মনিরপেক্ষ এবং সংখ্যালঘু মানুষদেরই করতে হবে। কিন্তু অন্যভাবে।
এই নূপুর শর্মা-নবীন জিন্দাল বিতর্কে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে দিকটি আলোচনায় আসা উচিত ছিল তা কিন্তু আমাদের দেশের সংবিধান মেনে চলা ধর্মনিরপেক্ষ মানুষদেরই তুলে ধরতে হবে। তা হল, এই ঘৃণা ও বিদ্বেষের আবহাওয়া তৈরি করতে গণমাধ্যম, বিশেষ করে টেলিভিশনের ভূমিকা। ২০১৪ সাল থেকে প্রতিদিন যে ভাবে দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অর্থাৎ বেকার যুবকদের চাকরি, শিক্ষা, মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদির বদলে দেশের নানান প্রান্ত থেকে সচেতনভাবে অ-গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক বিষয়কে আমাদের বসার ঘরে নিয়ে আসা হয়েছে, তাতে কি এই পরিস্থিতি খুব অবশ্যম্ভাবী ছিল না? আজ অনেকেই হয়তো নূপুর শর্মাকে দায়ী করছেন, কিন্তু তার আগে কি এই টেলিভিশনের চ্যানেলগুলো- যাঁরা রোজ বিতর্কের নামে মানুষের মনে ঘৃণা ও বিদ্বেষ বুনে চলেছে- তাদের দোষী সাব্যস্ত করা উচিত ছিল না? সবার আগে কি বলা উচিত নয়, এই ধরনের বিতর্ক যা মানুষের মধ্যে বিভেদের সৃষ্টি করছে তা বন্ধ করতে হবে।
বেশ কয়েক বছর আগে দেশের অন্যতম এক সাংবাদিক রভীশ কুমার বলেছিলেন, যদি নিজে বাঁচতে চান, যদি শিশুদের বাঁচাতে চান, তাহলে টেলিভিশন দেখা বন্ধ করতে হবে। অনেকে হয়তো বুঝতে চাননি। কিন্তু সেই কথাটি যে কী পরিমাণে সত্যি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সামাজিক মাধ্যম এবং টেলিভিশন যে কীভাবে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে, তা যদি আজও না বুঝতে পারি তাহলে কবে বুঝব। যে গণমাধ্যমের প্রচার এবং সামাজিক মাধ্যম দিয়ে নরেন্দ্র মোদীর ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছিল ২০১৪'র আগে, সেই গণমাধ্যম আজ নরেন্দ্র মোদীর ভাবমূর্তি নষ্ট হোক, তা কি চাইবে? এই সোজা প্রশ্নটা নিজেকে করলেই অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলবে। কিন্তু সেই সোজা কাজটা কি আমরা করতে চাইছি? গণমাধ্যম, বিশেষ করে টেলিভিশনের এই অনুষ্ঠানগুলো না দেখলেই কিন্তু আমাদের জীবনে অনেক প্রশান্তি থাকবে। কিন্তু এই অত্যন্ত সোজা কাজটা কি আমরা করব? করলে আর কবে করব? পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে বিষ প্রবেশ করে যাওয়ার পরে?
ভাল লেখা
ReplyDelete