অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
‘অগ্নিপথ’এ দাউ দাউ দাবানল। উত্তরপ্রদেশ থেকে তেলেঙ্গানা, বিহার থেকে রাজস্থান, এমনকি পশ্চিমবঙ্গেও এই দাবানলের দাবদাহে পুড়ছে বিভেদ-জঞ্জালের স্তূপ। এই মুহূর্তে উত্তাল দেশের অন্তত ১৩টি রাজ্য। গত কয়েক বছর ধরে ধর্মের রাজনীতি দিয়ে যে তীব্র বিভাজন, অবিশ্বাস, ঘৃণা ও হিংসার বাতাবরণ তৈরি করা হয়েছিল, তা যেন নিমেষে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। বিহারে উপ-মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি পর্যন্ত এই রোষানল পৌঁছে গেছে, সাসারামে ভস্মীভূত হয়েছে ধর্মীয় বিষবাষ্পের জনকদের দলীয় কার্যালয়। এতদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ যেন কোভিড-উত্তর পরিস্থিতির খোলা হাওয়ায় সজোরে আছড়ে পড়েছে। ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের পর আবারও এক জন-জাগরণ।
অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান- যার একমাত্র সুরাহা হতে পারে অর্থবহ কর্মসংস্থানে, সেই পরিসরটিকেই সংকুচিত করতে করতে দেশের সরকার এমন এক খাদের কিনারায় এনে আমাদের সকলকে দাঁড় করিয়েছে যে নিস্তারের পথ খুঁজতে মানুষের বেপরোয়া হয়ে ওঠা ছাড়া আর কোনও গত্যন্তর নেই। অন্তত সেনাবাহিনীতে নিয়োগ ও স্থায়ী কর্মসংস্থানের যে সুযোগ এতদিন ছিল, তাকেও অকেজো করে দিতে কেন্দ্রীয় সরকার যখন ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্পের ঘোষণা করল, তখন বিপর্যস্ত যুব সমাজের সামনে বিদ্রোহে ফেটে পড়া ছাড়া আর কোনও রাস্তা অবশিষ্ট ছিল কী?
বলা হল, চলতি বছর থেকে ১৭.৫ থেকে ২১ বছর বয়সী যুবকেরা যারা সেনাবাহিনীতে নিয়োগ পাবে তা হবে অস্থায়ী চরিত্রের এবং চার বছর পর তাদের মধ্যে মাত্র ২৫ শতাংশকে স্থায়ী ভাবে বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে; বাকী ৭৫ শতাংশকে ফিরে যেতে হবে। ফেরত যাওয়ার সময় তাদের হাতে ১১ লক্ষ টাকার কিছু বেশি এককালীন ভাতা দেওয়া হবে শুধু, কোনওরকম অবসরকালীন সুযোগ-সুবিধা তারা পাবে না। সরকারের এই একতরফা উদ্ধত ঘোষণা কর্মহীনতার আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছে।
গত দু’ বছর কোভিডের কারণে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ বন্ধ ছিল। ইতিমধ্যে অনেকেই সেনাবাহিনীর লিখিত পরীক্ষা, স্বাস্থ্য পরীক্ষা ইত্যাদি বিবিধ স্তরে উত্তীর্ণ হয়ে রয়েছে; বছরে গড়ে ৫০,০০০ মতো নিয়োগ-প্রাপ্তির তালিকায় তারা অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আশায় দিন গুনছে। এমনই এক পরিস্থিতিতে সরকারের ‘অগ্নিপথ’ ঘোষণা যেন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। এবার যারা নিয়োগপত্র হাতে পাবে, তাদের অধিকাংশেরই (৭৫ শতাংশ) চার বছর পর চাকরির আর কোনও নিশ্চয়তা থাকছে না। এই ৭৫ শতাংশ কারা হবে- এ নিয়ে চার বছর ধরে তাদের মনে থাকবে উদ্বেগ ও শঙ্কা। তারপর যারা বাতিলের দলে চিহ্নিত হবে, তারা এবার যাবে কোথায়? অর্থাৎ, ১৮ বছর বয়সে যে ছেলে সেনায় নিয়োগপত্র পেল, ২২ বছরে পৌঁছে সে আবার কর্মহীন হয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াবে, ‘অগ্নিবীর’ শিরোপা নিয়ে। অথচ, এই চাকরিতে যোগ দেবার জন্য সে তার উচ্চতর শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জনের ধাপগুলিকে পরিত্যাগ করেছে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এক অন্যতর কর্মজগতের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছে, পরিবার-পরিজন ছেড়ে দুর্যোগপূর্ণ পরিবেশ ও শত্রু বেষ্টিত অঞ্চলে নিজের জীবনকে বাজি রাখতে রাজী হয়েছে। এরপরেও এইভাবে তাদের রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলার অর্থ, সমাজের সর্বত্র জীবন-জীবিকা ও বেঁচে থাকার রসদগুলিকে আরও অনিশ্চিত ও বিপন্নতর করে তোলা। এই সার্বিক অধঃপতনের রচনাকারদের বিরুদ্ধেই তাই আজ ছাত্র-যুব ও চাকরিপ্রার্থীদের সর্বাত্মক রোষ।
সামগ্রিক ভাবে স্থায়ী কর্মের বাজার যখন সংকুচিত হয়ে আসছে, সরকারি, আধা-সরকারি চাকরির বাজারও যখন প্রায়-শুনশান, তখন শেষ পিদিমের সলতে এই সেনাবাহিনীর চাকরিতেই অল্পবয়সী কর্মপ্রার্থীরা আশার আলো দেখত। বিশেষ করে সেই সব রাজ্যের কিষাণ ঘরের যুবকেরা, যারা উজ্জ্বল চাকরি বলতে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্তিকেই বুঝত- তার স্থায়িত্ব, সময়মতো বেতন, নানারকম সুযোগ-সুবিধা ও অবসরকালীন পেনশনের জন্য। আর এই বিশ্বাসও খুব প্রচলিত ছিল যে, সেনাবাহিনীতে কখনই নিয়োগ বন্ধ হয় না- দেশের সুরক্ষার সঙ্গে বাহিনী জড়িত, অতএব, এখানে অর্থ, প্রযুক্তি ও নিয়োগে কোনও কার্পণ্য নেই- এমনতর বিশ্বাসের ওপরে শুধু তরুণ সমাজই নয়, দেশের এক বড় অংশও ভরসা রাখত। সরকারের ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্প এই বিশ্বাসের ওপর এক প্রবল আঘাত হানল।
কিন্তু কেন এই পথে সরকার অগ্রসর হল? তা কি শুধুমাত্র সামরিক খাতে বর্ধিত ব্যয় হ্রাসের উদ্দেশ্যে? অথচ তথ্য বলছে, ২০১৩-১৪ সাল থেকে ২০২২-২৩ সালের মধ্যে আমাদের দেশের প্রতিরক্ষা বাজেট উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু বৃদ্ধি পায়নি, দ্বিগুন হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, প্রতিরক্ষা খাতে সার্বিক ব্যয় কমানোটা সরকারের উদ্দেশ্য নয়! তাহলে কোন ব্যয়কে হ্রাস করতে চাইছে সরকার? কেনই বা? দেখা যাচ্ছে, ২০১৩-১৪ সালে যেখানে প্রতিরক্ষা খাতে মোট ব্যয়ের ৪২.২ শতাংশ খরচ হত বেতন ও পেনশনে, সেখানে ২০২২-২৩ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৪৮.৪ শতাংশে (প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি)। সরকার এই ব্যয়টাকেই হ্রাস করে অন্য খাতে বরাদ্দ বাড়াতে চাইছে। এর দু-তিনটে উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য আছে।
প্রথমত, এটা বোঝা খুব জরুরি যে, আজকের রাজনৈতিক-অর্থনীতি পুরনোকালের ভূ-পরিসর থেকে ডিজিটাল ও সাইবার পরিসরে প্রবেশ করেছে, যেখানে ভৌগোলিক অঞ্চলকে দখলে আনার প্রয়োজনীয়তা আর বিশেষ থাকছে না। অর্থাৎ, সামরিক যুদ্ধের উপযোগিতা আর সেভাবে নেই। হয়তো, রুশ-ইউক্রেন জাতীয় কিছু আঞ্চলিক সংঘাত থেকে যাবে সাবেক মেজাজী শাসকদের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার কারণে, কিন্তু সে প্রবণতাও ক্রমেই বিলীয়মান। বরং, ডিজিটাল ও তথ্যের দুনিয়ার ওপর দখল নেওয়াটাই এখন আধিপত্যের মূল কথা, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ইন্টারনেট অফ থিংকস ও মেটা দুনিয়াই হবে যুদ্ধের সম্ভার। ফলে, রাষ্ট্রের তরফে প্রতিরক্ষা বাহিনীতে সেনা নিয়োগের দায় ও দায়িত্বও ক্রমশ কমে আসারই কথা। সে অর্থে প্রতিরক্ষা বাজেটে বেতন-পেনশনের ব্যয় কমিয়ে আধুনিক প্রযুক্তিতে দর হয়ে ওঠাটাই আজকাল সাব্যস্ত হচ্ছে। অর্থাৎ, সেনা নিয়োগ কমিয়ে আধুনিকতম প্রযুক্তিতে ব্যয় বাড়ানো- যা গোয়েন্দাগিরি ও ‘বাধ্যত’ যুদ্ধে সর্বোৎকৃষ্ট দক্ষতা এনে দিতে পারে। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে, সেনাবাহিনীতে লোকবল কমানোর প্রশ্নটি জুড়ে আছে আমাদের দেশের কর্মসংস্থানের প্রশ্নের সঙ্গে। অন্যান্য সরকারি ক্ষেত্রে নিয়োগ হ্রাসের ফলে তা আরও প্রাসঙ্গিক ও কার্যকরী হয়ে উঠেছে। যুবকদের প্রশ্ন তাই যথার্থ: এই যে সরকার সমস্ত উপায়গুলোকে ধীরে ধীরে অবরুদ্ধ করে দিল, এবার আমরা যাব কোথায়?
দ্বিতীয়ত, অর্থনীতিতে সরকার যখন একের পর এক দায় ঝেড়ে ফেলে গোটা ব্যবস্থাটাকে কর্পোরেট ও বাজারের হাতে সঁপে দিতে চাইছে, বিপদে-আপদে কিছু অনুদান দেওয়া ব্যতিরেকে তারা যখন আর কোনও দায়িত্ব নিজের হাতে রাখতে চাইছে না, তখন স্বাভাবিক যে, মানুষের অসহায়তা ও বিপন্নতা অবশেষে একদিন এক সার্বিক বিদ্রোহের চেহারা নেবে। যখন দেখা গেল, প্রায়-সর্বত্র স্থায়ী কর্মসংস্থানের দরজা বন্ধ, মানুষের ক্ষোভ আঁচ করে ভোটের আগে ১০ লক্ষ সরকারি চাকরি দেওয়ার ঘোষণা (এইসব চাকরি ‘অগ্নিপথ’এর মতোই কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে), তখন সেনাবাহিনীতেও নিয়োগ-দরজা প্রায় বন্ধ হয়ে আসায় মানুষের বেদনা যে আর কোনও বাধা মানবে না, তা কিছুটা স্বতঃসিদ্ধ ছিল। এখন বিপদে পড়ে সরকার কিছুটা তাপ্পি দেওয়ার চেষ্টা করছে (অন্তত মুখে বলে)- চাকরিপ্রার্থীদের বয়সসীমা বাড়িয়ে, আধা-সামরিক বাহিনী ও পুলিশে ‘অগ্নিবীর’দের জন্য ১০ শতাংশ সংরক্ষণের ব্যবস্থার ঘোষণা দিয়ে। কিন্তু মোদ্দা কথায়, স্থায়ী কর্মসংস্থান প্রদানের ব্যবস্থাপনাটি যে আর আগের মতো থাকছে না, সেনাবাহিনীতেও নিয়োগের পরিমাণ যে আরও বহুল পরিমাণে কমে আসছে- এই সত্যটি এখন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। আর তা বুঝেই মরীয়া হয়ে দেশের যুব সমাজ এক সর্বাত্মক আন্দোলনে পথে নেমেছে। মুছে যাচ্ছে ধর্মের ভেদাভেদ, ভেঙে পড়ছে বিভেদ-হিংসার পাঁচিল।
এতদিন নির্দিষ্ট এক সম্প্রদায়ের প্রতিবাদীদের ঘরবাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে ধর্মের কারবারি-শাসকেরা যে বিভেদ-হিংসার আগুন জ্বেলেছে, আজ সেই আগুন লেলিহান হয়ে উঠেছে জনতার সম্মিলিত রোষানলে। আগুনের তো কোনও দেশ নেই, নির্দিষ্ট পরিচয়ও নেই। বর্বরতা, তীব্র জেদাজেদি ও নানারকম টালবাহানার পর তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করে সরকার নিজের মুখ পুড়িয়েছিল। তবুও নির্লজ্জ এরা। এরপরেও চেষ্টা চালিয়ে গেছে, কীভাবে ধর্মের আগুন জ্বালিয়ে এ দেশকে ক্ষতবিক্ষত করা যায়। কিন্তু আধুনিক রাজনৈতিক-অর্থনীতির গতিপথ তো বরাবর শ্রেণির ভিত্তিতেই এগোতে থেকেছে, যেখানে কর্মসংস্থান, গড় মজুরি, জীবনের মান ও সর্বোপরি প্রযুক্তির উল্লম্ফন নির্ধারণ করে এসেছে আগামীর পথ। ‘অগ্নিপথ’এর আগুন সেই মৌলিক যাপনের প্রশ্নটিকেই আবার সজোরে উত্থাপন করেছে, শ্রমজীবী মানুষের সম্মিলিত প্রতিবাদ-প্রতিরোধকে রাজনীতির সম্মুখ-সমরে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছে।
সেনানিয়োগের প্রয়োজনীয়তা যদি কমেই যায় তাহলে আর আলাদা করে অগ্নিপথের গুরুত্ব কোথায়? ব্যাপারটা আরো একটু বিশ্লেষণ করা দরকার
ReplyDeleteসেই জন্যই তো কম নিয়োগ। মাত্র ২৫ শতাংশ।
Deleteচাহিদা যখন কম, জোগান কমানোর গুরুত্ব বেশী | সেই জোগান কমানোর প্রকল্প হচ্ছে অগ্নিপথ |
Deleteএই সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অর্ধবেকার যুবকদের উপযুক্ত কাজ দেবার মত একটি মাত্র মিলিশিয়া বাহিনী এদেশে আছে।
ReplyDeleteআমার মনে হয় এই সিদ্ধান্ত প্রমান করে দিল আদতে যুদ্ধু টুদ্ধু নেই ছিলোনা। সব প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে আন্ডারস্ট্যান্ডিং। এখন শুধু প্রযুক্তি কিনে ঘুষ খাওয়ার দিন। কৃষকের সন্তানদের পেট মেরে কর্পোরেটের সাৎে নিজেদের পেট ভরাও।
ReplyDelete