Friday, 3 June 2022

কেকে: মেটাল গানের স্বর্ণযুগ!

মৃত্যু কি এত সহজতর?

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

তিনি এলেন। জয় করলেন। তারপর ঢলে পড়লেন চিরনিদ্রার কোলে।

কৃষ্ণকুমার কুন্নাথ। কে কে। গত দু’ দশকে সঙ্গীত জগতে ঝড় তোলা এক নীলকণ্ঠ। যার গায়কীতে জনপ্রিয় সঙ্গীতের ভুবনে এক নতুন ঘরানার জন্ম। যে গানের কন্ঠে অবস্থিত রক, কিন্তু কথা, উচ্চারণ ও সুরে তীব্র আবেগের তরঙ্গ। উর্দু শব্দের মিষ্টতা ও তেজ মিলে যেন এক গভীর দোলা।

কিন্তু তাঁকে কেন এত তাড়াতাড়ি চলে যেতে হল? তাঁর বন্ধুরা বলছেন, তিনি ধূমপায়ী ছিলেন না, মদ্যপানেও তাঁর অনাসক্তি, তেমন দুরন্ত কোনও জীবনও তাঁর ছিল না যেখানে অনিয়ম তাঁর ঘাতক হতে পারে। মধ্যবয়সেও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ও প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর এই মানুষটি প্রায় বিনা বাক্যব্যয়েই আমাদের সকলকে ছেড়ে হঠাৎ চলে গেলেন। শুধুমাত্র এক রাতে বেহিসেবী দর্শককুলের নিছক অতি-আতিশয্যেই কি তিনি বেতাল হয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন? বহু সহশিল্পীরা তো বলছেন, দর্শক-শ্রোতাদের এই উন্মাদনা বরং গায়কদের আরও উজ্জীবিত করে, তাঁরা সব থেকে সেরা পারফরম্যান্সটি এই ধরনের আবহেই দিতে পারেন। ঘামতে ঘামতে, উত্তেজনার শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছতে পৌঁছতে তিনিও নাছোড়বান্দা ছিলেন তাঁর শিল্পীসত্তার আবেগের কাছে। এ এমন এক আরোহণ যেখানে আর হুঁশ থাকে না শরীরের তন্ত্রীগুচ্ছের উন্মাদনাকর ওঠা-নামার। ডিজে বক্সের বাজনার ওই উত্তুঙ্গ আওয়াজ, আলোর তীব্র ছটা ও উষ্ণতা, অনতিদূরেই উত্তেজনায় থরথর শ্রোতাদের কর্ণবিদারক আর্তনাদ ও ঘন ঘন শ্বাস-প্রশ্বাস- সবটা মিলিয়ে যদি এরপর বদ্ধ ঘরে তিন কি চার গুণিতক দর্শক জমে যায়, তাহলে সেই বদ্ধাবস্থা যে মৃত্যুপুরীর সমান তা কে আর কাকে বোঝাবে? সকলেই তো স্বেচ্ছায় হেমলক পান করেছেন!

যদি প্রশ্ন ওঠে, এই উন্মাদনা কেন? তবুও নিস্তার নেই। এ তো নতুন কিছু নয়! বদ্ধ স্টেডিয়ামে আবদ্ধ হয়ে ‘বুল ফাইট’ উপভোগ করা, যেখানে একটি খোলা মাঠে এক মানুষ জীবনের ষোলআনা ঝুঁকি নিয়ে একটি বৃষকে উত্তেজিত করে তাকে কুপিয়ে কুপিয়ে মারবে আর সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে উত্তেজনা ও শিহরণের শিখরে পৌঁছতে থাকবে দর্শকেরা- সে তো স্পেনের জাতীয় উৎসব। শুধু স্পেন কেন, আমাদের দেশেও পোঙ্গাল উৎসবের সময়ে তামিলনাড়ুতে ‘জাল্লিকাট্টু’ও এমন ধরনের একটি ‘ক্রীড়া’। এ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে প্রবল আলোড়ন ওঠে এবং আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও এই ‘খেলা’কে বন্ধ করা যায়নি। এই ‘খেলাগুলি’কে উপভোগ করার সময় সমবেত দর্শকেরা গগনবিদারক চীৎকারে উন্মাদনার চরম স্তরে বিরাজ করে। কথায় বলে, ‘আধুনিক’ মানুষ; তাই আইনানুগ উপায়ে ক্রীড়াচ্ছলে তো মানুষ একে অপরকে ছিন্নভিন্ন করতে পারে না! তাই, অ-মানুষ অথবা জন্তু-জানোয়ারকে তিলে তিলে হনন করেই উত্তেজনার মজা নেওয়ার প্রথা। যদিও ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে গণ প্রহারে ‘চোর’, ‘বিধর্মী’ অথবা ‘ডাইনি’দের হত্যা করার চল এখনও ঘটমান বর্তমান, কিন্তু ‘আধুনিক’ মানুষ বলবে, আইনে তার বিধান নেই। অতএব বলতেই হয়, ‘জানোয়ার হত্যা-ক্রীড়া’ সমূহ থেকে যে উন্মাদনা-প্রসূত আনন্দানুভূতি, তার থেকে অবশ্যই ফুটবল মাঠে কিংবা গানের আসরের উন্মাদনা-প্রসূত আনন্দানুভূতি সার্বিক অর্থে হয়তো অনেক বেশি সহনীয়।

তবুও ৮ ডিসেম্বর ১৯৮০। বিটলস’এর জনপ্রিয়তম গায়ক জন লেনন গুলিবিদ্ধ হলেন তাঁরই এক ভক্তের হাতে: মার্ক ডেভিড চ্যাপম্যান। সকালেই চ্যাপম্যান তার প্রিয় গায়কের অটোগ্রাফ নিয়েছে, সন্ধ্যেয় রাস্তা ধরে সস্ত্রীক হেঁটে আসা লেননকে গুলি করে হত্যা করেছে। কারণ: লেননের বিলাস-প্রাচুর্য চ্যাপমেনের পছন্দ হয়নি। যন্ত্রানুষঙ্গের উচ্চ নিনাদে বিটলস’এর গানে ৬০-এর দশকে গোটা বিশ্ব উত্তাল হয়েছে। গান শুনতে শুনতে তরুণেরা নিজেদের ক্ষতবিক্ষত করেছে, শারীরিক ও মানসিক উত্তেজনার তীব্রতায় রাস্তায় পড়ে গড়াগড়ি দিয়েছে, ঘরবাড়ি ছেড়ে দেশান্তরী হয়েছে। গানের মায়ালোকই হয়ে উঠেছিল বাস্তব ভুবন, যেখানে আশ্রয় নেওয়াটাই ছিল তারুণ্যের বিদ্রোহ। সর্ব অর্থে ভেঙে পড়তে থাকা এক পচাগলা সমাজ, যেখানে চারপাশের ক্ষত, হিংসা, স্বার্থপরতা, দ্বেষ ও হন্তারক উপাদানগুলি দেখে ত্রস্ত ও মুক্তিকামী তারুণ্য তল্লাশ করে এক পবিত্র ও প্রেমময় আলোকভূমির। গানের সেই উদাত্ত কথা, সুর ও গায়কী যেন সে ভূমির হদিশ দেয়।

আমাদের দেশে এর প্রভাব পড়েছে কিছুটা দেরিতে। ৭০ দশকে তখনও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রের নিরাপদ আশ্রয়ে সমাজের মধ্যশ্রেণির কতকটা দিন গুজরান হয়ে যাচ্ছে। ৬০-এর বিদ্রোহের যেটুকু আগুন তা গানের চেয়ে বেশি সঙ্গত পেয়েছিল রাজনৈতিক কথামালা ও কৃষক-শ্রমিক অভ্যুত্থানে। যুবকেরা বরং গান নয়, Gun ধরেছিলেন মুক্তির আকাঙ্ক্ষায়। ৭০’এ গৌতম চট্টোপাধ্যায়রা চেষ্টা করেছিলেন, সে সময়ের গান বেঁধেছিলেন- কিন্তু তা তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। অবস্থাটা পালটে গেল ৯০’এর দশকে এসে। যখন উদারবাদী অর্থনীতির প্রবর্তন হল, আরও এগিয়ে, বিশ্বায়ন ও তথ্যপ্রযুক্তির উদয়ে এক নতুন অর্থনৈতিক যাপন ও শ্রেণির উদ্ভব ঘটল। রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্র ভিত্তিক রাজনৈতিক-অর্থনীতির তখন পিছিয়ে পড়ার পালা। বাংলায় আমরা সুমনকে পেলাম, সেই সঙ্গে আরও এক ঝাঁক গায়ক, তারপর বিবিধ বাংলা ব্যান্ড। গানের কথা, উপস্থাপনা, যন্ত্রানুষঙ্গ ক্রমেই বদলে যেতে থাকল। কর্ম ও ব্যক্তি জীবনে মানুষ আরও বেশি একাকী হল। গান আরও দলবদ্ধ, উচ্চকিত, গগনবিদারী ও উন্মাদনাময় হল।

সারা দেশেই সেই ঢেউ লাগল। বলা ভাল, বড় বড় শহরগুলিতে, যেখানে নগর জীবন দ্রুত বদলাতে থাকল। এই সময়েই ‘ইউফোরিয়া’, ‘পেন্টাগ্রাম’, স্কিনি অ্যালে’ প্রভৃতি নানাবিধ ব্যান্ডের উদয় ও জনপ্রিয়তা। আর স্বভাবতই বদলে যাওয়া এই গানের ভুবনের আঁচ গিয়ে পড়ল বলিউডেও। কেকে ছিলেন এমনই এক রক গায়ক, যার বলিউডে প্রথম অভিষেক ‘মাচিস’ ছবিতে, যেখানে তিনি সহশিল্পীদের সঙ্গে গলা মেলাবেন ‘ছোড় আয়ে হম’ গানটিতে। কিন্তু তিনি আদতে হয়ে উঠেছিলেন এক সন্ধিক্ষণ-পুরুষ- যখন গানের শুদ্ধ তালিম না-নেওয়া এক রক গায়কের গায়কী বলিউড ছবির নানা ধরনের দৃশ্য-নির্মাণের সঙ্গে মিশে এক অনন্য ঘরানা তৈরি করবে। যেমন, ‘হম দিল দে চুকে সনম’ ছবিতে (২০০১) ‘তরপ তরপ সে’ গানটি। ছবির সঙ্গীত পরিচালক ইসমাইল দরবারি মোটেও কল্পনা করেননি যে গানটি তিনি কেকে’কে দিয়ে গাওয়াবেন। যখন গাওয়াতে চাইলেন, কেকে’ও রাজী হননি। কিন্তু সব দ্বন্দ্ব অবসানে কেকে যখন সত্যিই গাইলেন তা এক অন্য স্বাক্ষর বহন করল। রকের মেজাজ এক তীব্র আবেগি সংঘাতে তৈরি করল অবিস্মরণীয় মূর্ছনা। তারপর কেকে’কে আর থামানো যায়নি।

কিন্তু কেকে তো আদতে এক রক শিল্পী। তিনি ওই উচ্চগ্রাম থেকে তো পিছু হঠতে পারেন না। ফলত, এল এক নতুন মিশেল যার অভিঘাতে আমরা পরে অরিজিৎ সিং, দর্শন রাভালকে পাব। আর এই মিশেলেই ‘তু হি মেরি শব হ্যায়’ গেয়ে কেকে প্রায়-ইতিহাস তৈরি করলেন। মেতে উঠল প্রজন্ম তাদের চারপাশের অনুষঙ্গ নিয়ে। মেটাল গানের স্বর্ণযুগ এল- ইলেক্ট্রিক গিটারের উচ্চনাদ, ভারী ড্রামবিট, bass notes এবং আগ্রাসী ও হাল্কা কর্কশ-খনখনে কন্ঠের মিলনে এক স্বপ্নালু গানের ভুবন।

কিন্তু শুধুমাত্র গানের জন্যই মৃত্যু কি এত সহজতর?

চারপাশে ঝকঝকে স্বল্পস্থায়ী ভোগ্যপণ্যের বাসনায় স্বার্থগন্ধী মানুষ যখন উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়চ্ছে, অনিশ্চিত জীবনযাপনের জাঁতাকলে যখন তার ত্রাহি মধুসূদন দশা, তখন সমস্ত কিছু স্তব্ধ করে ব্যক্তিগত ক্ষতগুলি আত্মপ্রকাশিত হতে চায় মেটাল শীৎকারে। এছাড়া যেন সে মানুষের তাৎক্ষণিক কোনও উপায়ন্তর নেই। আর সে গান যিনি পরিবেশন করেন, তিনি ডুবে যান এক অতল মায়াবী সুরলোকে যেখানে তিনি একাত্ম হয়ে ওঠেন যন্ত্রণাময় আকুতিগুলির সঙ্গে, তাঁর প্রতিটি সচল মুহূর্ত তখন তাল-লয়-ছন্দ-কন্ঠের এমন এক অনির্বচনীয় প্রকাশ হয়ে ওঠে যা জীবন-মৃত্যুর আঙিনাকে মিলেমিশে একাকার করে দেয়।

তবে এ কথাও সত্য, বহু শিল্পী নানা ধরনের অনুষ্ঠান করতে গিয়ে মঞ্চে মারা গেছেন। ২০২০ সালে আমেরিকার লোকশিল্পী ডেভিড ওলনি ফ্লোরিডায় একটি অনুষ্ঠানে গাইতে গাইতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। যদিও তাঁর বয়স হয়েছিল ৭১। অনেক নাট্যশিল্পীও এমনতর মৃত্যুবরণ করেছেন। বহু খেলোয়ারও।

তবুও, কেকে নিছকই এই মৃত্যু তালিকায় এক সংযোজন মাত্র নয়; তাঁর মৃত্যু বর্তমানের অসংলগ্ন, অনিশ্চিত ও ভঙ্গুর সমাজের মূর্ত প্রকাশ। যেখানে মৃত্যু অনেক সহজতর, অকাতর। আত্মহননও।

 

12 comments:

  1. দারন, সাবলীল লেখা।
    অনেক প্রশ্ন, বিতর্ক রেখে গেল কে কে।
    অযোগ্য কলকাতার অন্ধ উন্মাদনা।

    ReplyDelete
  2. ভালো লেখা।

    ReplyDelete
  3. এই মৃত্যু মেনে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে।

    ReplyDelete
  4. কে কে মেটাল গাইলেন কবে আবার?🙄

    ReplyDelete
  5. অনিন্দ্য দা, আপনার লেখা পড়ে সমৃদ্ধ হলাম। শেষ প্যারাটা মগজ কে নাড়িয়ে দিলেন।

    ReplyDelete
  6. সত্যিই তো এত কিছু তো ভাবি নি! লেখাটা পড়ে অনেক সমৃদ্ধ হলাম।

    ReplyDelete
  7. অসাধারন অনবদ্য, বিশ্লেষণ । ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  8. সঞ্চিতা মুখার্জি4 June 2022 at 12:33

    বাস্তবতার নিরিখে অনবদ্য প্রকাশ! ভীষণ ভালো তথ্য সমৃদ্ধ লেখা।

    ReplyDelete
  9. অনিন্দ্য র লেখার সব থেকে বড় গুণ ভাষা ও ভাবনার পরিশীলিত মোড়কে পরিবেশন। এখানেও তার অন্যথা ঘটে নি। অন্তঃসারশূন্য সমাজের নির্মম চিত্র। তবুও কেকের যিনি সচিব তার সঠিক সময়ে উপযুক্ত সিদ্ধান্তের অভাবে এই তরতাজা মানুষটির অকাল মৃত্যু।

    ReplyDelete
  10. বেশ ভালো লেখা । 👌🏼👍🏼

    কিন্তু ঘটনাটা হৃদয় বিদারক । 😔

    ReplyDelete
  11. কেকে র মৃত্যুর ঘটনার প্রেক্ষিতে রূপঙ্কর বাগচীর বিতর্কিত মন্তব্য সংবাদ শিরোনাম। প্রজন্মের সাথে প্রজন্মের দূরত্ব দ্রুত হচ্ছে তা আলোচ্য ঘটনা প্রবাহে স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করলাম।

    ReplyDelete