Sunday, 5 June 2022

কাশ্মীরে বাগাড়ম্বরবাজদের অশ্বডিম্ব!

কানে তুলো পিঠে কুলো

প্রবুদ্ধ বাগচী


 

আমরা চাই বা না-চাই, একেকটা বিষয়ের সঙ্গে আমাদের অজান্তেই অন্য একটা অনুষঙ্গ যুক্ত হয়ে যায় যেমন, বাজেট বিষয়টার সঙ্গে আমরা যুক্ত হলেই মনে মনে একটা ধারণা হয়, বাজেট মানেই বৃদ্ধি অর্থাৎ, বাজেট ঘোষণা মানেই বেশ কিছু জিনিসের দাম বাড়বে, তুলনায় কমার পাল্লা নিতান্তই হাতে গোনা একইভাবে কয়েক দশক আগে থেকে যখনই কাশ্মীরের কথা আলোচনায় আসে, তাতে যে অনুষঙ্গ মনের মধ্যে ছায়া ফেলে যায় তা হল চোখ জুড়নো প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়িয়ে আসা রক্তের দাগ সেই রক্ত কখনও সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত কাশ্মীরের নিরীহ নাগরিক বা শস্ত্রধারী নিরাপত্তা বাহিনীর সেনানীদের, কখনও বা ওইসব নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিরপরাধ কাশ্মীরিদের নির্যাতনের কে বেশি দায়ী তা নিয়ে চুলচেরা বিচার চলে, কিন্তু কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের তাতে কোনও সুরাহা হয় না একের পর এক ব্যর্থ শান্তি চুক্তির খসখসে কাগজের নিচে মুখ থুবড়ে পড়ে কাশ্মীর আর তার নাগরিকরা

একটা সময় পঞ্জাবে যে কথা বলা হত, সেখানকার বাসিন্দারা আসলে ছিলেন দুই বন্দুকের মাঝখানে- একদিকে খালিস্তানি জঙ্গিদের অস্ত্র অন্যদিকে ভারতীয় সেনার অস্ত্র ছত্তিসগড়েও একটা সময় এরকম অবস্থা তৈরি হয়েছিল আপাতত সেগুলো অতীত কিন্তু কাশ্মীরের অবস্থা বহু বছর ধরে একইরকম ইসলামি মৌলবাদের গর্ভজাত জিহাদিরা নির্বিচারে কাশ্মীরের মানুষকে হত্যা করে এসেছে একদিকে, অন্যদিকে কাশ্মীরের সব নাগরিককেই জিহাদি বিবেচনা করে ভারতীয় সেনাবাহিনী শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে যা খুশি তাই করে এসেছে তাদের সরকারি অস্ত্রের গোলাবারুদ দিয়ে সারা দেশের মধ্যে একমাত্র কাশ্মীরেই তৈরি হয়েছিল ‘নিখোঁজ’ পুরুষ নাগরিকদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে একটি সংগঠন যারা প্রশাসনের দরজায় দরজায় ঘুরেছে তাদের পরিবারের ‘নিখোঁজ’ সদস্যদের সন্ধানে- কোথাও সুরাহা হয়নি মানবিকতার এমন নির্মম প্রহসন আমরা খুব কমই দেখেছি।

কিন্তু আজ যে নতুন করে এইসব পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটতে হচ্ছে তার এক এবং একমাত্র কারণ, গত মাসখানেকের মধ্যে কাশ্মীরের নিরীহ নাগরিকরা আবার এক নতুন সন্ত্রাস-অধ্যায়ের মুখোমুখি প্রায় নিত্যদিন সন্ত্রাসবাদী জঙ্গিরা আঘাত করছে কাশ্মীরে আর তাদের নরম টার্গেট নিরীহ নাগরিকরা গত কয়েক দিনে অন্তত ১২জন সাধারণ কাশ্মীরবাসী তাদের হাতে নিহত ব্যাঙ্কের ম্যানেজার থেকে স্কুল শিক্ষিকা- সকলেই রয়েছে এই তালিকায় এইসব সাধারণ জীবিকার মানুষের সঙ্গে ইসলামি জঙ্গিদের বিরোধ কোথায়? নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে তাদের কোন উদ্দেশ্য পূরণ হবে বোঝা যায় না যেন নরহত্যা এদের কাছে এক ধরনের খেলা! বেশ বোঝা যায়, এবারেও হিসেব করে মেপেজুপেই সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলি সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে কিন্তু তারা এমন অকুতোভয় হল কীভাবে? এখন তো কাশ্মীর সরাসরি কেন্দ্রের শাসনে, কোনও ‘কুচক্রী’  নির্বাচিত সরকার তো এই মুহূর্তে সেখানে নেই যে কেন্দ্রকে ব্যতিব্যস্ত করার জন্য তারা তলায় তলায় সন্ত্রাসকে মদত দেবে! তাহলে?

এইসব প্রশ্নের জবাব পেতে গেলে আমাদের আরও একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে ‘সুবিবেচক’ প্রধানমন্ত্রী যখন নোটবন্দির কথা আচমকা ঘোষণা করে বলেছিলেন, দেশের ভালোর জন্যই নাকি এই সিদ্ধান্ত, তাঁর অন্যতম প্রধান যুক্তি ছিল, এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদী জঙ্গিদের শায়েস্তা করা যাবে- আচমকা টাকার জোগান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অস্ত্র কেনাবেচার পথ বেবাক বন্ধ হয়ে গেলে দেশ জুড়ে শুধু শান্তি আর শান্তি সত্যি কথা বলতে কি, অনেক মানুষ তাঁর এই আপ্তবাক্যে ভরসা রেখেছিলেন কারণ, দেশের সাধারণ মানুষ- কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা- আদপে শান্তিপ্রিয়, নিজেদের নিত্যদিনের জীবনযাপনে গুলি বারুদ হত্যার সশব্দ দাপাদাপি তাদের বিড়ম্বিত করে, বিধ্বস্ত করে সেই মানুষগুলি ভেবেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর এই ছকভাঙা পদক্ষেপ যদি তাঁদের জীবনে শান্তি আর নিরাপত্তার বাতাস বয়ে আনে, সে তো খুব সুখের সময়- একেই কি বলে ‘আচ্ছে দিন’! কিন্তু এই বুক-বাজানো ঐতিহাসিক ঘোষণার অল্প পরেই দেখা গেল, যা প্রচার করা হয়েছিল আসলে তার সঙ্গে বাস্তবের যোগ নেহাতই ক্ষীণ জাল নোট যেমন আশানুরূপ ঘরে ফিরল না, ঠিক তেমনই জঙ্গিদের কোমরের জোর এতে এমন কিছু কমল না অন্তত যা নিয়ে মানুষ আশ্বস্ত হতে পারেন নভেম্বর ২০১৭ থেকে আজ অবধি দেশে কি সন্ত্রাসের বাড়বাড়ন্ত কমেছে? অন্তত আজকের কাশ্মীর তো এই জ্বলন্ত প্রশ্নটা সামনে আনছেই

এর পরে ভেবে দেখতে হবে, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপের প্রসঙ্গটাও দেশবাসীকে চমকে দিয়ে ২০১৯-এ সরকারে ফিরে যা অত্যন্ত তড়িঘড়ির সঙ্গে রূপায়ন করে দেওয়া হল– দেশের সংবিধানের সামান্য একটি আইনি ছিদ্র খুজে বের করে লাগু হয়ে গেল আইন নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি হোক বা নাই হোক, আসলে তো বলা হয়েছিল এতে কাশ্মীরের উন্নয়ন হবে, রাজ্যে শান্তি ফিরবে যদিও এই বিলোপের মাধ্যমে কাশ্মীর রাজ্যটাকে দুটুকরো করে দেওয়া হল, নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে শাসন চালানোর বদলে কাশ্মীরকে নিয়ে আসা হল কেন্দ্রীয় শাসনে একতরফা এই সিদ্ধান্তে কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের মতামতের তোয়াক্কা করা হল না যাতে তারা প্রতিবাদী হয়ে উঠতে না পারেন সেইজন্য কণ্ঠরোধ করা হল মিডিয়ার, ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে রাখা হল সবই নাকি শান্তির জন্য! বলা হয়েছিল, এই ব্যবস্থা চালু হওয়া মাত্র কাশ্মীরে প্রচুর শিল্প বিনিয়োগ হবে, মানুষের কাজ তৈরি হবে আর সেই সঙ্গে কাশ্মীরি সুন্দরীদের অনায়াসে বিবাহ বন্ধনে বেঁধে নেওয়ার নাকি ঢালাও সুযোগ মিলবে বাকি দেশবাসীর কিন্তু গত তিন বছরে কাশ্মীর যে তিমিরে সেই তিমিরেই রইল। বিনিয়োগের বান সেখানে ডাকেনি, মানুষের কাজের সুযোগ বাড়েনি দারিদ্র, কর্মহীনতার সঙ্গে শিক্ষা-স্বাস্থ্যের বুনিয়াদি ব্যবস্থা এখনও কাশ্মীরে অধরা এর সবগুলিই সন্ত্রাসবাদের চাষবাসের সঙ্গে সরাসরি জড়িত আর ঘটছেও তাই হাতে তালি দিয়ে বা থালা বাজিয়ে যেমন কোভিডের যুদ্ধ জয় করা যায়নি, ঠিক তেমনই ৩৭০ ধারার বিলোপ করে কাশ্মীরকে সন্ত্রাসমুক্ত সজীব উপত্যকায় রূপ দেওয়া গেল না এমনকি তিন বছরের মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থাও করে ওঠা গেল না- পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের দেশে এত বড় একটা রাজ্য আজও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বাইরে! কেন্দ্রের ‘প্রচারসর্বস্ব’ সরকার যখন আজ তাদের অষ্টম বার্ষিকী ঘটা করে পালনের আয়োজন করছে, যখন দেশ জুড়ে স্বাধীনতার ‘অমৃত মহোৎসব’ পালন নিয়ে সাজো সাজো রব- তখন এই অসহায় মৃত্যু আর হত্যার দায় তারা নেবে না?

কিন্তু ‘কানে তুলো পিঠে কুলো’ বলে একটা বাংলা প্রবাদ আছে সেই প্রবাদের জ্যান্ত উদাহরণ আজকের দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকার এইসব কূট প্রশ্ন এড়িয়ে তারা বরং মন দিয়েছে চলচ্চিত্র প্রযোজনায় পছন্দের চিত্র পরিচালককে বরাত দিয়ে এরই মধ্যে বানানো হল ‘কাশ্মীর ফাইলস’- কাশ্মীরে হিন্দু পণ্ডিতদের প্রতি কীরকম নৃশংস অত্যাচার হয়েছে, সত্যি-মিথ্যে মিশিয়ে তার এক রসঘন চিত্র পরিবেশিত হল সেই মোড়কে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দলবল সচরাচর ফিল্ম দেখেন কি না তার কোনও খবরাখবর এত বছরে আমরা পাইনি, কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাঁরা দরাজ সার্টিফিকেট দিলেন ফিল্মটিকে, বেশি বেশি মানুষকে দেখানোর জন্য তাদের ‘ইয়েস ম্যান’ রাজ্য সরকারগুলি ফিল্মের ওপর প্রমোদকর মকুব করে দিল শোনা যায়, ফিল্ম ভাষ্যের দিক থেকে এই ফিল্ম নাকি তেমন সরেস কিছু নয়, তবে কোনও বিশেষ সম্প্রদায়কে নিশানা করার জন্য অব্যর্থ- কার্যত সেই লক্ষ্যেই ছবিটি নির্মিত আর তাছাড়া ভাল হোক কি মন্দ, ছবি বানিয়ে তো আর একটা উপদ্রুত রাজ্যের জনজীবন স্বাভাবিক করে দেওয়া যায় না, তার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা লাগে ছবি উচ্চমানের হল বা নিচুমানের, সত্যি কি তাতে কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের কিছু যায় আসে? তাঁরা আদপে চান শান্তি, রোজগারের নিশ্চয়তা, পরিবারের ছেলেমেয়েদের চাকরি, নিরুপদ্রবে ব্যবসা-বাণিজ্য করার আবহ আর তার জন্য একটা পোক্ত গণতান্ত্রিক কাঠামো লাগে, যোগ্য প্রশাসন লাগে ব্যাপার হল, যে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের নিয়ে এতদিন কেন্দ্রীয় সরকারি দলটি রাজনৈতিক কুম্ভীরাশ্রু ফেলে এসেছে, আজ সেই পণ্ডিতেরা এই পরিস্থিতিতে ক্ষুব্ধ ও বিপর্যস্ত কিন্তু কেন্দ্রের সরকার কেন যেন এই প্রতীতিতে এসে পৌঁছেছে- সন্ত্রাসবাদকে তারা সেনানীদের বুটের ডগায় অথবা বন্দুকের নলের সামনেই স্তব্ধ করবে বহু বছর ধরে এই একই পরীক্ষা তারা করে চলেছে আসলে যা মরুভূমিতে ধান চাষের মতোই অলীক ক্রমশ কাশ্মীর কেন্দ্রীয় সরকারের এলোমেলো ভাবনার গবেষণাগার হয়ে উঠছে আর এই নাগপাশে নিষ্পেষিত হচ্ছেন নিরীহ কাশ্মীরি নাগরিকরা বাকসর্বস্ব সরকারের অপদার্থতা যত বাড়ছে ততই তাঁদের প্রাণের মূল্য ক্রমশ কমে যাচ্ছে

সেনা দিয়ে যদি সব অন্ধকারকে আলো করা যেত, তাহলে আর গণতন্ত্রের কী প্রয়োজন? হিংসা আর প্রতিহিংসার মাঝখানে দমবন্ধ, স্থবির কাশ্মীরের বিপন্ন আমজনতা আজ নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে যেন এই প্রশ্নই করতে চাইছেন তাঁদের নিয়ামক সরকার বাহাদুরকে উত্তর আসবে বলে ভরসা হয় না

 

No comments:

Post a Comment