Monday, 13 June 2022

চাই সবল ইউ-টার্ন

আন্দোলনের মাঠ হ্যাঁচকা টানে বদলাতে হবে

সুখেন্দু সরকার



ভারতবর্ষ  কোন দিকে মোড় নিচ্ছে? প্রহর গণনা শেষ। শেষ অবধি আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য মাফিয়া শক্তিতে গুড়িয়ে দেওয়া হল আফরিন ফাতিমা'র বাড়ি। উদাসীনতার শামুক-খোলের ভিতর ঢুকে যাব? নাকি তিল তিল করে না মরে মরীয়া সংগ্রামে নামব? পুতুল-নাচের পুতুলই রয়ে যাব? নাকি সমস্ত অক্ষমের অজুহাত ছুঁড়ে ফেলে বুকের সব হিম্মত জড়ো করে সাহসের সাথে ঘুরে দাঁড়াব? 

কিন্তু কোথাও আমরা বারবার আটকে যাচ্ছি পরিস্থিতির মূল্যায়নে অস্বচ্ছতার কারণে। আমরা গল্পের  হবু রাজার ঢোলকের আওয়াজে একবার হাট বসাচ্ছি, পর মুহূর্তে পরবর্তী ঢোলবাদ্যের আওয়াজে হাট ভেঙ্গে দিচ্ছি। ক্লান্ত হয়ে পড়ছি ঘাতকদের মাঠে খেলতে খেলতে। এটাই ওদের কৌশল এবং এই কৌশলকে ব্যর্থ করার প্রতি-কৌশল আমাদের হাতে ইতিহাস তুলে দিতে চাইলেও আমরা, বলা ভাল, বিভ্রান্ত, আমরা তা ব্যবহার করতে চাইছি না। 'সাময়িকতা' আমাদের দৃষ্টি-সীমাকে খণ্ডিত করে ফেলেছে। 

স্পষ্ট করে বলা যাক: শ্রেণি সংগ্রামই হল প্রধান যোগসূত্র; এই ইতিহাস-সিদ্ধ উপলব্ধি মোটেই তামাদি হয়ে যায়নি। মেরুকরণের রাজনীতির কার্যকরী মোকাবিলার জন্য আমাদের শ্রেণি সংগ্রামের ঝোড়ো হাওয়াকেই আহ্বান করতে হবে। শাসকরা যখন বুনিয়াদি জনগণের ঐক্য ভেঙ্গে তছনছ করে ফেলার উপক্রম করেছে, তখন মাটি কামড়ে পড়ে থেকে শ্রেণি সংগ্রাম বিকশিত করার পথেই শ্রমজীবী-নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত জনগণের শ্রেণি-ঐক্য মেরামত করার কাজ হাতে নিতে হবে। কোনও মতাদর্শগত পক্ষপাত থেকে এই উচ্চারণ নয়। মার্কস বলেছিলেন: 'শ্রেণি সংগ্রাম মানুষের ইচ্ছা-নিরপেক্ষ সত্য।' বাস্তবেও একজন পূর্ণাঙ্গ বস্তুবাদী দেখেন, 'আগুন' সত্যি হলে যেমন তার 'দহন' সত্যি, 'শ্রেণি-বিভাজন' সত্যি হলে তার যৌক্তিক পরিণতি 'শ্রেণি সংগ্রাম'ও সত্যি। মার্কসবাদ শুধু মার্কসবাদীদের একচেটিয়া নয়, মার্কসবাদ শেষ বিচারে সমগ্র শোষিত জনগণের সম্পদ। 

'ধান ভানতে শিবের গীত' মনে হচ্ছে? একটু তবে আজকের ভারতবর্ষের দিকে তাকাই? এ দেশের ১৪.২ শতাংশ মুসলমান জনগণ ১৯৪৭ সালে তাঁদের সামনে বিকল্প থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তান ছেড়ে ভারতকে বেছে নিয়েছিলেন। আস্থা রেখেছিলেন এ দেশের সমন্বয়ধর্মী যাপনের উপর। কোনও শাসকের বাগাড়ম্বর-পূর্ণ প্রতিশ্রুতির উপর নয়। সংবিধানের শব্দ-চাতুরী নয়, তার ধারা-উপধারা-পাদটিকার উপর নয়, ভরসা ছিল বৃহত্তম সহ-নাগরিকদের উপর। তাই তাঁদের 'মুসলমান' থেকে 'ভারতবাসী' হতে কোনও কষ্ট হয়নি। তাঁরা ভারতবর্ষকে দেখেছেন এক মিশ্র সংস্কৃতি ও যাপনের দেশ হিসেবে। তার মানে এই নয় যে, দেশ সাম্প্রদায়িকতা-জাতপাত-লিঙ্গ বৈষম্য'র পাপ থেকে চিরতরে মুক্ত থেকেছে। রাষ্ট্র বারবার এই জঘন্য তাসগুলি খেলেছে বুনিয়াদি জনগণের ঐক্য ও সংহতি ভাঙ্গার কাজে। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার বিকেন্দ্রিকরণ করে তাকে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বুনে দেওয়ার যে পরিকল্পনা অতি-দক্ষিণপন্থী  আরএসএস-সংঘ পরিবার-বি জে পি ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গা থেকে নিতে শুরু করে, তার সমান্তরাল কিন্তু ১৯৪৭-উত্তর ভারতবর্ষে ছিল না। এটি ছিল পর্দার আড়ালের আসল শাসক সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিপতি-সামন্ত শাসকদের হাতিয়ার। হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদ এই শাসকদেরই পাইপলাইন প্রজেক্ট। পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের জমিতে হিন্দুত্ববাদী সার মিশিয়েই তৈরি আজকের ভারতবর্ষ। এই ব্যবস্থায় পার্লামেন্টারি নির্বাচনে জনগণ গৌণ নির্বাচক- আসল নির্বাচক সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিপতি-সামন্তবাদী শাসক শ্রেণিগুলি। পালাবদল হল সাময়িক প্রভাবিত জনগণের এবং এই শাসকদের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের এক বিস্বাদ মেলবন্ধন। আমরা যদি ২০১৪ সাল থেকে আজ পর্যন্ত আট বছর মোদি-জমানার চলন ঠিকঠাক লক্ষ করি, তাহলে দেখব যে ওরা টেবিল টেনিস খেলার মতো করে একবার হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা এবং পরের বার পুঁজিবাদী এজেন্ডা, এভাবেই এগোচ্ছে। ওদের কার্যক্রমে কোনওরকম অসংলগ্নতা নেই। একটা তালিকা দিই? 

২০১৪: গো-মাংস-ভক্ষণকারীদের উপর ধারাবাহিক হামলাবাজি যা চলল ২০১৭'র মাঝ পর্যন্ত। এটি একটি হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা। 

২০১৬: ৮ নভেম্বর নোটবন্দি। একটি কর্পোরেট এজেন্ডা। 

২০১৭: ১ জুলাই জি এস টি। 'এক দেশ এক বাজার'-মার্কা কর্পোরেট এজেন্ডা। 

২০১৯: ২৫ জুলাই-৩০ জুলাই লোকসভা ও রাজ্যসভায় তিন তালাক বিল পাশ। স্পষ্টতই একটি হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা। ৫ আগস্ট কাশ্মীরে ৩৭০ এবং ৩৫এ ধারা বিলোপ। হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা। ১২ ডিসেম্বর সিএএ ২০১৯ বিলে রাষ্ট্রপতির সই। হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা। 

২০২০: ১৪ ফেব্রুয়ারি আমেদাবাদ-মাঙ্গালুরু-লক্ষ্ণৌ- তিন বিমানবন্দর আদানির হাতে তুলে দেওয়ার জন্য AAI'এর সঙ্গে চুক্তি, যা একটি কর্পোরেট এজেন্ডা। ২৩-২৯ ফেব্রুয়ারি দিল্লি গণহত্যা। অবশ্যই হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা। ১৭ এপ্রিল বিদ্যুৎ সংশোধনী বিল ২০২০ পাশ। একটি কর্পোরেট এজেন্ডা। ১৭ মে খনি বেসরকারিকরণ। একটি কর্পোরেট এজেন্ডা। ১ জুলাই ১০৯টি রুটে ১৫১টি ট্রেনের বেসরকারিকরণ। এটিও একটি কর্পোরেট এজেন্ডা। ৫ আগস্ট রামজন্মভূমির ভূমি-পূজা। হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা। ২৩ সেপ্টেম্বর তিনটি শ্রমকোড পাশ। কট্টর কর্পোরেট এজেন্ডা। ২৭ সেপ্টেম্বর তিন কৃষি বিলে রাষ্ট্রপতির সই। এটিও কর্পোরেট এজেন্ডা। ৩০ সেপ্টেম্বর সিবিআই বিশেষ আদালতে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার মূল চক্রীদের রেহাই। একটি ঘৃণ্য হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা। নভেম্বর জুড়ে ভিন্ন ধর্মে বিয়ে বন্ধ করার লক্ষ্যে একের পর এক বিজেপি-রাজ্যে বিল পাশ। হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা।

২০২১: মার্চে বীমা-সংশোধনী বিল ২০২১ পাশ। কর্পোরেট এজেন্ডা। ৯ আগস্ট The Deposit Insurance and Credit Guarantee Corporation Amendment Bill 2021 পাশ, যার বলে ব্যাঙ্ক ফেল করলে কোনও আমানতকারীর ৫ লক্ষ টাকার বেশি অর্থ থাকলে সেই বাড়তি টাকা জলে যাবে। এটি একটি কর্পোরেট এজেন্ডা। 

২০২২: অপরাধী শনাক্তকরণ আইন পাশ, যা ব্রিটিশ আমলের অপরাধী উপজাতি আইনেরই প্রসারিত রূপ। একটি হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা। 

লক্ষ করুন: ২০১৪ থেকে ২০২২ পর্যন্ত মোট ১৯টি প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে ১০টি কর্পোরেট কর্মসূচি এবং ৯টি হিন্দুত্ববাদী কর্মসূচি। ওরা চাইছে আমরা লাগাতার হিন্দু-মুসলমান নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করতে থাকি এবং এই সুযোগে আমেরিকা-রাশিয়া-চীনা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি-আদানি-আম্বানি-বড় জোতদার মিলে দেশটা দখল করে নিক। বস্তুত মন্দির-মসজিদের লড়াই যত বেশি বেশি করে শ্রমিক-কৃষক-শ্রমজীবী মানুষের ঐক্যের ভিত ভাঙ্গবে ততই সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদ-সামন্তবাদ-বিরোধী সংগ্রাম দুর্বল হবে। 

এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, বিগত আট বছরে সংখ্যালঘু মুসলমান জনগণকে ওরা লাগাতার মারতে মারতে খাদের কিনারায় নিয়ে এসেছে। এত মার খাওয়ার পরেও তাঁরা যথেষ্ট ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে চলেছেন, এ কথাও সত্যি। কিন্তু অবরুদ্ধ ক্ষোভ মাঝে মাঝে আন্দোলনের ব্যাকরণ না মেনে ফেটে পড়তে চাইবে, এ কথাও সমান সত্যি (সাম্প্রতিক হাওড়ার ঘটনা-প্রসঙ্গ)। শুধু 'প্ররোচনা' দিয়ে এই ভাঙচুর-অবরোধ-অগ্নিসংযোগকে ব্যাখ্যা করা মোটেই ঠিক হবে না। তা কার্যত হয়ে দাঁড়াবে এক ধরনের 'ভিকটিম-শেমিং'! মনে রাখতে হবে, প্ররোচনা দিয়ে যদি জনগণকে বিশৃঙ্খল দিশাহীন জঙ্গিপনার দিকে ঠেলে দেওয়া যায়, তার গভীরতর কারণ হল এই যে, 'পাথরে তা দিলে বাচ্চা হয় না, ডিমে তা দিলেই হয়।' আজ যদি সংখ্যালঘু জনগণ দেশব্যাপী শান্তিপূর্ণ জমায়েত-আন্দোলন শুরু করেন- কাঁটায় কাঁটায় গণতান্ত্রিক পদ্ধতি-প্রকরণ মেনে পথে নামেন এবং এমন কি হিন্দু জনগণের সচেতন অতি-সংখ্যালঘু অংশটিকে এই লড়াইয়ে পাশে পান, তাতেও কি পরিস্থিতির বড় কোনও পরিবর্তন হবে? এর উত্তরে স্পষ্টই বলা যাক: না। হবে না। সমাজটাকে ইতিমধ্যে এতটাই মেরু-বিভক্ত করে ফেলা হয়েছে যে, সংখ্যালঘু জনগণের শতকরা একশো ভাগ ন্যায়সঙ্গত এই সংগ্রামকেও ওরা কাজে লাগাবে হিন্দু জনগণের মনে কাল্পনিক ভয়ের চাষ করার জন্য।

পথ এখন একটাই: এক সবল ইউ-টার্ন। আন্দোলনের মাঠ-ধরণ-প্রকরণ-সনদ সবগুলোকেই হ্যাঁচকা টানে বদলাতে হবে। চার  চারটে মূল ইস্যু আমাদের সামনে পড়ে পড়ে মরচে ধরছে: ১) মূল্যবৃদ্ধি ২) বেকারি ৩) বেসরকারিকরণ ৪) আয়-ছাঁটাই। এই চারটি ইস্যুতে আমাদের সমস্ত উদ্যোগ কেন্দ্রীভূত করতে হবে প্রধানত শ্রমিক-কৃষক-অন্যান্য শ্রমজীবী জনগণ এবং নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত জনতার গভীরে। গোটা দেশকে এই ইস্যুগুলিতে পথে নামার ডাক দিতে হবে। দেখলেন না, OIC-ভুক্ত ৫৭টা দেশ ভারতীয় পণ্য বয়কটের হুমকি দিতেই কেমন মোদি-কোম্পানি বেমালুম থুতু চেটে রাস্তা সাফ করে দিল? এই আন্দোলনই জনগণের মধ্যে সংগ্রামী শ্রেণি-ঐক্য গড়ে তুলে মেরুকরণের রাজনীতিকে মাটিতে পেড়ে ফেলবে। কোন পথে লড়লে ওদের বুকে কাঁপন ধরানো যায় তার দু-দুটো জ্যান্ত ক্লু কি আমরা পাইনি? 

ক্লু ১: সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলন। 

ক্লু ২: নূপুর শর্মা কেস। 

একটা দেশব্যাপী বড় গণ আন্দোলনের ঝড় তুলতে হবে আমাদের। তৈরি করতে হবে জনগণের বিকল্প দাবি সনদ। নাগরিক আন্দোলন-অধিকার আন্দোলনকেও জুড়তে হবে এর সাথে। সোজা কথায় ওদের মাঠে খেলতে সাহস ভরে অস্বীকার করতে হবে। লড়াইটাকে নিজেদের মাঠে নিয়ে আসতে হবে। মাঠটাকে বড়ও করতে হবে। অর্থনৈতিক ইস্যুতে দেশব্যাপী গণসংগ্রামের ঝড় ব্যবস্থা-বদলের লড়াইকে ধাক্কা মেরে সামনের দিকে এগিয়ে দেবে। এই পরিপূরকতার বড় স্বপ্নই হোক আজ-কাল-আগামীর  দিবালোকের বাস্তব।


1 comment:

  1. ভালো লাগলো। সময়োচিত লেখা। অভিনন্দন।

    ReplyDelete