Wednesday 9 February 2022

বাঙালিত্বের কথা

কর্তব্যনিষ্ঠার সঙ্গে যুক্তিশীলতা গড়ে তোলা যাবে কী?

অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়


বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে খুঁটি করে সম্প্রতি বড়বাজারের মাড়ওয়ারি ও বিহারীদের (ব্যবহৃত শব্দদ্বয় হল ‘মেড়ো’ ও ‘গুটকাখোর’) বিরুদ্ধে এক অংশের বাঙালি উচ্চকিত হয়ে নাকি স্বজাতির কাজের ও জীবনযাপনের অধিকারগুলিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে।  অন্তত এমনই একটা ভাবের প্রচার ফেসবুক-টেসবুকে অহরহ দেখা যাচ্ছে। প্রথমেই বলে রাখা ভালো যে, বন্ধনাবদ্ধ শব্দ দুটির চৌহদ্দিই স্পষ্ট করে দেয় আসলে কাদের বিরুদ্ধে এই সোচ্চার অবস্থান। কেননা, দক্ষিণাবর্তের কিংবা পশ্চিমাপথের ভারতীয়দের ক্ষেত্রে এইরকম নামের (বিদ্বেষ নয়, ‘পাঁইয়্যা’ কিংবা ‘গুজ্জু’ সম্বোধনে যে ব্যঙ্গ প্রচ্ছন্ন তা অন্য আলোচনার বিষয়) প্রচলন ও প্রয়োগ সচরাচর কর্ণগোচর হয় না; কেন হয় না, তা বলাই বাহুল্য।

সুতরাং, কারা উদ্দিষ্ট তা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পরে যে-প্রশ্নটা সবচেয়ে জরুরি হয়ে ওঠে তা হল, কাদের উদ্দেশ্যে? তথাকথিত আর্থ-সামাজিক অবস্থানকে বিচার করলে বাঙালি (হিন্দু-মুসলমান উভয়ই) মূলত তিনটি স্তরে বিন্যস্ত– ধনী, মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র। ধনী শ্রেণির বাঙালি, যাদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন শুধুমাত্র বাংলা ভাষা ও বাংলার ভৌগোলিক অঞ্চলের ওপরে নির্ভরশীল নয়, তাদের স্বজাতিপ্রীতি-টীতি নিয়ে ভাবার সবিশেষ সময় নেই। বাকিরা নিজেদের রোজগারের বিষয়টিকে টিকিয়ে রাখার জন্যই মাঝে-সাঝে এ-ব্যাপারে মাথা ঘামাতে কার্যত বাধ্য হন। দরিদ্র শ্রেণির বাঙালি, যাদেরকে সাধারণত 'অধিকাংশ বাঙালি' শব্দবন্ধের মধ্যে ধরাই হয় না, অর্থাৎ, চাষি-মজুর-জেলে-তাঁতি-মিস্ত্রি-কারিগর-কুমোর-সব্জি বিক্রেতা-রিক্সাচালক প্রমুখ শ্রেণির মানুষজনের দাবিদাওয়া খুব সামান্যই। তাঁরা শুধুমাত্র দু-বেলা পেট ভরে ভাত, মাথার ওপরে ছাদ আর সন্তানদের শিক্ষা ও বৃদ্ধ বাপ-মায়ের চিকিৎসা কোনওরকমে জুটিয়ে ফেলতে পারলেই যথেষ্ট বলে ঠাউরান। দরিদ্র স্তরে বেঁচে থাকার প্রাথমিক শর্তই হল সহাবস্থান ও সহযোগিতা। শহুরে বস্তি কিংবা গ্রামেগঞ্জে গেলেই পরিষ্কার বোঝা যায় যে একে অপরের ওপরে কীভাবে নির্ভর করে দিন-গুজরান করে থাকেন এঁরা। এখানেও জাত্যাভিমান বা জাতি-গৌরবের মতো চিন্তাগুলি কলকে পায় না। 

বাকি থাকল মধ্যবিত্ত শ্রেণির বাঙালি। এ দেশের এই শ্রেণির বাঙালিই দেশভাগের পরে বাঙালদের ওপরে হেব্বি চটেছিল কেননা অভিযোগ ছিল, এরাই সব চাকরি-বাকরি কাজ-বাজ খেয়ে ফেলছে। সম্প্রতি আবার এরাই (এইবারে ঘটি-বাঙাল উভয়েই) হিন্দুস্তানিদের ওপরে খচেছে সম্ভবত একই কারণে।

সময় ও অর্থনীতির মানদণ্ড যে ক্রমশ বদলে যাচ্ছে, তা মেনে নেওয়া মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বাঙালির পক্ষে একটু কঠিন হয়ে দেখা দিয়েছে। কেননা, এতদিন এরা দশটা-পাঁচটার চাকরি ও কয়েকটা লাইফ ইন্স্যুরেন্স করে ধনী শ্রেণিতে ওঠার বাসনা বুকে নিয়ে ঘুরত আর ছেলেমেয়েদের ভালো স্কুলে পড়িয়ে হয় তাদের এখানেই (পার্টি-টার্টি ধরে) চাকরি জুটিয়ে দিত, নয়তো বিদেশে পাঠিয়ে পাড়াপড়শির সামনে বুক ঠুকে বেড়াত। শেষে বৃদ্ধ বয়সে বলত, বৌমা বদ আর ছেলে দেখে না। কিন্তু এখন তারা ক্রমশ দেখছে যে, দশটা-পাঁচটার চাকরি বলে আর কিছু নেই (পার্টি ধরলেও নেই), লাইফ-ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি আজ বাদে কাল টিকবে কিনা নিশ্চয়তা নেই, তাদের সময়ের ভালো স্কুলের বদলে এখন যে-সব স্কুল চালু হয়েছে সেখানে পড়ানোর খরচ আকাশছোঁয়া, যদিও বা কোনওরকমে সেখান থেকেও সন্তানদের পড়ানো হয় তারপরেও তারা আদৌ কাজ-বাজ পাবে কিনা ঠিক নেই, পেলেও কদিন টিকবে জানা নেই– এমতাবস্থায় এতকাল যে নিরাপত্তার জীবনে মোটামুটি মধ্যবিত্ত বাঙালি নিশ্চিন্ত ছিল সেই স্থান আজ আর থাকছে না। অর্থাৎ, চিরাচরিত অর্থনীতির বদলে সময় এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্ভর গিগ-অর্থনীতিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে একমাত্র ভরসা- হয় পুঁজির জোর নয় গায়ে-গতরে খাটুনির জোর। আর এই দুইই আছে তথাকথিত বিদ্রূপবাণে জর্জরিত বড়বাজারি ‘মেড়ো’ আর বিহারের ‘গুটখাখোর’দের। ফলে, তারাই মোটামুটি কর্মক্ষেত্রের জায়গাগুলি দখল করছে। বাঙালি এখানে তার মধ্যবিত্ততাসুলভ আত্মসম্মানের জন্য হয় কাজ পাচ্ছে না, আর পেলেও থেকে যেতে হচ্ছে এদেরই কর্মচারী হয়ে। এইখানেই জমা হচ্ছে ঈর্ষা ও হতাশাজনিত যত উষ্মা যা প্রকাশ পাচ্ছে অন্য অজুহাতে। তার রূপ কিছুটা রণংদেহী। অর্থাৎ, ব্যাপারখানা এইরকম যে, ‘মুষ্ঠি থাকতে মুখে কেন’ অথবা ‘ভাতে না পারি হাতে মারব’ গোছের। এর সঙ্গে অনেকে মহারাষ্ট্রের শিবসেনার উত্থানকে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করছেন, কিন্তু আমার মতে সেটা সঠিক নয়। কেননা জাতিসত্তার চেতনার ওপরে রাজনৈতিক প্রেক্ষিতকে আরোপ করার প্রয়াস এখনও এখানে অমিল, অন্তত বহিরঙ্গে।

তাই বলে, হিন্দি ভাষা ও হিন্দিভাষীদের অন্যায় আগ্রাসন নেই– এ কথা কি বলা যায়? কিছুতেই বলা যায় না। তা আছে এবং চরম ভাবেই আছে। এ কথা তো সত্য যে, যে কোনও জাতিই তাদের মাতৃভূমির পরিবেশ বিদেশ-বিভুঁয়ে গিয়ে সৃষ্টি করতে চায়। ইংরেজরাও এক কালে কলকাতাকে কেন্দ্র করে তাইই করেছিল, বাঙালিও আমেরিকায় গিয়ে একই কাজ করেছে, এখানে উত্তরাপথের মানুষজনও সেই কাজই করছে। ফলে, সেকালেও যেমন ইংরেজের বিরুদ্ধে বাঙালির মধ্যবিত্ত শ্রেণি জাতিচেতনার প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, এ কালেও তেমনই বাঙালিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য করা প্রচেষ্টাগুলি প্রশ্নাতীত। ফলে, যা হচ্ছে তা অবশ্যই একটা আশার আলো। এর ফলে স্বদেশেই খোয়া যাওয়া বহু অধিকারকে বাঙালি নতুন করে ফিরে পাবে। কিন্তু একইসঙ্গে একটা মৃদু ভয়ের কালো মেঘও ক্রমশ কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে। কথায় বলে, জাতিবৈরিতা ছাড়া জাতিপ্রেম জাগরিত হয় না। এখন বৈরিতাই প্রধান উদ্দিষ্ট হয়ে উঠে যদি জাতিসত্তার প্রতিষ্ঠার বদলে জাতি-মৌলবাদের সঞ্চার হয়, তবে তা সমাজের শান্তি ও শৃঙ্খলার পক্ষে সুখবর হবে না।

প্রথমেই মনে রাখতে হবে যে, প্রাক্‌-স্বাধীনতা ও স্বাধীনতা-উত্তর বাঙালি জীবনের মধ্যে বিস্তর ফারাক তৈরি হয়ে গিয়েছে। প্রাক্‌-স্বাধীনতা কালের তথাকথিত ‘বাবু’ ও ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণির শিক্ষা-রুচি-বোধ-চেতনা-যাপন-আদর্শ কিছুই আর স্বাধীনতা-উত্তরকালে টিকে থাকেনি। থাকার কথাও নয়, কেননা চল্লিশের দশক থেকে জাপানি বোমা, মন্বন্তর, দেশভাগ, দাঙ্গা, নকশালবাড়ি ইত্যাদি সমস্ত কিছু মিলে বাঙালির জীবনের খাতকে সম্পূর্ণ অন্যদিকে বইয়ে দিয়েছে। সুতরাং, কী ছিল আর কী হল– সে আলোচনা এখানে অর্থহীন। কিন্তু কী এমন জিনিস যা সে কালে বাঙালিকে নিজের ঐতিহ্য সন্ধানে মগ্ন রেখে একদিকে বঙ্গীয় রেনেসাঁসের উদ্ভব ঘটিয়েছিল আর অন্যদিকে তারই অনুবর্তনে রাষ্ট্রিক অধিকার লাভের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে বিপ্লবীয়ানার আদর্শবাদকেও পুষ্টি জুগিয়েছিল– সেটাকেই খুঁজে বের করতে হবে। তবেই একুশ শতকের এইসব প্রচেষ্টাগুলি সফল হবে। নইলে মারদাঙ্গা, ঝগড়া-ঝামেলা ইত্যাদি করে শুধুমাত্র গায়ের জোরের আশ্রয় গ্রহণ করলে তা একদিন এক বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্ম দেবে।

স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাঙালির সমাজ জীবনে কী কী সমস্যা দেখা দিয়েছিল তা বোঝা জরুরি। ‘বাবু’ ও ‘ভদ্র’ শ্রেণির বদলে এই সময়ে উঠে এসেছিল এক স্বার্থান্বেষী মধ্যবিত্ত বাঙালি যারা শুধুমাত্র পয়সাটাকেই জীবনের সব মনে করত। আমলা থেকে অধ্যাপক, জমির কারবারি থেকে কথাসাহিত্যিক, ব্যবসায়ী থেকে ফাটকাবাজ, রাজনেতা থেকে প্রাইভেট টিউটর বা ডাক্তার– সর্বস্তরে কেবল অর্থই প্রাধান্য লাভ করছিল। এতটাই যে তার জন্য যা-খুশি করাটা কোনও ব্যাপার ছিল না। পাশাপাশি ছিল স্বজাতির সৃষ্টিশীলতার প্রতি অবহেলা-উপেক্ষা। ফলে, ধীরে-ধীরে ঘুষখোর-মাফিয়া-মাস্তান থেকে পাঠবিমুখ অধ্যাপক-শিক্ষার্থী, কর্মস্থলে ল্যাদ খাওয়া ডেলি প্যাসেঞ্জার, মালিকের সঙ্গে বসে মদ খাওয়া ইউনিয়ন নেতা ইত্যাদি নানা চরিত্রের রমরমা বেড়েছিল। এই মানসিক ও চরিত্রগত দৈন্যের শূন্যস্থানটিকেই বাইরের লোকজন এসে দখল করেছিল। ক্রমে দৈহিক শ্রমের জায়গাগুলি থেকে বাঙালি কাজ হারাতে থাকল আর মেধাবী বাঙালি মনোযোগী হল অন্য রাজ্যে বা বিদেশে গিয়ে পাকাপাকিভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে। এখন যে মধ্যবিত্ত বাঙালিকে রাস্তাঘাটে দেখা যায়, তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ, কথাবার্তা, আলাপ-আচরণ, চর্চা-চর্যা প্রায় সম্পূর্ণতই এক আশ্চর্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গোঁজামিলে পরিপূর্ণ। বিনোদনের দুনিয়ায় এরা কেবলই সত্যজিৎ ও সৌরভকে নিয়ে বুক পিটিয়ে বেড়ায়, কেউ নোবেল পেলে কেন পেল তা না ভেবেই ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে দেয় আর একইসঙ্গে তীব্রতর উপেক্ষা ছুঁড়ে দেয় এখানকার প্রকৃত অর্থে কাজ করে যাওয়া বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, নাট্যশিল্পী, লোকসংস্কৃতির কৃষ্টিকার থেকে অন্যান্য মননশীলদের দিকে, বিদ্রূপ করে ‘আঁতেল নাকি’ বলে, আর দরিদ্র-অসহায়দের কথা ঘুণাক্ষরেও ভাবে না। নিজেরাই নিজেদের বলে ‘কাঁকড়ার জাত’।

তবুও এখন যে আলোর উৎস দেখা যাচ্ছে তার সম্ভাবনা কিন্তু সামান্য নয়। বরং উনিশ শতকের বাঙালির উত্থানের থেকে অনেক বেশি বৃহত্তর বাঙালির স্বার্থ এইখানে জড়িয়ে আছে। এখনই যদি একটা সফল উত্থান ঘটানো যায় তবে তা বাঙালির জাতীয় জীবনের পক্ষে দৃঢ় পদক্ষেপ হবে। তাই এখানে কেবলমাত্র গলা ফাটিয়ে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করলে হবে না, সঙ্গে-সঙ্গে একটা বিকল্প সংস্কৃতির উদ্ভাসনের পরিবেশ সৃষ্টির প্রতিও মনোযোগী হতে হবে। আশীষ লাহিড়ী তাঁর ‘এই পঙ্ক-কালচারের হেজিমনি ভাঙুন’ নিবন্ধে লিখেছেন, 'যদি প্রতিনিয়ত আমরা প্রমাণ করতে পারি যে নিছক প্রকরণগত দিক থেকেও আমরা এই মুৎসুদ্দি বিকার-সংস্কৃতির চেয়ে বহুগুণে শ্রেষ্ঠ, সুরটা আমরা ঠিকঠাক লাগাতে শিখি, সম্-টা আমরা ঠিকঠাক জায়গাতে ফেলি, শুধু কারাওকে আর সিন্থেসাইজরের ভরসায় গান না গাই– তাহলে সমাজের ওপর তার একটা প্রভাব পড়তে বাধ্য।' আর সেই বিকল্প সত্তার উদবর্তন না করা গেলে হিন্দি ভাষা ও হিন্দিভাষীদের এই আগ্রাসনকে প্রতিহত করা কিছুতেই যাবে না। 

ফলে, যাঁরা এখন এইসব আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাঁদেরকে নিজেদের চরিত্র ও মনন গঠনের প্রতিও যত্নশীল হতে হবে। ‘আত্মমর্যাদার সঙ্গে সৌজন্যবোধ, সুরুচির সঙ্গে সংযম, স্বাধীনচিত্ততার সঙ্গে নিয়মানুগত্য, কর্তব্যনিষ্ঠার সঙ্গে যুক্তিশীলতা’– উনিশ শতকে এই জিনিসটাই বাঙালিকে উচ্চতম অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছিল, তাকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে এনে দিয়েছিল উচ্চাসন–  একমাত্র এগুলিকে পুনর্জীবন দিলে তবেই বাঙালির জাতিচৈতন্যকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা দেওয়া যাবে। নইলে ফেসবুক ভরে যাবে ঝাণ্ডায় আর আরেক হাল্লা রাজার সেনা তৈরি হবে– এর বেশি কিচ্ছুটি নয়। এটাই শুরুর কথা...     


1 comment:

  1. আত্মসমালোচনা ঠিকই আছে, দিকনির্দেশ বা দিশা অস্পষ্ট।

    ReplyDelete