প্রাথমিক শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ!
অশোকেন্দু সেনগুপ্ত
সারা দেশে হৈ চৈ পড়ে গেছে- এই রাজ্যের মা-মাটি-মানুষের সরকার নাকি প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রটিকে তুলে দিচ্ছে বেসরকারি হাতে। গেল গেল রবও উঠেছে। যদিও এক বড়সড় পদাধিকারী আমলা বলেছেন যে অভিযোগটি সত্য নয়, স্বাক্ষরহীন তারিখবিহীন এমন আদেশনামা (যা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে) সরকারি আদেশনামা হতেই পারে না। তিনি ঠিকই বলেছেন, তবে খসড়া তো এমনই হয়, নাকি? খসড়ার বাজার বা ক্রিকেটিয় ভাষায় 'পিচ পরিদর্শন' বলব নাকি? আমার এক বন্ধু জানিয়েছে, এমন উদ্যোগ দেশে নতুন নয়; সে বলেছে গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, কর্নাটক সরকার নাকি ইতোমধ্যে এমন অবিশ্বাস্য ব্যবস্থা নিয়েছে। কেন বলছি অবিশ্বাস্য?
এই কারণে তা অবিশ্বাস্য যে, এমন কিছু করার অর্থ শিক্ষা অধিকার আইনের পরিপন্থী। সে আইন মতো ৬-১৪ বয়সগুচ্ছের সকলের জন্য শিক্ষা মৌলিক অধিকার এবং রাষ্ট্র তার ব্যবস্থা করে দিতে বাধ্য। সে কথা তো আজকের নয়। সংবিধানের Directive Principle'এ তেমন দায়িত্বের কথা বলা হয়েছিল, রাষ্ট্রও মেনেছিল বা মানতে বাধ্য হয়েছিল, তবে তা মৌলিক অধিকার বলে গণ্য হয়নি, এই যা। গণ্য হল এই সেদিন আদালতের গুঁতোয়। সরকার মানল, তবে কৌশলে তারা বয়সটা বদলে করল ৬-১৪, যা আগে ছিল ০-৬। তা শিশু যে, তার বয়স হোক ০ বা ৬, সে কী বোঝে শিক্ষার, সে চায় তার খেলার সংসারে থাকতে।
এমন শিশুকে শিক্ষা দিতেই হবে? তার শিক্ষার আয়োজন করতে হবে সরকারি বিদ্যালয়েই? বেসরকারি বিদ্যালয়ে তেমন ব্যবস্থা করা যাবে না এমন কথা তো আইনে বলা নেই। কেউ বলতেই পারেন, আইনে তো অনেক কথাই বলা থাকে না। তাতে কী? ও নিয়ে তর্ক থাক (আমি যে আইন বুঝি না)। মূল প্রশ্ন- বেসরকারি ব্যবস্থা কি পারবে তেমন আয়োজন করতে, এমন আয়োজন যাতে প্রতিটি শিশু পাবে নিখরচায় সুশিক্ষা?
একটা গল্প বলি। গল্প হলেও সত্যি গোছের নয়, এ এক প্রকৃত ঘটনা-নির্ভর গল্প। আমার অভিজ্ঞতা। সেবার শিশু অধিকার আয়োগের শীর্ষ পদে থাকার সুবাদে বারাসাতে গিয়েছি ওই জেলার শিক্ষার হাল বুঝতে। জেলার পরিদর্শক মহাশয়কে প্রশ্ন করি, বেসরকারি স্কুল ব্যবস্থায় ১৫ শতাংশ ছাত্র ভর্তি হতে পারে সরকারি বিধি মেনে, জানেন? ঘাড় নাড়লেন– তিনি জানেন। কিন্তু তিনি জানেন না এর সুযোগ কোনও দরিদ্র পরিবারের সন্তান পেয়েছে কিনা! তিনি দুঁদে রাজনীতিবিদদের মতো উল্টে আমাকেই বললেন, 'কেউ না চাইলে আমি কী করতে পারি?'আমি তো রাজনীতির লোক নই, আমাকে মানতেই হল! যদিও বললাম, লোকে না জানলে আর চাইবে কেমন করে? লোককে জানান।
- সে দায়িত্ব আমার না।
সে দায়িত্ব যে কার তা বোঝা গেল না। যেমন বোঝা যায় না, কেন প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও সরকার জাতীয় গড় উৎপাদনের ৬ শতাংশ শিক্ষাখাতে খরচ করে না। একজন আমাকে বোঝাতে বসলেন। তিনি বললেন, কেউ চায় নাকি? বহুদিন আগে পড়া ছিল টলস্টয়, জানতাম রাষ্ট্র চায় না সুশিক্ষা পাক সকলে, কিন্তু রাষ্ট্র সকলের শিক্ষার দায়ও অস্বীকার করে না।- - তা হলে শিশুরা যে শিক্ষা পাচ্ছে তা সুশিক্ষা নয়?
তিনি স্মরণ করিয়ে দিলেন জন গলব্রেথের কথা। স্পষ্ট হল শিক্ষার উদ্দেশ্য। তা যে নিছক ব্রান্ড রেকগনিশন নয়, আরও কিছু, আরও অনেক কিছু। কিছুটা স্পষ্ট হল। রাষ্ট্র চায় না সুশিক্ষা পাক সকলে, কিন্তু রাষ্ট্র সকলের শিক্ষার দায়ও অস্বীকার করে না! কথাটা আরও স্পষ্ট বোঝা যায় যখন দেখি দেশ জুড়ে অশিক্ষিতদের ভীড়।আর নিখরচার শিক্ষা? পাগল হয়েছেন? তিনি বললেন। আরও বললেন, রঙ্গনাথ মিশ্রের হতাশার কথা (গত শতাব্দীর শেষ দশকে মানবাধিকার কমিশনের প্রধান হিসেবে তিনি সব রাজনৈতিক দলের কাছে আবেদন করেছিলেন যেন তারা তাদের নির্বাচনী ইস্তাহারে বলে যে তারা শিক্ষাখাতে ৬ শতাংশ বরাদ্দ চায়; কোনও দল রাজি হয়নি)। তবে যে ওরা মাঠে-ময়দানে বক্তৃতায় ৬ শতাংশ বরাদ্দ দাবি করে? মাঠে-ময়দানে! সংসদের ভেতরে কাউকে কখনও এমন দাবি তুলতে শুনেছেন? শোনেননি? শুনবেনও না। শিক্ষাখাতে বাড়তি খরচ মানে তো অন্য খাতে খরচ কমানো। এমন কথা বললে উন্নয়ন বা দেশপ্রেমে ঘাটতি আছে বলে মনে হতে পারে।
একবার তো সদ্যপ্রয়াত সাংসদ রাহুল বাজাজ বলেছিলেন যে যেহেতু তাঁরাই শিক্ষান্তে চাকরির ব্যবস্থা করেন তাই শিক্ষা কেমন হবে তা তাঁদের ঠিক করতে দেওয়া হোক। বিড়লা-কুমারমঙ্গলম কমিটি সে সুপারিশ গ্রহণও করে। তবে সরকার মানেনি এই যা। সেদিন মানেনি মানে এমন নয় যে সরকার পরে মানবে না।
রাজ্য সরকারের প্রতিনিধি বলে যাচ্ছেন, শিক্ষা বেসরকারিকরণের খবরটা ঠিক নয়। সদ্য ত্রিপুরা ফেরত মন্ত্রী মহোদয় কিছু বলছেন না, তিনি কিছুতেই কিছু বলেন না, হুকুম নেই, তাঁর নেত্রী বলেননি যে কিছু বলতে! দলও বলেনি। তাই কিছু না বলে চুপচাপ সিপাহীজোলায় স্যুটিং করা যায় কিনা তা নিয়ে ভাবা ঢের ভালো নয় কী? বা পূর্বসুরীদের কারও কারও মতো শান্তিনিকেতনে বাড়ি! এর জন্য যদি কেউ আমাকে হেড ক্লার্ক বলে তো বলুক– আমি মুখ খুলছি না। কতজন চাকরি না পেয়েও হল্লা করছে রাজ্যের রাস্তায় রাস্তায়, কোর্টে– করুক, আমি কিছু বলছি না, একবার কিছু বলে দলকে, মন্ত্রীসভার সহকর্মীদের বিপদে ফেলেছি আর নয়। (প্রাক্তন একজন এখন ফের দলের কর্তা হয়েছেন!)
তবে, এমন তারিখবিহীন স্বাক্ষরবিহীন প্রস্তাব দিল কে? রাজ্য সরকারকে তা নিয়ে ভাবতেই হবে। রাজীব গান্ধির মতো ‘হামে শোচনা হ্যায়’ বলে আর পার পাবার উপায় নেই। বেড়াল বেরিয়ে পড়েছে ঝুলি থেকে। নাকি একটা কমিটি গড়ে দিলে হবে? এমন লোকজনকে নিয়ে কমিটি যে বা যারা কদাচ আমলাদিগের নিন্দা করার কথা স্বপ্নেও ভাবে না, তায় কোনও মন্ত্রীকর্তার নিন্দা! তারা প্রশ্ন করে না এত টাকা খরচ হল (নাই বা হল তা ৬ শতাংশ, সব মিলিয়ে যা হল তাও কম কী?), তবু কেন দেশটা আজও পূর্ণ স্বাক্ষর হল না। দায় কার? স্কুল শিক্ষকদের? স্কুল শিক্ষকরা তো কর্তা নয়, তোমরাই কর্তা।
এসব প্রশ্ন করবে না এমন লোকজন চাই! বাপ রে বাপ! ‘সেই সাপ জ্যান্ত … ’
নয়া (বা জাতীয়) শিক্ষানীতিতেও যে PPP মডেলের কথা বলা হয়েছে! তাতে যে ভয় বাড়ে। দেশ সেবা করবেন শিল্পপতিরা! তারা ব্যবসা করবেন বিনা লাভে! ঘোড়ায় হাসব! আরও একটা বাংলা প্রবাদ তো জানি- শেয়ালকে ভাঙ্গা বেড়া দেখাতে নেই! উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে এমন বেড়া দেখিয়েছিল বামফ্রন্ট আর মনমোহন সরকারের শিক্ষামন্ত্রীরা। তো, তাদের বুদ্ধিশুদ্ধি কিঞ্চিৎ কম ছিল বলেই বোধহয় তারা p–র মানে philanthropic'ও হতে পারে ভাবেনি। তবে মোদ্দা জিনিসটা বুঝতে ভুল হয়নি। প্রাইভেট নানা কিসিমের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের শিক্ষাঙ্গণ ম’ ম’ করত্যাছে গো কত্তা। স্কুল শিক্ষায় কেবল খরচ! নিখরচায় বিদ্যাদান। হয় না। প্রাথমিক শিক্ষাকোষের টাকাতেও না। অবশ্য সে টাকার কতটা যে রাজ্য পায় কে জানে? শিক্ষার দায় শিক্ষকদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিব্যি চলে যাচ্ছে তো। কিন্তু টাকা ঢালতেই হবে যে স্কুল শিক্ষায়। নইলে ওরা খাবে কী? ওরা কে? রাজ্যের শিশুরা? নাকি শিক্ষকরা? বোকা কারে কয়? স্কুল শিক্ষকদের কথা ভাবলে চলে! চাই নতুন গন্ধ, নতুন ফন্দি, নতুন বর্ণ।
নিখরচায় বিদ্যা লাভ হয় না, সবাইকে শিক্ষার সুযোগ দেওয়া যায় না– সাহস করে কথাটা বলুন না। ঘোমটার আড়াল কেন? শিক্ষা অধিকার আইন, ২০০৯? তা বদলের সুপারিশ তো ছিলই। তাও এল বলে।
খুব জরুরি একটা লেখা৷ তবে আরও কিছু ডাইমেনশন যদি পরবর্তীতে ভাবা যায়, পাঠক হিসেবে সেই প্রত্যাশা জানালাম
ReplyDelete