ছাত্র আন্দোলন পথ দেখাবে?
শান্তনু ভট্টাচার্য
১৮ ফেব্রুয়ারি মাঝরাতে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক তরতাজা যুবক আনিস
খানের নির্মম হত্যার পর ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি ছিল ঘটনাবহুল। ওই দিন
বেলা ১২'টায় হাওড়ার পানিয়ারায় হাওড়া গ্রামীণ এলাকার এসপি'র কাছে
ডেপুটেশন দিতে জড়ো হয়েছিলেন কয়েকশো ছাত্র, অধিকার রক্ষা আন্দোলনের
কর্মী, সামাজিক আন্দোলনের অ্যাক্টিভিস্ট ও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার কর্মীরা।
আনিস হত্যার তদন্ত ও পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার প্রতিবাদে ডেপুটেশন চলাকালীন
এসপি'র ঘরে 'এবিপি আনন্দ'এর সম্প্রচার চলছিল। মুখ্যমন্ত্রী ওই লাইভ
সম্প্রচারে জানালেন, 'আনিসের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর তদন্তে আমরা স্পেশাল
ইনভেস্টিগেশন টিম তৈরি করছি। তদন্তে চিন্হিত দোষী ব্যক্তি, তিনি যেই হোন না
কেন, কাউকে রেয়াত করা হবে না। আমরা নিরপেক্ষ ভাবে এই তদন্ত করব। আনিস
আমাদেরই ফেভারিট, আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল।' এই সম্প্রচারের পর এসপি সাহেবের
আলাদা ভাবে কিছু বলার ছিল না। ডেপুটেশন শেষ, কিন্তু কর্মসূচি জারি থাকল।
একই দিনে কলকাতায় বেলা ৪'টের সময় 'স্টুডেন্টস এগেন্স্ট ফ্যাসিজম'এর তরফে
আয়োজিত নাগরিক মিছিলে বিভিন্ন পেশার মানুষ সমবেত হন। মিছিলের কলেবর ছিল
উৎসাহব্যঞ্জক। পোস্টার, ফ্লেক্সে সুসজ্জিত মিছিলের একটাই আহ্বান- 'জাস্টিস
ফর আনিস খান।' লেনিন মূর্তির পাদদেশ থেকে শুরু হওয়া ওই মিছিল শেষ হয়
মহাজাতি সদনে সংক্ষিপ্ত সভার মধ্যে দিয়ে।
পাশাপাশি, পার্ক সার্কাসে আলিয়া
ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে শনিবার থেকেই লাগাতার ধর্না, বিক্ষোভ চলছে।
ছাত্রদের উচ্চকিত জিজ্ঞাসা- কেন ৭২-ঘন্টা পরেও আনিস হত্যাকারীরা অধরা! এর দায় তো
পুলিশমন্ত্রীর উপরেই বর্তায়। অনুরূপ দাবিতে ছাত্র আন্দোলনের আঁতুড়ঘর
প্রেসিডেন্সি ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে শনিবার থেকেই চলেছে লাগাতার পথসভা, পথ অবরোধের
কর্মসূচি।
এবার গন্তব্য আরও ২০-২৫ কিলোমিটার দূরে আমতা থানার সারদা গ্রামের খানপুর,
যেখানে আনিসের বাড়িকে এক গভীর শূন্যতা গ্রাস করেছে। সারদা
গ্রামে আনিসের বাড়ির চারপাশে লোকে লোকারণ্য। সংবাদমাধ্যমের ভিড়। একজন
জানালেন, ওই সাংবাদিকদের লাগাতার পুলিশি জেরার মতো প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে
বাড়ির লোকেরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। সঙ্গে আছে শাকের আঁটির মতো ক্যামেরা
মোবাইলের লাগাতার ফ্ল্যাশ। ভিড়ের মধ্যে শান্তিরক্ষী বাহিনীর কয়েকজনকে
দেখা গেল। ওই দিন সকালে এসএফআই ও ডিওয়াইএফআই'এর আমতা থানা ঘেরাওয়ের
কর্মসূচি ছিল। গার্ড রেল ছুঁড়ে ফেলে, বাঁশের ব্যারিকেড ভেঙে বেশ কিছুক্ষণ
চলে ওই বিক্ষোভ। তার জেরেই হয়তো ওই পুলিশ বাহিনীর গ্রামে আসা।
ইতিমধ্যেই
ওই বাড়িতে এসেছিলেন পঞ্চায়েত মন্ত্রী পুলক রায়, সঙ্গে জনৈক কৌস্তুভ
রায়। পুলক রায় এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর বিশেষ বার্তাবাহক হিসেবে। তিনি
আনিসের পিতা সালেম খানের সঙ্গে নিভৃতে কথা বলে বাইরে এসে জানান
মুখ্যমন্ত্রী সালেম খানকে নবান্নে যেতে বলেছেন। আমি তাঁকে নিয়ে যেতে
এসেছি। পরিবারের সকলের সঙ্গে আলোচনা করে শেষ পর্যন্ত সালেম খান নবান্নে
যাওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ফেরার পথে পুলক রায়কে গ্রামের
মানুষের বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়। উল্লিখিত কৌস্তুভ রায় আগের দিন সালেম
খানের কাছে এক বা একাধিক চাকরির প্রস্তাব দেন। পরিবার থেকে তাঁকে সাফ
জানিয়ে দেওয়া হয় যে আনিস হত্যার নিরপেক্ষ বিচার ও খুনিদের যথাযোগ্য
শাস্তি ছাড়া তাঁরা আর কিছুই চান না।
কিছুটা দেরিতে হলেও আনিসের মোবাইল ফোনের সন্ধান পান
সালেম খানের পরিবারের লোকজন। তবে তা হাতছাড়া করতে নারাজ আনিসের বড়
ভাই। সংবাদমাধ্যমকে তিনি জানান যে পুলিশের উপর তাঁর কোনও আস্থা নেই। হয়তো
ওই মোবাইল ঘেঁটে, তথ্য বিকৃত করে আনিসকে অন্য কোনও কেসে ফাঁসিয়ে দেবে
পুলিশ। এর মধ্যেই তার চরিত্রে কালিমা লেপন করার চেষ্টা চলছে পুলিশের দিক
থেকে। যদি হাইকোর্ট নির্দেশ দেয়, অথবা সিবিআই তদন্ত করতে আসে, তবেই ওই
মোবাইল তাদের হাতে জমা দেওয়া হবে। 'আনিস আমাদেরই লোক' টিভি চ্যানেলে
প্রচারিত মুখ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্য সরাসরি খারিজ করে দেন আনিসের বড় ভাই।
আইএসএফ বিধায়ক নৌশাদ সিদ্দিকী বলেন, আনিস তাঁদের সেকুলার ফ্রন্টেরই সদস্য
ছিলেন। গত বিধানসভা নির্বাচনে তিনি জোটের কংগ্রেস প্রার্থীর হয়ে প্রচার
করেন।
এই হত্যাকাণ্ডে তৃণমূল যোগাযোগের অভিযোগটা উঠল কেন?
ঘটনা হল, ২০২১ সালের ২২ মে আনিসের উদ্যোগে এলাকায় একটি রক্তদান
শিবিরের আয়োজন করা হয় যা স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের হস্তক্ষেপ এবং গা-জোয়ারিতে বানচাল হয়ে যায়। আনিসকে অপদস্থ করা এবং প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি
দেওয়া হয়। আনিসের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ ছিল যে তার জন্যেই নাকি ওই
অঞ্চলে তৃণমূল প্রার্থী তুলনামূলকভাবে কম ভোট পেয়েছেন। পারিপার্শ্বিক
এইসব রাজনৈতিক ঘটনাবলীর কথা মাথায় রেখে আনিস পুলিশ প্রশাসনের উদ্দেশ্যে চিঠি
লেখেন এবং ওই চিঠিতে কয়েকজন তৃণমূলের নেতার নাম উল্লেখ করেন যাদের কাছ
থেকে তিনি বিপদের আশঙ্কা করছেন। ফলে, তাঁকে বাড়িছাড়া হয়ে থাকতে হয়
বেশ কিছু দিন। যথারীতি পুলিশের কাছে ওই চিঠি কোনও গুরুত্ব পায়নি। শনিবারই ছাত্রদের তরফে দাবি উঠেছিল আনিসের ওই চিঠিকেই এফআইআর হিসেবে ধরে নিয়ে
তদন্ত শুরু করুক পুলিশ। রবিবার সংবাদপত্রে একটা ছোট খবর প্রকাশিত হলে জানা
গেল যে ওই গ্রামের তৃণমূলের মাথারা সবাই গা ঢাকা দিয়েছে।
২১ ফেব্রুয়ারি সোনারপুরের এক যুবক তাঁর ফেসবুক ওয়ালে লিখলেন, নিরপেক্ষ
তদন্ত হলে হাওড়া গ্রামীণ এলাকার এসপি সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করতে পারবেন না,
কারণ, সোনারপুরের তৃণমূল বিধায়িকা সম্পর্কে তাঁর স্ত্রী। এই পোস্টের জন্যে সেই যুবককে সোনারপুর থানার ওসি তুলে নিয়ে যান আর জিজ্ঞাসাবাদের নামে থানায়
দীর্ঘক্ষণ বসিয়ে রাখেন। পরে বিক্ষোভের মুখে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পর পর
বেশ কিছু পুলিশি নির্যাতনের অভিযোগ উঠছে বিভিন্ন থানার বিরুদ্ধে, যেগুলো
সবই সাধারণের 'ভিন্ন মতের' সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করছে, যা গণতন্ত্রের
পক্ষে ভাল বিজ্ঞাপন নয়।
২২ ফেব্রুয়ারি
সারদা গ্রামে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা মতো সিট তার কাজ শুরু করেছে। মঙ্গলবার দুপুরের মধ্যেই আমতা থানার নিচুতলার পুলিশকর্মীদের তিনজনকে
সাসপেন্ড করা হয়। আনিসের পরিবার ও গ্রামবাসীরা সিবিআই তদন্তের কথা বলে
আসছেন গত শনিবার থেকে। তাঁদের মূল অভিযোগটাই ছিল আমতা থানার পুলিশের
বিরুদ্ধে। ঘটনা হল, গভীর রাতে পুলিশের পোশাকে চারজন দুষ্কৃতী পেশাদারি
কায়দায় আনিসকে খুন করে চলে যাওয়ার পর থানায় খবর দেওয়া সত্ত্বেও
আনিসের মৃতদেহ রাস্তায় পড়ে থাকে শনিবার বেলা ৯'টা পর্যন্ত। পরিবারের
অজান্তে বেআইনি ভাবে পুলিশি অতি সক্রিয়তায় ময়না তদন্ত করে জানানো হয় যে আনিসের পাকস্থলীতে অ্যালকোহল পাওয়া গিয়েছে। তাই পরিবারের আশঙ্কা,
একটা নির্মম খুনের ঘটনা হয়তো পুলিশের লেখা চিত্রনাট্যে নিছক আত্মহত্যার
গল্পে পরিণত হবে। শুক্রবারের ওই ঘটনার পর এক ধরনের ট্রমার মধ্যে দিয়ে
যাচ্ছেন আনিসের পরিবার। তদন্তে সিট'কেও কোনও সহযোগিতা করবেন না বলে জানাচ্ছেন
গ্রামবাসীরা।
২২ ফেব্রুয়ারি কলকাতায়
পার্ক সার্কাস থেকে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মহাকরণ অভিযানের ডাক দেন।
পুলিশ এই অভিযানের সক্রিয় বিরোধিতা করে। শিয়ালদহ, মৌলালি, কলেজ স্ট্রিট
সর্বত্রই মিছিলকে ছত্রভঙ্গ করার জন্যে টিয়ার-গ্যাস শেল, জলকামান
ইত্যাদি মজুত ছিল। কিন্তু পুলিশ অন্যান্য দিনের তুলনায় সংযত ছিল। মধ্য কলকাতার বিস্তীর্ণ
এলাকা পুরোটাই অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। বিক্ষোভকারীদের মধ্যে আনুমানিক ৫৭ জনকে গ্রেফতার
করা হয়। পরে লালবাজার থেকে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। কলেজ স্ট্রিট, যাদবপুর,
পার্ক সার্কাসে নিয়মিত অবরোধ চলছে, আন্দোলনের ঢল নামছে সর্বত্র। শোনা যাচ্ছে, ম্যাজিস্ট্রেট ও পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে পুনরায় আনিসের ময়না তদন্ত হবে।
আনিস হত্যা ও উত্তাল ছাত্রসমাজ সম্ভবত এ রাজ্যে এক নতুন পথের দিশা দেখাতে চাইছে। আমাদের সম্মুখ পানে তাকিয়ে থাকার সময় এখন।
আন্দোলন দিশা পাক।
ReplyDelete